নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এই শহরে অনেক হাজার হাজার ছেলে আছে যারা চুপচাপ থাকে, কথা কম বলে। পৃথিবীতে তারা বোকা, লাজুক, হাঁদারাম নামে পরিচিত। আমাকে এর সাথে তুলনা করলে তেমন একটা ভুল হবে না। নিজের ব্যাপারে বলাটা অনেক কঠিন। তবে নিজেকে মাঝে মাঝে অনিকেত প্রান্তর ভাবি।

জাহিদুল হক শোভন

এই শহরের বোকা ছেলেটি।

জাহিদুল হক শোভন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : মেঘজুড়ে জল

২৪ শে মার্চ, ২০১৯ সকাল ১০:৫৮

ইবনাতের থেকে আমি তিন দিনের বড় কিন্তু সে আমাকে ভাই, ভাইয়া এই টাইপের কিছু বলে ডাকে না। আমি ওকে আমার প্রেমিকা ভাবি কিন্তু ও আমাকে কি ভাবে এটা অবশ্য আমার জানা নেই। মাঝে মাঝে ও যখন আমায় তার ভিতরের জমানো দুঃখ কষ্টের কথা শোনায় তখন মনে হয় আমি ওর সব চাইতে আপন একজন মানুষ। এই ভাবাটার মাঝে যখন আকাশ মেঘলা হয়ে বৃষ্টি ঝড়ে অর্থাৎ আমাকে শাসন করে তখন আবার মনে হয় ও আমার একজন বোন।যদিও সে আমার বোন। মামাতো বোন। আমি এই ভাবার মাঝে ঝুলে থাকি। সে আমাকে বলে “এইভাবে কি দেখো ছেলে? তোমাকে না বলেছি আমার সামনে এলে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকবা। ভুলে গেছো?” আমি ঝট করে মাথা নিচু করে হ্যাঁ সূচক ইশারা দিয়ে বুঝাই হ্যাঁ ভুলে গেছি।গতকাল ওকে বলেছিলাম “তোমার চোখ গুলা খুব ভালো লাগে। এই চোখ গুলার মাঝে একটা সবুজেঘেরা রঙ্গের পাহাড় দেখতে পাই। মাঝ রাতে এই পাহাড়টা যখন একলা হয়ে যায় তখন এই পাহাড়ের কাছে আমার বসে থাকতে ইচ্ছে করে। তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে।” ও চোখে মুখে বিরক্তিকর একটা ভাব নিয়ে আমাকে বললো “তোমার মায়ের কাছে নালিশ দিব। তুমি দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো ছেলে। তুমি এখন থেকে আমার সামনে আসলে আমার দিকে তাকাবা না ঠিকাছে? একদম নিচের দিকে তাকিয়ে থাকবে।” আমি কিছু না বলে শুধু একটা হাসি দিয়েছিলাম। সে কতবার আমাকে নিয়ে মায়ের কাছে নালিশ দিয়েছে হিসেব নেই। এই নালিশে কাজ হয় বলে মনে হয় না।ওর সামনে আসলে আমি কেমন যেন আচরন করি। একদম বোকা বোকা একটা লুক ভেসে উটে চেহারায়। সে আমাকে ছোট বেলা থেকেই অবজ্ঞা করে। যখন বুঝতে পারলো আমি তাকে পছন্দ করি তখন থেকেই আমাকে পাত্তা দেয় না। ওদের বাসা থেকে আমাদের বাসা একদম কাছে। আমার মায়ের তখন বিয়ে হয়নি। বাবা আর মা ছিল একই এলাকার। যেহেতু দাদা দাদুর চোখের সামনে মা বড় হয়েছে। সেহেতু মাকে খুব ভালো লাগতো দাদুর। তাই বাবার সাথেই বিয়ে দেওয়ার জন্য দাদু সম্বন্ধ নিয়ে যায়। আর নানা নানুরাও রাজি হয়েছিল। আমি ইবনাতের দিকে তাকিয়ে বললাম “একটা কথা বলতে আসছি।” ইবনাত সম্ভত গল্পের বই পড়ছে। কার বই পড়ছে এটা অবশ্য আমি জানি। হাবিব আদনানের বই পড়ছে। আমি ইতস্তত হয়ে বললাম “গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছি। তুমি গান গাচ্ছো আর নাচ্ছো। আমিও তালে তালে নাচছি। হঠাৎ করে একটা ভিলেন এসে আমার মাথায় আঘাত করে আমার কাছ থেকে তোমাকে নিয়ে চলে যায়। তারপর আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি এই স্বপ্নটা দেখে খুব ভয় পেয়েছি খুব।” ও আমার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকলো। তারপর একটা হাসি দিয়ে বললো “ভিলেনটা নিশ্চয় আদনান ঠিক তো?” আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। এই আদনান নামের ছেলেটাকে ও পছন্দ করে। কিছু কিছু মানুষের কিছু গুন থাকে। কেউ ভালো গান গাইতে পারে, কেউ ছবি আঁকতে পারে আবার কেউ লেখালেখি করে। এই গুন গুলোর জন্য তারা মানুষের ভিতরে অনেক দিন বেঁচে থাকে। একটা ভালোবাসা অর্জন করতে পারে। আমার এসব গুনের কিছুই নেই। আমি জাস্ট একটা নিরামিশ ছেলে। সে হাসতে হাসতেই বই পড়াতে আবার মনোযোগ দেয়। আমি কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে আর কিছু না বলে চলে আসি। মাঝে মাঝে সে যখন আমাকে অবজ্ঞা করে তখন আমার ভালো লাগে না, একদম ভালো লাগে না। আজকে দুপুরে আমার একবার হাসপাতালে যাওয়া দরকার। গতকাল যাওয়া হয়নি।

হাসপাতালে যখন পৌছালাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল ছুই ছুই। আমি চিন্তা করতে থাকি কত টাকা জমেছে। আমার বন্ধুটার জন্য খুব মায়া হয়। আমার সবচাইতে ভালো বন্ধু রাশেদ এইভাবে হারিয়ে যাবে ভাবতেই কষ্ট লাগে। অনেক কষ্ট। কিন্তু আমি ওকে এইভাবে হারিয়ে যেতে দিব না। কেবিনে ঢুকতেই ও আমাকে দেখে একটা হাসি দিয়ে বললো “দোস্ত ভাল্লাগতেছেনা তোরে অনেক মিস করতেছিলাম। এখন একটু ভালো লাগতেছে তোরে দেখে।” আমি ওর পাশে গিয়ে বসে বললাম “আরও আগে আসার কথা ছিল। তোর অপারেশনের জন্য এখন লাখ খানেক টাকা জমা হয়েছে।আরও কিছু টাকা জমলেই তোরে বাহিরে নিয়ে যাবো।পাসপোর্ট সব ঠিক হয়ে গেছে।” আমার কথা শুনে রাশেদ কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকলো। ওর মা শাড়ির আচল মুখে দিয়ে একটা কান্নার গোঙরানী দিয়ে আমার কাছে এসে কান্না করতে থাকে। আমি বললাম “খালা কেন কান্না করেন? কিচ্ছু হবে না আমার বন্ধুটার।” খালা চোখের পানি মুছে বললো “ওর বাবা থেকেও নেই। একটা মাতাল আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। মানুষটারে ছাড়তেও পারি না। হাজার হলেও স্বামীতো। বাবা, তোমরা আমার ছেলেটার জন্য যা করতেছো এইটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আমার ছেলেটার জন্য সারা রাত কাঁদি। একটুও ঘুমাতে পারি না। আল্লাহ আমাদের মত মানুষদেরকেই বা কেন এমন রোগ দেয়?” এটা বলেই খালা আবার কান্না করতে থাকে। খালার কান্না দেখে আমার চোখেও পানি আসে। আমি খালাকে শান্তনা দেই। খালা বাহিরে চলে যায়। রাশেদ আমাকে বলে “ জাহেদ আমি আর কতদিন বাঁচবো তা জানি নারে। এটা নিয়ে আমার কোন দুঃখ নাই।একদিন সবাইরে যেতে হবে। আমি না হয় আগে গেলাম। কিন্তু এটার জন্য আমার খারাপ লাগে না। খারাপ লাগে বিথীর জন্য। মেয়েটা এমন কেন করলো আমার সাথে? আমার অসুখটা দিন দিন যখন বাড়তে থাকলো মেয়েটাও আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলো। আর যাই হোক সে আমারে ভালোবাসে নাই। ভালোবাসলে এমন করতো না। এটাকে ভালোবাসা বলে না। আমার অসুখটা কি অনেক বড় বন্ধু?” আমার চোখে আবার পানি আসে। আমার কি বলা উচিৎ আমি জানি না। বসা থেকে উঠে আমি কান্নার গোঙরানী দিয়ে বললাম “এক বিথী গেছে তো কি হইছে বেটা হাজার বিথী আসবো। হাজার বিথীর লাইন ধরাই দিব তোর পিছনে আমি। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মার্কেট সব জায়গায় আমাদের বন্ধুরা টাকা সংগ্রহ করার জন্য নেমে পড়ছে তুই কোন চিন্তা করবি না। এটা তেমন কোন অসুখ না। হার্টে ছোট্ট একটা ছিদ্র ধরা পড়েছে মাত্র। সব ঠিক হয়ে যাবে বন্ধু।” রাশেদ আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে হাসতে থাকে। এই হাসির অর্থ আমি বুঝি না। তারপর বললো “তুই ইবনাতকে ছাড়া কিছু বুঝিস? হাজার বিথীর তুলনা দেস ক্যান সালা।” আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। মুহুর্তেই আমার ভিতরটা কেমন করে উঠে। আমার চুপ থাকা দেখে ও বললো “কি? ভিতরে ছ্যাত কইরা উঠছে না? আকাশের অবস্থা ভালো না জানালা দিয়ে দেখ।বৃষ্টি আসতে পারে।” আমি জানালার বাহিরে তাকাই। আকাশে মেঘ জমেছে।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওকে বললাম “তুই ঘুমা।অনেক কাজ আছে।” এটা বলেই আমি বের হয়ে যাই।

আকাশে যখন মেঘ জমে তখন মনে হয় বৃষ্টির আগমন বার্তা নিয়ে আসে। মেঘ জমা এই আকাশটার মাঝে আমি অন্য কিছু দেখতে পাই। অন্য কিছু অনুভব করতে পারি। বৃষ্টি আসলেই ইবনাত নিজেকে মাঝে মাঝে বৃষ্টির মাঝে মেলে ধরে। আর আমি চুপ করে আড়াল হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। এই তাকিয়ে দেখতে দেখতে আমার চোখ দুটো ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। একদিন আমি সত্যি সত্যিই বৃষ্টির মধ্যে ওর সামনে যাই। সে আমাকে দেখে বলে “কি চাও? যাও ভাগো।” আমি অনেকক্ষন পর বললাম “ভিজতে আসছি। তোমার নীল চোখকে বৃষ্টি কিভাবে ধুয়ে দিয়ে যায় দেখবো।” সে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার খোলা চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পড়তে থাকে। আমাকে বলে “তুমি যে আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখো এটা আমি জানি। লুইচ্চা।” আমি এই কথার ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “কিছুদিন আগে যখন বৃষ্টি আসলো আমি তোমাকে কাঁদতে দেখেছি। এমন করে কেন কেঁদেছো? আমাদের মানুষের ভিতরটা মাঝে মাঝে চিৎকার দিয়ে উঠে। এই চিৎকারের অনুভূতিটা যখন বুঝতে শিখলাম তখন জানলাম যাকে পাবো না তবুও তাকে পাবার জন্য অনুভূতিগুলো কাঁদে। এই অনুভূতিগুলো মানুষ কি করে নিজের মাঝে লুকিয়ে রাখে? আমি তো এমন করে পারি না। তোমাকে বলে ফেলি। যতবার আমি তোমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখেছি ততবার আমি তোমার চোখ গুলোকে দেখেছি। আমি প্রতিবার মুগ্ধ হই যখন এমন মায়াকাড়া নয়নাকে বৃষ্টি ভিজিয়ে দেয়। কিন্তু আজও এই মায়াকাড়া নয়নার মাঝে আমি জল গড়িয়ে দেখতে পেয়েছি। বুঝতে পারি না ইদানিং বৃষ্টি আসলেই এমন ময়ুরাক্ষি মেয়েটা কেন কাঁন্না করে?” ও আমার একটা কথারও উত্তর দেয়নি। শুধু কিছুক্ষন ছলোছলো চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গিয়েছিল। আজকেও আকাশটার অবস্থা মেঘময়। এই মেঘময় আকাশটাকে দেখলে আমার এখন ভালো লাগে না। আকাশটা মেঘলা হলেই ইবনাতের কথা মনে পড়ে। ওর চোখের জল গুলো আমার চোখে ভাসে। আমার ইচ্ছা হয় এই জলগুলোকে ছুয়ে দিয়ে উপলব্দি করতে তার এতো দুঃখ কেন?

আমার মিউজিক প্লেয়ারে আর্টসেলের অবশ অনুভূতির দেয়াল এই চমৎকার গানটা বাজতে থাকে।

আমার দেহে খুঁজে ফিরি তোমার অনুভূতি
তোমার চোখের দূরের আকাশ মিশে থাকে রূপক হয়ে,
তোমার জন্য বিষণ্ণ এক নিথর হৃদয়
আমার ভেতর দাঁড়ায় সরব একা...

যতবার এই গানটা শুনি চারপাশটা কেমন যেন থমথমে মনে হয়। ভিতরটা একদম নেড়ে উঠে। অনেকদিন এই গানটা শোনা হয়না। ইচ্ছে করেই শুনিনি। শুনলেই ভয়ংকর একটা খারাপ লাগা কাজ করে। গানটা যখন শেষ হলো তখনি ইবনাত দরজার ভিতরে ঢুকে দরজার মাঝে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি খানিকটা অবাক হয়েছি। এমন করে কেন সে তাকিয়ে থাকলো। তার চেহারায় একটা গম্ভীরতার ভাব। আমি বললাম “দরজার মাঝে এভাবে হেলান দাঁড়িয়ে আছো কেন?” সে চুপ করে থাকে। তার চুপ থাকাতে আমার নিজেকে স্বাভাবিক লাগলো না। একটু সময় নিয়ে ও আমার সামনে এসে বললো “তুমি আমাকে এমন করে কেন চাও?। এই যে তোমাকে আমি এতো এতো ফিরিয়ে দেই তারপরও কেন আমাকে নিয়ে এমন ভয়ংকর স্বপ্ন আঁকো? কষ্ট লাগে না?” আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। আমি ইতস্তত হয়ে বললাম “তোমাকে ভালো লাগে। এই ভালোলাগাটা ভিতর থেকে তৈরি হয়। ভিতর থেকে যে ভালোলাগাটা বের হয় সেটার মাঝে ভালোবাসা থাকে। তাই তুমি আমাকে হাজার বার অবজ্ঞা করলেও তোমাকে ভালোবাসি।” সে একটু সময় নিয়ে বললো “আমি গত মাসে বাসায় তিন দিন আসিনি মনে আছে? ঘুরতে গিয়েছিলাম বান্ধবীদের সাথে।” আমি একটু ভেবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক ইশারা দেই। সে আবার বলতে থাকলো “আসলে আমি বান্ধবীদের সাথে যাইনি। এই তিন দিন কোথায় ছিলাম জানো? আদনানের সাথে। আমার সমস্ত ভালোবাসা ওকে দিয়েছি। আমাকে এই তিনটা দিন সে কতবার ছুয়েছে। আমি ওকে আমার সমস্ত কিছু দিয়ে ভালোবেসেছি। আমার ভালোবাসা তার কাছে কোন মূল্য নেই। তবুও আমি তাকে এতো এতো ভালোবাসি।কিন্তু সে যখন আমাকে এড়িয়ে চলে খুব কষ্ট লাগে জানো। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।” কথা গুলো শুনে আমি কি বলবো বুঝতে পারি না। আমার ভিতরটা ফেটে যাচ্ছে ওর কথা শুনে। বুকটা ধক ধক করছে। মুহের্তেই আমার মাথাটা ঝিম ঝিম করতে লাগলো। ইবনাত নিচের দিকে তাকিয়ে বললো “আমি জানি এখন থেকে তুমি আমাকে অনেক ঘৃনা করতে শুরু করবে। আসলেই আমি একজন ঘৃনার মানুষ।” এটা বলেই ও চলে যায়। আমি একটা কথাও বললাম না। পুরুষ মানুষ বড় হলে তার চোখে কান্নাটা মানায় না। একজন পুরুষ মানুষ কারও সামনে কাঁদতে পারে না। কাঁদলেও লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। ও চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে আমি ভয়ংকর ভাবে খুব কাঁদলাম। অনেক কাঁদলাম।

বুকের ভিতর যে শূন্যতার অনুভূতিটা জমাট বেধেছে আমি তার নাম দিয়েছি অপ্রাপ্তি। এই অপ্রাপ্তির ছায়াটা আমার মা ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না।দুইটা দিন আমার রুমটাতে আমি বিষন্ন মন নিয়ে প্রহর কাটাই। জানালা দিয়ে বাহিরের জগৎটাকে চোখের মাঝে বন্ধি করি।সেই চোখে নীল রঙ্গা আকাশ দেখা যায়। শরতের আকাশ। পুরো আকাশ জুড়ে সাদা মেঘের ভেলা।মা আমার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।আমি মায়ের দিকে তাকাই। মা বললো “যে হারিয়ে যায় তাকে জোর করে নিজের করা যায় না।এটা বুঝিস না?” আমার কি বলা উচিৎ আমি বুঝতে পারি না। আমার চোখে জল আসে।শরতের মেঘের জল। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম “প্রচন্ড কষ্টে আমার বুকটা ভেঙ্গে গিয়েছে মা।অদ্ভুত একটা যন্ত্রনা আমার বিষন্ন মনে প্রবেশ করে ভিতরটাকে আরও বিষন্নময় করে তুলেছে।” মা কিছু বলে না। শুধু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্তনা দেয়।
.
হাসপাতালের বারান্দার গ্র্রিল ছুয়ে আমার বন্ধু রাশেদ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি কাছে যেতেই আমাকে দেখে বললো “আজকাল কিছু ভালো লাগে না।ঘন্টা খানেক আগে বিথী আসছিল।ওকে দেখেই আমার ভিতরটা কেমন করে উঠছিল জানিস? আমি এখন কেমন আছি।আগের থেকেও শরীর ভালো কিনা টুকটাক কথা বলার পর আমি কিছুক্ষন চুপ করে ছিলাম।অনেক ইতস্তত করে যখন বললাম “আমাকে কতটুকু ভালোবাসো? সে কিছু বলে নাই জানোস।শুধু ঝিম মেরে ছিল। পরে আমি নিজেই হেসে দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে বললাম “আমি এখন ঘুমাবো।তুমি এখন আসতে পারো মেয়ে।” আমি রাশেদের দিকে তাকিয়ে বললাম “ভালোবাসা ব্যাপারটা আমি এখনো ঠিক করে বুঝতে পারি না।এর অনুভূতি অনেক গভীর। এই অনুভূতি কখন কাকে কেমন ভাবে আচ্ছন্ন করে আমার জানা নেই বন্ধু। সামনের সপ্তাহে তোর ফ্লাইট। তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি।”

ঘড়িতে তখন সন্ধ্যা সাতটা। আমি রাতের আকাশে তাকাই। এই বিশাল আকাশটার মাঝে যখন তাকাই তখন নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়। ঝকঝকে তারা গুলো মাথার উপর দিব্যি জ্বলতে থাকে। কিন্তু আমার ভিতরটা এমন করে কখনো জ্বলেনি। জ্বলার প্রদিপটা আমার ছিল না। কোন কালেই না। এর একটু পরই আমি ইবনাতদের বাড়িতে যাই। নানু আমাকে দেখে বললো “তোরে আজকাল দেখাই যায় না।” ইবনাত পাশে বসে নানুর চুল আচড়িয়ে দিচ্ছে।আমি ওর দিকে তাকাই। সেও আমার দিকে তাকায়।আমার চুপ থাকা দেখে ইবনাত নানুকে বললো “তুমি তো এখন বুড়ি হয়ে গেছো। তোমাকে এখন কি আর ভালো লাগবে যে তোমার কাছে আসবে।?” নানু ওর কথা শুনে হাসতে থাকে। আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকি।আর ভাবি এতোকিছু হওয়ার পরও মেয়েটা এতো স্বাভাবিক ভাবে কেমন করে কথা বলে? কেমন করে চলে? আমি কিছু না বলেই বের হয়ে বাসায় চলে আসি। আধঘন্টা পর ইবনাত ফোন করে বললো “এই ভাবে চলে গেলে কেন?” আমি কি প্রত্যুত্তর দিব বুঝতে পারি না।আমি ঠিকঠাক প্রত্যুত্তর না দিয়ে বললাম “আমি এখনো তোমার হাতটা আমার করতে চাই।এই চাওয়াটা ভিতর থেকে পচে যায়নি।আমার হবে মেয়ে?” সে চুপ করে থাকলো। তার চুপ থাকা বুঝে আমি বললাম “আমি দেশের বাহিরে চলে যাবো আগামীমাসে। ইতালিতে। চাচার কাছে।ওখানেই পড়াটা শেষ করে কিছু একটা করবো।” সে কিছুক্ষন সময় নিয়ে বললো “ভালো খুব ভালো। জাহান্নামে গিয়ে মরো। আমাকে ক্যান বলো?” এরপরই সে ফোনটা রেখে দেয়।

মাসে একবার হলেও এই জায়গায় আমি আসি। এই জায়গাটায় আসলে আমার কেন যেন খুব শান্তি শান্তি লাগে। ইতালির “লেক কমোর” পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে যখন আকাশটাকে দেখি, ঘনো ঘনো নিশ্বাস নেই তখন অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ভিতরে আচ্ছন্ন করে। এই পাহাড়ের চারপাশেই বিশাল বিশাল প্রাসাদ। তার সামনে বয়ে গিয়েছে একটা নীল নদ। সন্ধ্যা বেলা পাহাড়ী বাতাস আর নদীর ডাকটা আমার কেন যেন খুব ভালো লাগে। এই ইতালীয় শহরে আমার পাঁচটা বছর কেটে গেছে।যদিও আমি লেক কোমর শহরটাতে থাকি না। আমি থাকি ইতালির ভেনিস শহরে। এই ভেনিস শহরে পানির উপর নৌকা চলাচলের দৃশ্যটা ভয়ংকর সুন্দর।তার চারপাশেও কি চমৎকার চমৎকার প্রাসাদ। এই শহরের বুক জুড়েই শুধু পানি।এই পানিতে নৌকা চড়ে মাঝে মাঝে আমি ভেনিসের চমৎকার প্রাসাদ গুলোকে দেখি। ছোট্ট নৌকা দিয়ে পানির বুকে বয়ে যাই আর পানির দুপাশের প্রাসাদ গুলোকে দেখি।আমার খুব অবাক লাগে এতো বছর পানির ধারে থাকা সত্ত্বেও এই প্রাসাদ গুলোর কোন সৌন্দর্য কমে যায়নি।এই এতো গুলা বছর ইতালিতে কাটিয়ে দেওয়ার পরও এই জায়গা গুলোকে যতবার দেখি ঠিক ততবারই ভালো লাগে।কোন বিরক্ত লাগে না।ইতালিতে আসার তিন মাস পর ইবনাতকে ফোন করেছিলাম। সে আমার কথার শব্দ শুনেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। এতে আমি কষ্ট পেয়েছি বটে।আমার উপর তার অভিমান ছিল কিনা তা আমি বুঝতে পারিনি।ঠিক এক বছর পর সে আমাকে ছোট্ট একটা ই-মেইল করেছিল। যেখানে লিখা ছিল “আমার উপর এতোই রাগ তোমার এতোই রাগ? এইভাবে কেন গেলে ছেলে?” এই ই-মেইলের জবাব আমি তাকে আজও দিতে পারিনি।প্রতিবার আমি মেইলটা অপেন করে তার এই ছোট্ট লিখাটার মাঝে তাকিয়ে থাকি।আর ঠিক ততবারই আমার চোখে জল চলে আসে।বেদনার জল।”

আমার বন্ধু রাশেদ এখন খুব ভালো আছে।গতকাল ওর সাথে ইমোতে কথা হয়েছে।নাছরিন নামের এক মানবীকে বিয়ে করে সংসার করছে। ভালো একটা চাকরি করে। তার ছোট্ট মেয়ে নিশি মামনিকে আমাকে দেখায়।নিশি মামনির কপালে আমি চুমু এঁকে দেই এই ইতালির শহর থেকে।” নাছরিন ভাবী আমকে বলে “ভাই আসেন না কেন দেশে? বিয়েও তো আসলেন না।” আমি শুধু একটা হাসি দিয়েছিলাম।রাশেদ আমাকে একটা গালি দিয়ে বলেছিল “সালা আর কত দুরে দুরে থাকবি? এবার তো দেশে আয়।” আমি বললাম “খুব শিঘ্রই আসবো।” ইতালিতে আসার আগে ইবনাত একটা বার যদি বলতো “ছেলে যাস না এইভাবে আমাকে ফেলে।তোর মত এমন ভয়ংকর করে আমাকে কেউ ভালোবাসে নাই।” আমি সত্যি এখানে আসতাম না।

আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সেও এখন ভালো আছে।ভালোবেসেছিলাম এই শব্দটা এই জন্য বললাম ইবনাতকে আমি এখন ভালোবাসি এই শব্দটা আমার মুখে মানায় না। এই ভালোবাসাটা অন্যায়। সে এখন অন্যজনের বউ। আদনানের বউ। ইবনাত হয়তো জানেই না ইতালিতে আসার দু বছর পর আদনানের কাছে রাশেদকেও সহ আমার আরও দুজন বন্ধুকে পাঠিয়েছিলাম। রাশেদকে বলে দিয়েছিলাম “মেয়েটা ভালো নেইরে। আমি বুঝি। প্রতিটা রাতে মেয়েটা কাঁদে ছেলেটার জন্য আমি সূদর ইতালিতে অবস্তান করেও অনুভব করতে পারি। তুই আদনানের কাছে যা। ওকে প্রথমে খুব ভালো করে বুঝাবি ভাই।দরকার হলে ওর পায়ে ধরবি। না বুঝলে একটু ভয়ংকর করে ভয় দেখাস। কিন্তু মারিস না।” ভয়েই কাজ হয়ে গিয়েছিল। আদনানও বুঝতে পেরেছিল সে অন্যায় করেছে। এটা করা ওর ঠিক হয়নি। ইবনাতের একটা ছেলে আছে। আমি মাঝে মাঝে তার আইডিতে ঢুকে তাদের ছবি গুলো দেখি।অন্য আইডি দিয়ে দেখি।আমার আসল আইডি থেকে ওকে ব্লক করে রেখেছি। ওদের ছবি গুলো দেখলে আমার ভিতরটা কেমন করে যেন উঠে।

চাচা রুমের ভিতর এসে বললো “তোর বাবা ফোন করেছিল।তোর মোবাইল অফ কেন? দেশে যেতে মন চায় না? কারন কি বলতো? আমি প্রতি বছরে যাই তুই একটা বারও আমার সাথে যাস না।” আমি মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি অফ হয়ে আছে।চাচাকে বলি “মোবাইলে চার্জ নেই।পড়া শেষ করেই চাকরিটা পেয়েছি একবছর হলো একটু নিজেকে গোছাতে সময় লেগেছে।সামনে ছুটি নিবো। লম্বা ছুটি।বাবা মাকে কতদিন সামনে থেকে দেখি না।” চাচা আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে রুম থেকে চলে যায়। আমি সময়ের জন্য অপেক্ষা করি কখন আবার আমার প্রিয় দেশটার কাছে যাবো। ভোরের আলোর মাঝে নিজেকে তলিয়ে দিব। কখন আমার মাকে জড়িয়ে নিয়ে বলবো তোমার বোকা ছেলেটাকে বকা দিবে না? শান্তনা দিবে না?” আচ্ছা মা কি সত্যি আমাকে বকা দিবে? একটু কাঁদবে? মা কাঁদলে তখন কেমন লাগবে? ”আমি জানি না। ইবনাতের সাথে আমার যখন দেখা হবে তখনো কি সে বলবে “ছেলে আমার উপর তোমার এতো কিসের রাগ? কেন এভাবে চলে গেলে?” আমি শুধু হাসবো।নিজেকে স্বাভাবিক করে তাকে জানিয়ে দিব “তখন কিনা কি পাগলামি করেছি মনে নেই। এগুলো মনে পড়লে এখন হাসি পায়।” আমি তাকে আমার বিষন্নতার কোন কিছুই বুঝতে দিব না।আমি এটাও জানি না ইবনাতকে ভুলতে পারবো কিনা। কিন্তু আমাকে যে ভুলে থাকার চেষ্টা করতে হবে। আমি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। ইতালির আকাশের বুকে যখন মেঘ বয়ে যায়, চোখের সামনে থেকে এই মেঘ গুলো হারিয়ে যায় আমার তখন একটা আশ্চর্য রকমের অনুভূতি তৈরি হয়। মনে হয় যাকে আপন ভাবি, যাকে পাওয়ার জন্য কিংবা এই মেঘ গুলোকে ছুয়ে দেওয়ার মত তার কাছে হাত বাড়িয়ে দেই তখন সে হারিয়ে যায়। ঘনঘোর বা আঁধারে হারিয়ে যায়। এই মেঘ ছোয়া যায় না।শুধু ছোয়ার স্বপ্ন দেখা যায়…

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে মার্চ, ২০১৯ সকাল ১১:৪৪

মা.হাসান বলেছেন: কথার যাদুকর, বরাবরের মতো মুগ্ধতা।
ভালোবাসায় পেলেও কষ্ট, না পেলেও কষ্ট, না পাওয়াটাই মনে হয় বেশি ভালো। ভালোবাসার অবহেলা সবাই সহ্য করতে পারে না।

২| ২৪ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:০০

কানিজ রিনা বলেছেন: বেশ ভাল লাগল, ধন্যবাদ।

৩| ২৪ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১:০৩

আলমগীর জনি বলেছেন: মুগ্ধ হয়ে পড়ছিলাম। মনে হচ্ছে কারো একদম নিজের গল্প ।

৪| ২৪ শে মার্চ, ২০১৯ দুপুর ২:২৮

রাজীব নুর বলেছেন: ভালোবাসা শব্দটার উপর আস্থা নেই। শুধু বাবা মা, সন্তান আর স্ত্রীর ভালোবাসাটাই আসল। সত্য।

৫| ২৪ শে মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৪:৩৮

মাহমুদুর রহমান বলেছেন: সহজ সরল সুন্দর গল্প।

৬| ২৫ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ৮:০৮

মুক্তা নীল বলেছেন: গল্পটা পড়ার পর কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে ভাবলাম, খাঁটি ভালোবাসা কি কেবল অপাএেই পড়ে? আত্মার সম্পর্ক আসলে ভালোবাসার মূল টান। তা থেকে যদি দুঃখ, বেদনা যা-ই পাওয়া যাক না কেন, সেটুকুই না হয় সুখস্মৃতি হয়ে বেচে থেকে।
অনেক অনেক ভালোলাগা রইলো।

৭| ০৬ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ২:১১

অন্তরা রহমান বলেছেন: চমৎকার পোস্ট। বেশ ভালো লাগলো গল্পটা পড়ে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.