![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এমন সুন্দর কাটলো দিনটি, তবু হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেল। আকাশে নীলের ছড়াছড়ি, শুভ্রতাও ছিল দিনভর। শেষ বিকেলের এমন সৌন্দর্য, পাশেই কৃষ্ণচুড়ার সপ্রতিভ বিচ্ছুরণ, উদাসী মনে আরো হাওয়া দেয়। কিন্তুু কারখানায় কাজ করলে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। সারাক্ষণই সতর্ক থাকতে হয়। তটস্থও। এরইমধ্যে দিনাতিপাত, বেতনের টাকায় সংসার চালানো- সেই তো ঢের। মুক্তিযোদ্ধা বাবার অহমিকা পুত্রের ভেতরেও সুগ্রথিত এবং সুতীব্র। তাই, রোজকার এমন সুন্দর বিকালটাও আজ যেন বড়ই অসুন্দর। যেন বারবার টিপ্পনি কাটছে, মনে করিয়ে দিতে চাইছে শফিকের অসহায়ত্বকে।
শফিকতো খাপখাইয়ে চলার মত মানুষ। নিরিবিলি কাজ, শেষে বাসায় ফিরে যাওয়া। আজ তার একেবারেই মন চাইছে না বাসায় ফিরতে। কারখানায় বসে থাকতেও ভাল্লাগছে না। বন্ধুদের দু’জনকে ফোন দিতে গিয়েও থেমে গেল। স্বাভাবিক হতে পারছে না সে। খুব মন খারাপ হলে যা হয়।
শফিককে অনেকক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে সুপারভাইজার হাতেম আলি। বলে, বাসায় যান। অযথা মাথা গরম করে কি লাভ। চাকরি করতে আসছি- এক টু তো.....
- না, শ্রম দিয়ে টকা নেই। কারো দয়া-দাক্ষিণ্য চাইতে আসিনি।
- তবুও...।
- এমন চাকরি না করলে কি হয়। বলেই এক মাসের ছুটির দরখাস্ত হাতে দিয়ে বের হয়ে যায় শফিক। তারপর দিনতিনেক কেটে গেছে। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না শফিক। চাকরিতে ইস্তফা দেয়ার বিষয়টিই কেবল তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। ছুটি মঞ্জুর হলো কি না, তা নিয়ে কোন টেনশন নেই তার।
কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না কি করবে সে এখন। এমনিতেই অফিসের পরিবেশ দিন দিন খারাপ হচ্ছে। মালিকপরে বাইরে কর্মচারিদের মধ্যেও দলাদলি বেড়েছে। ইউনিয়ন নেতাদের হস্তপে এতই বেড়েছে যে, কাজের লোকেরা আর পদোন্নতি পাচ্ছে না। পুরো অফিস জুড়েই এক ধরনের চাপা ােভ বিরাজমান।
শফিক দলাদলিতে নেই। নিজের কাজটা ভালোভাবে করেই সুস্পষ্ট। ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে কাজই হচ্ছে বড় এমন ধারনা নিয়েই সে এই কারখানায় যোগদান করেছিল। যদিও চাকরিতে যোগদানের সময় শফিকের বাবার মৃদু আপত্তি ছিল। খোলাসা করে কিছু না বললে, শফিক জয়েন করে। চাকরির বাজারে যা অবস্থা, প্রতি বছর নতুন করে কুড়ি লাখ বেকার যোগ হচ্ছে। দেশে পৌনে চার কোটি লোক যেখানে বেকার, সেখানে কোন মতে একটা চাকরি জুটানোর পর তা হাতছাড়া করা বোকামি হবে মনে করেই শফিক সেদিন এই কোম্পানিতে যোগদান করে। পাকিস্তান আমলের কারখানা, ব্যবসাও করে ভাল, কাজেই বেতন-ভাতাদি পরিশোধে গাফেলতি ছিল না।
অনেক বছর কেটে গেছে শফিকের, এই কোম্পানিতে। বড় কর্তার সুদৃষ্টি অনেক আগেই পড়েছে তার দিকে। অন্য কোন কারণে নয়, কাজ জানে বলে। তারপর দায়িত্বও বেড়েছে। কিন্তু বছর শেষে একটি মাত্র ইনক্রিমেন্ট যোগ হচ্ছে তার বেতনের ঝুড়িতে। এ নিয়ে শফিকের মনে চাপা ােভও আছে। আজকাল আর দশ টাকা কেজিতে চাল পাওয়া যায় না। চল্লিশ টাকা হলে মোটা চাল পাওয়া যায়। জিনিসপত্রের দাম, বাড়ি ভাড়া সবই বাড়ছে। এর মধ্যে সবাই চলছে। শফিক মাঝে মাঝে ভাবে লোকদের বাজেট মিলে কিভাবে? কখনো মনে হয় চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে অন্য কোন কোম্পানিতে জয়ে করতে। ওর বন্ধু বান্ধব চাকরিতে লম্ফঝম্প দিয়ে বেতন বাড়িয়ে নিয়েছে। শফিক সেটাও করতে পারেনি। সেদিনও নতুন এক কোম্পানি থেকে চাকরির অফার এসেছিল। শফিকের সহকর্মী সিদ্দিক বলল, যান ভাই চলে যান। আমরা এখানে জীবনযৌবন সব দিয়েছি। লাভ হয়নি। এখন চাকরি হারানোর ভয়ে আছি।
সিদ্দিকের চাকরির বয়স চল্লিশ বছর। চাকরি ছেড়ে দিলে এককালীন কিছু টাকা পাবে এই আশা তার। কিন্তু কোম্পানি এখন আর আগের মত চলছে না। বয়স্ক দেখে চাকরি থেকে বের করে দিচ্ছে। বেশি বেতনের লোকদের ছাঁটাইয়ের কাজটি কেশৈলে সারছে কোম্পানি। ইউনিয়ন নেতাদের আগেই হাত করে নিয়েছে ম্যানেজমেন্ট। নেতাদের সবাইকে বছর খানেক আগেই পদোন্নতি দিয়ে খুশি করা হয়েছে।
শফিক চলে যেতে চায়, কিন্তু মনের টান তাকে বাধা দেয়। নতুন কোম্পানিতে ঝুঁকি আছে, সেটিও চিন্তার বিষয়। দেশে যে হারে চটের কারখানা চালু হয়েছে তাতে নতুনদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাও কষ্টকর। শফিক ভাবে যাক না আরো কিছুদিন। কিন্তু সেদিনের ঘটনা তাকে দারুনভাবে পীড়া দিয়েছে। তাই চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে যেতে চায় সে। চাকরিটা বেশিদিন করা ঠিক হবে না। শফিক সেদিনই চাকরিটা ছেড়ে দিত, কিন্তু নিজের সংসারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তা করেনি। তবে এই কোম্পানিতে কাজ করার ইচ্ছা তার পুরোপুরি উবে গেছে। কি হয়েছিল সেদিন?
বড় কর্তার মেয়ে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে। বড় কর্তা মানুষ হিসাবে যেমনি হোক, অফিসের কর্মচারিদের সঙ্গে সম্ভাব রেখে চলেন। মাঝে মধ্যে গালমন্দ করেন না যে তা নয়। তার মেয়ে যদি এত বছরের পুরনো কর্মচারিদের গালাগাল দেয়, সেটা কোন বিবেকবান মানুষের সহ্য হওয়ার কথা নয়। বড় কর্তার ছেলেটি বিদেশে থাকে। বৃটেনে পড়তে গিয়ে এক পর্তুগীজ মেয়ের সঙ্গে প্রণয় ঘটে। দেশের প্রতি কোন টান নেই। ছোট দুই মেয়ে এখানে থাকে। বড় কর্তা মাস ছয়েক হয় ওদের ডেকে এনে কোম্পানির পরিচালক বানিয়েছে। কোম্পানি কাঠামোয় চললেও ‘নতুন দেশ’ নামক চটকলটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজির আলি। তাকে সবাই বড় কর্তা হিসাবেই সম্বোধন করে। তিনিও তার বাপের কাছ থেকে এই কোম্পানি পরিচালনার ভার নিয়েছেন। এখন নিজের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই মেয়েকে কোম্পানি পরিচালনায় নিয়ে এলেন। বড় মেয়ের নাম হোসনেয়ারা আলি। সবাই বলে খামখেয়ালি। যখন তখন আসে যায়। টাকা নিয়ে হোটেল রেস্তোঁরা, ফূর্তি করাই তার কাজ। ছোট মেয়ে তৌফিকা আলি। ব্যবসা বোঝে না, কিন্তু খবরদারিতে ওস্তাদ। বেতন বন্ধ, কথায় কথায় হুমকি-যেন ঘরের চাকর বাকর সবাই। কারখানার কর্মীরা খুবই বিরক্ত তাকে নিয়ে। কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। চাকরিটা চলে গেলে এই বাজারে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। শফিক ভাবে প্রতিবাদটা তাকে দিয়েই শুরু হোক। আবার ভাবে-চাকরি ছেড়ে দিলে ওদের কিছুই হবে না। ওরা সমাজের ওপরতলার মানুষ। বরং শফিকই চাকরিহীন হয়ে গেলে সংসার চলবে না। বৃদ্ধ বাবা মাকে নিয়ে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। বাবাকে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা নিয়ে চলতে হবে?
-না, তা কখনো হতে দিতে পারে না শফিক। শফিকের বাবা মাহমুদ সাহেব মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কোন সুবিধাই রাষ্ট্রের কাছ থেকে নেননি। দেশকে তিনি মায়ের মতই ভালোবাসেন। তাই দেশের জন্য যুদ্ধ করে বিনিমযে কিছু নেয়া সমীচিন নয় বলে মনে করেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর øেহভাজন ছিলেন। একবার বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন-মাহমুদ তুমিতো কখনো আমার কাছে এলে না?
-আমার চাওয়ার পাওয়ার কিছু নেই বঙ্গবন্ধু।
শুনে বঙ্গবন্ধু মৃদু হাসলেন। মাহমুদ সাহেব চললেন স্বাধীনতা চেয়েছি, তা পেয়েছি। এরচেয়ে আর বেশি সুখ কিছুতে নেই।
বাবার দেশ প্রেমের কথাগুলো মনে পড়ে যায় শফিকের। যে দেশকে ভালবেসে স্বাধীন করেছে তার বাবা, সেই দেশে ছেলের একটা চাকরি না থাকলে মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে না খেয়ে থাকতে হবে। তাহলে কি গালমন্দ খেয়েও চাকরিটা করবে শফিক? সেটাও তার বাবার চেতনার পরিপন্থী হবে। ঘটবে তার নিজের ব্যক্তিত্বের হানি। অন্তত: বাবাকে ছোট করে কারো সঙ্গে আপোষ করবে না শফিক। বাবার পেছনের জীবনে ফিরে যায় সে। মনে পড়ে বাবার যুদ্ধে যাবার গল্প। মামারা যেতে দেবে না। মা বললেন-যাও। তারপর তিনি চলে গেলেন রণেেত্র। ভুরঙ্গামারিতে আজকের যে সামাদনগর, তার নামকরন হয়েছিল শহীদ লেফটেন্যান্ট সামাদের নামেই। মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকার খনন পরখ করতে গিয়ে রাস্তায় উঠলেন। অন্যপাশ থেকে ছুটে আসা শেলবিদ্ধ হয়ে মুহূর্তেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। এই ঘটনা দারুন পীড়া দিয়েছিল বাবাকে। চোখের সামনে একজনকে হারিয়ে আরো বেশি প্রি হয়ে উঠলেন তাদের ছোট মুক্তিযোদ্ধার দলটি। বাবা ঘটনার বর্ণণা দিয়ে বলেছিলেন ঃ
‘পাক বাহিনীর নিয়মিত টহল ছিল ভুরুঙ্গামারিতে। এটি আমাদের জন্য একদিকে যেমন ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, অন্যদিকে শত্র“র অবস্থান জানতে পারায় সুবিধাই হল। পাক সেনাদের প্রস্তুতির খবর আমাদের কাছে ছিল। তাই আমরাও ‘ওয়ান আপ-টু ডাউন’ পদ্ধতিতে অস্ত্র মোতায়েন করলাম। একটি এলএমজি ও একটি টমিগান পজিশন নিয়ে কমান্ড করলাম। আর এভাবেই শেষ করে দিয়েছিলাম পাক বাহিনীর দুর্গ।’
ছোটবেলা থেকেই বাবার যুদ্ধজয়ের গল্প শুনতে শুনতে নিজেকেও যেভাবে প্রস্তুত করেছে শফিক। বাবা স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, এই অর্জন ধরে রাখার দায়িত্ব তার। সে কারণে স্বাধীনচেতা শফিক প্রতিবাদীও।
দুই.
গত ক’দিন ধরে অফিসে যাচ্ছে না শফিক। প্রশাসন বিভাগ থেকে ফোন এসেছিল। একমাসের ছুটি মঞ্জুর হয়নি তার। সপ্তাহখানেক ছুটি কাটিয়ে অফিসে জয়েন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এতে আরো রাগ বেড়েছে শফিকের। এই প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে ঢোকার আগে বাবার জোরালো সম্মতি কেন ছিল না, সেটিও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। শফিক সেদিন বুঝতে পারেনি, বাবাও ভেঙে কিছু বলেনি।
ড্রয়িংরুমে বসে শফিক টেলিভিশনের রিমোট ধরে নাড়াচাড়া করছে। বাবা এসে কাছে বসলেন।
-কি হয়েছে তোর, শরীর ভালো আছে তো?
- হ্যাঁ, বাবা। শরীর ভালো।
- অফিসে যাচ্ছিস না যে।
বাবার প্রশ্নের উত্তর কিভাবে দেবে সে। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তৌফিকা আলির রুদ্রমূর্তি, - ঐ হারামজাদার বাচ্চা।
কথাটি মনে হলেই শফিকের মাথা বিগড়ে যায়। কোন দোষ করেনি সে। তৌফিকা আলি একটি ফাইল রেডি করতে বলেছিল। শফিক ফাইলটি তৈরি করে তার সুপারভাইজারের নিকট জমা দিয়েছিল। সে খবর না নিয়েই তৌফিকা আলি গালমন্দ দিল। সেই ােভেই অফিসে ছুটির দরখাস্ত দিয়ে এসেছিল সে।
বাবাকে বলল, চাকরিটা আর করতে পারছি না।
-বেশতো, ছেড়ে দে। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোন কাজ করার দরকার নেই।
বাবা উঠতে গিয়েও বসলেন। শফিকের কাঁধে হাত রেখে বললেন, আমি জানতাম একদিন তুই একথাই বলবি।
- বাবা,
- হ্যাঁ রে। শোন তাহলে, যুদ্ধের ডামাঢোলে কত কিছুই না ঘটে গেছে। হঠাৎ খবর এলো নতুন দেশ কারখানার মালিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবার ধারণা ছিল পাকবাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর জানতে পারি তোদের বড় কর্তার বাবাই ওদের হত্যা করেছিল। শুধু এই কারখানাটি দখলে নেয়ার জন্য।
বাবার মুখে এমন কথা শোনার পর শফিকের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয় না। খুনীর রক্ত যার শরীরে বইছে, তার কারখানায় একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান চাকরি করতে পারে না। চাকরিটা ছেড়ে দিয়েই তাই প্রমাণ করতে চায় সে - শফিক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, হারামজাদার বাচ্চা নয়।
©somewhere in net ltd.