নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জয়দেব করের লেখাজোকা

জয়দেব কর

অন্ধ আমি অন্ধকারে আলো কুড়াই,গন্ধরাজের গন্ধে মাতাল জীবন পোড়াই!

জয়দেব কর › বিস্তারিত পোস্টঃ

সোমপুর মহাবিহারে একদিন /জয়দেব কর

২৭ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১২:০৫

International Vesak Day উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সোমপুর বিহারে (পাহাড়পুর) যখন পৌঁছলাম, তখন প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান প্রায় শেষের দিকে। অনুষ্ঠান উদযাপন কমিটির সচিব প্রকৌশলী পুলক কান্তি বড়ুয়ার ডাক পড়ল। উনার চমৎকার একটি সময় উপযোগী বক্তব্যের পর স্থানীয় এমপির ভাষণ অল্প শুনে আমি কেন্দ্রীয় মন্দিরের টেরাকোটার ছবি তুলতে যাই।


টেরাকোটার ছবিগুলো যখন তুলি তখন মাথার উপর যত কড়া রোদ ছিল সব যেন নিমিষেই মিষ্টি হয়ে গিয়েছিল ক্লিকের পর ক্লিকে। আমার বাংলা, আমার সোনার বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য কত যে মণি-মুক্তো ধারণ করে আছে তা সোমপুর মহাবিহারে ভ্রমণে গিয়ে আরও পাকাপোক্ত আসন করে নিয়েছে মনের গভীরে। বিহারের গায়ে এত সুন্দর শিল্পকর্ম নিয়ে আমি গর্ববোধ করি। আমরা আজকের দিনের সুন্দর ও শুভতে নিবিষ্ট যারা, তারা নির্দ্বিধায় এর উত্তরাধিকার বহন করছি। মধ্যযুগের অন্ধকারের কত আগেই আমরা অতি উচ্চমানের শিল্পকলার মধ্য দিয়ে নিজেদের মননের পরিচয় দান করতে সক্ষম হয়েছিলাম তা ভাবলেই গর্বের সীমা থাকে না। এগুলোর মধ্যে প্রকাশিত বাংলার লৌকিক জীবন ও প্রকৃতির বিভিন্ন অনুষঙ্গ আজও আমদের মধ্যে বিদ্যমান।


টেরাকোটাগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সঠিক কোনও পদক্ষেপ নেই সরকারের। কিছু বিকৃত মননের মানুষ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, আর কিছু নষ্ট হচ্ছে অন্য কোনও কারণে হয়ত। সিসিটিভি ক্যামেরা নেই, নেই তেমন ভালো তত্ত্বাবধায়ক। সন্ধ্যার পরে অন্ধকারে ঢেকে যায় অতীশ দীপঙ্করের স্মৃতিধন্য এই প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়টি। দশম শতকে বাংলার এই কৃতি সন্তান সোমপুর মহাবিহারে আচার্যের দায়িত্বে রত ছিলেন। তিনি আজ বাংলাদেশ সরকারের যতটা কূটনৈতিক হাতিয়ার ততটা নিজেদের শ্রেষ্ঠতর সন্তান হিসেবে নিজ ভূমিতে পূজিত নন। ১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু আমরা এই ঐতিহাসিক স্থাপনার জন্য কী করতে পারলাম? বাংলাদেশে যে সকল চারুকলা ইন্সটিটিউট আছে সেগুলো থেকে স্নাতকোত্তরদের এখানে যথাযথ প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে স্থায়ী নিয়োগের মাধ্যমে এর ঐতিহাসিক শিল্পমূল্য বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি এমন কথা ভাবতে ভাবতে ছবিতোলা শেষ হলে ফিরে এসে দেখি যে প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান শেষ।

দ্বিতীয় পর্ব শুরু হওয়ার আগে খাওয়াদাওয়া শেষ করে মহাবিহার সংশ্লিষ্ট মিউজিয়াম ঘুরে দেখলাম। ছবি তুলতে মানা-করা ছাড়া ওখানকার কর্মীদের তেমন কোনও কাজ নেই। মহাবিহার ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পর্কিত কিছু প্রকাশনা চোখে পড়ল একটা কাচের বাক্সের ভেতর, যার পাশে লেখা কাউন্টার থেকে সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু কাউন্টারে গিয়ে কোনও লাভ হলো না। বোরকা-আবৃত মহিলা বিরক্তির সাথে জানালেন এগুলো শেষ হয়ে গেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান পাওয়া একটা বিহারের মিউজামের অনান্তরিক পরিবেশ দেখে। কোনও পরিদর্শন বই বা অভিযোগ বক্স পেলাম না যেখানে মনের ক্ষোভগুলো লেখা যায়। আমি তো চাইলেই যেতে পারব না,আর এটা তো আমার বাড়ির কাছের জায়গা না। সোমপুর বিহার তো শুধুই বাহ্যিকভাবে প্রদর্শনের বস্তু নয়। এটাকে বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় বলে মনে করা হয়। বৌদ্ধ দর্শন, ব্যাকরণ, হেতুবিদ্যা, গণিতবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যাসহ নানা বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীরা এখানে আসতো।


মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে দেখি দ্বিতীয় পর্বের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। আদিবাসী মাদলের ধ্বনী শোনা যাচ্ছে, মাইকে ভেসে উঠছে ‘বন্দে ত্রিরত্নম'। আদিবাসী কিশোরীদের মেজেন্টা কালার শাড়ী,খোঁপায় মেজেন্টা ফুল। মহিলাদের অনেকের পরনে সাদা ও হলুদ শাড়ি। তাদের অগ্রে শ্বেতবস্ত্রধারী মুন্ডিতমস্তক কিশোর, তরুণ, যুবক, বৃদ্ধ। ওদের অগ্রে ভিক্ষুসঙ্ঘ। এ এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রায় নয়শ বছর পর মহাবিহারের মাটিতে ভিক্ষুসঙ্ঘের নেতৃত্বে প্রব্রজ্যাপ্রার্থীরা দীর্ঘ সারির মধ্য দিয়ে ধর্মপাল প্রতিষ্ঠিত সোমপুর মহাবিহারের কেন্দ্রীয় মন্দির প্রদক্ষিণ করছেন। বাতাসে ভেসে উঠছে, ‘বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি, ধম্মং সরণং গচ্ছামি, সংঘং সরণং গচ্ছামি’। এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য যিনি আমাদের করে দিয়েছেন, তিনি এ সময়ের কৃতি সাঙ্ঘিক ব্যক্তিত্ব শাসনরক্ষিত থের। তিনি আয়োজক কমিটির চেয়ারম্যান, তাঁর সাথে গৃহীদের মধ্যে যিনি বলিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন তিনি আয়োজক কমিটির মহাসচিব প্রকৌশলী পুলক কান্তি বড়ুয়া যার নিকট আমি কৃতজ্ঞ আমাকে এমন ঐতিহাসিক কর্মযজ্ঞে যোগদান করতে সফরসঙ্গী করার জন্য। এছাড়াও সরিৎ চৌধুরী সাজু, রুবেল বড়ুয়াসহ অনেক নাম না-জানা ভিক্ষু-গৃহীদের অনেক অবদান এতে আছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ষাটের অধিক প্রব্রজ্যাপ্রার্থী এখানে ছিলেন। এরাই তো এ মাটির ভূমিপুত্র, এরাই তো প্রথমে নির্দ্বিধায় বুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। এরাই সোমপুর বিহারের প্রকৃত উত্তরাধিকারী। কতো নিপীড়ন-নির্যাতনে নিষ্পেষিত হয়ে আজও টিকে আছেন। শুধু বুদ্ধের অনুসারী ছিলেন বলেই এরা সেন, তুর্কীদের কাছ থেকে কম অত্যাচার পাননি। হাজার বছরের নির্যাতন অবহেলায় ছিটকে পড়েছেন মূলধারা থেকে। কালের পরিক্রমায় নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে টিকিয়ে রেখেছেন বৌদ্ধিক মনোবৃত্তি। আবছা-আবছা বৌদ্ধ রীতির অনুসরণ থেকে বেড়িয়ে এসে থেরবাদী পরম্পরায় এদের দীক্ষিত হওয়ার যাত্রা শুরু হয় মূলত নব্বইয়ের দশকে ভিক্ষু সুনন্দপ্রিয় ভন্তেদের হাত ধরে।

সর্বতোভদ্র মন্দির পরিভ্রমণ করে প্রব্রজ্যার‍্যালী ধীরে ধীরে মূল ফটকের বাইরে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছল। ড. জ্ঞানরত্ন মহাস্থবিরের উপাধয়াত্বে শ্বেত বস্ত্রধারীদের বিভিন্ন ক্রিয়া শুরু হলো। এতে আরও অনেক ভিক্ষু ছিলেন। সবার নাম আমার মনে নেই। যখন অষ্টপরিষ্কার দানের মুহূর্তটি আসলো, তখন নয়ন জুড়িয়ে গেলো। আদিবাসী মায়েরা নিজেদের সন্তানদের তা তুলে দিচ্ছেন, তাদের পুত্ররা একটু পরেই হয়ে উঠবে বুদ্ধপুত্র আর সোমপুর বিহারও যেন মায়েদের সূর্যবর্ণ চীবরদানের আলোয় কিছুটা আলোকিত হয়ে উঠছে। সমস্বরে বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি ধ্বনীতে কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল এই বিহারটি।


যথাসময়ে শ্বেতবস্ত্রধারীদের চীবর পরিধানে পাঠানো হলো অনতিদূরের রেস্টহাউজে। চীবর পরিধান শেষে সারিবদ্ধ শ্রমণেরা আবার ভিক্ষুসঙ্ঘের নিকট ফিরলেন, আর তাঁদের বরণনৃত্যের মধ্য দিয়ে নিয়ে আসলো তাদেরই সমাজের বোনেরা। এ দৃশ্য ছিল অতীব মনোরম। পুনরায় সঙ্ঘের নিকট এসে দশশীল গ্রহণের মধ্য দিয়ে তারা হয়ে উঠলেন শ্রমণ। তারপর ভিক্ষু ও গৃহীরা বক্তব্য দিলেন। শেষপর্বে গৃহীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন অনুষ্ঠানের প্রধান বক্তা সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল হাসপাতালের পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া। এভাবেই পাহাড়পুরের মাটির সুপ্ত বুদ্ধবিভা জাগরিত হলো বলে বোধ করি, তা যেন বহাল থাকে চিরায়ত বাংলার গৌরব হয়ে।

মন্তব্য ১৭ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (১৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১২:৩৭

কাওসার চৌধুরী বলেছেন: পাহাড়পুর বিহার নিয়ে অনেক তথ্য জানতে পারলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।

২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৪০

জয়দেব কর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

২| ২৭ শে মে, ২০১৮ দুপুর ১:৩৩

সামছুল মালয়েশিয়া প্রবাসী বলেছেন: আমাদের বাড়ীর কাছে,পড়ে ভালো লাগলো, ধন্যবাদ।

২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৪১

জয়দেব কর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

৩| ২৭ শে মে, ২০১৮ দুপুর ২:০১

কাইকর বলেছেন: ভাল পোস্ট। অজানা কিছু জানা হলো

২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৪২

জয়দেব কর বলেছেন: ধন্যবাদ।

৪| ২৭ শে মে, ২০১৮ দুপুর ২:২৯

শিখা রহমান বলেছেন: চমৎকার লেখা ও ছবিগুলো। পাহাড়পুর বিহার নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধন্যবাদ ও শুভকামনা।

২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৪২

জয়দেব কর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

৫| ২৭ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:০২

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
পাহাড়পুর বিহার নিয়ে চমৎকার তথ্য নির্ভর লেখা,
অনেককে পাহাড়পুর ভ্রমনে উৎসাহিত করবে।

ধন্যবাদ লেখাটির লেখকের জন্য।

২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৪২

জয়দেব কর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।

৬| ২৭ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৪:৩২

রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার লেখা চমৎকার ছবি।

২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ৮:৪২

জয়দেব কর বলেছেন: ধন্যবাদ।

৭| ২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:২৬

ching বলেছেন: তিনি আজ বাংলাদেশ সরকারের যতটা কূটনৈতিক হাতিয়ার ততটা নিজেদের সন্তান হিসেবে নিজ ভূমিতে পূজিত নন

২৮ শে মে, ২০১৮ সকাল ১০:৪২

জয়দেব কর বলেছেন: ঠিক তাই! পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

৮| ২৭ শে মে, ২০১৮ রাত ১১:৩৮

হবা পাগলা বলেছেন: সুন্দর পোস্টের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ব্লগে আমি নতুন। আমার ব্লগটা একটু ঘুরে আসার নিমন্ত্রণ রইলো।

২৮ শে মে, ২০১৮ সকাল ১০:৪৩

জয়দেব কর বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ। সময় করে দেখব।

৯| ২৯ শে মে, ২০১৮ রাত ১০:২০

সামু পাগলা০০৭ বলেছেন: দারূণ একটি তথ্যবহুল ভ্রমণ পোষ্ট। কষ্ট করে লেখাটি শেয়ার করার জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে।

পোষ্টে প্লাস।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.