![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি অসম পাহাড়ে সরলভাবে বেড়ে উঠা ছেলে।
বাংলাদেশ এক ভাষা, এক জাতি বা এক ধর্মের দেশ নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শুধু মুসলমানের দেশ করার খেসারত দিতে হয়েছে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে 'বাঙালির রাষ্ট্র' বলে সংখ্যালঘু জাতিসত্তার স্বীকৃতি না দিয়ে এবং তাদের জোর করে বশীভূত করার পরিণতিও প্রত্যক্ষ করেছে। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অশান্ত রূপও দেখতে হয়েছে। এ দুই ভুল থেকে শিক্ষা না নিয়ে শাসকশ্রেণী যদি বাংলাদেশকে বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র মনে করেন, তবে সেটি হবে মহাভুল। এ ভ্রান্ত রাজনীতির তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাও হাজির করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশি-বিদেশি পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। এ ভ্রান্ত তত্ত্ব নীতিনির্ধারক থেকে প্রশাসকদের একাংশের মধ্যে সংক্রমিত। এর পুনরাবৃত্তি শুনেছিলাম সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনির মুখেও। উনার ভাষায়- বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। তাহলে সমতলের সাঁওতাল, গারো, মুণ্ডা, রাজবংশীসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এবং চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মুরং ইত্যাদি জনগোষ্ঠীকে কী বলবেন ? আদিবাসীর পরিবর্তে বাঙালি বলা হবে, না উপজাতি বলে উপহাস করা হবে ?
আদিবাসীর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। জাতিসংঘের আইএলও কনভেনশন ১০৭ (বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেছে) এবং আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী যে বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হলে সেই জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী বলে চিহ্নিত করা হয় তা হলো-
ক. সনাতনী জীবন পদ্ধতি;
খ. প্রথা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য;
গ. নিজস্ব সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান;
ঘ. অন্যরা প্রবেশের আগে কোনো বিশেষ অঞ্চলে বসতি স্থাপনের নজির।
এ ব্যাখ্যার আলোকে কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ বৈশিষ্ট্যগুলো নেই ? তারা কি পাহাড়ে প্রথম বসতি গড়েনি ? কী করে অগ্রাহ্য করা হবে উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল-মুণ্ডাদের কথা। যখন বিভিন্ন জনস্রোত একত্র হয়ে ভাষার পরিচয়ে বাঙালি হয়ে ওঠেনি, ইতিহাস তখনও মুণ্ডা-সাঁওতালদের উপস্থিতির কথা বলে।
দেশকে বহিরাগতদের আগ্রাসন থেকে মুক্ত রাখতে আদিবাসীদের অবদান কি খাটো করে দেখার মত ? মোগলসহ নানা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চাকমারা লড়েছে, ইংরেজদের সঙ্গে সাহসী লড়াই করেছে মুণ্ডা-সাঁওতাল-গারোরা। সর্বশেষ বাঙালি-আদিবাসী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, মানুষে মানুষে সৃষ্ট বৈষম্যের অবসানের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীনতার ফসল। সেই স্বাধীন দেশের সংখ্যালঘু জাতি ও ধর্মের মানুষ কেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে ?
সংখ্যালঘু জাতিসত্তার পরিচয় অস্বীকার করে নয়, বরং দেশের সামগ্রিক কল্যাণ ও উন্নয়নে নাগরিক হিসেবে সব জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদা এবং সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজ জরুরি। ১৯৭২ সালে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার জাতিসত্তার স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে যে ভুল হয়েছিল, পঞ্চদশ সংশোধনীতে 'আদিবাসী' শব্দটি সংযোজন করে সেই ভুল শোধরানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু তা না করে সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে 'উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়' সম্বোধন করে মহাজোট প্রকারান্তরে পুরনো ভুলটিই টিকিয়ে রেখেছে, যা আদিবাসীদের দুঃখ-কষ্ট কমায়নি, বরং বাড়িয়ে দিয়েছে। সব মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করতে '৭২-এর সংবিধানে সেক্যুলারিজমকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সেক্যুলার মানে কেবল ধর্মনিরপেক্ষ নয়, একে হতে হবে ধর্ম, জাতি ও লিঙ্গনিরপেক্ষ। দেশে সব জাতির, সব ধর্মের, নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সমমর্যাদার নাগরিক হবে। আর যারা পিছিয়ে আছে তাদের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার হাত। উন্নয়নের ধারায় তাদের যুক্ত করতে নেওয়া দরকার পর্যাপ্ত পদক্ষেপ। তাই অধিকার কেড়ে নয়, অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে, সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে পাহাড় ও সমতলের আদিবাসীদের কাছে টানতে হবে, মূলধারায় স্থান করে দিতে হবে।
কোনো আদিবাসী আজ পর্যন্ত জাতির পিতাকে অসম্মান করেনি। এ থেকে বোঝা যায় আদিবাসীদের আস্থা বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ওপর আছে। কিন্তু এ আস্থা আর কত দিন থাকবে ? সরকারপক্ষ বা প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানাব আদিবাসীদের এ আস্থাকে সম্মান দেখাতে। এতে পারস্পরিক সম্প্রীতি বাড়বে। 'পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির বিষয়ে সরকার শুধু বিভিন্ন বিভাগ হস্তান্তরের কথা বলে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যায়। কিন্তু সেখানকার ভূমি কমিশনকে কার্যকর করতে পারলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে আশা রাখি।'
©somewhere in net ltd.