নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি অসম পাহাড়ে সরলভাবে বেড়ে উঠা ছেলে। সরলতায় যেমন আমার ভালবাসা তেমনি আমার পাহাড়ের অধিকারেও আমি ক্ষিপ্র।

জয় মারমা

আমি অসম পাহাড়ে সরলভাবে বেড়ে উঠা ছেলে।

জয় মারমা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভূমি কমিশনঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি সংগঠনের নামে সাম্প্রদায়িক উস্কানি

০৮ ই অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৯


গত ০৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন(সংশোধিত) বিলটি ২০১৬ পাশ হয়। অপরদিকে একই দিন খাগড়াছড়ি আলুটিলা বিশেষ পর্যটন জোন প্রকল্প বাতিলের সিদ্ধান্তের কথা জানান পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। আর এই দুই ইস্যুতে পাহাড়ে প্রতিবাদের নামে পার্বত্য পরিস্থিতি উত্তাল করতে সংগঠনের আগে বাঙালি নাম ব্যবহার করে মিছিল করছে সমতল হতে পুনর্বাসিত সেটেলাররা। এখন কথা হচ্ছে এই বাঙালি গণপরিষদ, বাঙালি ছাত্র পরিষদ এরা কারা ? এবং এই বাঙালী নাম ব্যবহৃত সংগঠনের ব্যানারে পার্বত্য এলাকার সকল বাঙালিদের সামগ্রিক অংশগ্রহণ আছে কিনা ?

আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, গত ১০ জানুয়ারি রাঙ্গামাটিতে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম স্থগিতের দাবিতে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ডাকা সড়ক ও নৌপথ অবরোধের কর্মসূচীতে এই বাঙালি সংগঠনগুলোর সাথে দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাঙ্গামাটির কোর্ট বিল্ডিং, বনরুপা বাজার, দোয়েল চত্বরসহ পুরো রাঙ্গামাটিতে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া রক্তপাতের মত ঘটনা ঘটে। সেসময় এই বাঙালি সংগঠনের ব্যানারের কর্মীরা অধিক সংখ্যক চাকমা বসতি এলাকা আসামবস্তিতে হামলার উদ্দেশ্যে প্রবেশ করতে গেলে স্থানীয় বাঙালিদের প্রতিরোধের মুখে ফিরে যায়। তারও কিছুদিন পর রাঙ্গামাটি কলেজে সামান্য তর্কাতর্কীকে ইস্যু করে এই বাঙালি সংগঠনের ব্যানারের কর্মীরা কলেজ গেইটে কয়েকটি চাকমা দোকানকে ভাংচুরের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উস্কানি ছড়ায়। কিন্তু সেদিনও সেখানকার স্থানীয় বাঙালি দোকানদারদের প্রতিরোধে পরিস্থিতি শান্ত হয়। তাহলে আপনারা একটু বিবেচনা করুন, এই যে বাঙালি নাম ব্যবহারকারী সংগঠনগুলোকে স্থানীয় বাঙালিরা কেন বারবার প্রতিরোধ করছে ? যেহেতু পার্বত্য প্রত্যেক সহিংস ঘটনার কারন ভূমি বিরোধ, ধর্ষণ এবং পাহাড়ি ও বাঙালি কেন্দ্রিক তাহলে স্থানীয় বাঙালিরা কেন সেই বাঙালি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম প্রতিরোধ করে তাদের বিরোধিতা করছে। যেখানে জাতিয়ত্ব সহিংসতা বা সংঘাত হচ্ছে সেখানে তো স্থানীয় বাঙালিদের সেইসব বাঙালি নাম ব্যবহৃত সংগঠনগুলোর পক্ষে অবস্থান করার কথা, কিন্তু তা না করে সেই স্থানীয় বাঙালিরা কেন পাহাড়িদের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে ? এর কারন স্থানীয় বাঙালিরা খুব ভালো করে জানেন এই বাঙালি নাম ব্যবহৃত সংগঠনগুলো আসলে কোন বাঙালি জাতিয়ত্ব সংগঠন না, এরা হচ্ছে সামরিক শাসক এরশাদ ও জিয়ার সরকারের সমতল হতে পাহাড়ে উৎক্ষেপিত বহিরাগত বাঙালি। পারভাঙ্গাবাসির নাম দিয়ে যাদের রেশন সুবিধা, জায়গা-জমি, বাসস্থানের লোভ দেখিয়ে সমতল হতে পাহাড়ে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। যাদের কে অভিধানিক শব্দে সেটেলার বলা হয়। এখন এই সেটেলার অধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সরকারি অধিক সুযোগ-সুবিধা নিতে ও প্রশাসনিক সুবিধা নিয়ে এজেন্ডারি বাস্তবায়নে এই সংগঠনগুলো গড়ে তোলা হয়েছে। সংগঠনের আগে বাঙালি নাম ব্যবহার করা হয়েছে শুধুমাত্র জাতিগত সহানুভূতি ও সুবিধা নেয়ার জন্যই। সমতল হতে পাহাড়ে পুনর্বাসিত এই সেটেলাররা যে খাস জায়গা দখলের নামে শুধুমাত্র পাহাড়িদের জায়গা জমি দখল করছে তা কিন্তু না, এখানে বসবাসকারী পাহাড়ি ছাড়াও স্থানীয় বাঙালিদের ভূমি দখল করে বসতি স্থাপন করছে। যার প্রেক্ষিতে স্থানীয় বাঙালিরাও এদের বিরোধী অবস্থান নেয়।

এবার মূল বিষয়ে আসি, "পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন (সংশোধনী) ২০১৬" পাশ করা নিয়ে পাহাড়ে এই বাঙালি সংগঠনগুলো কেন এত উদ্বিগ্ন এবং কেন বিরোধিতা করছে ? তাহলে সংশোধনী আইনের কিছু বিষয় তাহলে দেখা যাক-

ভূমি নিয়ে এ চুক্তির 'গ' অনুচ্ছেদের ১৪(৪) এ বলা হয়েছে- "জায়গা-জমি বিষয়ক বিরোধ নিষ্পত্তিকল্পে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিশন(ল্যান্ড কমিশন) গঠিত হইবে। পুনর্বাসিত শরণার্থীদের জমি-জমা বিষয়ক বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তি করা ছাড়াও এ যাবৎ যেইসব জায়গা-জমি ও পাহাড় অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল হইয়াছে সেই সমস্ত জমি ও পাহাড়ের মালিকানা স্বত্ব বাতিলকরণের পূর্ণ ক্ষমতা এই কমিশনের থাকিবে। এই কমিশনের রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল চলিবে না এবং এই কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া বিবেচিত হইবে"। ফ্রীঞ্জল্যান্ড(পানিতে ভাসা জমি)- এর ক্ষেত্রে ইহা প্রযোজ্য হইবে।

এই কমিশন নিম্নোক্ত সদস্যদের লইয়া গঠন করা হইবে:
ক) অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি;
খ) সার্কেল চীফ (সংশ্লিষ্ট);
গ) আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান/প্রতিনিধি;
ঘ) বিভাগীয় কমিশনার/অতিরিক্ত কমিশনার;
ঙ) জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান (সংশ্লিষ্ট)

অর্থাৎ এই আইন কার্যকর হলে কমিশন চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে আর গণ্য হবেনা। উল্লেখিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সিদ্ধান্তই এখন কমিশনের সিদ্ধান্ত বলে গণ্য হবে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে কয়েক দশকের সংঘাতের অবসান ঘটে। সেই চুক্তি অনুযায়ী পাহাড়ের ভূমির অধিকার নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে এই কমিশন গঠন করা হয়। তৎসময়ে কমিশন চেয়ারম্যানের একান্ত সিদ্ধান্তেই চুরান্ত হিসেবে গণ্য হত এবং এবং তাদের এই অবৈধ দখলে কমিশনের চেয়ারম্যানের কোন হস্তক্ষেপ ছিলনা বলে এই পুনর্বাসিত সেটেলাররা কমিশনের প্রতিও অনুগত ছিল। কিন্তু সংশোধনী আইনের মাধ্যমে যখন আঞ্চলিক পরিষদসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মাধ্যমে ভূমি কমিশনের সিদ্ধান্তকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তখনি তাদের এই বিরোধিতা শুরু হয়ে যায়। কারন এই পুনর্বাসিত সেটেলাররা এখন খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছে পাহাড়ে তাদের এতদিন অবৈধভাবে বন্দোবস্ত ও বেদখল করা পাহাড়িদের জায়গা জমি মালিকানা স্বত্ব বাতিল হয়ে যাবে। ভূমি-সংক্রান্ত বিরোধের সঙ্গে অবৈধ বন্দোবস্ত ও বেদখল হওয়া ভূমি এবং পানিতে ভাসা ভূমিসহ যে কোন ভূমিকে সন্নিবেশিত করায় পুনর্বাসিত সেটেলারদের অবৈধভাবে বন্দোবস্ত নেওয়া জমির বৈধতা নিয়েও প্রশ্নের সম্মুখীন। এখন আপনি যদি অন্যায়ভাবে বা জোরপূর্বক যদি কারো জায়গা-জমি দখল না করে থাকেন তাহলে তো এই কমিশনের বিরোধিতা করা বা এই সংশোধনী আইন নিয়ে ভয় পাওয়ার কথা না। সমতল হতে পুনর্বাসিত এই সেটেলাররা পাহাড়ে অন্যায় ও অবৈধ দখল করেছে বলেই আজকে তারা এই সংশোধনী নিয়ে এত আতংক এবং বাঙালি নাম ব্যবহৃত সংগঠনের ব্যানারে পাহাড়ে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করতেই বাঙালি উচ্ছেদের ইস্যু তুলে মিছিল মিটিং এর নামে সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়াচ্ছে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলটি ১৫৫০ সালের দিকে প্রণীত বাংলার প্রথম মানচিত্রেও বিদ্যমান ছিল। তবে এর প্রায় ৬০০ বছর আগে ৯৫৩ সালে আরাকানের রাজা এই অঞ্চল অধিকার করেন। ১২৪০ সালের দিকে ত্রিপুরার রাজা এই এলাকা দখল করেন। ১৫৭৫ সালে আরাকানের রাজা এই এলাকা পুনর্দখল করেন, এবং ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত অধিকারে রাখেন। মুঘল সাম্রাজ্য ১৬৬৬ হতে ১৭৬০ সাল পর্যন্ত এলাকাটি সুবা বাংলার অধীনে শাসন করে। ১৭৬০ সালে ব্রিটিস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই এলাকা নিজেদের আয়ত্তে আনে। ১৮৬০ সালে এটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসাবে যুক্ত হয়। ব্রিটিশরা এই এলাকার নাম দেয় চিটাগাং হিল ট্র্যাক্ট্‌স বা পার্বত্য চট্টগ্রাম। এটি চট্টগ্রাম জেলার অংশ হিসাবে বাংলা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল। ১৯৪৭ সালে এই এলাকা পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি বাংলাদেশের জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৮০ এর দশকের শুরুতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তিনটি জেলা- রাঙামাটি, বান্দরবান, ও খাগড়াছড়িতে বিভক্ত করা হয়।

১৯৪৭ সালে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল শতকরা ৯৭ ভাগ(%), ৬১ সালে তা কমে ৮৫ ভাগে(%) দাঁড়ায় এবং সর্বশেষ ১৯৯১ সালের আদমশুমারিতে ছিল ৫০ ভাগ(%)। আর ১৯৯৭-এ শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনসংখ্যা হয়ে যায় শতকরা ৪৮ ভাগ আর বাঙালি শতকরা ৫২ ভাগ। এই সমীকরণ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় সমতল হতে কি পরিমাণ বাঙালিদের পাহাড়ে পুনর্বাসিত করা হয়েছে এবং স্বেচ্ছায় স্থানান্তরের মাধ্যমে পুনর্বাসন সুবিধা নিয়েছে। তাই সচেতন নাগরিক সমাজ ও মহলের কাছে প্রত্যাশা থাকবে পার্বত্য এলাকায় সেইসব বাঙালি গণপরিষদ বা বাঙালি ছাত্র পরিষদের নামে যারা সাম্প্রদায়িকতা ছড়াচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান গ্রহণের জন্য। এবং ১৯৯৭ এর পূর্ববর্তী যে রক্তক্ষয়ী পরিস্থিতি ছিল তার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.