নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শুভ সরকারের বাংলা ব্লগ ...

শুভ-অশুভ

জানা ভালো, না জানা খারাপ, ভুল জানা অপরাধ

শুভ-অশুভ › বিস্তারিত পোস্টঃ

তপুর ঘুড়ি

০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ সকাল ১১:৩০

আমি তপু। না না, জাফর ইকবাল স্যারের বইয়ের অঙ্কপাগল তপু না। তবে, বইটি আমি পড়েছি। দারুন বই। কতবার যে পড়েছি, বলে শেষ করা যাবেনা। জাফর ইকবাল স্যারের সবকয়টা বই আমার পড়া, মুখস্থও বলা যায়। যখনই খারাপ লাগে, স্যারের বই পড়ি, মন ভালো হয়ে যায়।

বিকেলবেলা মনখারাপ হলে আমি আমাদের বাসার ব্যালকনিতেও এসে বসে থাকি। কী সুন্দর ফুরফুরে হাওয়া এসে শরীরটাকে ঠান্ডা করে দিয়ে যায়। আমার বাসার ব্যালকনি থেকে দূরের অনেক বাসার ছাদ দেখা যায়। সারা সকাল, দুপুর ছাদগুলো খাঁ খাঁ করে, কোনো জনমানুষ থাকেনা। বিকেলে রোদের তেজ কমে এলেই কী সুন্দর পিলপিল করে মানুষ এসে জড়ো হয় ছাদগুলোতে। বাচ্চারা ছাদে খেলে, মাঠের অভাব ছাদেই পূরণ করার ব্যর্থ চেষ্টা আর কী। অনেকেই দেখি ঘুড়ি ওড়ায়, নীল-সাদা আকাশে নানা রং এর ঘুড়িগুলো কী সুন্দর ওড়ে, দেখলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। মাঝে মাঝে ঘুড়ি-লড়াই হয়, পরাজিত ঘুড়ি আকাশ থেকে বিতাড়িত হয়ে হারিয়ে যায় বিশাল বিশাল বিল্ডিংগুলোর আড়ালে। মানুষের জীবনও তো ওরকম। পরাজিত হলেই বিতাড়িত হতে হয় উচ্চস্থাণ থেকে।

বর্ষাকালে ব্যালকনিতে বসে থাকার মজাই আলাদা। কী সুন্দর টুপটুপ করে বৃষ্টি এসে গায়ে পড়ে, তখন খুব ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু, ব্যালকনি থেকে আর কতটুকুই বা ভেজা যায়। তবুও, যতটুকু ভিজতে পারি, ওতেই আমার আনন্দ।

আমার খুব শখ একবার বইমেলায় যাবো। আমি সারাদিনই বই পড়ি, বই পড়তে আমার অসম্ভব ভালো লাগে। বাবা আমার জন্য প্রতিসপ্তাহেই নতুন নতুন বই কিনে নিয়ে আসে।
এত এত বই পড়ি, কিন্তু এখনো বইমেলায় যাওয়া হলোনা। বাবা, মা আমাকে নিয়ে যেতে চায়, আমিই যাই না। একটু ঘরকুনো স্বভাবও আছে আমার, তাই ঘরের কোণে থাকতেই ভালো লাগে।

আমার একটা ছোট্ট পেটডগ আছে, নাম কুট্টু মিয়া। অসংখ্য সাদা লোমে আর বড় বড় চোখের কারণে কুট্টু মিয়াকে একটা তুলতুলে পুতুলের মত দেখায়। এই কুট্টু মিয়া আমাকে ছাড়া কিছু বোঝেনা, সারাক্ষণ আমার চারপাশে ঘুরঘুর করে। আমি ব্যালকনিতে বসে থাকলে, কুট্টু মিয়াও আমার পাশে বসে থাকে। মাঝে মাঝে কুট্টু মিয়ার সাথে নানা বিষয়ে আলোচনাও করি, কুট্টু মিয়া আমার সব কথাতেই আমাকে সমর্থন দেয় তুলতুলে লেজ আর ঝোলানো কান নাড়িয়ে। মাঝে মাঝে আনন্দের আতিশয্যে পা চেটে দেয়, হাত চেটে দেয়। আমার ভালোই লাগে কুট্টু মিয়ার এই আদিখ্যেতা।

পাশের ফ্ল্যাটের একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে প্রায়ই আসে আমার কাছে। যখনই নতুন কোনো খেলনা কেনে, আমাকে দেখাতে নিয়ে আসে। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের নার্সারীতে পড়ে, কিন্তু ভাবভঙ্গি খুবই গম্ভীর। চোখে ইয়া বড় ফ্রেমের একটা চশমা থাকায় বাচ্চাটাকে দেখতেও সুন্দর লাগে। আমাদের বাসায় এসেই বলবে, "তপু ভাইয়া, তোমার রিমোট কন্ট্রোল এয়ারক্রাফট আছে? আমার কিন্তু আছে।" এই বলেই সে রিমোটচালিত যন্ত্রের কার্যপ্রণালী আমাকে দেখাবে। আমাকেও চোখ বড় বড় করে সবকিছু দেখতে হবে আর সবশেষে হাততালি দিতে হবে। আমি হাততালি দিলেই বাচ্চাটা মনে করে যে, ওর খেলনাটা সত্যিই ভালো। যেন, আমার হাততালিই ওর খেলনাটা ভালো কী না তা নির্ধারণ করার মাপকাঠি।

মাঝে মাঝে বাচ্চাটা আসে আমার কাছ থেকে কমিকসের বই নিতে। চাচা চৌধুরী আর বিল্লুর কমিকস ওর খুবই পছন্দ। আর আমার কাছেও সেগুলোর বড় সংগ্রহ আছে। তাই ওরও হয়েছে পোয়াবারো, মাঝেমাঝেই একটি-দুটি কমিকসের বই নিয়ে চলে যায়। মনে থাকলে ফেরত দেয়, না থাকলে দেয়না। আমিও কিছু বলিনা। থাক না, বাচ্চা মানুষ। দিলে দেবে, না দিলে দরকার নেই। আমার কোনো ভাই-বোন নেই, তাই ওকেই আমার ছোটভাই মনে হয়। এজন্য কিছু বলতেও পারিনা।
মাঝে মাঝে পেছন থেকে এসে হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে বাচ্চাটা জিজ্ঞেস করে, "বলো তো, আমি কে?" আমি ছোট ছোট হাত ধরেই বুঝতে পারি, এটা ও। কিন্তু বলিনা, বললে পিচ্চিটার মনখারাপ হয়। আমি তখন অভিনয় করে বলি, চিনতে পারছিনা। আপনি কে? ছোট খালা?
তখন, পিচ্চিটা খিলখিল করে হাসে আর বলে, "পারেনি, পারেনি, আমাকে চিনতে পারেনি।" আমিও তখন ওর সাথে হাসি আর চিনতে পারিনি এজন্য লজ্জালজ্জা ভাব করি। আমাকে পরাজিত করেই বাচ্চাটার আনন্দ। এই আনন্দ নষ্ট করা কী আমার পক্ষে সম্ভব?

আমার শরীর খারাপ হলেই বাচ্চাটা কিটক্যাট আর চিপস নিয়ে আমার বাসায় চলে আসে। এসে আমার বিছানায় আমার পাশে বসে থাকে আর মাঝে মাঝে কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপে। ওর কাছে শরীর খারাপ মানেই জ্বর হওয়া। অন্যকিছুতেও যে শরীর খারাপ হতে পারে, এটা ওর মাথায় এখনো আসেনি। আমিও ওর পাগলামী মেনে নিই। আমার বিছানার একপাশে কুট্টু মিয়া বসে থাকে, আর আরেকপাশে তুতুন। হ্যাঁ, বাচ্চাটার নাম তুতুন। দুজনেই দুরন্ত, কিন্তু আমার শরীর খারাপ হলেই এরা স্থির হয়ে যায়। আমি আবার সুস্থ হলেই, এদের দুরন্তপনা শুরু হয়...

এটুকু লেখার পরেই ডায়েরীটা বন্ধ করলো তপু। আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। মনখারাপ লাগছে। তপুর বাবা নতুন এই ডায়েরীটা আজই কিনে এনেছে তপুর জন্য।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আকাশে এখনো লাল টুকটুকে একটা ঘুড়ি মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে। তপুরও খুব শখ ঘুড়ি ওড়াবে। কিন্তু, তপুর অজস্র শখের ভীড়ে এই শখ তার বাবা-মা পূরণ করতে পারবেনা।
হুইলচেয়ারে বসা তপুর পা দুটি তপুর ভার আর বহন করতে পারেনা। ডাক্তারের ছুরিকাঁচির নির্ভুল সংযোগে তপুর পা দুটি বেশ কিছুকাল ধরেই তপুর শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন।

সন্ধ্যার আকাশে লাল টুকটুকে ঘুড়িটা আবছা হয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে তপুর গাল বেয়ে নেমে আসা জলধারাও। দু'ফোটা পানি বোধহয় ডায়েরীতেও পড়লো।

ঘুড়িটা আবছা হচ্ছে...হারিয়ে যাচ্ছে...

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.