![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
জোরে জোরে হাঁটছেন মতিন সাহেব। তাকে তাড়াতাড়ি বাসস্টপে পৌঁছাতে হবে, তা না হলে বাস মিস হয়ে যাবে, অফিসে ঢুকতেও দেরী হয়ে যাবে। এমনিতেই গত দুইদিন লেট করে অফিসে ঢোকার জন্য বসের ঝাড়ি খেতে হয়েছে। বসের মেজাজ বেশ তিরিক্ষি। অফিসে লেট করে আসা তিনি একদমই পছন্দ করেন না।
মতিন সাহেবেরই বা কী দোষ? সকাল থেকে তো আর তার কাজের অন্ত নেই। তার স্ত্রী রোজী মারা যাওয়ার পর সংসারের সব দায়িত্বই তো তার কাঁধে এসে পড়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চাদের জন্য নাশতা বানাতে হয়। মতিন সাহেবের দুই ছেলে। একজন পড়ে ক্লাস ওয়ানে, আরেকজন ক্লাস থ্রীতে। নাশতা বানানোর পর ওদেরকে ঘুম থেকে তুলে, হাত-মুখ ধুইয়ে, নাস্তা খাইয়ে, ইউনিফর্ম পরিয়ে, স্কুলব্যাগ গুছিয়ে, স্কুলের বাসে তুলে দিতে হয়। বাস আসে ৮টায়। এই ৮টার মধ্যেই পুরো কর্মযজ্ঞ চালাতে হয় তাকে।
তারপরে মতিন সাহেব নিজের জন্য দুটো চাল-ডাল ফুটিয়ে, আলুসেদ্ধ করে নেন। দুপুরের খাবার হিসেবে টিফিন ক্যারিয়ারে ভাত-ডাল ভরে তিনিও অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন।
তার অফিস ১০ টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা, বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হয় ১ টায়। বাচ্চাদের কাছে বাসার চাবি থাকে, বাস এসে বাসার গেটে ওদের নামিয়ে দেওয়ার পর ওরা বাসায় এসে বাবার রান্না করা ভাত-ডাল খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
৬টায় অফিস ছুটি হওয়ার পর মতিন সাহেবের বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ৭টা-৭.৩০ হয়ে যায়। বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়েই তিনি চুলায় রান্না চাপিয়ে দেন। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে বাচ্চাদের লেখাপড়াও তদারকি করেন তিনি। রান্না হয়ে গেলে বাচ্চাদের খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেন মতিন সাহেব। তারপর খেয়েদেয়ে, ঘর ঝাড়পোঁছ করে নিজেও শুতে যান।
এভাবেই প্রতিটি দিন কেটে যায় মহাকালের নিয়মে। মাঝে মাঝে যে ব্যতিক্রম হয় না, তা নয়। প্রতি ছুটির দিনেই বাচ্চাদের নিয়ে তিনি বাইরে বেরিয়ে পড়েন। যাদুঘর, শিশুপার্ক, চিড়িয়াখানায় বাচ্চাদের ঘুরতে নিয়ে যান। সারাদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে সন্ধ্যায় ছেলেদের নিয়ে ঘরে ফেরেন মতিন সাহেব। বাচ্চারাও তাই এই ছুটির দিনের জন্য সারা সপ্তাহ হাপিত্যেশ করে বসে থাকে, এই দিনের জন্য অপেক্ষা করে সারা সপ্তাহ।
মতিন সাহেবের মাসিক বেতন খুব একটা বেশি না, ১০০০০ টাকা। এ টাকায় ঢাকার মত জায়গায় খেয়েপরে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টের একটা কাজ। প্রতিমাসের শেষে এসেই টাকার সংকটে পড়তে হয় তাকে। বাসাভাড়া, বাজার করা, বাচ্চাদের স্কুলের ফি এগুলো মেটাতে মেটাতেই হাতের টাকা উধাও হয়ে যায়। তার পৈত্রিকসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি বলতে গ্রামে এক চিলতে জমি আর ছোট্ট একটা বাড়ি, আজকের দিনে ওটুকু সম্পত্তিতে কিছুই হয়না।
আজকে মতিন সাহেবের ছোট ছেলে দীপুর জন্মদিন। বড় ছেলে অপু বাবার আর্থিক অবস্থা কিছুটা হলেও বুঝতে পারে, তাই কখনোই কোনো আবদার করেনা। কিন্তু, ক্লাস ওয়ানে পড়ুয়া ছোটছেলে দীপুর বাবার আর্থিক সামর্থ্য বোঝার ক্ষমতা এখনো হয়নি। সে বাবার কাছে আবদার করেছে আজ তার জন্য বেকার'স এর কেক কিনে আনতে হবে। স্কুলের বন্ধুরা নাকি তাকে বলেছে, বেকার'স এর কেক খুব ভালো। তাই তার এটা লাগবেই।
দীপুর জন্মদিন জুলাইয়ের ২৭ তারিখ, মাসের শেষদিকে। হাতে টাকাপয়সা নেই অথচ ছোট ছেলেও আবদার করেছে। মতিন সাহেব পড়েছেন উভয়সংকটে। বেকার'স এর কেকের দাম কত তাও তো তিনি জানেন না। এই কেকের নামই শুনলেন প্রথম। যাই হোক, বেকার'স এর কেক আনবেন বলে তিনি ছোট ছেলেকে আশ্বস্ত করলেন। জন্মদিন উপলক্ষ্যে তার কোনো ছেলেই আজ স্কুলে যায়নি, বাসাতেই আছে। মতিন সাহেবও ছুটির আবেদন করেছিলেন, যাতে সারাদিন বাচ্চাদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে পারেন, কিন্তু ছুটি পাননি। আবার বসের ঝাড়ি শুনতে হয়েছে।
অফিসে ঢুকলেন মতিন সাহেব। কোনো কলিগের কাছ থেকে টাকা ধার করতে হবে। নিজের পকেট তো গড়ের মাঠ, অথচ দীপুর জন্য কেকও কিনতে হবে, তাই ধার করা ছাড়া উপায় কী? কলিগ বশির সাহেবের কাছ থেকে ৫০০ টাকা আর রফিক সাহেবের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করলেন মতিন সাহেব। অফিস শেষে বেরিয়ে পড়লেন বেকার'স এর কেকের দোকানের সন্ধানে। কেক কিনলেনও দুই পাউন্ডের একটা। চকলেটের উপরে সাদা ক্রিমে লেখা হলো "Happy Birthday To You Deepu". তারপর সাদা বক্সে লাল ফিতা দিয়ে প্যাকেট করা হলো কেক। জিনিস ভালো বলেই দামটা একটু বেশি, এই বলে নিজেকে বোঝালেন মতিন সাহেব। তারপর বাসার দিকে রওয়ানা হলেন। দুই ছেলে তার অপেক্ষাতেই বসে আছে। বাসায় গেলেই কেক কাটা হবে, জন্মদিন পালন হবে।
বাসে প্রচন্ড ভীড়, সবাই ফিরছে নীড়ের টানে। বাসভর্তি মানুষ, একটু পা রাখারও জায়গা নেই। কোনোমতে পাদানিতে এক পা দিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসের হ্যান্ডেলে এক হাত রেখে আরেকহাতে কেকের প্যাকেট আগলে বাসে উঠলেন মতিন সাহেব। সচরাচর, বাসে এরকম ভীড় থাকলে সে বাসে তিনি ওঠেন না। কিন্তু, আজকে তাড়া আছে, রাত হয়ে যাচ্ছে, বাচ্চাদুটি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, তাই বাধ্য হয়েই এই জনাকীর্ণ বাসে উঠেছেন তিনি।
বাস যাচ্ছে গন্তব্যের পানে। মতিন সাহেব নামবেন জিগাতলায়। তিনি সেখানেই থাকেন। শাহবাগে এসে অনেকেই নেমে গেছে বাস থেকে। পেছনের দিকে একটা সীটও পেয়েছেন মতিন সাহেব। এতক্ষণের অমানুষিক কষ্টে হাতদুটো টনটন করছে। সীট পেয়ে তিনি যেন স্বর্গ হাতে পেলেন। সীটে বসার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। সারাদিন অফিসের ধকল, তারপর বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝোলাঝুলি করায় মতিন সাহেব বেশ পরিশ্রান্ত হয়ে গেছেন।তাই, সীটে বসেই তার একটু তন্দ্রাভাব হলো।
আচমকা ঝাঁকুনিতে তার তন্দ্রাভাব কেটে গেলো। ড্রাইভার আচমকা হার্ডব্রেক করেছে। হঠাৎ করে মতিন সাহেব খেয়াল করলেন, তার হাতে কেকের প্যাকেটটা নেই। উদভ্রান্তের মত তিনি এদিকওদিক খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, তিনি যে সীটে বসেছেন, সেই সীট থেকে তিন সীট সামনে তার কেকের বাক্স পড়ে আছে দোমড়ানো মোচড়ানো অবস্থায়। ড্রাইভার যখন হঠাৎ বাসে হার্ডব্রেক করে, তখনই মতিন সাহেবের হাত থেকে কেকের বাক্সটা ছিটকে বাসের ধাতব সীটে সজোরে আছড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়।
মতিন সাহেব ফ্যালফ্যাল করে কেকের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাক্স ছিঁড়ে ভেতরের চকলেট আর ক্রিম বাসের ধুলোবালিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সাদা বাক্সটার মধ্যে ছোট ছেলে দীপুর হাসিমাখা মুখ দেখলেন যেন মতিন সাহেব, সে মুখে বাবার জন্য অধীর অপেক্ষা। বাবা কেক নিয়ে আসবে, তারপর কেক কাটা হবে। মতিন সাহেবের পকেটে এখন আছে মাত্র ৫৭ টাকা। এই টাকা দিয়ে কী বেকার'স এর কেক পাওয়া যাবে? মতিন সাহেবের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।
হঠাৎ করে বাস থামিয়ে গন্তব্যের আগেই নেমে পড়লেন মতিন সাহেব।বাসায় ফেরার তাড়াটা হঠাৎ করেই ফুরিয়ে গিয়েছে। আজ আকাশে গোল থালার মত চাঁদ উঠেছে। বাইরে ফুরফুরে হাওয়াও দিচ্ছে।
ল্যাম্পপোস্ট এর নীচে বসা মতিন সাহেবের চোখের পানি কেউ দেখতে পাচ্ছেনা... ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোর কারসাজিতে সবকিছু অতিপ্রাকৃত মনে হচ্ছে।
আকাশে বড় চাঁদ উঠেছে... বেকার'স এর কেকটা ঐ চাঁদের মতই গোল ছিলো। ভেতরে লেখা ছিলো "Happy Birthday To You Deepu".
©somewhere in net ltd.