নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

এপিটাফ \n\nএক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস...খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে...কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়।আমার অদক্ষ কলমে...যদি পারো ভালোবেসো তাকে...ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে,যে অকারণে লিখেছিল মানবশ্রাবণের ধারা....অঝোর

জুল ভার্ন

এপিটাফ এক নিঃশব্দ প্রচ্ছদে ঢাকা আছে আমার জীবনের উপন্যাস... খুঁজে নিও আমার অবর্তমানে... কোনো এক বর্তমানের মায়াবী রূপকথায়। আমার অদক্ষ কলমে... যদি পারো ভালোবেসো তাকে... ভালোবেসো সেই অদক্ষ প্রচেষ্টা কে, যে অকারণে লিখেছিল মানব শ্রাবণের ধারা.... অঝোর শ্রাবণে।।

জুল ভার্ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদের ঐতিহাসিক প্রেম....

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:২৬

মৈত্রেয়ী দেবী ও মির্চা এলিয়াদের ঐতিহাসিক প্রেম....

ইতিহাস আর সাহিত্যে অসমাপ্ত প্রেমের গল্প বরাবরই মানুষের মনে সবচেয়ে বেশি দাগ কেটেছে। আর ব্যর্থ প্রেমের বিরহ কাতরতায় দুটো হৃদয়ের ব্যাকুলতা মানু্ষের অন্তরকে সবসময় ছুঁয়ে যায়। এমনই এক ঐতিহাসিক অসম্পূর্ণ প্রেমের উপাখ্যানের সাক্ষী হয়েছিল সত্তরের দশকের বাঙালিরা। এই প্রেমের শুরুটা কলকাতাকেন্দ্রিক হলেও পুরো ঘটনা ও এর রেশ ছড়িয়ে ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে।

বাঙ্গালী কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক মৈত্ৰেয়ী দেবী ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর বরিশালের বিখ্যাত দাসগুপ্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন দার্শনিক, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত আর মা হিমানী মাধুরী রায়। মৈত্রেয়ী দেবীর শৈশব কাটে বাবার বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলাধীন মনসামঙ্গলের কবি বিজয়গুপ্তের স্মৃতিধন্য মানসী ফুল্লশ্রী গ্রামে। তবে পিতার কর্মক্ষেত্রের সুবাদে তিনি কৈশোরেই সপরিবারে কলকাতার ভবানীপুরে বসবাস শুরু করেন। সেই সঙ্গে ক্রমেই তিনি তৎকালীন কলকাতার ‘এলিট’ সম্প্রদায়ের সাহচর্য এবং স্নেহধন্যা হতে থাকেন।

তৎকালীন বাংলার অন্যতম শিক্ষাবিদ, গবেষক ও দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টরেট। তাঁর ভবানীপুরের বিখ্যাত বাড়িতে রোজ আনাগোনা হতো পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে শিক্ষিত ও প্রগতিশীল বলয়ের তৎকালীন বিখ্যাত সব লেখক-লেখিকা, সম্পাদক, এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও। অবিভক্ত পূর্ব বাংলার রাজশাহী কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজসহ পরবর্তীকালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি।

সুরেন্দ্রনাথের তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় মৈত্রেয়ী দেবী ছিল তার সবচেয়ে কাছের। মৈত্রেয়ী ছিলেন ভীষণ সুন্দরী - তার বড় বড় কাজল-আঁকা চোখ, ছিপছিপে বাঙালি আদলে গড়া মাটির মূর্তির মতো চেহারা অনেককেই মুগ্ধ করতো। একইসাথে বয়সের তুলনায় তার বুদ্ধি, স্বভাব, গাম্ভীর্য ও বিদ্যানুরাগ তাকে তার সমসাময়িক কিশোরীদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল।

রবীন্দ্রনাথকে সে গুরু বলে শ্রদ্ধা করতো, ভালোবাসতো। কবিগুরুও অল্পবয়েসী সেই ভক্তটিকে অগাধ স্নেহ করতেন। এভাবেই এক অসাধারণ পরিবেশে বিদ্বান বাবা, স্নেহময়ী মা, ভাইবোন, লেখাপড়া, সংস্কৃতিচর্চা ও তার হৃদয়ের খুব কাছের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন মৈত্রেয়ী।

১৯২৮ খ্রি: ২১ বছর বয়েসী রোমানিয়ান শ্বেতাঙ্গ যুবক মির্চা এলিয়াদ, সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের অধীনে ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে গবেষণা করার উদ্দেশে কলকাতায় আসে। পেয়িং গেস্ট হিসেবে অধ্যাপক দাশগুপ্তের ভবানীপুরের বাড়িতেই একটি কক্ষ নিয়ে থাকার ব্যবস্থা হয় মির্চার।

ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্ত মির্চা কলকাতায় এসে ভারতবর্ষ ও বিশেষ করে বাংলাকে এক কথায় ভালোবেসে ফেললো। বাংলাকে জানা আর বাংলা ভাষা শেখার ভাবনা থেকেই প্রথমত মৈত্রেয়ীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চিন্তা করে মির্চা। ওদিকে যথেষ্ট উদার ও প্রগতিশীল সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তার কন্যাকে নিয়ে উচ্চাভিলাষী ছিলেন। তিনিও চাইলেন, মির্চার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তার কাছ থেকে রোমানিয়ান ভাষা শিখুক মৈত্রেয়ী, জানুক সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কেও।

পরিচয়ের ক'দিনের মধ্যেই মির্চা টের পেলো, এই বাচ্চা মেয়েটি চিন্তায় ও ব্যক্তিত্বে অত্যন্ত পরিণত। মৈত্রেয়ীর লেখা কবিতা, তার গভীর জীবনবোধ, সবকিছুই মির্চাকে বিস্মিত করত। সে মৈত্রেয়ীর কাছে একটু একটু করে বাংলা শিখছিল কিন্তু তার চেয়েও বেশি শিখছিলো বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতির প্রতি মৈত্রেয়ীর অতুলনীয় প্রেম।

কিছু দিনের মধ্যে তাদের দুজনের বন্ধুত্ব বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠলো। এর মধ্যেই মৈত্রেয়ীর মাধ্যমে মির্চা জানতে পারলো রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর প্রতি মৈত্রেয়ীর অদ্ভুত ভক্তি দেখে মির্চা অবাক হলো, এবং খানিকটা ঈর্ষাও হলো তার। একসময় মির্চা সত্যিই রবীন্দ্রনাথকে হিংসে করতে লাগলো। মৈত্রেয়ী তখন তাকে শেখালো, ভালোবাসা আর প্রেমের সীমানা এই বাংলার ভূমিতে কত বিস্তৃত। কবিগুরুর প্রতি তার যে প্রেম, সে প্রেম হলো সূর্য আর আকাশের মধ্যকার প্রেমের মতো। ঈশ্বর আর তার সৃষ্টির মধ্যকার প্রেমের মতো।

রোমানিয়ান যুবক মির্চা বাঙালি নারীর হৃদয়ের এই অজস্র রহস্যময় দরজাগুলোর এপারে দাঁড়িয়ে ছিল - কখন যে তার ভেতর সেই দরজার ভেতর প্রবেশের এক গোপন ইচ্ছে জন্মে গিয়েছিল, তা হয়তো মির্চা নিজেও জানতো না।

মির্চা ও মৈত্রেয়ীর গায়ের রঙ, ভাষা, ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি সবই আলাদা। মির্চা ছিল শ্বেতাঙ্গ, মৈত্রেয়ী গাঢ় বাদামী বর্ণের। রোমানিয়ান মির্চা ধর্ম পালন না করলেও জন্মেছিল খ্রিস্টান পরিবারে, মৈত্রেয়ীর বাবা যুক্তিবাদী দার্শনিক হলেও তাদের পরিবারটি ছিল মূলত রক্ষণশীল হিন্দু পরিবার। তবুও এই সমস্ত বাধাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবী পরস্পরের কাছে আসতে লাগলো। কবিতা, দর্শন, গানের আদান-প্রদানের ভেতর অনেকটা অজান্তেই, তারা হৃদয়ের আদান-প্রদান করে ফেললো।
একদিন হঠাৎ করেই বাড়ির লাইব্রেরি ঘরে বসে মির্চা মৈত্রেয়ীকে বলে বসেছিল,
“আমাকে বিয়ে করবে?’’

ভবানীপুরের বাড়ির সেই লাইব্রেরি ঘরে বসেই মির্চা আর মৈত্রেয়ী একে অন্যের কাছাকাছি এসেছিল। বাড়ির সবার চোখকে ধুলো দিয়ে তাদের বন্ধুত্ব থেকে জেগে ওঠা প্রেম সময়ের সাথে সাথে গভীর হতে লাগলো। এক সাথে মুক্ত বিহঙ্গের মতো কাটানো মির্চা যেন মৈত্রেয়ীর ভেতর সমগ্র বাংলাকে দেখতে পেতো।

সহজ সরল মির্চা ধরেই নিয়েছিল, সে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কাছে মৈত্রেয়ীর হাত ধরতে চাওয়া মাত্রই পেয়ে যাবে, কারণ ছাত্র হিসেবে মির্চাকে খুব ভালোবাসতেন অধ্যাপক দাশগুপ্ত। রক্ষণশীল হিন্দু পরিবারের গোঁড়ামি সম্পর্কে সেভাবে কোনো ধারণাই ছিল না মির্চার।

মৈত্রেয়ী দেবীর ছোট বোন কিশোরী চিত্রিতা দেবী সেসময় কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার মানসিক সুস্থতার জন্য কোনো এক বিকেলে মৈত্রেয়ী আর মির্চা, চিত্রিতার হাওয়া বদলের জন্য তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়। সেদিন মির্চা আর মৈত্রেয়ী যেন নিজেরাই নিজেদের দুর্ভাগ্যকে আমন্ত্রণ জানালো। চিত্রিতার সামনেই দুজন হঠাৎ অসাবধান হয়ে গেলো। মানসিকভাবে অস্থিতিশীল চিত্রিতার চোখে মির্চা আর বড় দিদির আচরণ কেমন অদ্ভুত ঠেকলো।

সন্ধ্যাবেলা বাড়ি ফিরে চিত্রিতা তার মায়ের কাছে সবটা বলে দিলো। মির্চা বা মৈত্রেয়ী তখনও জানে না, ভালোবাসার কী পরিণাম অপেক্ষা করে আছে তাদের জন্য। রাতের দিকে মৈত্রেয়ী নিজের ঘর থেকে নিচতলা থেকে ভেসে আসা বাবা-মায়ের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলো। এ বাড়িতে সাধারণত কোনো ঝগড়াঝাঁটি হয় না। তাই মৈত্রেয়ীর কেমন জানি খুব অস্থির লাগছিল।

কিছুক্ষণ পর মা হিমানী মাধুরী দাশগুপ্ত মৈত্রেয়ীর ঘরে আসেন এক গ্লাস দুধ নিয়ে। মায়ের প্রশ্নের মুখে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভেঙে পড়ে কিশোরী মৈত্রেয়ী। মৈত্রেয়ীর মা সেদিন তাকে তিরস্কার করার পরিবর্তে জানতে চেয়েছিলেন, “তুমি কি মির্চাকে বিয়ে করতে চাও?”

মৈত্রেয়ী কান্না জর্জরিত কণ্ঠে তার মাকে বলেছিল, “হ্যাঁ, চাই, আমি ওকে ভালোবাসি।” কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েই মৈত্রেয়ী বুঝতে পেরেছিল মির্চা আর তার বিয়ে কখনো সম্ভব নয়। অন্তত এই পরিবারের কেউ এই বিয়েতে কোনোদিন সম্মতি দেবেন না।

পরদিন সকাল হতেই সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত যে ভালোবাসা আর সম্মান নিয়ে মির্চাকে এ বাড়িতে এনেছিলেন, ঠিক ততটাই অসম্মান আর ঘৃণা নিয়ে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন। যাওয়ার সময় বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে মির্চা একবার শেষ দেখা পেয়েছিল মৈত্রেয়ীর। মৈত্রেয়ীর দিকে তাকিয়ে দু'হাত জোর করে ‘নমস্কার’ জানিয়েছিল সে। মৈত্রেয়ীর দু'চোখ ভেঙে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে। সেটাই ছিল মির্চা ও মৈত্রেয়ীর এক প্রকার শেষ দেখা।

জীবনের প্রথম হৃদয় উথালপাথাল করা এই ব্যর্থ প্রেম ভুলতে মৈত্রেয়ী ও মির্চা, দুজনকেই প্রচুর বেগ পেতে হয়েছিল। অনেকদিন প্রায় অস্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল মৈত্রেয়ী। সেসময় আবার রবীন্দ্রনাথের শরণাপন্ন হয়েছিল সে। গুরুর দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করে ধীরে ধীরে আবার লেখাপড়ায় মনোযোগ দেয়। সঙ্গে যুক্ত হয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উদ্দীপনা। পরবর্তী সময়ে যোগমায়া দেবী কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক হয় মৈত্রেয়ী।

ওদিকে মির্চা কিছুদিন পর ভারতবর্ষ ত্যাগ করে দেশে ফিরে যায়। কয়েক বছর পর, পারিবারিকভাবে মৈত্রেয়ী দেবীর বিয়ে হয় তার চেয়ে চৌদ্দ বছরের বড় বিজ্ঞানী মনমোহন সেনের সঙ্গে, মৈত্রেয়ীর বয়স তখন বিশ।
স্বামীর সঙ্গে মৈত্রেয়ী দেবীর জীবন কাটে মংপুর পাহাড়ি অঞ্চলে। মানুষ হিসেবে মৈত্রেয়ীর স্বামী এত সহজ সরল ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন যে, মৈত্রেয়ী জীবনকে আবার ভালোবাসতে শিখে গেলেন। তাদের দুটো সন্তানও হলো।

কলকাতা শহর থেকে দূরে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যেই ছিলেন মৈত্রেয়ী। বিবাহিত জীবনে সাহিত্যচর্চা ও সমাজসেবা করে সমাজে একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। ১৯৭১ খ্রি: বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে শরণার্থী শিবিরে মৈত্রেয়ী সর্বাত্মকভাবে সেবা ও সাহায্য করেন।

ওদিকে ভারতবর্ষ ত্যাগ করার পর মির্চা এলিয়াদ তার গবেষণা, লেখাপড়ার মধ্যেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। ভালোবাসা, সংসার যেন মির্চার ভাগ্যে কখনো স্থায়ী হতেই চাইতো না। তাইতো মৈত্রেয়ীর সাথে ব্যর্থ প্রেমের পর অভিনেত্রী সোরানা টোপার ভেতর প্রেম খুঁজতে গিয়ে আবার ব্যর্থতার স্বাদ পান তিনি। এরপর নিনা মার্সের কাছে আবারও ভালোবাসার আশ্রয় খোঁজেন মির্চা। আগে থেকেই বিবাহিত ও এক কন্যার মা নিনাকে শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন ও এই সংসারে থিতু হন।

তবে জীবনের মধ্য বয়সে এসে মির্চা একদম একাই ছিলেন। মৈত্রেয়ীর সাথে সম্পর্কের যে দুঃখজনক পরিণতি মির্চার হয়েছিল, সেই গভীর বেদনা আর ক্ষতকে একা বয়ে নিতে পারছিলেন না বলেই হয়তো, এই সত্য ঘটনাকে উপজীব্য করে ১৯৩৩ খ্রি:, অর্থাৎ কলকাতা ছাড়ার ৩ বছর পর, রোমান ভাষায় উপন্যাস "লা নুই বেঙ্গলি" লেখেন। যাকে বাংলা করলে হয় 'বাংলার রাত্রি'।

এই একটি উপন্যাস মির্চা এলিয়াদকে তার দেশে ঔপন্যাসিক হিসেবে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়। এটি ছিল সেসময়ের রোমানিয়ান ভাষায় লেখা বেস্ট সেলার বই। সমস্ত দেশ মির্চা ও মৈত্রেয়ীর ভালোবাসার গল্প পড়ে কেঁদেছিল। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাতীয়তার ভেদাভেদ কিভাবে মানুষের হৃদয়ের পথ আলাদা করে দেয়, তা জেনে অনেকের মনই ভারাক্রান্ত হয়েছিল।

অদ্ভুত বিষয় হলো, মির্চা যে মৈত্রেয়ীকে তার উপন্যাসে স্বপ্নের নায়িকা বানিয়েছে, সেই খবর স্বয়ং মৈত্রেয়ী জানতেন না। অনেক বছর পর সত্তরের দশকে, মধ্যবয়সে এসে মৈত্রেয়ী যখন এই বইয়ের কথা জানতে পারেন, তখন তার ছেলে মেয়েরও বিয়ে হয়ে গিয়েছে ও তাদের নিজেদের সন্তান আছে।

মৈত্রেয়ী জানতে পারলেন, বইয়ে তার নাম স্পষ্ট অক্ষরে প্রকাশ করা হয়েছে এবং তাকে আঁকা হয়েছে নায়িকা রূপে। চল্লিশ বছর পর জীবনের প্রথম প্রেম আবার মৈত্রেয়ীর জীবনে ঝড় তোলে। পুরনো প্রেম তাকে নতুন করে কষ্ট দিতে থাকে। এরই মধ্যে মৈত্রেয়ীর সুযোগ আসে আমেরিকা সফরের। শিকাগো থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। মির্চা এলিয়াদ তখন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক।

লোকলজ্জার ভয় তুচ্ছ করে মৈত্রেয়ী তার স্বামীর অনুমতি নিয়েই দেখা করতে যান, তার জীবনের প্রথম ভালোবাসার সাথে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরির এক কোণায়, দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর আবার দেখা হয় মির্চা আর মৈত্রেয়ীর।

সেই ষোলো বছর বয়েসী কিশোরী মৈত্রেয়ী কিংবা একুশ বছরের যুবক মির্চা এত দীর্ঘ সময় পরেও মহাকালের কোনো এক অংশে যেন আটকে গিয়েছিল। তাদের এই দেখা হয়তো ‘পুনর্মিলন’ ছিল না, কিন্তু এই দেখার ভেতর তারা একে অপরের হৃদয় দেখতে পেয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল, এ জীবনে না হলেও অন্য কোনো জীবনে, অন্য কোনো জন্মে তারা এক হবেই।

জীবন সায়াহ্নে এসে ভালোবাসার কাছে এমন আত্মসমর্পণের ঘটনা হয়তো পৃথিবীতে খুব বেশি নেই, বিশেষ করে একজন বাঙালি বিবাহিত নারীর জন্য তার শৈশবের ভালোবাসার সাথে আবার দেখা করতে সুদূর শিকাগো যাওয়া তখনকার সময়ে ভাবা যেতো না।

১৯৭৪ খ্রি: প্রকাশিত "ন হন্যতে", মৈত্রেয়ী দেবীর এতদিনের সাজানো গোছানো জীবনে তীব্র বিতর্ক ও সমালোচনার সঞ্চার করে। তার আত্মীয়স্বজন ও অনেক বন্ধুবান্ধবই এই বই প্রকাশের পর তার সাথে সম্পর্ক রাখতে পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানায়।

মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন বুদ্ধিমতী, জ্ঞানতাপস ও সাহিত্যচর্চায় নিবিষ্ট এক নারী। পাশাপাশি তিনি ছিলেন চঞ্চলা, চপলা ও আনন্দময়ী। ক্ষুরধার বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আপন সত্তার মাঝে যিনি লালন করতেন একজন প্রেমময়ী নারীকে। যিনি কি না প্রতিনিয়ত পাড়ভাঙা নদীর মতো ভেঙে ভেঙে নদীর বুকে বিলীন হয়ে যাওয়ার মাঝেও আপনার চরম সার্থকতা উপলব্ধি করেন। কিন্তু কালিক চিন্তাদর্শের বিপরীতে গিয়ে মৈত্রেয়ী ও মির্চা যে-প্রেম সাজিয়েছিলেন চিরকালের বুকে অর্ঘ্যদানের নিমিত্তে সমকাল ও সংস্কার তাকে যেনো ছুড়ে ফেলে দিতে চায়! কিন্তু সমাজ, সভ্যতা, সমকাল ও সংসারের সামনে ভালো মানুষের ঠুনকো মুখোশ পরে থাকা মানুষ মৈত্রেয়ী ছিলেন না। যে-প্রেম তাঁর কাছে ছিল আত্মার আনন্দ, তাকে তিনি কাল্পনিক কথকতার মাঝে ম্রিয়মাণ হতে দেননি। সব ভয় তুচ্ছ করে তিনি সবসময় থেকেছেন সত্য প্রকাশে অটল।

সেসময়ের রক্ষণশীল সমাজে একজন বিবাহিত বৃদ্ধ নারীর তার অল্প বয়সের প্রেমের পুঙ্খানুপুঙ্খ ঘটনা লেখাকে কোনোভাবেই ভালো চোখে দেখা হতো না। কিন্তু মৈত্রেয়ী দেবী তার ইচ্ছে ও সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। ‘ন হন্যতে’ এর অর্থ, যার মৃত্যু নেই। প্রেম ও আত্মার অবিনশ্বরতাকে এক করে মৈত্রেয়ী তার ও মির্চার ভালোবাসার সত্যকে নির্ভীকভাবে মানুষের সামনে তুলে আনেন। এই সত্যভাষণ তাঁকে এনে দেয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার। ১৯৭৭ খ্রি: তিনি ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত হন।

মির্চা ও মৈত্রেয়ীর এই অভূতপূর্ব প্রেম নিয়ে ১৯৮৮ খ্রি: দ্য বেঙ্গলী নাইট নামের চলচ্চিত্র তৈরি করেন নিকোলাস ক্লতজ। মৈত্রেয়ীর চরিত্রে অভিনয় করেন সুপ্রিয়া পাঠক।

১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার ভবানীপুরে শুরু হওয়া এই হৃদয় ভাসানো প্রেমের উপাখ্যানের শাখা ছড়িয়ে গেছে সুদূর ইউরোপ, আমেরিকাতেও। মির্চা এলিয়াদ ও মৈত্রেয়ী দেবীর অনিঃশেষ ভালোবাসা সে যুগের ধর্ম বর্ণ ও জাতের ভেদাভেদের কাছেও হার মানেনি। তারা তাদের ভালোবাসার মাঝেই বেঁচে আছেন।

মৈত্রেয়ী দেবী ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি ইহলোক ত্যাগ করেন। প্রেমকে ঐশ্বরিক মর্যাদা দেয়ার ক্ষমতা হয়তো সকলের হয় না, কিন্তু সমাজ সংস্কৃতির বলয়ে অসমাপ্ত প্রেমের এমন উপাখ্যান; প্রেম ভালোবাসার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখে।

মন্তব্য ২২ টি রেটিং +৭/-০

মন্তব্য (২২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১৫

শেরজা তপন বলেছেন: আমার লেখা-জোখার দৌড়..... শিরোনামে লেখাটা এই পোষ্টের পরে দিলে ভাল হোত।
তাহলে পাঠকেরা বুঝত আপনি কোন মানের লেখক। বহুদিন ব্লগে অনুপস্থিতির কারনে নতুন অনেকেই চেনে না 'জুলভার্ন' কি জিনিস!

ন হন্য তে'র ছায়া কাহিনী অবলম্বনে বোম্বেতে ~ হাম দিল দে চুকে সনম' নামে বেশ জনপ্রিয় একটা চলচ্চিত্র হয়েছিল। যদিও নির্মাতা অস্বীকার করেছিল।
মির্চা এলিয়াদ নাকি শেষ জীবিনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন?
মৈত্রেয়ী দেবী'র ওই উপন্যাসটি লেখার পেছনের কাহিনী নিয়ে শ্রীযুক্তা 'গৌরী আইয়বে'র বইয়ে বেশ খানিকটা লেখা আছে।
দারুন লিখেছেন অনেক কিছু জানলাম নতুন করে।
দুটো বই পড়ার জন্য খুব সহজেই হৃদয়াঙ্গম হোল। ধন্যবাদ

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২২

জুল ভার্ন বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ প্রিয় ভাই।

২| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:১৭

সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: ১৯৮৮ সালের দিকে বন্ধুদের হাতে লা নুই বেঙ্গলি বইটা দেখেছিলাম। পড়া উচিত ছিল। শুনেছি দুই বইয়ে দুইজনের বর্ণনায় কিছু অসঙ্গতি প্রকাশ পেয়েছে।

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:২৮

জুল ভার্ন বলেছেন: হ্যা মির্চা এলিয়েদের লেখার দু একটা পয়েন্ট নিয়ে মৈত্রেয়ী দেবী ভিন্নমত পোষণ করেছেন। এমনঃ মির্চা লিখেছেন -প্রায়শই গভীর রাতে মৈত্রেয়ী দেবী তার ঘরে লুকিয়ে দেখা করতেন এবং একবার পালিয়ে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন"- এই দুটো পয়েন্ট মৈত্রেয়ী দেবী স্বীকার করেননি।

বই দুটি সুযোগ পেলে পড়বেন - ভালো লাগবে।

৩| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৯:০৭

শূন্য সারমর্ম বলেছেন:

প্রেম অসমাপ্ত ও ব্যর্থ হলেই বোধ হয় ইতিহাসে জায়গা পায়। প্রেমের ব্যর্থতাই আসল প্রেম।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:২৮

জুল ভার্ন বলেছেন: প্রেমের স্বার্থকতা ব্যর্থতায়।

৪| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:০২

মরুভূমির জলদস্যু বলেছেন: দুজনের লেখা দুটি বইয়ের সাথেই কিছুটা পরিচয় হয়েছিলো শুধু আমার।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:২৯

জুল ভার্ন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৫| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:১৮

পদাতিক চৌধুরি বলেছেন: আমি ন হন্যতে পড়ে এতোটাই ডুবে গেছিলাম যে লা নুই বেঙ্গলি না পড়ে তৃষ্ণা মেটাতে পারিনি।দুটি বইয়ের বিবরণের মধ্যে বেশ অসঙ্গতি লেগেছিল।এক জায়গায় বলা হচ্ছে মৈত্রেয়ী দেবীর বাবা ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। যার অধীনে কাজ করতে এসেছিলেন মির্চা এলিয়াদ। আবার অন্য স্থানে মৈত্রেয়ী দেবীর বাবার পেশা প্রসঙ্গে আপনার পোস্ট উল্লিখিত অধ্যাপক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।তার অধীনে রিসার্চ করতে এসেছিলেন মির্চা। দুজনেরই বর্ননার মধ্যেও বেশ অসঙ্গতি লেগেছিল।আমার মনে হয় কম বয়সের প্রেমকে লিখিত আকারে রূপ দেওয়ার সময় লেখিকা অনেক সাবধান হয়ে গেছিলেন।যেখানে মির্চা খুল্লাম খুল্লা ভাবে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছিলেন। তবে একটা বিষয় পরিষ্কার নিকট আত্মীয় স্বজন থেকে দূরে থাকতে বা নিজেকে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিতে মংপুতে কর্মরত পাত্রের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
যাইহোক সে সময়ের উচ্চবিত্ত পরিবারের বাঙালির উদারতা, সংস্কৃতি প্রেমিতা, সাহিত্যানুরাগী, ধর্মীয় উদাসীনতার মতো আর্থসামাজিক অনেকগুলো বিষয় উপন্যাসে উঠে আছে। সঙ্গে তো আছেই প্রেমের উদ্যমতা। সব মিলিয়ে দুটি উপন্যাস ইং ভীষণ ভালো লেগেছিল।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:৩০

জুল ভার্ন বলেছেন: চমতকার মন্তব্য!

৬| ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১১:৪৪

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লিখেছেন।

৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:৩১

জুল ভার্ন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৭| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:৩৮

নীল আকাশ বলেছেন: আমার পড়া সেরা প্রেমের উপন্যাস দুটা। লেখা খুব ভালো হয়েছে। নির্বাচিত পোস্ট কেন হলো না?

০১ লা অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১১:৩৬

জুল ভার্ন বলেছেন: ধন্যবাদ।

৮| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:০৪

লিখন২০১৬ বলেছেন: আমার প্রিয় বই।

০১ লা অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১১:৩৭

জুল ভার্ন বলেছেন: আমারও।

৯| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ দুপুর ১:৫৫

জুন বলেছেন: এই বই দুটো মির্চা এলিয়াদ আর মৈত্রেয়ী দেবীর মত আমার চোখেও পানি এনেছিল। সুন্দর লিখেছেন।
+

০১ লা অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১১:৩৮

জুল ভার্ন বলেছেন: আপনি পড়েননি এমন কোনো বই আমি বের করতে পারবোনা!
ধন্যবাদ।

১০| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩২

ভুয়া মফিজ বলেছেন: বই দুটাই পড়েছি। চমৎকার দু'টা বই। তবে মৈত্রেয়ী দেবীর 'ন হন্যতে' লেখার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু ততোটা প্রেম ছিল না, যতোটা ছিল মির্চার কিছু ঘটনার অতিরন্জিত বর্ণনার (মৈত্রেয়ী দেবীর ভাষায়) কাউন্টার দেয়া।

যাই হোক, আপনার বিশ্লেষণধর্মী লেখাটা চমৎকার হয়েছে, যদিও 'ন হন্যতে' লেখার মূল উদ্দেশ্য উঠে আসে নাই পুরোপুরিভাবে। :)

০১ লা অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১১:৪১

জুল ভার্ন বলেছেন: ন হন্যতে মৈত্রেয়ী দেবীর কিচু লুকোছাপা ছিলো, যা মির্চা এলিয়েদ খোলাসা করেছেন।

১১| ৩০ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৪৩

মনিরা সুলতানা বলেছেন: বহুল পাঠিত দুইটি বই এর বিশ্লেষন ভালো লেগেছে। ইন্টার পরীক্ষার পরপর পড়েছিলাম তত বুঝে আসে নাই। আপনার লেখায় নতুন ভাবে দেখলাম আবার।

০১ লা অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১১:৪১

জুল ভার্ন বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.