নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। কালেভদ্রে লিখি :)

মোঃ জুনায়েদ খান

ভোর হয়, সূর্য ওঠে... সেই সূর্যও একসময় রাতের কোলে ঘুমিয়ে যায়। আমিও সূর্যের সাথে উঠি, রাতের কোলে ঘুমিয়ে যাই, মাঝিবিহীন নৌকায় বসে উত্তাল সমুদ্রে নিয়মিত ঘুরপাক খাই, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিদ্যুৎ বেগে দৌড়াই আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে কচ্ছপ বেগে হেঁটে হেঁটে আসি, তারপর চৈত্রের কড়া দুপুরে কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ! কারণ আমার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই!\n\n\nপেশায় ছাত্র। পড়ছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। এইতো..

মোঃ জুনায়েদ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্পঃ বিজলী

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১৬

এক



মেয়েটাকে দেখে চোখ কচলায় অন্তু। চশমা খুলে দ্বিতীয়বার দেখে। বুকের ভিতরের ইঞ্জিনটার আরপিএম চক্রবৃদ্ধিতে বাড়তে থাকে। দৃষ্টিভ্রম। না, দৃষ্টিভ্রম প্রতিদিন হয় না। গত কয়েকদিন থেকে এভাবেই চোখ কচলিয়ে মেয়েটাকে দেখছে সে। সদ্য জন্ম নেয়া গোশাবকের মত একজোড়া বড় বড় চোখের ভীরু ভীরু চাহনি, সুউচ্চ নাকে ছোট্ট একটা সাদা রঙয়ের নাক ফুল, এক গুচ্ছ কোকরানো বাদামী চুল, উপবৃত্তাকার অমনি মজার একখানা মুখ, কালো ভ্রূ যুগলের মাঝের কালো টিপটি যেন সে মুখের সৌন্দর্যকে হাজার গুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। থেকে থেকে মেয়েটা মুচকি হাসছে। শব্দ হয় না। কিন্তু সে হাসি অন্তুর বুকে ধকধক শব্দ তোলে, সবকিছু ওলট-পালট করে দেয় প্রতিদিন।



এ মুচকি হাসিটার সাথে অন্তুর পরিচয় বহুদিনের। কোন এক দুপুরে এমনি এক মুচকি হাসিতে ফেঁসে গিয়েছিল অন্তু। তখন সবেমাত্র বদ্ধ জেলখানার মত বাড়িটা থেকে মুক্তি মিলেছে ওর। রাজধানীর সেরা কলেজের ছাত্র সে। বিমানের বোঁ বোঁ শব্দে হঠাৎ ভোরের ঘুম ভেঙে যায়, পাঁচ মিনিটের কলেজের পথ যেতে পঁচিশ মিনিট লাগে, খাওয়ার পানিটাও ফুটিয়ে খেতে হয়, ইচ্ছে করলেই যখন তখন গোসল করা যায়না, সময়ে অসময়ে পানি চলে যায়। কিন্তু অনেক রাত অবধি জাগলেও কেউ বাঁধা দেয় না। বলতে গেলে নতুন একটা জীবন পেয়েছে অন্তু। যে জীবনে বাবার বকুনি নেই, মায়ের হাতের রান্না নেই, বাড়ির পিচ্চি গুলোর উৎপাত নেই, আছে শুধু স্বাধীনতা, অপার স্বাধীনতা। চার তলার পশ্চিমের দিকের একটা সিঙ্গেল রুমে থাকে সে। পশ্চিম দিকের জানলা খুললেই পাশের তিন তলা বিল্ডিং এর বিস্তৃত ছাদটি দেখা যায়। নানান রঙ ও ঢঙের কাপড়ে ভরে থাকে সব সময়। রোদের উৎপাতে বছরের অধিকাংশ সময়ই বন্ধ রাখতে হয় পশ্চিমের জানালাটা। কোন এক ছুটির দিনে তার কুশ্রী ঘরখানাকে শ্রী দেয়ার চেষ্টা করছিল অন্তু। ঘরের ভ্যাঁপসা বদ্ধ বাতাস বের করে দেয়ার জন্য পশ্চিমের জানালাটা খুলে দেয় সে। অনেকদিনের বন্ধ স্টিলের জানালা চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করে। জানালার আত্নচিৎকারে চমকে ওঠে জানালার অপর পাশের এক বালিকা। ছাঁদে কাপড় শুকোতে এসেছে সে। এক জোড়া ডাগর কালো চোখে আকাশসম বিস্ময় নিয়ে অন্তুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে বালিকা। তারপর মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে চলে যায়।



হাসিটা অন্তুকে হিপনোটাইজড করে দিয়েছিল। জানালা থেকে নড়তে পারেনি অনেকক্ষণ। সেদিনের পর জানালাটা আর বন্ধ করেনি অন্তু। চৈত্রের রোদে ঘরের প্রতিটি আসবাবপত্র গরম হয়ে উঠত, ফ্যান দিয়ে মরুভূমির লু হাওয়া প্রবাহিত হত, শিমুল তুলার তোষক-বালিশ অনেক রাত অবধি উষ্ণতা বিলাত, তবু পশ্চিমের জানালাটা এক মুহুর্তের জন্য বন্ধ হত না। হঠাৎ হঠাৎ ছাঁদে আসত মেয়েটা। জানলার গ্রিলের আড়ালে একজোড়া অপেক্ষমান চোখ চঞ্চলিত হয়ে উঠত। তারপর চোখে চোখে চোখাচোখি হতেই সেই রহস্যময় মুচকি হাসি হেসে চোখের পলকেই অদৃশ্য হয়ে যেত। অদৃশ্য হত না গ্রিলের আড়ালের ক্ষুধাতুর চোখজোড়া; হিপনোটাইজড হয়ে বিরতিহীন ভাবে পশ্চিমের আকাশে চেয়ে থাকত। ক্ষণিকের ঝলকানি দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য দিগন্তে মিশে যেত অন্তুর বিজলী, দেখা দিত না অনেক দিন।



অন্তুর কলেজ জীবনের দিনগুলি এভাবে কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু সে কেটে যাওয়ায় একদিন ছেদ পরে, কই থেকে একটা অদৃশ্য শক্তি এসে ভেঙেচুরে সব তছনছ করে দেয়। দিনটা ছিল শুক্রবার। প্রতি শুক্রবার কলেজ মাঠে ক্রিকেট খেলা হয়। ক্রিকেট পাগল অন্তু এ সু্যোগটা কখনো মিস করে না। শুক্রবার এলেই আর অন্তু কে খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্তু ভালো বল করতে পারে। আজ সেই দলকে জিতিয়েছে। শেষ ওভারে দুই রান দরকার ছিল, হাতে ছিল এক উইকেট। সে প্রথম বলেই বোল্ড করে দিয়েছে। আজকের ম্যাচ সেরা সে। তাই অন্তুর মন টা আজ বেশ ফুরফুরে। গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে হেঁটেই বাসায় ফেরে অন্তু। বাসার কাছাকাছি মাঝারী ধরনের একটা জটলা দেখে থেমে যায় সে। জনা ত্রিশেক মানুষ দলা পাকিয়ে তিন তলা বাসাটার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘কি হয়েছে? কি হয়েছে ভাই ঐ বাসায়?’ – কেউ সদুত্তর দিতে পারে না। এই বাসা থেকে কিছুক্ষণ আগে জোড়ে কেউ চিৎকার করে উঠেছিল। এখনও চিৎকার-চেঁচামেচি চলছে। বাসার সদর দরজাটাও বন্ধ। এক রাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বাসাটার দিকে তাকিয়ে থাকে অন্তু! অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে ওঠে। প্যাঁপোঁ প্যাঁপোঁ শব্দ করে অ্যাম্বুলেন্স আসে। সদর দরজা খুলে যায়। একজন মধ্যবয়সী পুরুষ আর দুজন মহিলা ধরাধরি করে একটা মেয়েকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠায়। ভীর ঠেলে দেখার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয় অন্তু। দ্রুত দরজা বন্ধ করে চলে যায় অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সের কালো কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখার শেষ চেষ্টা করে অন্তু। না, ড্রাইভার ছাড়া আর কাউকে দেখতে পায় না সে।



মেয়েটা মারা যায়। কারেন্ট শকে। পশ্চিমের জানালাটা আবার বন্ধ হয়ে যায়। বাসা বদল করে একটা মেসে উঠে অন্তু। মেয়েটার মৃত্যু অন্তুকে অনেক বড় একটা শক দিয়েছিল। যে শকে শরীরের মৃত্যু হয় না, কিন্তু মনটা ধীরে ধীরে মরে যায়।



‘আপনি কি বিজলী?’- আচমকা মেয়েটাকে প্রশ্ন করে অন্তু। খিল খিল করে হেসে ওঠে মেয়ের পাশে থাকা বান্ধবীটি। হাসতে হাসতেই বলে- ‘আপনি নিশ্চয় জেমস তাই না?’

হতভম্ভ হয়ে যায় অন্তু। প্রতিক্রিয়াটা এমন হবে আশা করেনি সে। মেয়েটা মাথা নিচু করে এক দৃষ্টে পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া ঘাস গুলির দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্তুর প্রশ্নটাকে আমলে নেয়নি সে। তাহলে কি মেয়েটা অন্তুকে নিঃশব্দে অপমান করছে? মাথা নিচু করে নিঃশব্দে ফিরে আসে অন্তু।

ঠোঁটকাটা বান্ধবীটি হাসি চেপে নিচু কন্ঠে গান ধরে- ‘ও বিজলী চলে যেও না...’





দুই



কিছু কিছু মানুষ আছে যারা নিজের সাজানো কল্পনার জগতে একাকী বিচরণ করতে ভালোবাসে। নিজের চাওয়া কিংবা প্রাপ্তী গুলো আবর্তিত হয় ঐ কল্পনার জগতকে কেন্দ্র করে। অনেকটা বাচ্চাদের পুতুল খেলার মত। বাচ্চা নিজে পুতুল বানায়, পুতুলের নাম রাখে, নিজেই ইচ্ছে মত রঙ মাখিয়ে শাড়ি পড়িয়ে সেই পুতুলটার বিয়ে দেয়। কিন্তু বেচারী পুতুল জানতেই পারেনা যে তার বিয়ে হয়ে গেছে, সে বিবাহিত! অন্তুও এর ব্যতিক্রম না। নিজে নিজে ঠিক করে নিয়েছে মেয়েটার নাম বিজলী তো বিজলীই হতে হবে। বলা নেই কওয়া নেই অমনি ঠাস করে বলে দিল- ‘আপনি কি বিজলী?’! সব মুচকি হাসিওয়ালা মেয়ের নাম যে বিজলী হয়না এ সহজ বিষয়টা অন্তুর মত কল্পনাপ্রবণদের মেনে নিতে কষ্ট হয়। এ জন্যও হয়তোবা কল্পনাপ্রবণ মানুষরাই পৃথিবিতে সবচেয়ে বেশী কষ্টে থাকে।



সে তো মেয়েটাকে টিজ করে নি। ভদ্র ভাবে শুধু একটা প্রশ্ন করেছিল। একটা ইয়েস নো উত্তর দিলেই পারত। উলটো চামচা কতৃক টাটকা অপমান করল! মেয়েটা হয়তো জানেনা অন্তু ওর দু’বছরের সিনিওর । ইচ্ছে করলেই মেয়েটাকে ডেকে কড়া সুরে ভদ্রতা শিখিয়ে দিতে পারে সে। কিন্তু সে দেবে না।! জুনিয়র কে ডেকে কড়া কথা শোনানো অন্তুর পছন্দ না। কিন্তু তাই বলে ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ে ক্যাম্পাসে এসেই যাকে তাকে ভাব দেখিয়ে অপমান করতে তো পারে না! এবার সামনে পেলে সত্যিই মেয়েটাকে ভদ্রতা শিখিয়ে দেবে অন্তু! সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর পেছনে বুড়ো আমগাছটির নিচে কংক্রিটের বেঞ্চে বসে প্রায় আধ ঘন্টা ধরে এসব উল্টা-পাল্টা চিন্তা করছে সে। খট খট হিল জুতোর শব্দে পেছনে তাকায় সে। অদূরেই দুই মানবী অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে আছে।



‘ভাইয়া স্লামুলাইকুম’- অন্তুর দিকে কাচুমাচু করে সালাম ছুঁড়ে দেয় খিল খিল হাসি দেয়া মেয়েটা।



অন্তু সালামের উত্তর দিয়ে মাথা ঘুড়িয়ে বেঞ্চটাতে শক্ত করে বসে। মেয়েগুলো কি আবার অপমান করতে এসেছে নাকি? মনে মনে কিছু কড়া বাক্য সাজিয়ে ফেলে সে।

‘সরি ভাইয়া। আমি আপনাকে সরি বলতেই এসেছি। আমার মাথা খারাপ তো। তাই মাঝে মাঝে বেশী কথা বলি!’ খিল খিল করে হাসা মেয়েটা এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে অন্তুর দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অন্তু কিছু বলে না। মেয়েটা দ্বিতীয়বারের মত হতভম্ভ করে দিয়েছে অন্তুকে।

মাথা খারাপ মেয়ে চেঁচিয়ে ওঠে- ‘কি ব্যাপার কথা বলেন না কেন? সরি বললাম তো!’

চমকে ওঠে অন্তু। ঠোঁটের কোনে আচমকা হাসি খেলে যায় অন্তুর। ‘ইট’স ওকে’

‘আমার নাম মিনা। সবাই আমাকে পাগলী মিনা বলে ডাকে!’ বলে মেয়েটা।

‘আমি কি তোমার নাম জানতে চেয়েছি?’ অন্তু মিনাকে প্রশ্ন করে।

‘বারে, সেদিন তো জিজ্ঞেস করলেন –‘আপনি কি বিজলী?’ সেদিন আমার মন ভালো ছিল না তাই আপনাকে নিয়ে মজা করেছি’। বলে আবার খিল খিল করে হেসে ওঠে মিনা।

মেয়েটা বোধহয় আসলেই পাগল! আধ ঘন্টা ধরে করা প্ল্যানটা ভেস্তে যায় অন্তুর।

‘আমি যে তোমার সিনিওর সেটা বুঝলে কি করে?’

‘আপনার দাড়ি ও গোফ দেখে! আমাদের ক্লাসের ছেলেগুলোর এখনো দাড়ি-গোফ ওঠেনি!’ বলে আবার অট্টহাসে মিনা।

অন্তুও হাসে। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মুচকি হাসি দেয়া মেয়েটিকে ডাকে সে। হঠাৎ করে নিজেকে অনেক সাহসী মনে হয় অন্তুর। এর আগে কোন মেয়েকে এভাবে ডাকেনি সে।

‘দূরে দাঁড়িয়ে কেন? তুমিও নিশ্চয় মিনার সাথেই পড়?’

‘জ্বি’

শুধু জ্বি তেই শেষ! আর কিছু বলেনা কেন মেয়েটা? আচ্ছা কিছু না বলুক। ওর বিখ্যাত মুচকি হাসিটা তো দিতে পারে। কই গেল সেই মুচকি হাসি?

‘তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?’ নরম গলায় বলে অন্তু।

‘ভয় পাব কেন? আপনি মিনার সাথে কথা বলছিলেন তাই...’

‘ও আচ্ছা। তোমার নাম তাহলে বিজলী নয়?’ –অন্তু কৌতুক করে।

এবার মেয়েটা সত্যিই মুচকী হাসে। কিছুটা অবাকও হয়।

‘আমার নাম বিজলী হতে যাবে কেন? আমি তুবা!’

‘হুম...! সেদিন বলনি কেন?’

‘সেদিন কি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন?’ তুবা সত্যি সত্যি অবাক হয়। অবাকের ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে বলে ‘আমি ভেবেছিলাম আপনি মিনার পরিচিত। মিনাকে খ্যাপাতে ও কথা বলেছেন’

মিনা খুব মনোযোগ দিয়ে ওদের কথা শোনে। হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় সে। এতক্ষণ ধরে সে যা ভেবে এসেছে তার সবি ভুল। অন্তুর বিজলী মিনা নয়, তুবা! তীব্র অপমানবোধ গ্রাস করে মিনাকে। পাগলী মেয়েদের ঐ একটাই সমস্যা। পৃথিবীর তামাম কঠিন বিষয়গুলোকে সহজে হজম করতে পারলেও আত্ন সম্মানে ঘা লাগাটা সহজে সইতে পারে না। পান থেকে চুন খসলেই এদের হৃদয়ে মধ্যম মাত্রার সাইক্লোন শুরু হয়।



মিনার চলে যাওয়াটা অন্তু তুবা কেউই লক্ষ্য করেনি। ওদের কথা চলে অনেকক্ষণ। অন্তুর যেন কৌতূহল ফুরোবার নয়। ভার্সিটি কেমন লাগছে, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা, পড়াশুনা কেমন লাগছে, বাবা-মাকে ছেড়ে থাকতে কেমন লাগে ইত্যাদি কিছু কমন প্রশ্নে জর্জরিত করে তোলে সে তুবাকে। উত্তর দিতে তুবারও খারাপ লাগে না। কেউ আগ বাড়িয়ে কেয়ার করলে খারাপ লাগবে কেন? ‘মিনা চল। দেরী করলে ডাইনিং এ খাবার পাব না’ - বলে মিনার দিকে তাকায় তুবা। কিন্তু মিনা যে অনেক আগেই অপমানিত হয় চলে গেছে সে খবর তুবা পায়না। মুখে কপট রাগ এনে অন্তুকে নালিশ করে তুবা – ‘মেয়েটা আসলেই একটা পাগলী’ তারপর চারদিকটা আবার পরখ করে তুবা। গত রাতের শিলা বৃষ্টিতে পিষ্ট হওয়া কচি আমের গুটি ছাড়া কিছুই নজরে আসে না তুবার। আশে পাশে কেউ না থাকায় লজ্জায় গা শিরশির করে তুবার। কেউ দেখেনি তো? আর দেখলেই তুবার কি? সে তো ইচ্ছে করে এখানে আসেনি। সব দোষ ওই পাগলী মিনার। হলে আগে যাক সে। পাগলী মিনার এবার বারোটা বাজাবে তুবা। অন্তুকে বাই জানিয়ে বিপদগ্রস্ত ইঁদুরের মত দ্রুত চলে যায় তুবা।





তিন



সেদিনের পর প্রায় দু’সপ্তাহ কেটে গেছে। তুবার সাথে আর দেখা হয়নি অন্তুর। একদিন মিনাকে দেখেছিল কিন্তু মিনা না দেখার ভান করে চলে গেছে। বলতে গেলে একটু বিরহেই আছে সে। এ কদিনে তুবাকে খোঁজার চেষ্টাও কম করেনি অন্তু। অবশ্য তুবার ক্লাস বা হলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মত সাহসটা অন্তু এখনও দেখায়নি। তবে ফেসবুকে তুবাকে অনেক খুঁজেছে সে। তুবা নামে কয়েকস’শ আইডি আছে ফেসবুকে। কোনটাতে পুতুলের ছবি, কোনটাতে কার্টুন আবার কোনটাতেই বিড়াল অথবা ভালুকের ছবি দেয়া। ইনফো দেখে যে শিওর হবে তার উপায় নেই। সব হাইড করা। মুচকী হাসিওয়ালা তুবাকে বুঝি পাওয়াই যায় না। তবুও হাল ছাড়েনা অন্তু। কয়েকবার মনে হয়েছে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েই দেখা যাক না কি হয়। কিন্তু পরক্ষনেই সে সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে সে। অপরিচিত তুবাকে রিকোয়েস্ট পাঠালে পরিচিত তুবা মাইন্ড করতে পারে। তাছাড়া সেও তো অপরিচিত কারো রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেনা। সকালে ‘হুতুম পেঁচা’ নামের একটা মেয়ে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল। অন্তু নট নাউ করে রেখেছে। ইনফোতে যেন কি একটা মজার বিষয় লেখা ছিল। অন্তু ভুলে গেছে। ইনফোটা দেখার জন্য ‘হুতুম পেচা’র ওয়াল চেক করে অন্তু। হুতুম পেঁচার প্রফাইল পিক দেখে চোখ আটকে যায় ওর। হুতুম পেঁচার ছবিটা আর নেই! কয়েক মিনিট আগে প্রফাইল পিকচার চেঞ্জ করেছে প্রফাইলের মালিক। কয়েকবার জুম করে দেখে নিশ্চিত হয় অন্তু। তুবা!



ফেইসবুকে অপেক্ষায় থাকে অন্তু। হুতুম পেঁচা কবে অনলাইনে আসবে কবে তাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করবে সে। কিন্তু হুতুম পেঁচা আসে না। বিরক্ত হয়ে মেসেজ করে অন্তু-‘তুমি কি ফেসবুকে ইরেগুলার নাকি?’ দু’মিনিটের মাঝে রিপ্লাই আসে- ‘আমি তো সবসম ফেসবুকেই থাকি!’

বলে কি মেয়েটা? তাহলে এতক্ষণ বসে বসে অপেক্ষা করছিল কেন অন্তু? বড়দের মত করে জিজ্ঞেস করে অন্তু- ‘ ফেইসবুকে সারাদিন থাকাটা তো ভালো না খুকি!’

- আমাকে আপনার খুকি মনে হয়? কাজ না থাকলে করবটা কি সারাদিন?

- ঘোড়ার ঘাস কাটবে

- ও... আপনার বুঝি ঘোড়া আছে?

- ঘোড়া নেই তবে ঘোড়ার আন্ডা আছে!

- আন্ডা মানে কি??

- আন্ডা মানে আন্ডা!

- বললে কি হয়?

- আন্ডা মানে ডিম এটা জাননা?

- না।

- তা জানবা কেন? পেঁচারা বুঝি ডিম পারেনা?

- আমি সত্যিই পেঁচা নাকি? পেঁচার ছবি ছিল বলে রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেন না দেখে নিজের ছবিই তো দিয়ে দিলাম। তবুও পেঁচা বলবেন?

- হুম। তুমি দেখতেও পেঁচার মত, তোমার হাসিটাও পেঁচার মত! হি হি হি...

- আপনার সাথে কথা বলাটাই ঠিক না। বাই

- ওকে, হুতুম পেঁচা! বাই...

প্রথম দিনের ফেসবুক চ্যাটিংটা এভাবেই শেষ হয় ওদের। ওদের কপট অভিমান আর স্লেজিং এর ধরন দেখে কে বলবে এটা ওদের প্রথম ফেসবুক চ্যাটিং? কিছুক্ষণ আগের বিরহী ভাবটা কেটে যায় অন্তুর।



বিষয়টা যে এত দ্রুত আগাবে সেটা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি অন্তু। সব কিছু যেন অন্তুর মনের মত করেই এগুচ্ছে। এটা খুব খারাপ। খুব সহজেই যদি বহুল আকাঙ্ক্ষিত কিছু হাতের নাগালে চলে আসে তবে খুব সহজেই সেটা দূরেও চলে যায়। বিজলীর মত। খুব অল্প সময়ের জন্য অন্তুর আকাশ আলোকিত করে না ফেরা দিগন্তে মিলিয়ে গেছে বিজলী। রাতে নানান আজগুবি চিন্তা ঘুরপাক খায় অন্তুর মাথায়। পরদিন অনেক দেরী করে ঘুম থেকে ওঠে সে। ক্লাসেও যায় অনেক দেরী করে। রাস্তায় দেখা হয় তুবার সাথে। বান্ধবীদের সাথে দলবেঁধে ক্লাসে যাচ্ছে। অন্তুকে দেখে ভুবনভুলানো মুচকী হাসি দেয় তুবা। ব্রেকফাস্ট না করার ক্ষুধাটাকে ভুলিয়ে দেবার জন্য সে হাসি যথেষ্ট।



সারাজীবনের মনোযোগী ছাত্র অন্তু ব্যাকবেঞ্চে বসে। স্যারের চোখ ফাকি দিয়ে ফেসবুক চালায়। হুতুম পেঁচাকে মেসেজ করে। হুতুম পেঁচা রিপ্লাই দেয় অনেক পরে।

- আমার হাসি যে সুন্দর সেটা আমি জানি। এভাবে ঢোল পিটিয়ে বলার কি আছে?

- তোমার সাথে তোমার ফেসবুক নামটা কেমন যেন খাপছাড়া লাগে

- আমার কাছে খাপ টাপ নেই। থাকলে লাগিয়ে দিতাম!

- নামটা চেঞ্জ কর!

- করব না।

- কেন??

- আমার ইচ্ছা!

বলতে বলতেই হুতুম পেঁচা ‘তাহিয়াত তুবা’ হয়ে যায়। এ কেমন ইচ্ছা পেঁচার? অন্তু খুশি হয়।

- ধন্যবাদ হুতুম পেঁচা

- ভাববেন না আপনাকে খুশি করতে নাম চেঞ্জ করেছি। আপনি না বল্লেও করতাম

- জানি তো! ক্লাস ফাকি দিয়ে ফেইসবুকে কি সারাক্ষণ?

- আমার ক্লাস করতে ভালো লাগেনা

- লক্ষণ খুব খারাপ। বিবাহ সন্নিকটে!

- আমার বিয়ে এত তারাতারি হবে না। তাছাড়া আমার মত পেঁচাকে বিয়ে করবেটা কে শুনি?

- কেন ড্যেরেন সামির চাচাত ভাই!

- আপনার মাথা!

ক্লাসে বসে এমন অনেক কথাই চলে ওদের। চ্যাটিং এ ব্যস্ত অন্তু অ্যাটেন্ডেন্স মিস করে। অনেক রিকোয়েস্ট করার পরও আফজাল স্যার আর অ্যাটেন্ডেন্স দেয় না। তাতে কিছু এসে যায়না অন্তুর। ওর চারিদিকে শুধু একজনই ঘুরঘুর করে। সে তুবা। অন্তু তুবা নামক মেয়েটির প্রেমে পড়েছে। প্রেমে পড়লে প্রেম ছাড়া বাকী সবকিছুই অর্থহীন মনে হয়। সেখানে সামান্য ক্লাসের অ্যাটেন্ডেন্স এর পাত্তা না পাওয়াটাই স্বাভাবিক।



অন্তুর এমন উদাসীনতায় অবাক হয় বন্ধুরা। তারা চেপে ধরে অন্তুকে। সবচেয়ে বেশী চাপাচাপি করে অন্তুর ভার্সিটি জীবনের প্রথম বন্ধু জিসাদ। না, অন্তুর কিছুই হয়নি। কিছু হলে সবার আগে সে তো বন্ধুদেরকেই বলত। কিন্তু অন্তুর কথা বিশ্বাস হয়না বন্ধুদের। বেঁকে বসে লীনা। অন্তু যদি তাদেরকে বিশ্বাসই করতে না পারে তবে তার এ বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই বলে সাফ সাফ জানিয়ে দেয় সে। তুবার কথাটা কয়েকবার বলতে গিয়েও থেমে যায় অন্তু। বন্ধুদের উপর বিশ্বাসের কমতি নেই অন্তুর। কিন্তু এত তারাতারি ওদের জ্বালাতন সহ্য করতে প্রস্তুত নয় সে। যাক না আর ক’টা দিন।



বিকেল থেকে মাথা ব্যাথা করছে অন্তুর। খবরটা তুবাকে এখনও দেয়া হয়নি। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রীয়জনের কাছ থেকে সহানুভূতি আশা করে। অন্তু চায় তুবা তার মাথা ব্যাথার কথা শুনে একটু উদ্বিগ্ন হোক। ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করুক মাথা ব্যাথার সাথে জ্বরও আছে কিনা? একটু সাবধানে থাকার উপদেশ দিক সে অন্তুকে। তুবাকে ফোন করে খবরটা দিতে ইচ্ছে করছে অন্তুর। কিন্তু তুবার ফোন নাম্বার অন্তুর কাছে না থাকায় তা আর হয়ে ওঠে না। কেন যেন ফোন নাম্বারটা আর নেয়া হয়নি, তুবাও তো যেচে দেয়নি। ইগো প্রবলেমটা কারুরই কম না। যাহোক ফেসবুকে তো মেসেজ করতে পারে অন্তু। ফোনের চেয়ে বরং সেটাই ভালো। ফোন রিসিভ না করলে অন্তুর মাথা ব্যাথাটা আরো বাড়তে পারে।

- হুতুম পেঁচার খবর কি?

- হুতুম পেঁচার মাথা ব্যাথা করছে।

আহত হয় অন্তু। টেক্সটা মাথা ব্যথা দিয়ে শুরু করলে কি এমন ক্ষতি হত? মাথা ব্যাথা ইস্যুতে যেন তুবার কাছে হেরে যায় অন্তু।

- কখন থেকে? আমারও বিকেল থেকে মাথা ব্যথা করছে

- ওমা তাই নাকি? আপনার ব্যথা তাহলে আমার কাছে চলে এসেছে! আমার সন্ধ্যা থেকে

- ওষুধ খেয়েছো? জ্বর টর নাই তো?

- আরে ধুর! মাথা ব্যথার জন্য ওষুধ লাগে নাকি? এমনি সেরে যাবে। আপনার খবর কি তাই বলুন?

- আমার কোন খবর নেই।

- না বলতে চাইলে জোড় করব না

- এইতো বুঝতে পেরেছো। বোঝার জন্য ধন্যবাদ

- ওয়েলকাম। কি করছিলেন?

- ফেসবুকে মানুষ কি করে?

- অনেক কিছুই তো করে! গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন না তো?

- সব গোবরে কি পদ্মফুল ফোটে?

- আপনি সব সময় বাঁকা কথায় উত্তর দেন। বিষয়টা খুব একটা ভালো না

- আম গাছ থেকে কাঁঠাল আশা করাটাও কিন্তু অন্যায় তুবা!

- আবার! আচ্ছা বাদ দেন। আমার সাথে প্রেম করবেন?? শর্ত প্রযোজ্য!

আরে বলে কি মেয়েটা! মেয়ের সাহস তো কম না! আগামী ছ’মাসে এমন কথা অন্তুর মুখ দিয়ে বেরোবে কিনা সন্দেহ আছে সেখানে তুবার মত একটা মেয়ে এত তারাতারিই বলে দিল! অন্তু কি রাজী না হয়ে পারে? যেকোন শর্ত মানতে অসুবিধা নেই অন্তুর।

- হু... আমি রাজী!

- কিন্তু শর্ত আছে যে সিনিওর! আমার সাথে প্রেম করতে হলে আমার সাথে কোন প্রকার দেখা করা কিংবা যোগাযোগ করা যাবে না!

- এইটা কিছু হল?

- মজাটা তো এখানেই। কেউ কাউকে দেখবে না জানবে না কিন্তু একটা অদৃশ্য কানেকশন থাকবে। সে কানেকশনই বলে দেবে কে কেমন আছে! ভালো না?

- শুধু ভালো না খুব ভালো! সিনেমা নাটকেও এমন প্রেম দেখা যায় না। আদিম মানুষের মাঝে এমন প্রেম থাকলেও থাকতে পারে! তোমার দাদীকে একটু জিজ্ঞেস করে দেখিও তো তাদের আমলে এমন জিনিসের অস্তিত্ত্ব ছিল কিনা?

- প্রেমের আবার আদিম-আধুনিক কি? আপনার মত বেরস মানুষের সাথে এসব আলোচনা করে লাভ নেই। রাত অনেক হয়েছে। আপনার মাথা ব্যথা করছে আপনি ঘুমান। গুড নাইট! বাই

- তুমি কি করবে?

- দেখি কোন প্রেমিক কে রাজী করাতে পারি কিনা?



কিবোর্ডে BYE টাইপ করে খট করে ইন্টার চেপে দেয় অন্তু। মিনা ছাড়াও জগতে অনেক পাগল আছে। দেখা হবেনা, কথা হবে না শুধু মনে মনে যোগাযোগ হবে! ঘুম আসি আসি করেও আসে না অন্তুর। মাথা ব্যথাটা টিনটিন করে বাড়তে থাকে। মেয়েটা কি সত্যিসত্যিই অনলাইনে বসে প্রেমিক খুঁজবে নাকি?



চার



দেখতে দেখতে গ্রীষ্মের ছুটি চলে আসে। লাইব্রেরীর পেছনের আমগাছটায় শিলা বৃষ্টির পরে যে গুটিগুলো অবশিষ্ট ছিল সেগুলো আজ পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। হালকা বাতাসেই টুপটাপ করে পড়তে থাকে ক্লান্ত আমগুলি। দু’সপ্তাহের জন্য ভার্সিটি বন্ধ হয়ে যায়। অন্তু তুবা দু’জনেই নিজ নিজ বাসায় চলে যায়। বাসায় যাওয়ার পর ফেসবুকে অনিয়মিত হয়ে যায় তুবা। দু-একদিন পর হঠাৎ পাঁচ মিনিটের জন্য উঁকি দিয়ে টুপ করে ডুবে হয়ে যায় সে। অন্তুর মেসেজের উত্তর আসে সাত-আট ঘন্টা পর। কোথায় যেন একটা ছন্দপতনের গন্ধ পায় অন্তু। কিন্তু খুব বিষয়টাকে খুব একটা আমলে আমলে নেয় না সে। একদিন নিজে থেকে মেসেজ করে তুবা। তুবার জীবনে নাকি বিশাল একটা ঘটনা ঘটে গেছে! ভার্সিটিতে ফিরে বিস্তারিত জানাবে সে। অনেক জোরাজুরি করে অন্তু। কিন্তু নাছোড়বান্দী তুবা কিছুতেই বলেনা। সে এটা সারপ্রাইজ হিসেবে রেখে দেয় অন্তুর জন্য।



ভার্সিটি খোলার দু’দিন পর আসে তুবা। বিকেলে তুবাই ফোন করে অন্তুকে। এই প্রথম অন্তুকে ফোন করল তুবা।

- অন্তু ভাইয়া বলছেন?

- জ্বি, কে বলছেন?

- হুতুম পেঁচা!

- তুমি!! ক্যাম্পাসে আসো নি কেন? নাম্বার কোথা থেকে পেলে? আমার মেসেজের রিপ্লাই দাওনি কেন?

- এত গুলো প্রশ্ন একসাথে করলে কি করে উত্তর দেই বলুন? ফেসবুকে নাম্বার দিয়ে রেখে আবার বড় বড় কথা বলে! লাইব্রেরীর পেছনের আমতলায় এখন একটু আসতে পারবেন?

- আমি তো ওখানেই আছি

- ওকে। আমি এখুনি আসছি

এখুনি আসার কথা বললেও প্রায় ত্রিশ মিনিট পর আসে তুবা। দু’মাস আগে যে বেঞ্চটায় অন্তু বসে তুবার সাথে কথা বলেছিল অন্তু আজও সেই বেঞ্চটাতেই বসে আছে সে। তুবাকে দেখে রীতিমত ভিমরী খায় অন্তু। বাছুরের মত টানাটানা চোখ দুটো ছাড়া তুবার সারা শরীর কালো কাপড়ে ঢাকা। তুবা বোরকা আর হিজাব পরে এসেছে। অন্তুর জন্য তুবা বাসা থেকে কি যেন নিয়ে এসেছে! একটা আইসক্রিমের বাক্স খুলে হার্ট আকৃতির পিঠা বের করে তুবা। অন্তুর দিকে একটা পিঠা এগিয়ে দেয় তুবা।

- নেন পিঠা খান!

- কারো হার্ট আমি খেতে পারব না!

- খেয়েই দেখুন না! অনেক টেস্টি। আমি নিজে বানিয়েছি। আম্মু শুধু নারকেল কুড়ে দিয়েছে।

তুবার বানানো পিঠা! অন্তু কি না খেয়ে পারে? কিন্তু এত কিছু থাকতে হার্ট আকৃতির পিঠা কেন? তবে কি তুবা আকারে ইঙ্গিতে বুঝাতে চাইছে সে অন্তুকে ভালোবাসে? মুখ ফস্কে বলে অন্তু-

- এতকিছু থাকতে তোমার হার্ট পিঠা বানানোর ইচ্ছে হল কেন?

- আমাকে কি তাহলে আপনি পিস্তল পিঠা বানাতে বলেন? আমার যুদ্ধ ভালো লাগেনা, ভালবাসতে ভালো লাগে! তাই হার্ট পিঠা বানিয়েছি!

যাক। নিশ্চিত হওয়া গেল মেয়েটা অন্তুকে ভালোবাসে। প্রশান্তির একরাশ ঠান্ডা হাওয়া খেলে যায় অন্তুর মনে। বিশ্বজয়ের আনন্দে বিভোর অন্তু পিঠা মুখে দিয়ে চিবুতে ভুলে যায়।

- কি হল? খাচ্ছেন না কেন? মজা হয়নি?

- তুবা, মেয়ে হিসেবে তুমি কিন্তু খারাপ না

- থাক আর বাতাস করতে হবে না। আমি বাতাসে ফুলি টুলি না! যাকগে, আপনাকে কেন ডেকেছি জানেন?

- পিঠা ভালো হয়েছে!

- জ্বি না জনাব! বড্ড ভুলো মনতো আপনার। সেদিন যে বললাম একটা বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে! ক্যাম্পাসে আসতে না আস্তেই ভুলে গেলেন!

- তুমি তো বললে না

একটু লজ্জ্বা পায় তুবা। ওর হাতের আঙুল গুলো মেলে ধরে অন্তুর সামনে।

- কি বুঝলেন?

- দশটাই তো!

- আপনি আসলে একটা হাদারাম!

হো হো করে হেসে ওঠে তুবা। তুবা এই প্রথম অট্টহাসি হাসল। বা হাতের অনামিকার সোনার আংটিটি দেখিয়ে বলে- ‘এবার বুঝেছেন? আই অ্যাম নাউ ইনগেজড!’

কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যায় অন্তু। বড় একটা ঢোক গিলে মুখে কৃত্রিম হাসি আনার চেষ্টা করে। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ফ্যাসফ্যাস করে বলে-

- ওয়াও! কংগ্রাচুলেশানস! কবে? কখন? কিভাবে??

- হঠাৎ করে! আমাকে দেখতে আসল, পছন্দ পছন্দ করল, আংটি পড়িয়ে চলে গেল!

- আর তুমিও চুপচাপ আংটি পড়লে?

- হুম। বর পছন্দ না হলে পরতাম না! ড্যারেন সামির চাচাত ভাই যে এত সুন্দর হবে ভাবতে পারেনি! থ্যাঙ্কস এমন একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ বাণী করার জন্য!

- ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

সেন্ট্রাল মসজিদ থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসে। তুবা পিঠার বাক্সটা বেঞ্চে রেখে উঠে দাঁড়ায়। ‘আমার জন্য দোয়া করবেন সিনিওর। চেহারার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। চললাম’



তুবা চলে যায়। জড় পিঠার বাক্সটার পাশে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকে অন্তু। তারপর মাতালের মত দুলতে দুলতে নদীর দিকে পা বাড়ায় সে। দুঃসময়ে নদীর থেকে অনেক কিছুই শেখা যায়।



আজ বোধহয় পূর্ণিমা। পূর্ণ চাঁদের রূপোলী আলোয় যেন ঝলসে যাচ্ছে ব্রহ্মপুত্রের সবুজাভ পানি। ইঞ্জিনচালিত নৌকার ভটভট শব্দ করতে করতে কাছে আসে, একটু পর আবার দূরে চলে যায়। একটা ডিঙি নৌকা পাড়ে ভেড়ে। খিলখিল করে হাসতে হাসতে এক যুবকের হাত ধরে একটা মেয়ে নৌকা থেকে নামে। বা চোখটা বন্ধ করে ডান চোখ দিয়ে মেয়েটাকে দেখার চেষ্টা করে অন্তু। মীনা। মনে হয় জ্যোৎস্না স্নান করতে এসেছে। অদূরে দাঁড়িয়ে পাগলী মেয়েটা অন্তুকে চিনতে পেরেছে কিনা কে জানে? হয়তো ভাবছে বেয়াদ্দপ অন্তু তাকে চোখ মারছে। কিছুক্ষণ আগে অন্তুর চোখে একটা ঝাঝালো পোকা পড়েছে। চোখটা খচ খচ করছে অন্তুর। বা হাতের মধ্যমা দিয়ে সজোরে চোখ কচলায় সে। লাল টকটকে চোখ বেয়ে টপটপ করে রক্তের মত পানি পড়ে। বড় শান্তি লাগে অন্তুর। অনেকদিন শত কষ্ট করেও কাঁদতে পারেনি সে। বিজলী মারা যাওয়ার দিন কষ্টে বুকটা ফেটে গিয়েছিল অন্তুর কিন্তু অভাগার চোখ ফেটে এক ফোটা জলও গড়িয়ে পরেনি। প্রাকৃতিক ভাবে যারা কাঁদতে অক্ষম, এমন কৃত্রিম কান্নাও অনেক সময় তাদের ক্ষণিকের প্রশান্তি দিতে পারে।



ডান চোখ দিয়েও কয়েক ফোটা উষ্ণ পানি গড়িয়ে পড়ে অন্তুর! ডান চোখ দিয়ে পানি পড়ে কেন? পোকা তো ডান চোখে পড়েনি অন্তুর!



মন্তব্য ১০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১০) মন্তব্য লিখুন

১| ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৮:৫৭

তাশফিকাল বলেছেন: vai opurbo shundor hoyeche golpo ta..eto kom pothito keno? bujhlam na.. plz lekhalekhi thamaben na.

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:১৫

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ। গল্পে অমিত অন্তু নিয়ে একটু বিড়ম্বনা ছিল। এখন ঠিক আছে।

২| ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ৯:৫৯

হাসান মাহবুব বলেছেন: লেখনীর গুণ আছে। ভালো লাগলো।

(বিজলী গানটা কিন্তু বাচ্চুর না, জেমসের।

রিপ্লে না রিপ্লাই)

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:১৬

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ। ভুল গুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য স্পেশাল ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন :)

৩| ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১০:৫৩

নিষ্‌কর্মা বলেছেন: সুন্দর হয়েছে। অনেক ভাল লাগা।

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:১২

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৪| ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১১:২৬

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:


সিম্পল গল্পগুলো পড়তে বেশ লাগে, লেখাও খুব ভাল লাগল। কিছু কিছু টাইপো আছে ঠিক করে নিয়েন।

++++++ রইল। নববর্ষের শুভেচ্ছা।

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ রাত ১২:১৪

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন :)

৫| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৪ দুপুর ১২:৫৬

শাকিল ১৭০৫ বলেছেন: ভালো হয়েছে গপ্পটা !

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১০:১৪

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.