নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। কালেভদ্রে লিখি :)

মোঃ জুনায়েদ খান

ভোর হয়, সূর্য ওঠে... সেই সূর্যও একসময় রাতের কোলে ঘুমিয়ে যায়। আমিও সূর্যের সাথে উঠি, রাতের কোলে ঘুমিয়ে যাই, মাঝিবিহীন নৌকায় বসে উত্তাল সমুদ্রে নিয়মিত ঘুরপাক খাই, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিদ্যুৎ বেগে দৌড়াই আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে কচ্ছপ বেগে হেঁটে হেঁটে আসি, তারপর চৈত্রের কড়া দুপুরে কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ! কারণ আমার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই!\n\n\nপেশায় ছাত্র। পড়ছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। এইতো..

মোঃ জুনায়েদ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ল্যাপটপ (ছোটগল্প)

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:৪৭

মাওলানা জামিলুর রহমান ওরফে জামিল মাস্টার। জামিলুর রহমান কামিল পাশ করেছিলেন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের বছর দুয়েক আগে। মানে ১৯৮৮ সালের দিকে। পাশ করার পরপরই সদ্য প্রতিষ্ঠিত এক আলিম মাদ্রাসায় শিক্ষকতার চাকুরী পেয়ে যান তিনি। তখন থেকেই মাওলানা পদবীটি উহ্য হয়ে যায় জামিলুর রহমানের। জামিল মাস্টারের চার ছেলে দুই মেয়ে। জমজ মেয়ে দুইটার বিয়ে দিয়েছেন গত বছর। বড় ছেলে এ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে আর ছোট তিনটার দুইটা হাইস্কুলে আর একটা প্রাইমারিতে পড়ছে। পরিবারের কনফিগারেশন দেখলেই বোঝা যায় মাস্টারির স্বল্প বেতনে এ পরিবার চালানো অসম্ভব। তবুও চলছে। পৈতৃক কিছু জমির ফসল আর মাস্টারির আয় এ দুই দিয়েই ভাঙা গরুর গাড়ির মত টেনেটুনে চলছে সংসার। সংসারে অভাব থাকলেও সন্তানদের কিছু বুঝতে দেন না তিনি। তিনি বেঁচে থাকতে সন্তানরা কেন কষ্ট পাবে? তবে ইদানিং তার এক সন্তান একটা ল্যাপটপের অভাবে তীব্র কষ্ট পাচ্ছে।



ঐযে বড় ছেলেটা, ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে এ বছর, জানিয়ে দিয়েছে জরুরী ভিত্তিতে তার ল্যাপটপ চাই। ভার্সিটিতে আন্ডা বাচ্চা সবাই নাকি ল্যাপটপ ব্যবহার করে। একটা ল্যাপটপ ছাড়া পড়াশুনা চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে ওর। ছয় মাস থেকে একই রেডিও বারবার বাজিয়েই চলছে ছেলেটা। কিন্তু জামিল মাস্টার ছেলের কথা মানতে পারে না। আবদার টা অন্যায় মনে হয়। সুখ বেশী হয়ে গেছে ছেলের। পড়তে আবার ল্যাপটপ লাগে নাকি? পড়াশুনা তো তিনিও করেছেন।



বাবার টানাটানির সংসার ছিল। অনেক কষ্ট করে পড়েছেন জামিল মাস্টার। মাদ্রাসায় পড়ার সময় কফিল উদ্দিনের বাসায় লজিং থাকতেন। ভদ্রলোকের দুই নাতি টুনু আর মনুকে পড়াতেন। সকালে পড়ত টুনু। পড়া শেষে ভাত পাঠাত টুনুর মা। মনু পড়ত রাতে। মনুর মা কখনো ভাত পাঠাত আবার কখনো যেচে গিয়ে খেয়ে আসতে হত। তবে দুপুরে কেউ কিছু পাঠাত না। মাদ্রাসা থেকে ফিরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন জামিল মাস্টার। টুনু অথবা মনুর মা’র সাথে দেখা হয়ে গেলে খাবার মিলত, নতুবা না খেয়েই থাকতে হত সেদিন। অনেকে সময় দেখা হয়েও কোন লাভ হত না। টুনুর মা শুকনো কন্ঠে জানিয়ে দিত- ‘আজ খাবার শেষ হয়ে গেছে মাস্টার সাহেব। দোকান থেকে বিস্কুট-টিস্কুট খেয়ে চালিয়ে দিন’। দোকান থেকে খসখসে টোস্ট বিস্কুট এনে পানি দিয়ে ভিজে খেতেন জামিল মাস্টার। তারপর বাঁশের টঙটায় শুয়ে পড়তেন। গোয়ালঘরের মত একটা ছোট ঘর, কোণায় একটা বাঁশের টঙ, একটা লেপ আর লাল রঙয়ের একটা বিছানার চাদর। এটাই ছিল মাস্টারের বেড রুমের চিরাচরিত দৃশ্য। গরমকালে লেপটা তোষক হয়ে যেত আর শীতে খড়ের তোষক বানিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতেন জামিল মাস্টার।



বছর দেড়েক পরে একটা টিউশনি পেয়েছিলেন জামিল মাস্টার। মাদ্রাসা থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে, নোয়াখালী পল্লীতে। ছয় কিলমিটারের এ দীর্ঘপথে প্রতিদিন হেঁটেই যাতায়াত করতেন তিনি। মাস্টারের থাকত ইয়া বড় একটা বুখারী শরীফ। না, ছাত্রকে তিনি হাদিস পড়াতেন না। পড়ানো শেষ হলে গমের রুটি আর চিনি দিয়ে খেতে দিতেন ছাত্রের মা। জামিল মাস্টার সেই শুকনো রুটি বুখারী শরিফে করে লুকিয়ে আনতেন। দুপুরে খিদে পেলে বাঁশের টঙটায় শুয়ে রুটি ছিড়ে মুখে দিতেন আর ছাঁদের কড়িকাঠ গুণতেন।



ছেলেতো এসব জানেনা। ছেলের ল্যাপটপ চাই, নতুন নতুন মোবাইল চাই, মাস ফুরোনের আগে টাকা চাই। অথচ ছেলেটা এমন ছিল না। মুখ ফুটে কোনদিন বলেওনি এটা চাই ওটা চাই। ভার্সিটিতে গিয়ে ছেলের যে কি হল সেটা বুঝতে পারেনা জামিল মাস্টার। জেদহীন ছেলেটা হঠাৎ অনেক জেদী হয়ে উঠল।





- কি দিয়েছেন আমাকে? একটা নতুন সাইকেল পর্যন্ত দেন নি

- তোমাকে আমি জন্ম দিয়েছি

- ইমোশনাল কথা বলবেন না। ছ’মাস থেকে একটা ল্যাপটপ চাচ্ছি। ফকিরও তো এভাবে চায় না

- ফকিরের ল্যাপটপ লাগেনা

- কিন্তু আমার যে লাগবে

- তোমার ল্যাপটপের দরকার কি?

- আছে। আপনি বুঝবেন না। আমাকে ল্যাপটপ দেবেন কি না তাই বলেন?

- দেব তো অবশ্যই। যদি আমাকে বুঝাতে পার ল্যাপটপ ছাড়া পড়াশুনা করা সম্ভব নয় তবে আগামী ঈদেই তোমাকে ল্যাপটপ কিনে দেব




ছেলে বুঝায়, জামিল মাস্টার বুঝেন না। ছেলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। গায়ে মাখে না মাস্টার। বাড়ি ছেড়ে ছেলে আর যাবে কই? জামিল মাস্টারের থিউরি ভুল প্রমাণ করে ছেলে বের হয়ে যায়। একদিন যায়, দুইদিন যায়, তিনদিন যায় ছেলে ফিরে আসে না। রাতে ঘুমান না জামিল মাস্টার। ছেলের বন্ধ থাকা মোবাইলটায় বার বার ফোন দেন। একটা মেয়ে সুরেলা কন্ঠে দুঃখ প্রকাশ করে। জামিল মাস্টারের ব্লাড প্রেসার বেড়ে যায়। রাতে ঘুমান না, মাদ্রাসাতেও যান না। একটা চেয়ার নিয়ে বাড়ির সামনের রাস্তাতায় বসে থাকেন। এই বুঝি ছেলে ফিরে এল! ছয়দিনের দিন ছেলের ফোন আসে। ব্যাকুল হয়ে ফোন রিসিভ করে জামিল মাস্টার। ছেলে ফিরতে চায় না। কেঁদে ফেলেন জামিল মাস্টার। ছেলের যেকোন শর্ত মানতে রাজি হয়ে যান তিনি। রাতের অন্ধকারে ছেলে ফিরে আসে।



তিনমাস অতিবাহিত হয়। টাকা জমান জামিল মাস্টার। টাকা জমেনা, অভাবী সংসারে খরচ হয়ে যায়। ছেলে গো ধরে বসে থাকে। বাড়ি আসে না। জামিল মাস্টার ভেবে কোন কুল কিনারা পাননা। একসাথে এত টাকা কোথায় পাবেন তিনি?



ছোট বাছুর সহ দুধেল গাইটা বিক্রি করলেন জামিল মাস্টার। সাথে যোগ হল একমাসের বেতন আর তিনমাস ধরে জমানো পাঁচ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে পয়ত্রিশ হাজার তিনশত পঞ্চাশ টাকা। সবটুকুই আজ সকালে পাঠিয়ে দিয়েছেন ছেলেকে। ছেলের খুশিমাখা মুখটা কল্পনা করে পুরোদিনটা কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু সন্ধ্যা হতে না হতেই জামিল মাস্টারের সেই ভালোলাগার অনুভূতি ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। ছেলের ফোন আসে। এ টাকায় ছেলের পছন্দের ল্যাপটপ হবে না। চাই আরো পাঁচ হাজার টাকা!



কি করবেন জামিল মাস্টার? ছেলেকে বকাঝকা করে বলবেন-‘ দরকার নেই তোমার পড়াশুনা করার! এক জোড়া হালের গরু কিনে দেই, বাড়ি এসে হাল চাষ কর!’ না, ছেলে তাতে কষ্ট পাবে। এখনকার দিনের ছেলেমেয়েরা অল্পতেই কষ্ট পায়।



বাড়ি থেকে মাদ্রাসায় যাবেন জামিল মাস্টার। বাবার কাছে এসে টাকা চাইলেন। পাঁচ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলেন বাবা।



- বাবা, যেতেই তো পাঁচটাকা লাগবে

- যাওয়ার ভাড়াই তো দিলাম। তোমার আর আসার দরকার নাই!




পাঁচ টাকা হাতে নিয়েই বেরিয়ে পরেছিলেন তিনি। সেদিন কি কষ্ট পাওয়া উচিৎ ছিল জামিল মাস্টারের? ধুর! কি এসব ভাবছে জামিল মাস্টার? ভার্সিটি থেকে ছেলে টাকা চেয়েছে, যে করেই হোক টাকা দিতেই হবে। এখানে তো না বলার কোন অপশন নেই। সবটুকু সইল আর নখটুকু সইবে না? এবার হয়তো বাড়ির সামনের মেহগনি গাছটা বিক্রি করবেন জামিল মাস্টার। ছেলেকে টাকা পাঠাবেন। বাবার পাঠানো টাকায় ছেলে তার পছন্দের ল্যাপটপ কিনবে।



তারপর?



তারপর জামিল মাস্টারের ছেলে ল্যাপটপ নিয়ে প্রোগ্রামিং করবে, ইবুক পড়বে, অ্যাসাইনমেন্ট করবে, পড়তে পড়তে আটকে গেলে গুগল করবে, ডকুমেন্টস ডাউনলোড করবে আর পড়বে, পড়বে আর ডকুমেন্টস ডাউনলোড করবে...। অথবা রাত জেগে স্কাইপি অথবা ফেইসবুকে বসে থাকবে, মুভি দেখবে, মুন্নি-শিলার কোমর দোলানী দেখবে...।



তারপর?



তারপর আর কিছু নেই। ছেলে বাড়ি আসবে। ল্যাপটপ সামনে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকবে। জামিল মাস্টারের ছোট ছেলেটা কৌতূহল দমাতে না পেরে বড় ভাইয়ের ঘরে ঢোকার চেষ্ঠা করবে। বাঁধা দেবে জামিল মাস্টার।



‘ওকে ডিস্টার্ব করিস না। ও পড়ছে...’

মন্তব্য ১৪ টি রেটিং +৫/-০

মন্তব্য (১৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:১৮

শ্রাবণধারা বলেছেন: চমৎকার লিখেছেন.........।

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ :)

২| ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১:৪৬

টাবলীগহেপী বলেছেন: good writing! salam & respect to you.

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৩| ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:১৪

নিয়ামুলবাসার বলেছেন: ভালো লাগলো..

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১০

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৪| ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৪৬

মদন বলেছেন: ++++++++++++

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১১

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ :)

৫| ০৮ ই জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৫১

পাজল্‌ড ডক বলেছেন: এমন পোলার কানের নীচে দেওয়া উচিত,আমার ইচ্ছা করতেছে নিজে গিয়া দিয়া আসি X((

০৮ ই জুলাই, ২০১৪ সন্ধ্যা ৭:১২

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: থাক। পোলা কষ্ট পাবে! :D

৬| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ১:২৭

রাজু মাষ্টার বলেছেন: এমন পোলার ৩ বেলা খাওয়া দাওয়ার বদলে ল্যাপটপ এর সামনে বসাই রাখা দরকার,তাইলে বুঝবো জীবনে কি বেশি খুব দরকারি ! /:)

২২ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৯:৫৮

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: :#) :#) :#) ছেলে তাতেও রাজি হবে!

৭| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ২:১১

শান্তির দেবদূত বলেছেন:
জীবন ঘনিষ্ট লেখা, অনেক আবেগ তুলে এনেছেন চমৎকার ছোট আকারের এই গল্পটিতে; বেশ ভালো লেগেছে। মানুষগুলো, সুন্দর সম্পর্ক্যগুলো দিনদিন কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে!

২২ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ৯:৫৯

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ :) সত্যিই মানুষের সম্পর্কগুলো দিনদিন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে :(

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.