নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। কালেভদ্রে লিখি :)

মোঃ জুনায়েদ খান

ভোর হয়, সূর্য ওঠে... সেই সূর্যও একসময় রাতের কোলে ঘুমিয়ে যায়। আমিও সূর্যের সাথে উঠি, রাতের কোলে ঘুমিয়ে যাই, মাঝিবিহীন নৌকায় বসে উত্তাল সমুদ্রে নিয়মিত ঘুরপাক খাই, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিদ্যুৎ বেগে দৌড়াই আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে কচ্ছপ বেগে হেঁটে হেঁটে আসি, তারপর চৈত্রের কড়া দুপুরে কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ! কারণ আমার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই!\n\n\nপেশায় ছাত্র। পড়ছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। এইতো..

মোঃ জুনায়েদ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প: পলায়ন (সম্পূর্ণ)

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:০৭

(এক)



অনেকদিন পর বৃষ্টিতে ভিজছি। মধ্যরাতে এমন নির্ভেজাল প্রাকৃতিক পরিবেশে এটাই আমার প্রথম বৃষ্টিস্নান। অনুভূতিটাকে মন্দ বলা যায় না। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটু আগে মিটিমিটি করে জ্বলতে থাকা জোনাকি গুলো বৃষ্টির অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আকাশপথ ছেড়ে জলপথ ধরেছে। কেউকেউ আবার মনের দুঃখে কাঁদায় লুটোপুটিও খাচ্ছে। তীব্র বেগে বক্র-বৃষ্টি হচ্ছে। বক্র-বৃষ্টি হলেই আমার ছাতা ধরার অঙ্কটার কথা মনে পড়ে যায়। তবে এখন অঙ্কটার কথা মনে করতে একদম ইচ্ছে করছে না। কারণ এইমুহুর্তে আমার কাছে কোন ছাতা নেই। তবে থুতনী কাঁপানো ঠান্ডা বাতাস বাতাস আছে। থেকে থেকে আমার থুথনীটা ঠকঠক করে কেঁপে উঠছে। পানি পড়ছে নাকি পাথরের গুড়ো পড়ছে এ নিয়ে হালকা কনফিউশনে আছি। চারদিকে ঝুম ঝুম ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। কোনদিকে হাঁটছি বুঝতে পারছি না। তবে সামনে যে এগুচ্ছি এটা মোটামুটি নিশ্চিত। লাল মাটির কাঁদার খপ্পরে পড়ে পাদুকা জোড়াকে অনেক আগেই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছি। শতভাগ খালি পা নিয়ে এবড়ো-থেবড়ো ভাবে পা ফেলছি। প্যাঁচ-প্যাঁচ শব্দ হচ্ছে। আঙুল ভেদ করে কাঁদা ওঠার শব্দ ওটা।



সাথে একটা টর্চ থাকলে মন্দ হত না। আমার হাজার টাকার ফোনটায় অবশ্য একটা উন্নত মানের এলইডি লাগানো আছে। বৃষ্টির বিমুখী আচরণে ওটাকে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। একবার বন্ধ হয়ে গেলেই ঘন্টা বেজে যাবে! অন্তত আগামী দু’ঘন্টার জন্য যন্ত্রটাকে যে করেই হোক চালু রাখতে হবে। বৃষ্টি আসার সাথে সাথেই ওটাকে সামনের পকেট থেকে পিছনের পকেটে ট্রান্সফার করে দিয়েছি। বৃষ্টির সময় পেছন পকেটই মোবাইলের জন্য একমাত্র নিরাপদ স্থান।



এর আগেও এ রাস্তায় আমি কয়েকবার এসেছি। বটতলা মোড় থেকে হেঁটে লিপিকাদের বাড়ি পৌঁছতে বিশ মিনিটের বেশী লাগে না। অথচ নির্ধারিত বিশ মিনিট অনেক আগেই পেড়িয়ে গেছে। এখন অতিরিক্ত সময়ের হাঁটা চলছে। তবে মনে হয়না আর বেশীক্ষণ হাঁটতে হবে না। সবকিছু ঠিক থাকলে আমি আমার গন্তব্যে পৌঁছে গেছি। হ্যা এটাই ‘লিপিকালয়’। বাড়ির নামটা লিপিকার বাবার দেয়া।



এখন একটা গোসল দিতে পারলে খুব ভালো লাগত। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব নয়। বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার্থে মাঝে মাঝে ক্ষুদ্রতর স্বার্থকে বিসর্জন দিতে হয়। আমিও দিলাম। বৃষ্টি কমেছে। ভেজা কাপড়ে লিপিকাদের পেছনবাড়ির বাঁশের টঙটায় গা এলিয়ে দিয়েছি। দেড় কিলোমিটারের এ কাঁচা রাস্তাটা পাড়ি দিতেই আমার চৌদ্দটা বেজে গেছে! লিপিকাকে এখুনি টেক্সট করবো নাকি আরেকটু বিশ্রাম নেব ঠিক বুঝতে পারছি না। পেছন পকেট থেকে ধীরে ধীরে মোবাইলটা বের করলাম। মাঝারী ধরনের একটা লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম! একটা দুইটা না, বিশ বিশটা টেক্সট করেছে লিপিকা! এই মুহুর্তে সবগুলো টেক্সট পড়া সম্ভব না। র‍্যান্ডমলি কিছু পড়লাম। অবস্থা বেগতিক!



নির্দেশনা অনুযায়ী আমি লিপিকাদের বাসার পেছন গেটে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা জিনিসটা এমনিতেই কষ্টকর তারউপর থুথনীর কাঁপাকাঁপি কষ্টটা অসহনীয় করে তুলছে। মেয়েদের ঘড়ির কাটা বোধহয় একটু ধীরেই চলে! রাগ আর বিরক্তি মিশিয়ে যেইনা লিপিকাকে টেক্সট করেছি অমনি স্টিলের গেটটা হালকা ফাঁক করে কুঁচকুঁচে কালো রঙয়ের একটা মূর্তি বেড়িয়ে এলো! পূর্বপ্রস্তুতি না থাকলে নির্ঘাত সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠতাম! ‘ভূউউউউউত!’



আবার সেই পুরনো পথ। হাতে মোবাইল টর্চ, পাশে আপাদমস্তক কালো বোরকায় আচ্ছাদিত লিপিকা। পাশাপাশি হাটছি দু’জন। দু’জোড়া পায়ের দশ জোড়া আঙুল লালমাটির রাস্তায় প্যাঁচ প্যাঁচ করে শব্দ তুলছে। থেকে থেকে আমার থুতনীতে গিটগিট করে শব্দ হচ্ছে। জোনাকীরা জলপথ ছেড়ে আবার আকাশপথে ফিরে এসেছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও মুখ বন্ধ করে নেই! শুধু ব্যতিক্রম লিপিকা! নো সাউন্ড, নো ভ্রূক্ষেপ। হাঁটছে তো হাঁটছেই...







(দুই)



পুরো রাতটা বাসেই কেটেছে। ভেজা কাপড় গায়ের উত্তাপে কখন শুকিয়ে গেছে টেরই পাইনি। ঘুমের মধ্যে আমি স্বপ্ন ছাড়া কিছুই টের পাই না। জ্বর আসার সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর আসেনি। জ্বরও দেখি ইদানিং ভদ্রতা শিখে গেছে! তবে সর্দিটা কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে। বাধাহীন ভাবে সময়ে অসময়ে টপটপ করে পড়ছে।

লিপিকাদের বাসায় কি হচ্ছে কে জানে? মোবাইলটা খোলা থাকলে এতক্ষণে হাজারটা কল আসতো। চার্জ না থাকায় গতরাতে আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে গেছে ওটা। অবশ্য বাস থেকে নেমেই শরিফের ফুল চার্জওয়ালা ব্যাটারীটা সুযোগ বুঝে খুলে নিয়েছি। তবে কেন যেন মোবাইলটা অন করার সাহস পাচ্ছি না। লিপিকাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘বাসা থেকে কেউ ফোন-টোন করেনি?’



‘কাকে করবে? ফোন তো বাসায় রেখে এসেছি!’ লিপিকা সাবলীল ভাবে উত্তর দিয়েছিলো।



এটা মেয়ে না খারাপেত্তা ডাইনী? বাবা-মার জন্য একটুও ফিলিংস নেই দেখছি। অন্য কোন মেয়ে হয়ে এতক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানিতে ভাটা ফেলে দিত। আর সেখানে লিপিকা নির্বিকার! আত্নস্বার্থের জন্য মাঝে মাঝে পরিবারের মত দৃঢ় বন্ধনটাও ঠুনকো হয়ে যায় নাকি? গত মাসে লিপিকাকে ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল। ছেলে সুদর্শন, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। লিপিকাকে ছেলের মনে ধরেছে। বাবা-মারও আপত্তি নেই বিয়েতে। একেবারে পাক্কা কথা দিয়েছেন লিপিকার বাবা। লিপিকা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করেছে। কেঁদে বালিশ ভাসিয়েছে, ভাতের বদলে পানি খেয়ে রাত কাটিয়ে দিয়েছে। তবুও বরফ গলেনি। বরফ যখন গলবেই না তখন আর বৃথা চেষ্টা করেনি লিপিকা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দু’দিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়েছে সে।



লিপিকাকে সকাল সকাল মণিদের বাসায় চালান করে দিয়েছি। মণিদের বাসা বলতে মণিদের ফ্যামিলি না। কয়েকজন বান্ধবী নিয়ে একটা ভাড়া বাসায় থাকে ওরা। শুধুমাত্র এ সুবিধাটুকুর জন্যই ময়মনসিংহ আসা। সাজুগুজু থেকে শুরু করে কাজী অফিস যাওয়া পর্যন্ত যাবতীয় কাজ ওদের।



কাজী অফিসের ঝামেলাটা লাকু সামলাবে। কেওয়াটখালীতে ওর পরিচিত এক কাজী সাহেব আছেন। অল্প খরচেই নাকি সব সেরে দিবেন। অল্প মানে স্বল্প না। রেজিস্ট্রি থেকে শুরু করে সব মিলিয়ে পনের হাজার টাকার বাজেট লাকুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন কাজী সাহেব!



লাকুর কথা মনে হতেই তড়িঘড়ি করে মোবাইলটা অন করলাম। দু মিনিটের মধ্যেই লাকুর ফোন এলো। প্রথম ত্রিশ সেকেন্ড অধোবদনে ওর কাউয়া কন্ঠে নন-স্টপ গালী শুনলাম। আমি নাকি মানুষের জাতের মধ্যেই পরিনা! ওর গালির প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিতে ইচ্ছে করছে! “Who am I?” – Feeling confused! কিন্তু লাকু সেটাও হতে দেবে না। দশ মিনিটের মধ্যেই কায়সারকে নিয়ে কাজী অফিস পৌঁছানোর আল্টিমেটাম দিয়েছে সে!



শুভ কাজে দেরী করতে নেই। তবে অনিচ্ছা সত্বেও কাজী অফিস পৌঁছতে অনেক দেরী হয়ে গেলো। দেরীর কারণ অবশ্য আমি না, কায়সার। শালা পাঞ্জাবী ছাড়াই এসেছে!



মানুষ বেশী না, তারপরও ছোট্ট কাজী অফিসটা মানুষে গিজগিজ করছে। শুভাকাঙ্ক্ষীর অভাব নেই। অভাব শুধু স্বাক্ষী আর উকিলের। এসব বিয়েতে মানুষ স্বাক্ষী দিতে ভয় পায়। আইনের মারপ্যাঁচে কি থেকে হঠাৎ কি হয়ে যায় কে জানে! কিছুক্ষণ দ্বিধায় থেকে অবশেষে লাকু আর পিয়াল রাজী হয়েছে। লাকু কণে পক্ষের স্বাক্ষী দেবে আর পিয়ার বরপক্ষের। কিন্তু উকিল পাওয়া যাচ্ছে না। উকিল হতে হবে অভিভাবক মহল থেকে! মেয়ে যেহেতু আমার তত্ত্বাবধানেই এসেছে সেহেতু আমিই মেয়ের অভিভাবক! ওকালতি না পড়েও শুধু মনে হয় এই একটা ক্ষেত্রেই উকিল হওয়া যায়। শুধু উকিল না, উকিল বাবা!



বিয়ে সহি সালামতেই হয়ে গেলো। জীবনে প্রথমবারের মত বাবা(উকিল বাবা) হওয়ার আনন্দে শব্দ করে রসগোল্লা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ করেই পকেটে রাখা ফোনটা হুংকার দিয়ে উঠলো! ভোঁ... ভোঁ...



যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই!



‘Lipika Calling ... …’





(তিন)



আমি এখন লিপিকাদের বাসায়। লিপিকাদের বাসায় আমার আনাগোণা কম থাকলেও ওদের বাসার প্রতিটা মানুষ আমাকে খুব ভালো করেই চেনে। শুধু চেনেই না, খাতিরও করে। সব লিপিকার কল্যাণে। আমার গুণকীর্তন করতে করতে বাড়িসুদ্ধ লোকজনের কান-মাথা ভারী করে ফেলেছে মেয়েটা। বিনিময়ে সে বড় ধরনের একটা সুবিধা ভোগ করে এসেছে এতদিন। আমার নাম ভাঙিয়ে কায়সারের সাথে চুটিয়ে প্রেম করেছে। ‘হ্যালো, সাদিব...’ বলে কথা শুরু করলেই আর বাবার শোকোজের মুখোমুখি হতে হতো না ওকে। লিপিকাদের বাসায় আমার রেপুটেশনটা এরকমই। লিপিকা সংক্রান্ত যেকোন সমস্যায় আমি নাক না গলালে যেন সমাধানই হবে না! লিপিকা যখন বিয়ের শোকে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো তখন আমার দু’মিনিটের ফোনালাপটাই কিন্তু লিপিকা ডাইনিং টেবিলে নিয়ে গিয়েছিলো!



অভিনয়ে তেমন পারদর্শী না হলেও গতকাল থেকে ছোটখাটো অনেকগুলো অভিনয়ই করতে হয়েছে আমাকে। জানি লিপিকা ফোনটা করেনি তারপরও বলেছিলাম, - ‘লিপিকা বলো...’। লিপিকার বাবা গদগদ কন্ঠে মেয়ে পালানোর খবরটা জানিয়েছিলেন। আমি চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম - ‘কখন? কিভাবে?? আমাকে জানান নি কেনো???’ তারপর ভদ্রলোককে অভয় দিয়ে বলেছিলাম, ‘পালিয়ে আর যাবে কই? আমি আসছি...’



বাসাটা শোকে স্তব্ধ হয়ে আছে। লিপিকার মা তো একটু পরপরই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ‘যেখান থেকে পারো আমার মেয়েকে এনে দাও! তোমার জন্য মেয়ে পালিয়েছে’ বলে বারবার লিপিকার বাবাকে দুষছেন ভদ্রমহিলা। মাসরুর আহমেদ নিরব। মেয়ে যে পরিবারের মুখে এভাবে চুনকালী লাগাবেন সেটা তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন নি। লিপিকার ছোটবোন টার চোখ দুটো টকটকে লাল। ফর্সা মুখ আর লাল চোখে ভালোই লাগছে ওকে। সকাল থেকে কয়েকবার ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়েছে। মেয়েটা ওভাবে তাকায় কেন?



লিপিকার নিখোঁজ হওয়ার এখন পর্যন্ত চাউর হইনি। তবে হবে। দ্রুত লিপিকার খোঁজ না মিললে খবর টা এক কান থেকে দুই কানে যাবে, দুইকান থেকে চার কান তারপর কানে কানে বহুকান হবে। এরকম কিছু ঘটে গেলে মাসরুর আহমেদ মানুষকে মুখ দেখাতে পারবেন না! তার আগেই মেয়ের খোঁজ চান তিনি। অসহায় মুখ নিয়ে কয়েকবার আমার রুমে হানা দিয়েছেন ভদ্রলোক। প্রতিবার ঐ একটি প্রশ্নই করেছেন, – ‘কোন খোঁজ পেলে বাবা?’



আমি ইচ্ছে করলেই যেকোন সময় লিপিকার খোঁজ দিতে পারি। কিন্তু তাতে চোর ধরা পড়ার ভয় আছে। তাছাড়া এ বাড়িতে লিপিকার অবস্থান পুনরায় নিশ্চিত না করা পর্যন্ত আগেভাগে খোঁজ দেই কি করে?



দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল এখন পর্যন্ত খাবারের জন্য আমার ডাক আসেনি। লিপিকার বাবা-মা না হয় টেনশনে আছেন, তাই বলে বাড়িতে কি আর মানুষ নেই? শুধু চোখ লাল করে থাকলেই যে বোনের খোঁজ যে মিলবে না সেটা ঐ মেয়েটার বোঝা উচিৎ। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। লিপিকার খোঁজ পাওয়া না পর্যন্ত এরা খাবার দেবে না নাকি?



পেটের চিৎকার চেঁচামেচি সহ্য করতে না পেরে খুব দ্রুত নিউজ ব্রিফিং এর আয়োজন করলাম। হাসিহাসি মুখ নিয়ে জানিয়ে দিলাম ‘আংকেল! লিপিকার খবর পাওয়া গেছে’!

তারপর গলা নামিয়ে বললাম, ‘ওরা তো বিয়ে করে ফেলেছে!’ প্রথম খবরটা মাসরুর আহমেদকে স্বস্থি দিলেও দ্বিতীয় খবরটা তুমুলভাবে রাগিয়ে দিল ভদ্রলোককে। মেয়ের জন্য বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ করবেন তিনি। এবার ঈদে গরুর বদলে মেয়েকেই আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানি দেবেন। ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই বললেন তিনি। এমন ভয়ংকর প্রতিক্রিয়ার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। ব্যাকআপ থাকলে বোধহয় মানুষের কনফিডেন্স লেভেল আপনাআপনিই বেড়ে যায়! পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে ভয়ে ভয়ে বললাম, -

‘লিপিকা নিঃসন্দেহে অনেক খারাপ কাজ করেছে। তবে লোক জানাজানি হওয়ার আগে বিষয়টা ধামাচাপা দেয়াই মনে হয় ভালো হবে। সবার আগে পরিবারের সম্মান। তবে মেয়ে যখন আপনার, ডিসিশনও আপনার।’



প্রস্তাবটা লিপিকার মার পছন্দ হলো। কিন্তু লিপিকার বাবা সায় দেবেন কেন? বরের বাবাকে যে তিনি পাক্কা কথা দিয়েছেন! লিপিকার মা ফিসফিস করে মাসরুর আহমেদের কানেকানে কি যেন বললেন। অতঃপর রাজী হলেন ভদ্রলোক। ঠিক আছে মেয়েকে মেনে নেবেন তিনি। তবে আবার ধুমধাম করে বিয়ে হবে লিপিকার!



লোক দেখানোর জন্য দুনিয়াতে কত কিছুই না করতে হয়! মনের অজান্তেই হেসে ফেললাম। দেখি লাল চোখওয়ালা মেয়েটা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার সমস্যা কি? এভাবে তাকায় কেন???



এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরেছে লিপিকার মার। ‘মা রেণুকা, কই গেলি? ছেলেটা সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি! ওকে খেতে দে...’



সন্ধ্যা হতে খুব একটা দেরী নেই। আজকেও বৃষ্টি হচ্ছে। আমি ডিম ভাজি আর বেগুনের ঝোল দিয়ে ইফতার করছি! কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রেণুকা। না, এভাবে চুপচাপ কারো চোখ রাঙানী সহ্য আর সম্ভব না। কিছু বলা উচিৎ মেয়েটাকে।



- ‘আচ্ছা তুমি এভাবে আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে থাকো কেন?’

- ‘আপনি নাটক টা না করলেও পারতেন’

- ‘কিসের নাটক?’

- ‘নিজেকে এতোটা স্মার্ট ভাবিয়েন না। আপুকে যে আপনিই পালিয়ে নিয়ে গেছেন সেটা আমি জানি!’

- ‘মানুষকে এমনি এমনি সন্দেহ করা কিন্তু ঠিক না!’

- ‘আপনি কি চান এসএমএস টা আমি আব্বুকে দেখাই?’



রেণুকার শান্ত কন্ঠের হুমকী বুকের ভেতর হালকা একটা কাঁপন তুললো। মুখের ভেতরের শক্ত চাল সেদ্ধ গুলো কেন যেন আরো শক্ত মনে হচ্ছে। মেয়েটা তাহলে সবই জানে। কিন্তু কাউকে কিছু বলেনি কেন?



‘কি হলো খাচ্ছেন না কেন? ভয় পেয়েছেন?’ রেণুকার চোখে বিশ্বজয়ের আনন্দ!

নিজের অজান্তেই মাথাটা বারকয়েক আপ-ডাউন করলাম।



খিল খিল করে হেসে উঠল রেণুকা!



মেয়েটা আমার সাথে এমন করে কেন???





(চার)



ধুমধাম করে লিপিকার দ্বিতীয় বিবাহ সুসম্পন্ন হলো। ‘উকিল বাবা’ এর পদ থেকে আমাকে জোরপূর্বক অব্যাহতি দেয়া হলো। আমার স্থলাভিষিক্ত হলেন লিপিকার বড় মামা জনাব আজগর আলী। মামার মাথায় চুল না থাকলেও লাদেনের মত মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি আছে। চুল-দাড়ি না পাকলে নাকি ‘উকিল বাবা’ হওয়া যায় না! তাই নির্বাচন কমিশন উকিল হিসেবে মামাকেই নির্বাচিত করেছে! আমি বলি নির্বাচনে যথেষ্ট কারচুপি হয়েছে! আমার দাড়ি না পাকলেও, মাথার পেছনের দিকে কয়েকটা চুল কিন্তু ঠিকি পাকা ছিলো! এ বিয়ে আমি মানিনা!



যত সহজ ভাবছেন বিয়েটা কিন্তু তত সহজে হয়নি। সব মিলিয়ে গুণে গুণে একশত ষোল দিন সময় লেগেছে। মেয়ে পক্ষের কোন সমস্যা ছিলো না। মেয়ের বিয়ের জন্য সবকিছু তো প্রস্তুতই ছিলো মাসরুর আহমেদ এর। সমস্যা দেখা দিলো কায়সারের বাবা কে নিয়ে। ছেলে যে বিয়ে করেছেন এ খবরটাই ভদ্রলোক জানেন না। অনাকাঙ্ক্ষিত গোলযোগ এড়াতে তাকে আর নতুন করে জানানো হয়নি। বুদ্ধিটা এসেছিলো পাভেলের মাথা থেকে। সে একটা ভালো ঘটককে হাত করার পরামর্শ দিয়েছিলো। এরপর ঘটকই সব করেছেন। নতুন করে আবার এনগেজমেন্টও হয়েছে ওদের। আমি বসে বসে শুধু সিনেমা দেখেছি!



কমেডি সিনেমাটা যে হঠাৎ করে ট্রাজিক মোড় নেবে কে জানতো? বাবা-মাকে নিয়ে খেতে বসেছে নবদম্পতি। সাথে মাঝ বয়সী এক অচেনা ভদ্রলোকও আছেন। আমি খাবার পরিবেশন করছিলাম। লিপিকার বাবা নতুন বেয়াইকে হবু বেয়াই এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন! আমি চোখ বড় বড় করে তাকালাম। ‘ইহা সেই ইঞ্জিনিয়ায়ের বাবা, যাহার পুত্রের সহিত লিপিকার বিবাহ ঠিক হইয়াছিলো!’ ইঞ্জিনিয়ারের সাথে এবার রেণুকার বিয়ে! ইঞ্জিনিয়ার পরিবার কে দেয়া পাক্কা কথা রাখতেই লিপিকার বাবা এ অকাজটা করেছেন। সেদিন কানেকানে কি এ কুবুদ্ধিটাই দিয়েছিলেন লিপিকার মা?



কোথায় যেন একটা ছন্দপতন অনুভব করলাম। রেণুকাকে আমি বাস্তবিকই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। মেয়েটার কটমট চাহনীতে কেমন যেন একটা ভালোলাগা লুকায়িত ছিলো। আমি উপেক্ষা করতে পারতাম না। এ চারমাসে কমপক্ষে হাজার পাঁচেক বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে আমাদের। দু চারদিন লুকিয়ে লুকিয়ে কথাও হয়েছে। তবে প্রেমালাপ হয়নি। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে দ্বিবীজপত্রী ছোলা বীজটা যখন কেবল একটু একটু করে অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে ঠিক তখনি লিপিকার বাবার কচি চারার জুস খাওয়ার শখ হলো! মানলাম কচি চারায় উপকারী এনজাইম থাকে। তাই বলে শুধুমাত্র এনজাইমের লোভে একটি চারার অনাগত ভবিষ্যতকে ব্লেন্ড করা কোন ধরণের মানবিকতা?



আগত বিরহ ব্যাথায় খুব তারাতারিই আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। উদাস উদাস একটা ভাব চলে এলো চেহারায়। আকাশ আর নদীর প্রতি আগ্রহটাও বেড়ে গেলো অনেকগুণ। খেতে ইচ্ছে করেনা, ঘুমোতে ইচ্ছে করেনা, শুধু খোলা আকাশের নিচে বসে চিৎকার করে গাইতে ইচ্ছে করে। বিয়েতে সবাই রাজী। লিপিকালয়ে সারদিন ধরে এখন ইঞ্জিনিয়ারের গুণকীর্তন চলে। এমন সুপাত্র কি আর চাইলেই পাওয়া যায়? লম্বা ফর্সা, ঢাকায় বাড়ি আছে, নিজের গাড়ী আছে... আর কি চাই? মাঝে মাঝে মনে হয়ে বিয়েটা ভেঙে দেই! কিন্তু তাতে লাভ কি? আমি তো আর সুপাত্র না। বেকার ছেলেরা কোনদিন সুপাত্র হতে পারে না।



রেণুকার বিয়ে আমার স্বাভাবিক জীবনকে অস্বাভাবিক করে তুললেও রেণুকা পুরোদস্তুর স্বাভাবিক। এখনো মাঝে মাঝে আমাকে টেক্সট করে সব বলে দেয়ার হুমকী দেয়। সব বিষয়েই কথা বলে শুধু বিয়ের বিষয় ছাড়া। আমিও বিষয়টা তুলি না। তুলবোনা তুলবোনা করে একদিন বিয়ের বিষয়টা তুলেই ফেললাম।



- ইঞ্জিনিয়ারের বউয়ের বিয়ে কবে?

- আমার কি আগেও বিয়ে হয়েছিলো নাকি?

- তা হয়নি তবে হবে তো!

- ও দাওয়াত নিয়ে টেনশন করছেন তো? ঠিক সময়ে পেয়ে যাবেন!

- আচ্ছা রেণুকা, বিয়েটাতে তুমি কি খুশি?

- শুধু খুশি না মহাখুশি! আপনার আগেই আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে! আমি সিনিয়র হয়ে যাচ্ছি! হে হে হে

- এতে হাসির কি হলো?

- হাসবো না? এখন থেকে আপনি আমাকে ‘আপনি’ করে সম্বোধন করবেন। ওকে?



লিপিকালয়ে থেকে আর কি লাভ? যেটুকু দ্বিধা ছিল সেটুকুও আজ কেটে গেলো। বেকার বলে তো আর নিষ্কর্মা নই? লিপিকার বিয়ে তো শেষই। চলে যাই। সেটাই বরং ভালো হবে।



(পাঁচ)

আবার সেই পুরনো পথ। অন্ধকারটা চারমাস আগের মত ঘুটঘুটে না, ঝকঝকে। আকাশে চাঁদ তার স্বমহিমায় উজ্জ্বল। জোনাকীরা মরিচবাতীর মত একবার জ্বলছে আর একবার নিভছে। ঝিঁ ঝিঁ পোকারাও বসে নেই। কাদার প্যাঁচ প্যাঁচ শব্দটাকে খুব মিস করছি। বৃষ্টিভেজা ঠান্ডা বাতাস নেই, তবুও কেন যেন থুতনীটা আজকেও গিটগিট করে কাঁপছে।



পাশাপাশি হাঁটছি দুজন। হাতে ছোট্ট একটা ট্রাভেল ব্যাগ। পাশে আপাদ মস্তক কালো বোরকায় আচ্ছাদিত রেণুকা। মেয়েটার মুখে আজকে যেন খই ফুটছে...



মন্তব্য ৪ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১১:৪০

বকুল০৮ বলেছেন:
এক কথায় দারুণ লাগলো!
অনেক শুভেচ্ছা!

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:৩২

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই :)

২| ০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:২৩

মফিজ বলেছেন: ভাল।২জোড়া পায়ে কি ২০ জোড়া আঙ্গুল?থুতনী হবে?

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১:২৯

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। ঠিক করে দিয়েছি :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.