নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। কালেভদ্রে লিখি :)

মোঃ জুনায়েদ খান

ভোর হয়, সূর্য ওঠে... সেই সূর্যও একসময় রাতের কোলে ঘুমিয়ে যায়। আমিও সূর্যের সাথে উঠি, রাতের কোলে ঘুমিয়ে যাই, মাঝিবিহীন নৌকায় বসে উত্তাল সমুদ্রে নিয়মিত ঘুরপাক খাই, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিদ্যুৎ বেগে দৌড়াই আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে কচ্ছপ বেগে হেঁটে হেঁটে আসি, তারপর চৈত্রের কড়া দুপুরে কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ! কারণ আমার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই!\n\n\nপেশায় ছাত্র। পড়ছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। এইতো..

মোঃ জুনায়েদ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প: মেয়েটা (সম্পূর্ণ)

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ২:৫৭



এক

আচমকাই দেখা হয়েছিলো মেয়েটার সাথে। ডিম বিক্রেতার মতন দিবা স্বপ্নে বিভোর হয়ে হাঁটছিলাম। আর ক’দিন পর পড়াশুনা শেষ হবে। তারপর শুরু হবে চাকুরীর জন্য দৌড়ঝাঁপ! লটারীর টিকেটের মত আবেদন পত্র কিনেই যাব প্রতিদিন। “যদি লাইগা যায়!” এর আশায় শুরু হবে দিনগোণা। হুট করে হয়তো একদিন লেগেও যাবে। কাগজ ভর্তি মানি ব্যাগে টাকা ঢুকবে, বাড়ি হবে, গাড়ি হবে, তারপর সুন্দর একটা বউ... ...! না, বউ পর্যন্ত বোধহয় যাওয়া হয়নি। তার আগেই বাগড়া বাঁধায় মেয়েটা। বাঁশ ফাটা গলায় চিৎকার করে ওঠে! পেছন ফিরে তাকানোর আগেই দেখি ভার্সিটির নীল রঙয়ের বাসটা আমার ডান কাঁধের ইঞ্চি দুয়েক দূর দিয়ে সাঁই করে চলে গেল। কলিজাটা লাফ দিয়ে উঠে বুকের পাঁজরে ধাক্কা দিল কয়েকবার! ডানে বায়ে বারকয়েক তাকানোর পর নিজেকে যখন মাঝ রাস্তায় আবিষ্কার করলাম মেয়েটা ততক্ষণে আমার কাছাকাছি চলে এসেছে।



“সুইসাইড করার খুব সখ হইছে না?”



কলিজার কাঁপন তখনো থামেনি। জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। মুখ যেন আমার সুপার গ্লুতে আটকানো। কথা বেরুলো না।



“এই যে জনাব! কান দিয়ে কিছু ঢুকেছে?”



আমি এবার সরাসরি মেয়েটার দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ আগে সমূহ দূর্ঘটনার ভয় এখনো সে কাঁটিয়ে উঠতে পারেনি। এক জোড়া ভয়ার্ত চোখে কৌতূহলী প্রশ্ন। আমি ওর ডাগর কালো চোখ জোড়ার ভিতরে ঢুকে সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজেতে লাগলাম। “আমার কি সত্যিই সুইসাইড করার সখ হয়েছে?”



ছোট বেলায় অনেক কিছুরই সখ ছিলো। একবার দুই টাকার পয়সার ভূত মাথায় চেপেছিলো। যেখানেই দুইটাকা পয়সা পেতাম যেকোন মূল্যে হস্তগত করতাম। মাঝে মধ্যে দ্বিগুণ মূল্য দিয়েও কিনতাম সে পয়সা! বয়স বাড়ার সাথে সাথে সখগুলো লেজ গুটিয়ে নেড়ি কুত্তার মত পালিয়ে গেছে। বহুকাল পরে সেই পালিয়ে যাওয়া সখ আবার হুট করে উদয় হলো কোত্থেকে? তাও আবার যেন তেন সখ না, সুইসাইড করার সখ!



অবাকমাখা কন্ঠে একটু জোরেই বলে ফেললাম, - “নাতো!”



“কি নাতো? শুনতে পাননি? স্বাভাবিক! বাসের হর্ন যার কানে ঢোকে না তার থেকে এর চেয়ে বেশী আশা করা যায় না” মেয়ের কন্ঠে তাচ্ছিল্যের আভাস।



অপরিচিত রমণীর উদ্বেগমাখা কণ্ঠে আলাপচারিতায় খারাপ লাগছিলো না। কথা চালিয়ে গেলাম...



- স্বার্থপর এ পৃথিবীতে বেঁচে থেকে কি লাভ বলুন?

- লাভ নেই। যান এক্ষুণি বাসের নিচে চাপা পরে মরেন গিয়ে!

- যেতেই তো চেয়েছিলাম। থামালেন কেন?

- আপনার মত স্বার্থপরদের জন্যই পৃথিবী স্বার্থপর। যারা বেঁচে থাকতেও লাভ খোঁজে, মরার মাঝেও লাভ খোঁজে।

- কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে...

- ও... আপনাকে বুঝি সাপে কেটেছে? কই দেখি দেখি...

- আমি ফাইজলামি করছি না। সবাই যদি সবার ইমোশন বুঝতো তবে তো হতই...

- সরি। আপনাকে হার্ট করার আমার কোন ইনটেনশন নেই।

- তবুও তো করছেন! পৃথিবীটা সবার জন্য সুখস্বর্গ নয়...

- তাই বলে সুইসাইড করবেন? কত লোক না খেয়ে রাস্তার পাশে পরে আছে, কত ছোট ছোট বাচ্চা পেটের দায়ে রিক্সার প্যাডেলে পা দিচ্ছে সে খবর আপনি রাখেন? কই তারা তো কষ্টের দোহাই দিয়ে সুইসাইড করছে না! আরে সুইসাইড তো কাপুরুষরা করে!...

- গ্রেট স্পিস! অনেকগুলো হাততালি আপনার জন্য! আচ্ছা আপনাকে কে বলল আমি সুইসাইড করবো?

- মানে??

- কিছু না। তুমি মেয়েটা অনেক কেয়ারিং। সংসার জীবনে শাইন করবে! আর বাঁশ ফাটা কণ্ঠে সুমিষ্ট চিৎকারের জন্য ধন্যবাদ!



ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল মেয়েটা। কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে একবার তাকিয়ে হনহন করে চলে গিয়েছিল। একবারের জন্যও ফিরে তাকায়নি।







দুই

মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে হুট করেই কিছু মন খারাপের ক্ষণ চলে আসে। ঘটনা ভেদে মনখারাপের তীব্রতাতেও তারতম্য ঘটে। দুই এর সাথে দুই যোগ করলে চার না হয়ে যখন তিন বা পৌনে তিন হয়ে যায় মন খারাপের ঘটনাগুলো ঠিক তখনি ঘটে। ধরে নিন জীবনের ফার্স্ট টাইম আপনি খিচুড়ি রাঁধছেন। কালার, ফ্লেভার টেস্ট সবকিছু ঠিকঠাক। আর দুইমিনিটের মধ্যেই আপনার খিচুড়ি হয়ে যাবে। সবাইকে তাক করে দেবেন আপনি। ফাইনাল টেস্টিং এর জন্য ঢাকনা খুললেন আর অমনি কোত্থেকেএকটা গোবরে পোকা উড়ে এসে আপনার খিচুড়ির পাতিলের মধ্যে আত্নাহুতি দিলো! কেমনটা লাগবে?



শুরুটাতে প্রচন্ড রাগ লাগলেও একটু পর কিন্তু ঠিকই মন খারাপ হবে আপনার। আমারও সেদিন মন খারাপ ছিলো। সাতদিন ধরে করা এক্সপেরিমেন্ট শেষ মুহুর্তে এসে ইন্সট্রুমেন্টাল ইররের জন্য পন্ড হয়ে গিয়েছিলো। প্রচন্ড মন খারাপের অনুভূতি নিয়ে জালাল ভাইয়ের এর চায়ের দোকানে বসে ছিলাম। প্রিয় আদা চা টাও বিস্বাদ লাগছিল।



মেয়েটা কখন এসেছে টের পাইনি।



‘এই যে চাখোর! আপনি চা খাচ্ছেন নাকি বিষ খাচ্ছেন?’



আমি হকচকিয়ে শব্দ উৎসের দিকে তাকালাম। মেয়েটা তখন প্রায় খালি চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়ে ফেলেছে।



মুখ থেকে বাই ডিফল্ট সবচেয়ে কমন প্রশ্নটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বেড়িয়ে এলো- ‘আপনি! আপনি এখানে কি করছেন?’



‘সিনেমা দেখতে এসছি! দেখছেন না টিভিতে কেমন ঢিসুম ঢিসুম রোমান্টিক সিনেমা হচ্ছে’- জালাল ভাইয়ের দোকানের সিলিঙয়ের একটু নিচে সেট করা সাদাকালো টিভির দিকে তাকিয়ে বললো মেয়েটা।



‘ও... তাহলে দেখেন’ - বলে দায়সারা একটা উত্তর দিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চার টেম্পারেচার বিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেরও নিচে নেমে গেছে।



মেয়েটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিভির দিকে তাকাতে বাধ্য হলো। একমিনিট পূর্ণ হতে না হতে টিভি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো সে। তারপর সরাসরি আমার নাক বরারবর তাকিয়ে কিছুটা তিক্ততা মিশিয়ে বলল, - ‘আচ্ছা আপনার সমস্যাটা কি? চায়ের দোকানে কি কেউ সিনেমা দেখতে আসে?’



আমি বললাম, - ‘মসজিদে কিন্তু চোর চুরি করতেই যায়!’



মেয়েটার কন্ঠে তিক্ততার সাথে কিছুটা ঝালও যোগ হলো- ‘হোয়াট ডু ইউ মিন??’



কষ্টের মাঝেও হাসি চলে এল। হাসিটাকে নিয়ন্ত্রণ করে গম্ভীর মুখে বললাম,- ‘নাথিং সিরিয়াস। জাস্ট এন্সার্ড ইউওর কোশ্চেন।’

মেয়েটার কণ্ঠ গিরগিটির মত বদলে গেলো। নিচু স্বরে বললো,- ‘আপনার কি খুব মন খারাপ?’



‘তা জেনে আপনি কি করবেন? পত্রিকায় ছাপবেন?’ – মুখ ফোঁসকে বলে ফেললাম।



‘এইযে দেখুন আমি কিন্তু আপনার সাথে খুব নম্র ভাবে কথা বলছি। আপনি এমন হিল জুতার মত খট খট করছেন কেন?’ অভিমানের সুরে বলল মেয়েটা।



আমিও আমার অবস্থান থেকে সরলাম না। - ‘আপনার উদ্দেশ্যটা কি বলুন তো? হঠাৎ আমার পিছু নিলেন কেন?’



মেয়েটা কোন প্রতিক্রিয়াই দেখাল না। উলটো আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘হাঁটবেন আমার সাথে?’



চোখে মুখে বিস্ময় মেখে তাকালাম মেয়েটার দিকে। কিছু বললাম না। মেয়েটাই বলল, - ‘আপত্তি আছে নাকি ভয় পাচ্ছেন?’



দ্বিধা কাঁটিয়ে বললাম, - ‘চলুন...’



হাঁটার জন্য বেড়িয়ে পড়লেও খুব বেশীদূর হাঁটা হলোনা। বোটানিক্যাল গার্ডেনের সামনে এসে থেমে গেলাম আমরা। মেয়েটার দ্বিতীয় অনুরোধে বসতে হলো ওরই প্রীয় এক জায়গায়। আহামরি কিছুনা। ঝাউ গাছের নিচে একটা কংক্রিটের বেঞ্চ। পূর্ব দিকে মুখ করে বেঞ্চটায় বসলে নদী দেখা যায়। টুকটাক অসংলগ্ন কথা তো চলছিলই...





‘বললেন না তো?’



‘কি বলবো?’



‘কি হয়েছে? গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া?’



‘গার্লফ্রেন্ড থাকলে তো!’



‘তো?’



‘তো কিছু না।’



‘কিছু না তো একঘন্টা ধরে চা খাচ্ছিলেন কেন?’



‘এমনি...’



‘বলার মত না হলে বলতে হবে না। জানেন, মন খারাপ ওয়ালা মানুষ দেখলে আমার না খুব খারাপ লাগে। কিন্তু তাদের জন্য কিচ্ছু করতে পারিনা। আসাদের মা মারা যাবার পর যেদিন ওর সাথে প্রথম দেখা করেছিলাম সেদিন আসাদ ঠিক আপনার মত অস্বাভাবিক আচরণ করছিলো। আপনি যেমন চায়ের গ্লাস হাতে একঘন্টা বসে ছিলেন, আসাদও আইসক্রিম হাতে এভাবে বসে ছিল। আমি যে এসে ওর পাশে বসেছি এটা বুঝতেই ওর পাঁচ মিনিট লেগেছিল।’



‘প্যাথেটিক। আমাকে দেখে কি আপনার তাই মনে হচ্ছে?’



‘হুম। তারচেয়েও বেশী কিছু!’



‘আরে নাহ!’



তারপর মন খারাপের অজানা কারণ অবলীলায় ফাঁস করে দিলাম মেয়েটার কাছে। মেয়েটা প্রথমে খুব মনযোগ দিয়ে শুনলো, তারপর মুচকি হাসলো এবং তারও পর বলল, - ‘মন খারাপ নিয়ে মানুষ এমন বিলাসীতাও করে??”



সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো। আমরা উঠলাম। একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেল মেয়েটা। আমি হাঁটতে থাকলাম। কত বিচিত্র মানুষই না আছে পৃথিবীতে। স্বল্প পরিচিত মানুষের মন খারাপও যেন এদের কাছে অনেক বড় বিষয়।



ভালো মেয়ে! কিন্তু ‘আসাদ’ টা কে?





তিন

ব্যস্ত মানুষরা সুখ দুঃখের হিসেব কষার সময় পায়না। তাদের পুরো মাথা জুড়ে সর্বদা কাজের জীবাণুগুলো গিজগিজ করতে থাকে। সূর্য উঠলো কি উঠলো না, প্রীয় দল হারল না জিতলো, কে খেলো, কে খেলোনা, কার কষ্টের গভীরতা কত হলো... এসব খবর রাখার কোন ফুরসতই তারা পায়না। তারপর আস্তে আস্তে যখন ব্যস্ততার মেঘ কেটে গিয়ে মনের আকাশে শরতের সাদা মেঘ উঁকি দেয়, তখন ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো এক এক করে সেই সাদা মেঘের পর্দায় প্রদর্শিত হতে থাকে। যার আবেশে আবিষ্ট হয়ে চিরচেনা ব্যস্ত মানুষটি হঠাৎ অচেনা হয়ে যায়।



গত সপ্তাহের পুরোটা জুড়েই ব্যস্ত ছিলাম। মহান প্রজেক্ট ওয়ার্ক সম্পন্ন করার নিমিত্তে প্রতিদিন ঘুম ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে ল্যাবে ঢুকতাম আবার সেই ঘুম ঢুলুঢুলু চোখ নিয়েই রুমে ফিরতাম। মাঝের সময়টা যে কি করে কেটে যেত সেটা বুঝতামই না। পেটের মধ্যে যখন খাবাবের টান পড়ত শুধু তখন বুঝতাম যে লাঞ্চ করার সময় হয়েছে। রাতটাও কেটে যেত মহা ব্যস্ততায়। ডাটা এনালাইসিসে গোঁজামিল দিতে দিতে মাঝ রাত পেড়িয়ে যেত। তারপর লম্বা লম্বা হাই তুলে ঘুমকে আলিঙ্গন করতাম। পরদিনটাও ঠিক এভাবেই কেটে যেত। কাজেই দেশ ও দশের খবর শত চেষ্টা করেও এ কয়দিনে আমার মাথার ত্রি-সীমানায় ভীড়তে পারেনি।



প্রজেক্ট ওয়ার্কের কয়েক টনি বোঝাটা যখন মাথা থেকে নামিয়ে স্যারের রুমে দিয়ে আসলাম তখন মনে হলো – “পৃথিবী এত সুন্দর কেন? আহা! কী সুন্দর আকাশ! কী সুন্দর বাতাস! কী সুন্দর চারিপাশ!” ফুরফুরে মন নিয়ে চলে গেলাম নদীর পাড়ে।



নদী আমার বরাবরই ভালো লাগে। কিচ্ছু না, নদীতে শুধু সাধারণ একটা ডিঙি নৌকা থাকলেই চলবে। নদীর মৃদু স্রোতে ভাসমান নৌকা দেখলেই মনটা কেমন যেন হয়ে যায়। সাধ জাগে নৌকাটার মত ঢেউয়ের তালে তালে ভাসতে। স্রোতের সাথে তুমুল যুদ্ধ হবে। স্রোত আমাকে দক্ষিণে টানবে আর আমি স্রোতকে ঠেলবো উত্তরে। তারপর শরীরের সবটুকু শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেলে স্বেচ্ছায় স্রোতের অধীনে চলে যাব...



ঐযে বলছিলাম হাতে কাজ না থাকলে মানুষ কল্পনাপ্রবণ হয়ে যায়, আমিও নদী পাড়ে বেকার বসে কল্পণার জাল বুনছিলাম। ভাবনায় ছেঁদ ফেলালো নীল রঙা একটা মেয়ে। মেয়েটা নীল না, মেয়ের শাড়িটা নীল। সুপ্ত স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এতো সেই মেয়েটা!



মেয়েটার অবস্থান আমার থেকে খুব বেশী দূরে না। বড়জোর পনের ফিট। আমি বড় একটা পাথরে বসা আর মেয়েটা আরো কয়েকজন শাড়ি পড়া রমণী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নৌকার অপেক্ষায়। আমি মেয়েটার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। মেয়েদের দিকে এক দৃষ্টে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকতে নেই। গুণীজনরা বলেন এতে নাকী প্রেমে পরে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া বিষয়টা দেখতেও দৃষ্টিকটু। পূর্বপরিচিত হিসেবে কথা বলা যেতেই পারে। কিন্তু আগ বাড়িয়ে সাজুগুজু করা একটা সুশ্রী রমণীর সাথে কথা বলতে যাওয়াটা তাকিয়ে থাকার চেয়েও খারাপ জিনিস। নদীর অবাধ্য ঢেউগুলোর মত মনটা দুলছিল। মেয়েটার দিকে তাকাবো কি তাকাবো না? উঠে গিয়ে কথা বলবো নাকি উঠবোই না? এভাবে মিনিট পাঁচেক মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ সেরে যখন মেয়েটার দিকে তাকালাম তখন নৌকা মেয়েটিকে মাঝ নদীতে নিয়ে গেছে!



বুকের ভেতর থেকে একটা বড় পাথর নেমে গেল। এবার নিঃসংকোচে তাকিয়ে থাকলাম নদীর দিকে। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হলাম! এ কী করছি আমি?



আমি কি মেয়েটার প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছি? এমন তো কথা ছিল না। প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিনই অবশ্য হুট করে আপনি থেকে তুমিতে নেমেছিলাম সত্য, তবে সেটা নিছক কৌতুক করেই। পরে যেদিন দেখা হল সেদিন তো আবার আপনিতেই ফিরে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিকই তো ছিলাম! তবে আজ এমন করলাম কেন?



নৌকাটা অনেক দূরে চলে গেছে। আমি পাথরটায় পাথর হয়ে বসে আছি। চাইলেই উঠে যেতে পারি... তবুও উঠছি না। মানুষের উদাসীনতা, বৈরাগ্য, ভালো লাগা সবকিছুতেই পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রত্যক্ষ একটা প্রভাব থাকে। যে মেয়েটার কথা গত এক সপ্তাহে একটিবারের জন্যও আমার মনে হয়নি, সেই মেয়েটাকে হুট করে দেখে আমি বিনাকারণে অবশ হয়ে পড়ে আছি।



মনকে স্থির করলাম। মনের ভেতরে যত আত্নঘাতী বিক্রিয়াই চলুক না কেন আমাকে স্থির হতে হবে। মেয়েটা ফিরলে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করতে হবে। তার নীল শাড়ির রহস্য উৎঘাটন করতে হবে। মলিন ঠোঁট দুটো ডানে বামে প্রসারিত করে গুটিকয়েক মিষ্টি কথা বলতে হবে। এগুলোকে দূর্বলতা বলেনা, এগুলো সামাজিক রীতি; ভদ্রতা!



নৌকা তীরে ভিড়েছে। দেহের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে উঠে দাড়ালাম। এবড়ো থেবড়ো পা ফেলে মেয়েটার সামনে চলে এলাম। তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম, ‘কেমন আছেন?’



মেয়েটা একটা মুচকী হাসি দিয়ে বলল, - ‘তখন থেকে এখানেই আছেন?’



তখন থেকে মানে? মেয়েটা তখনও আমাকে লক্ষ্য করেছে! কি উত্তর দেব আমি? কাচুমাচু করে শুধু বললাম, - ‘হুম!’



পাল্টা প্রশ্ন করার সুযোগ ও শক্তি কোনটাই পেলাম না। মেয়েটা তার দলবল সহ চলে গেল। আমি ফের গিয়ে ঐ পাথরটায় বসলাম। মনের ভেতরের আত্নঘাতী বিক্রিয়া চলছে। তীব্র গতিতে!



চার

ময়মনসিংহ শহরে একটা স্বল্পমাত্রার জরুরী কাজ সেরে ক্যাম্পাসে ফিরছিলাম। বাহন যথারীতি অটোরিক্সা। আমি বসেছিলাম চালকের সহযোগীর আসনে! রাতের অন্ধকারকে ঢাল বানিয়ে দুই একবার হেল্পারের মত সুরকরে চিৎকারও করেছি – ‘এই ভার্সিটি – কেওয়াটখালি - ভার্সিটি!’ আমার চিৎকার শুনে চালক মহোদয় পুরো দুই সেকেন্ড আমার দিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে ছিলেন! অবশ্য তখন পেছনের যাত্রীগুলোর কেউই ছিলো না!



পেছনের যাত্রীগুলো বলতে গোটা পাঁচেক ছেলেমেয়ে! প্রায় পনের মিনিট হয়ে গেল ওরা উঠেছে। এই পনের মিনিটে আমার কানের সাড়ে বারোটা বেজে গেছে! বলতে গেলে মাঝারী ধরনের একটা উদ্দেশ্যহীন রাজনৈতিক টকশো চলছে আমার পেছনে। কয়েকবার চেষ্টা করেও টকশোর টপিকসটা উদ্ধার পারিনি। তবে একটু পর পরই বিজ্ঞাপন বিরতি হচ্ছে। হুটহাট করে মোবাইল বেজে উঠছে আর নিমিষের মধ্যেই মাছের বাজারটা তেপান্তরের নির্জন মাঠ হয়ে যাচ্ছে!



একটা ফোন ভোঁ ভোঁ করে ভাইব্রেট করছে।



‘বাবা আমি এক ফ্রেন্ড এর রুমে এসেছি। একটু পর কথা বলি তোমার সাথে?’



বাবা কি বললেন শুনতে পেলাম না। তবে ফোন টা কেটে দিয়েই সেকেন্ডের মধ্যেই টকশোতে মেতে উঠলো মেয়ে! অটোরিক্সার গ্লাসটাকে হঠাৎ জানালার কাঁচ মনে হলো। একটা তিন চাকার ভ্রাম্যমান ঘর কাঁপতে কাঁপতে রাতের ঝাঁপসা অন্ধকার ভেদ করে মৃদু গতিতে ছুটে চলছে।



টকশো চলছে। আলোচনা চলছে খাবার নিয়ে। ভাবে বুঝলাম তারা বড় ধনের একটা ভোজন পর্ব সেরে এসেছে!



মেয়ে-১: ‘ডান মাখানি’ টা না পঁচা হইছে...

মেয়ে-২: একদম ঠিক বলেছিস! আমারও ভাল্লাগে নি

ছেলে-১: ‘কার পেটে যেন ঘী হজম হয় না?’

ছেলে-১ ও ছেলে-২: হা হা হা ...

ছেলে-২: আচ্ছা বলো ‘বিফ পাঞ্জাবী’ টা কেমন লেগেছে?

মেয়ে-১: ভালই। তবে আরো ভালো কিছু এক্সপেক্ট করছিলাম।



ওদের ‘পোস্ট ইটিং’ পর্যালোচনা আমার ‘প্রি-ইটিং’ স্ট্রাটিজিতে ব্যপক প্রভাব ফেলছিল। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। ওদের ডান-বাম মাখানি আর বিফ পাঞ্জাবী-গেঞ্জি-ফতুয়া সব অমৃত ভেবে মনে মনে গলাধঃকরণ করছিলাম। হঠাৎ বিজ্ঞাপন বিরতির সময় এসে গেলো। কিছুক্ষণের জন্য চুপচাপ হয়ে গেল কথিত ঘরখানা। এবার একটা ছেলের ফোন এসেছে..



ছেলে-১ : ‘ভালো আছি। তুমি ভালো আছো?’



অপরপ্রান্ত : ‘... ... ... ... ... ... ... ... ... ...’



ছেলে-১ : ‘খাইছি। ঐ ডাইনিং এর খাবার! মিষ্টিকুমড়া আর ডিম সেদ্ধ!’

... ... ...



মিষ্টি কুমড়ার কথা শুনেই কেমন যেন একটা অরুচি ভাব চলে এল। ছোট বেলায় লাখ টাকা দিলেও যে জিনিসিটা খেতামনা এখন বাধ্য হয়েই অখাদ্যটা গলাধঃকরণ করতে হয়। তবে আজ খেতে হবেনা বলে নিজেকে একটু হলেও সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে। ছেলেটার জন্য আফসোস হচ্ছে। তাহলে কি বাকীরা ছেলেটাকে ছাড়াই গরুর পাঞ্জাবী খেয়েছে? আহা বেচারা!



অটোরিক্সা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পেড়িয়ে বেশ খানিকটা পথ চলে এসেছে। পেছন থেকে এক ছেলে বলে উঠলো- ‘তোমাদের ভার্সিটিটা এত বড় ক্যান? কোথায় শুরু কোথায় শেষ কিচ্ছু বুঝিনা!’



সঙ্গে সঙ্গে রেডিমেড উত্তর দিয়ে দিলেন ক্যাম্পাসের এক মেয়ে!



মেয়ে-৩: ‘মি. আসাদ! এটা কবুতরের খোঁপ না, ভার্সিটি!’





চমকে উঠলাম! প্রশ্নের উত্তর শুনে না, মেয়েটার কন্ঠ শুনে! মেয়েটা মানে সেই বাঁশ কন্ঠী মেয়েটা!



কালো চাঁদরটা শক্ত করে গায়ে জড়িয়ে নিলাম। অকারণেই বুকটা কাঁপছিলো। নির্ধারিত গন্তব্যের আগেই নেমে পড়লাম।



লাল বাতি দেখাতে দেখাতে মেয়েটাকে নিয়ে চলে গেলো অটোরিক্সাটা। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। দূরত্বও মাঝে মাঝে মানুষকে স্বস্তি দেয়।



পাঁচ

মাঝে মাঝে দুপুরের ঘুমটা যে এত গভীর হয় ঘুম ভাঙার পরও চোখ খুলতে অস্বস্থি লাগে। একটু হাঁটাহাঁটি করে এসে হাশেম ভাইয়ের দোকানের আদা-চা না খেলে সত্যিকারের ফ্রেশনেস টা আসে না। ভার্সিটি লাইফের প্রথম দিকে ঘুরতে যাওয়ার লোকের অভাব পরতো না। এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজেও একটা প্রাণীকে পাওয়া যায় না। কেউ সংগী নিয়ে ব্যস্ত, কেউ টিউশন নিয়ে আবার কেউবা ক্যারিয়ার নিয়ে। তাই চোখ কচলাতে কচলাতে ঘুম ভাঙানোর মহান ব্রত নিয়ে একাকিই বেড়িয়ে পড়লাম। আম বাগানের সবুজঘেরা রাস্তাটায় অনেক দিন থেকে হাঁটা হয় না।



শীত চলে গেছে। প্রকৃতিতে তবুও শীতের হালকা একটা রেশ থেকেই গেছে। মোটর সাইকেল চলে যাওয়ার পর পেট্রোল পোড়া গন্ধের রেশ যেমন থেকে যায় ঠিক তেমন। বসন্তের আগমনে গাছে গাছে একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এই বুঝি শাখা-প্রশাখা বিদীর্ণ করে আম গাছগুলো ফুলে ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠবে। মৌমাছি আসবে, ভ্রমর আসবে, তারপর একে একে ক্ষতিকারক কীট-পতঙ্গও আসবে। বসন্তের প্রতিটি দিন গাছপাড়ার গাছদের জন্য একেকটা বিশেষ দিন। এসব দিনে প্রাপ্তীর আনন্দ যেমন আছে, হারানোর বেদনাও আছে। কখনো গাছতলায় বসে, কখনো বা উদ্দেশ্যহীন হেঁটে বেশ খানিকটা সময় পার করলাম। নির্জনতার সুখ যে এতটা তীব্র হতে পারে আমার জানা ছিলো না। গোধুলীর যে লাল সূর্যটা এতক্ষণ ধরে আমাকে সঙ্গ দিচ্ছিলো, দেখতে দেখতে সেও চুপ করে দিগন্তের আড়ালে কেটে পরলো।



সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসার সাথেসাথেই জংলী মশাগোষ্ঠীর প্রসিদ্ধ ব্যান্ডদল তাদের সুমিষ্ট পপ সঙ্গীত একটু পর পর আমার কর্ণকুহরে পৌঁছে দিচ্ছিল। আর ডাক্তারগোষ্ঠী উপুর্যুপরি সূচ ফুটিয়ে ডাক্তারী ভাষায় বলছিল, ‘হাজার মশার জীবন বাঁচাও... অথবা পালাও!’ পালিয়েই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ পরে গেলাম বাঘের সামনে! যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই নাকি সন্ধ্যে হয়। নাকি সন্ধ্যে হয়েছে বলেই বাঘ চলে এসেছে! ভেবেছিলাম চোখ বন্ধ করে পাশ কাঁটিয়ে যাব। কিন্তু বাঘ আমাকে সে সুযোগ দেবে কেন?



বাঁশ ফাটা কন্ঠে হুংকার দিয়ে সরাসরি আক্রমণ করে বসলো।

‘এই যে সুইসাইড স্কোয়াডের প্রেসিডেন্ট! রাতের অন্ধকারে আমবাগানে কি? আমগাছে ঝুলে পরবেন নাকি?’



মৃদু হেসে মেয়েটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটা আজও নীল রঙয়ের শাড়ি পড়েছে। সন্ধ্যার আবছা আলোয় শাড়ির রংটা উদ্ধার করতে রীতিমত হিমশিম খেলাম। সদ্য ডুবে যাওয়া সূর্যটা মেঘের গায়ে যে গোলাপী আভাটা রেখে গেছে সেটিই যেন কয়েকগুণ বর্ধিত হয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে মেয়েটার মুখে। সৌন্দর্য আর মায়ার অপূর্ব সংমিশ্রণ সে মুখে। যে মুখের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, তবুও চোখ সরানো যায়না। মন্ত্রমুগ্ধের মত বললাম, - ‘ইচ্ছে তো সেরকমই ছিলো! আপনিই তো বাগড়া বাঁধালেন!’



‘তাই না? ভন্ডামী বাদ দেন! আসুন পরিচয় করিয়ে দেই...’ - বলে মেয়েটা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন ছেলেটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ছেলেটার নাম আসাদ।



আসাদকে গ্রহণ করার জন্য আমি সর্বোতভাবে প্রস্তুত ছিলাম। অবাক হলাম না। হাত মেলালাম ছেলেটার সাথে। অমায়িক ব্যবহার আসাদের। দু’ মিনিটের আলাপচারীতায় যে কাউকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা ছেলেটা রাখে। মুগ্ধ হয়েও কেন জানি শেষমেষ মুগ্ধ হতে পারলাম না। মানুষের বৈশিষ্ট্যটাই এমন। প্রতিদ্বন্দ্বী কে কখনো মন থেকে গ্রহণ করতে পারে না। মনের অজান্তে তার সাথে একটা শীতল যুদ্ধ চলেই।



ভেবেছিলাম পরিচয় পর্বটা সেরেই কেটে পরবো। পারলাম না। দু’জনের জোরাজুরিতে ঘুরতে হলো ওদের সাথে। চটপটি, ফুচকা, চা বাদ গেলোনা কিছুই। পুরোটা সময় জুরে গাল ভরিয়ে গল্প করলাম আসাদের সাথে। ভাবখানা এমন ছিলো যে পুরনো বন্ধু আসাদকে পেয়ে আমি সব ভুলে গেছি। আমার স্মৃতিকোষে আসাদের পাশে বসে থাকা মেয়েটার কোন অস্তিত্ব নেই।



রুমে যখন ফিরেছি তখন প্রায় রাত এগারোটা বেজে গেছে। মাথা ব্যাথার শুরুটা তখন থেকেই। এখন রাত তিনটে বাজতে চলল অথচ ব্যথাটা একটুও কমছে না। সেকেন্ডের কাঁটার সাথে তাল মিলিয়ে মিনিটে ষাটবার টিনটিন করছে। চেয়ারে রাখা টেবিল ফ্যানটা ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ঘুরছে। চোখ বুজে আছি অনেক্ষণ থেকে। ঘুম আসছে না। বিকেলের ভারী ঘুমটা যে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে এতটাই হালকা হয়ে যাবে কে জানতো!





ছয়

সেদিনই শেষবারের মত কথা হয়েছিল মেয়েটার সাথে। এরপর ক্যাম্পাসে যতদিন ছিলাম আচমকাই হোক আর ইচ্ছে করেই হোক আর দেখা হয়নি। যতদিন ছিলাম বলতে মাত্র তো তিন মাস।



এক বড় ভাইয়ের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে মার্কেটিং এক্সুকিউটিভ এর চাকুরীটা জুটে গেল। তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেলাম কর্মস্থলে। তারপর অফুরন্ত ব্যস্ততায় ডুবে ডুবে কিভাবে যে তিনবছর কেটে গেলো টেরই পেলাম না।



এ তিন বছরে একাডেমিক কাজে বহুবার ক্যাম্পাসে গিয়েছি। মেয়েটার জন্য নদীর পাড়, বোট্যানিক্যাল গার্ডেন, আম বাগান এমনকি জামিল ভাইয়ের দোকানেও ঠান্ডা চা হাতে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছি। অসংখ্যবার নৌকা এসে পাড়ে ভিড়েছে, আমবাগানে সূর্যটা আগের মতই চুপ করে ডুবে গেছে, একের পর এক চায়ের কাপ শেষ হয়েছে, কিন্তু মেয়েটা আসেনি।



আজ তিন বছর পরে মেয়েটার দেখা পেলাম।



ব্যাপারটা কাকতালীয়ই বলা যেতে পারে। আমার বন্ধু দিদার একদিন হন্তদন্ত হয়ে আমার অফিসে এসে উপস্থিত। দিদারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, চোখে মুখে অসহায়ত্ব।

‘দোস্ত আমারে বাঁচা!’

‘কি হইছে বলবি তো!’

‘আমার বিয়ে!’

‘মাশাআল্লাহ! তোদের প্রণয় তাহলে এতদিনে পরিণতি পাচ্ছে!’

‘চুপ শালা! সব না শুনে পকপক করিস ক্যান? বিয়ে সুমির সাথে না, অন্য মেয়ের সাথে। আম্মায় ঠিক করছে’

‘এখন কি করবি?’

‘কি করবো মানে! আমি এ বিয়ে করলে সুমি নির্ঘাত সুসাইড করবে। দোস্ত কিছু একটা কর।’



ঘোর বিপদ। কিছু তো একটা করতেই হবে। বন্ধুর বিপদে তো হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না।



দীর্ঘ দুই ঘণ্টা মূল্যবান সময় আমার বিফলে গেলো। বেবুঝ দিদারের মা বুঝলেন না। সুমির মত ডাইনী মেয়ের সাথে উনি কিছুতেই ছেলের বিয়ে দেবেননা। বিয়ে ওখানেই হবে। চাহে দিদার বিয়ে করুক নতুবা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাক!



বিয়ের দিন সকালে ঘরের দরজা বন্ধ করে ছোট বাচ্চার মত ডুকরে ডুকরে কাঁদলো দিদার।



মেয়ের বাসা রংপুরে। ঢাকা থেকে রংপুর অনেক দূরের পথ। টাঙ্গাইল আসতে না আসতেই দিদার অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। দিদারের অবস্থা বিবেচনা করেই আমরা বন্ধুরা উঠেছি বরের গাড়িতে। মুরব্বীদের মধ্যে শুধু আছেন দিদারের ছোট চাচা। রীতিমত ঠাট্টা মস্করা চলছেই। থেকে থেকে লজ্জ্বায় লাল হচ্ছে দিদার। হঠাৎ দিদারের ফোনটা বেজে উঠলো। ধরলাম আমি। কানে ধরা মাত্রই কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। সুমির ছোটবোন লীরা কাঁদছে। স্লিপিং পিল খেয়ে সুমি এখন হাসপাতালে। অবস্থা আশঙ্কাজনক না হলেও ভালো না।



সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ইতস্তত করলাম। দিদারকে খবরটা জানানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না। পারলাম না। লীরার কান্না বার বার তীরের ফলা হয়ে কানে বিঁধছিলো। নাস্তা করার ছুতো দিয়ে দিদারকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নেমে পড়লাম। তারপর চা খেতে খেতে হবু ওর মোবাইল থেকে হবু বউয়ের ছবিটা দেখে নিলাম। মেয়েটা বাস্তবিকই অনেক সুন্দর। আমার বাঁশকন্ঠীর সাথে কোথায় যেন একটা মিল আছে। তারপর সুমির বিষয়টা জানালাম ওকে। সেকেন্ডের মধ্যেই দিদারের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা পাংশু হয়ে গেলো। দিদারকে একটা ঢাকার বাসে তুলে দিয়ে বললাম, ‘দোস্ত, তুই যা...আমি সামলে নেব!’



কিন্তু কিভাবে সামলাবো আমি? এত্তগুলো মানুষ! কণে পক্ষ, বর পক্ষ। নিমিষেই দরদর করে ঘামতে থাকলাম। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তে আল্লাহর নাম নিয়ে মাইক্রোর দিকে রওয়ানা হলাম। আমার পরনে দিদারের পাঞ্জাবী আর পাগড়ী।



আমাকে দেখে দিদারের চাচা যেন আকাশ থেকে পড়লেন! কিছুক্ষণ উচ্চবাচ্চ করলেন বটে, তবে আগত বিপদের কথা আঁচ করতে পেরে চুপ হয়ে গেলেন। এক্সিডেন্টলি সুমির কিছু হয়ে গেলে দিদারের দৌদ্দ গুষ্টিকে জেলের ঘানী টানতে হবে। চাচার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দুই পক্ষের অভিভাবক মহলের উপস্থিতিতে একটা বিধ্বংসী অধিবেশন হয়ে গেলো বগুড়ায়। ইস্যুটা মান সম্মানের। সম্মান বাঁচাতে মেয়ে পক্ষ রাজি হয়ে গেলেন বিয়েতে। বর আমি নিজেই। মান-সম্মান আর দায়িত্ববোধ সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। কী আছে কপালে! বিয়ে তো একদিন করতেই হবে! আমার অভিভাবক হিসেবে বড়মামাকে আনা হলো। ভিডিও কলে কথা হলো মেয়ের সাথে। তার কোন আপত্তি নেই। বাবার সম্মান তারকাছে অনেক বড় বিষয়।



কনের বাড়িতে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে গেলো। পুরো বাড়িতে সাজসাজ রব। পটকা ফুটছে একটু পর পর। আমি আমি দিদারের পাঞ্জাবী আর পাগড়ী পরে বসে আছি। ভিতরের খবর হাতে গোণা পনের-বিশ জন ছাড়া কেউ জানেনা। এজন্য হয়তো এখনো স্বাভাবিক ভাবে বসে আসি। বিয়েটা ছেলেখেলা নয়। তবুও সময়ের পরিক্রমায় সেই খেলার পাক্কা খেলোয়ার বনে গেছি।



আমার বিয়েটা যে এভাবে হবে, স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি। যদিও শুরুর দিকে একটু নার্ভাস ছিলাম, কণে দেখার পর নার্ভাসনেসটা একেবারেই কেটে গেছে! মেয়ের সৌন্দর্য নিয়ে প্রশ্ন তুলবো না। আমার বাঁশ কণ্ঠীর যেন কার্বন কপি মেয়েটা। অলরেডি জামাই আদর শুরু হয়ে গেছে। লোকজন পরিচিত হচ্ছেন আর দাক্ষিণ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এক ভাবী সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। ইনি তোমার ফুফা শ্বশুর, ইনি দাদা শ্বশুর, ইনি বড় ভাবী... এভাবে একের পর এক পরিচয় পর্ব চলছিল।



হঠাৎ ভাবী স্বর তুঙ্গে তুলে চিৎকার করে উঠলেন,- ‘ঐ তাসনুভা, ঐ বান্দরনী! লুকিয়ে লুকিয়ে কি দেখিস? এখানে আয়!’

একটা নীল শাড়ি পড়া মেয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো।

‘তাহমিদ, এটা তোমার ছোট গিন্নী!’ - এক গাল হেসে শালিকার সাথে পরিচয় করে দিলেন ভাবী।

আমি ছোট গিন্নীর দিকে তাকালাম। ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম! ছোটগিন্নীর চোখে মুখে লাজুক হাসি। আমার দিকে তাকিয়েছে বলে মনে হলো না। মাঝারী ধরনের একটা চীৎকার দিয়েই ফেললাম, ‘আপনি!!’

মেয়েটা সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্বিগুণ জোরে চিৎকার করে উঠলো।

মনে মনে তিন গুণ জোরে আর্তনাদ করে উঠলাম আমি! ‘এ বিয়ে আমি মানিনা!’



আমি হা করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার ছোটগিন্নী ততক্ষণে একটা মুচকী হাসি দিয়ে ফেলেছে।



সাত

বিয়ের তিনমাস পরে জানতে পেরেছিলাম যে, আসাদ তাসনুভার বিএফ বটে তবে বয়ফ্রেন্ড না, বেস্ট ফ্রেন্ড!



সমাপ্ত

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৩:৫২

ব্লগার মাসুদ বলেছেন: এত ছোট কেন ভাই আরেকটু বড় করা গেল না ।

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৫:৩৯

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: মন থেকে বললেন নাকি মজা করলেন? গল্প লিখতে লিখতে তো আমার নিজেরই বিরক্তি এসে গেছে!

২| ২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১০:১৪

দিশেহারা রাজপুত্র বলেছেন: আমার ভাল লেগেছে।
+++

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ রাত ১১:০৯

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ রাজপুত্র ভাই। প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানবেন :-)

৩| ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৯:৪২

চাঁদেরকণা বলেছেন: এত বড় গল্পটা এত্ত ভালো লাগলো !!

০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৮

মোঃ জুনায়েদ খান বলেছেন: ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.