নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। কালেভদ্রে লিখি :)

মোঃ জুনায়েদ খান

ভোর হয়, সূর্য ওঠে... সেই সূর্যও একসময় রাতের কোলে ঘুমিয়ে যায়। আমিও সূর্যের সাথে উঠি, রাতের কোলে ঘুমিয়ে যাই, মাঝিবিহীন নৌকায় বসে উত্তাল সমুদ্রে নিয়মিত ঘুরপাক খাই, উত্তর থেকে দক্ষিণে বিদ্যুৎ বেগে দৌড়াই আবার দক্ষিণ থেকে উত্তরে কচ্ছপ বেগে হেঁটে হেঁটে আসি, তারপর চৈত্রের কড়া দুপুরে কম্বল মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ! কারণ আমার জীবনের কোন লক্ষ্য নেই!\n\n\nপেশায় ছাত্র। পড়ছি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে। এইতো..

মোঃ জুনায়েদ খান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্প : নাটক

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২৬

মন খারাপ বা মেজাজ খারাপের দিনগুলিতে পা দু’টোকে বিন্দুমাত্র অবসর দেয়না সমীর। মোবাইল-মানিব্যাগ ফেলে উদ্দেশ্যহীন বেরিয়ে পরে। মন যেদিকে সায় দেয় সমীরের পা জোড়াও সেদিকে এগুতে থাকে। প্রথম পনের-বিশ মিনিট অনেকটা অবচেতন মনেই হাঁটে সে। ট্রেনের হুইসেল অথবা কোন মোটর গাড়ির কর্কশ হর্ণে সম্বিৎ ফেরে সমীরের। সময় বাড়ার সাথে সাথে মন খারাপটাও নেমে আসে পায়ের নিচে। তারপর ফুরফুরে মন নিয়ে রাস্তাঘাটে মানব জীবনের লাইভ নাটক দেখে সে। বড়ই উপভোগ্য সেসব নাটক।

একটা বিশেষ কারণে ঘন্টা দু’য়েক আগে সমীরের ভালো মনটা হুট করে খারাপ হয়ে গেছে আজ। হাঁটাটা তখনই শুরু করেছিলো সে। রাস্তার পাশে চায়ের দোকানটা ফাঁকা না থাকলে সমীরের পা জোড়া কোথায় গিয়ে থামতো সেটা সেই ভালো বলতে পারবে। যাহোক, এখন আদা দিয়ে দুধ চা খাচ্ছে সমীর। মাথার ভেতর হাজার হাজার কেঁচো কিলবিল করছে। রাস্তায় তেইশ-চব্বিশ বছরের একটা ছেলে কানে মোবাইল গুঁজে হাসি মুখে ফিসফিস করছে আর হাঁটছে। সমীরের হাতে থাকা চায়ের কাপটা থেকে সাদা ধোয়া উঠছে। সমীরের খুব ইচ্ছে করছে গরম চা ভর্তি কাপটা ছেলেটার চোখে মুখে ছুড়ে মারতে। পরিণাম যাই হোকনা কেন এতে সমীরের মাথার ভেতরের কেঁচো গুলো একটু শান্তি পেতো। কেঁচোগুলোর অত্যাচার আর সইতে পারছে না সমীর।

‘ভাতিজা, চা ফালায়া দিল্যা ক্যান? ভালো হয় নাই?’ - বিরস মুখে দোকানী প্রশ্ন ছোড়ে।

‘না চাচা! চমৎকার হইছে চা। এজন্যই মাটিরে একটু খাওয়াইয়া দিলাম! বেচারা সারা জীবন তো মানুষের লাত্থিই খায়, আজ না হয় একটু চা ই খাইলো!’ - বলে দোকানীর দিকে তাকিয়ে একটা সুপ্রসন্ন একটা হাসি দিল সমীর। সমীরের টার্গেটটা মিস হয়ে গেছে। একটা রিক্সা নিয়ে চলে গেছে ছেলেটা।

চায়ের বিল মেটাতে গিয়ে সমীর আবিষ্কার করলো তার পকেটে মানিব্যাগ নেই। দোকানী অবস্থা আঁচ করতে পেরে বলল, ‘ভাতিজা, চায়ের ট্যাকা দেওন লাগবো না। চা তো আর তুমি খাও নাই, মাটিরে খাওয়াইছো!’ বলে ফিক করে হেসে দিলো দোকানী।

লোকটা কি সমীরকে পাগল ভাবছে? ভাবলে ভাবুক। সব পাগলেই নিজেকে ছাড়া অন্যদের পাগল ভাবে। কথা না বাড়িয়ে আবার হাঁটতে থাকে সমীর। অন্যদিন এসে চায়ের তিনগুন দাম দিয়ে যাবে সে।

পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলটার খোঁজ করে সমীর। ওটাও রুমে ফেলে এসেছে। পেটের ভিতরেও একদল কেঁচো খামচা-খামচি করছে। মন খারাপ বা মেজাজ খারাপের সাথে পেটের খামচাখামচির সম্পর্ক নাই। যারা বলে ক্ষুধা লাগেনা, তারা যে তাদের রাগ থেকেই বলে এ বিষয়ে সমীরের চেয়ে জ্ঞান আর কারো বেশী আছে বলে সে মনে করেনা। ‘যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত্রী হয়’ বাগধারাটা হয়তো একটু হলেই সমীরের জন্য প্রযোজ্য হতো। কিন্তু যখন পকেট থেকে সমীরের হাত মোবাইলের বদলে পঞ্চাশ টাকার একটা গোসল হওয়া নোটকে কান ধরে ছেচরিয়ে বের করলো তখন ‘সোনায় সোহাগা’ ছাড়া অন্য কোন বাক্য ব্যবহারের দুঃসাহস আমি দেখাতে পারছিনা। কেননা অদূরেই একটা হোটেল থেকে খিচুরীর মৌ মৌ সুঘ্রাণ সমীরের নাকে এসে উষ্কানি দিচ্ছিলো।

সমীর খেতে বসেছে। ভুনা খিচুড়ি আর মুরগি! মুরগিটা ভালই রেঁধেছে মনে হচ্ছে। টেবিলের অপর পাশে উসকো-খুশকো সাদা চুলের এক বৃদ্ধ খুব সতর্কতার সাথে ভাত খাচ্ছে। সমীর এতক্ষণ লোকটাকে লক্ষ্য করেনি। প্লেটের ভাতগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করেছে লোকটা। একভাগ হালকা হলুদ আর অন্যভাগ পুরো সাদা। হলুদ অংশটা বোধহয় কোন কিছুর ঝোল দিয়ে মাখানো। ঝোল যে অপর্যাপ্ত ছিলো সেটা ভাতের রঙ দেখেই নির্ভুল ভাবে বলে দেয়া যায়। লোকটা নিপুণ শিল্পীর মতো অধোঃবদনে হলুদ অংশ থেকে হাত ভর্তি ভাত মুখে দিয়েই গিলে ফেলছে। সমীর লোকটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। লোকটা হলুদ অংশটা দু’মিনিটের মধ্যে সাবার করে ফেলল। বৃদ্ধ লোকটা এখন সাদা ভাতগুলোর দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে আছে। হোটেল বয় কোন মাপজোক ছাড়াই কিছু ভাত এনে লোকটার প্লেটে ঢেলে দিলো। সাথে কিছু পাতলা মসুরের ডাল। সমীরের সামনে ভুনা খিচুড়ি আর মুরগির মাংশ। মাংশের ওপাশে একটা সত্তর বছরের বৃদ্ধ লোক। লোকটা গাপুস গুপুস করে ডাল মাখানো ভাত পেটে চালান করছে। বাকরুদ্ধ হয়ে লোকটার খাওয়া দেখছে সমীর। প্লেটের মুরগির পিসটা লোকটার প্লেটে চুপ করে তুলে দিতে ইচ্ছে করছে সমীরের। কিন্তু কেন যেন সে পারছেনা। কেউ যদি দেখে ফেলে? কিংবা এটো জিনিস খেতে যদি লোকটার সম্মানে বাঁধে? তখন? দুই মিনিট ধরে মনের সাথে যুদ্ধ করে মুরগির পিসটা হস্তান্তরের যখন ফাইনাল সিদ্ধান্তটা সমীর নিয়ে ফেলেছে তখন লোকটা প্লেটের বাড়তি ডালটুকুতে চুমুক দিচ্ছিলো। লোকটার খাওয়া শেষ! ‘ডাক্তার আসিবা মাত্র রোগিটি মারা গেলেন!’
ভুনা খিচুড়ি আর মুরগীর পিসটা নিয়ে অনেক্ষণ টেবিলে বসে ছিলো সমীর। তারপর ওটাকে অক্ষত রেখেই বেরিয়ে পড়েছে সে। চব্বিশ বছরের জীবনে অগণিত বার মন খারাপ হয়েছে সমীরের। তবে এমন অনুভূতি হয়নি কখনো! ‘সামান্য একটা মুরগির পিসের লোভ সামলাইতে পারলিনা! ছি... সমীর ছিহ!’

সমীর হাঁটছে। মাথার ভেতরের অবাধ্য কেঁচোগুলোকে তাড়িয়ে মনে হয় কিছু গোখরা সাপের বাচ্চা মাথাটা দখল করে নিয়েছে। অনুশোচনা বিষয়টা মন খারাপ বা মেজাজ খারাপের চেয়েও অনেক ভয়ঙ্কর। সমীর হাঁটছে। সমীর উদ্ভ্রান্তের মতো হাঁটছে...

একটা মোটর সাইকেল উদ্ভ্রান্ত সমীরের গা ঘেঁসে থামলো।

- ‘ঐ শালা ফোন ধরিস না ক্যান? মানুষকে টেনশনে রেখে খুব মজা লুটিস না?’
- ‘ফোন তো রুমে রেখে আসছি। কি হইছে বল?’
- ‘তোর মাথা আর শিনুর মুন্ডু!’
- ‘তোদের সমস্যাটা কি? সব কিছুর মাঝে শিনুকে টানিস ক্যান?’
- ‘টানবো না? আপনে রাস্তায় রাস্তায় হাওয়া খাবেন। অন্যদিকে আপনার চিন্তায় আরেকজন কান্নাকাটি করে আমাদের চড়কিতে করে নাচাবে আর আমরা তারে টানবো না?’
- ‘ও...’
- ‘ও... মানে? চুপচাপ পেছনে উঠে বস। বুড়াতি বয়সেও শালাদের নাটক কমেনা!’

নাটক! জীবনটা একটা নাটকই তো। কেউ মনের তাড়নায় হাঁটাহাঁটির নাটক করে, আবার কেউবা পেটের তাড়নায় প্রতিদিন ডালভাত খাওয়ার নাটক করে।

জিসানের মোটর সাইকেলটা ধুলো উড়িয়ে ছুটে চলে। পেছনে বসে সমীর জীবনের নাটক দেখে। বড়ই উপভোগ্য সেসব নাটক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.