![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
"কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল
চঞ্চল চীএ পইঠো কাল।।" - লুইপাদ, চর্যাপদ
১
হাসিবের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জয়া । ছেলেটা প্রচন্ড অদ্ভুত । চালচলন , কথাবার্তা থেকে পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুই অদ্ভুত। মুখভর্তি উষ্কখুষ্ক দাড়ি। কপালের উপরে মাঝে মাঝেই এসে পড়ছে এলোমেলো ঢেউ খেলানো চুল। অন্যকোন ছেলে হলে নিশ্চই চুলগুলোকে আবার কপালের উপরে তোলার চেষ্টা করত। কিন্তু হাসিবের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে উদাস চোখে ক্লাসের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে দেখছে। খুব ধীরে কাঁপা ঠোটে সে বিড়বিড় করছে।
জয়া প্রথম হাসিবকে দেখেছিল, ভার্সিটির নবীনবরণ অনুষ্ঠানে। অডিটোরিয়াম ভর্তি একদল উচ্ছ্বল ছেলে মেয়ে। সবাই সদ্য ভার্সিটিতে পা রেখেছে। স্যারদের দীর্ঘ বক্তব্যের পর শুরু হল মিনি কনসার্ট। সবাই গানের তালে নাচানাচি, মাতামাতি করছে। কিন্তু অডিটরিয়ামের একেবারে পিছনে একাএকা একটা ছেলে জবুথবু হয়ে বসে আছে। বসে থাকার ভঙ্গিটাও অদ্ভুত। বসেবসে সে সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে। কনসার্ট নিয়ে তাঁর কোন মাথাব্যাথা নেই। দেখে মনে হচ্ছে, কি জানি একরাজ্য ভেবে চলছে একমনে। সবার মাঝে এধরনের আচরণের কারণেই হয়তো এই ছেলেটাকে সুষ্পষ্টভাবে আলাদা করা যায়।
ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই জয়া তাঁর চারপাশ ঘিরে অসংখ্য ছেলেদের উচ্ছলতা দেখে আসছে। এটা ভার্সিটিতেই প্রথম না । কিন্টারগার্ডেন থেকেই জয়ার পেছনে ছেলেরা ঘুরঘুর করে । জয়া তাতে মনেমনে খুশিই হয় । একটা ছেলে পেছনে ঘোরাঘুরি করা মানে তাঁর কাছে একটা মেডেল পাওয়ার মত । সৌন্দর্য্যের উপরে মেডেল । ছেলেটা খুব বেশী স্মার্ট আর সুন্দর হলে গোল্ড-মেডেল। তাঁর থেকে একটু কম হলে রৌপ্য , আরো কম ব্রোঞ্জ। একেবারেই গোবেচারে টাইপ হলে প্লাস্টিক মেডেল, শান্তনা পুরুষ্কার।
নতুন পাওয়া বন্ধুদের সাথে নাচানাচির এক পর্যায়ে জয়া এরকম সিলিং এ তাকানো অবস্থায় হাসিবকে দেখে ফেলে। কে এই ছেলে? এভাবে একা একা বসে আছে কেন? জয়া খানিকটা কৌতুহল নিয়ে ভিরের মাঝ থেকে সরে আসে। ধীর পায়ে হাসিবের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। হাসিবের সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপই নেই। সে আগের মতই একমনে সিলিং এর দিকে তাকিয়েই আছে। জয়ার ব্যাপারটা দেখে গা জ্বলে। একটা সুন্দর মেয়ে এসে একটা ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে আর ছেলেটা তাকাবে না! এটা কি! তাহলে ছেলেটা কি তাঁর সাথে ভাব নিচ্ছে?
আজকালকার ছেলেরা অনেকেই এমন করে। একধরনের অভিনয়। সুন্দর মেয়েদের দেখলে এমনভাব করে যেন সে কিছুই না। ঐপাড়ার কুলসুম তাঁর থেকে বহুত সুন্দর। এতে করে সুন্দর মেয়েটা তাঁর চারপাশে অপূর্ণতা অনুভব করে। সবাই তাঁর পেছনে ঘুরবে কিন্তু এই ছেলে ঘুরবে না! এ যেন একধরনের শূন্যস্থান। মেয়েরা শূন্যস্থান পছন্দ করে না। কাজেই মেয়েটা নিজে যেচে গিয়ে ছেলেটার সাথে কথা বলবে। ছেলেটার চারপাশে ঘেঁষার চেষ্টা করবে। এ ছেলেটাও কি এমন করছে? নিজেকে ইউনিক রাখার চেষ্টা। যেনো, দেখ জয়া তুমি কত্ত সুন্দর, সবাই তোমার চারিদিকে ঘোরে অথচ আমি তোমাকে গুনিই না। আমি কত ব্যাতিক্রম! সবটাই কি নিজেকে ব্যাতিক্রম রাখার চেষ্টা?
বিষয়টা ভাবতেই জয়া খানিকটা লজ্জা পেলো। সে নিজেও তো ঐসব মেয়েদের মত তাঁর চারপাশের শূন্যস্থান পূরণ করতে এই ছেলেটার কাছে এসেছে। ব্যাপারটা ভেবেই সে আবার পিছু ঘুরলো। আবার গিয়ে ভিরের মাঝে মিশে গেলো। কিন্তু তাঁর মনের মাঝে কেমন একটা অস্বস্থি কাজ করতে লাগলো। সে ভিরের মাঝে সবার সাথে আনন্দ করতে করতে আড়-চোখে হাসিবকে দেখতে লাগলো।
কনসার্ট শেষ হলো। নিউ ব্যাচে ভর্তি হওয়াদের মাঝে যাদের সাথে জয়ার পরিচয় বাকি ছিল, তাঁরাও একে একে এসে জয়ার সাথে পরিচিত হতে লাগলো। কিন্তু পেছনে একা একা বসে থাকা সেই ছেলেটি আসলো না। এমনকি সবাই একসাথে মিলে গ্রুপ ছবি তোলার সময়েও ছেলেটি অংশ নিলো না।
ভার্সিটি থেকে জয়া বাসায় ফিরে গেল। কিন্তু তাঁর মনের খচখচানিটা মোটেও কমলো না।সেদিনের পর থেকে আজকে পর্যন্ত প্রায় আড়াইমাস কেটে গেছে। এই আড়াইমাসে জয়া প্রায় আড়াইডজন প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছে। সবগুলি ফিরিয়েও দিয়েছে। কিন্তু হাসিবের সাথে তাঁর আজ অবধি একটা কথাও হয়নি। সে নিজেও যেচে কথা বলেনি। কয়েকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রতিবারই লজ্জা পেয়ে ফিরে এসেছে। মনে হয়েছে বাকি সুন্দরী মেয়েদের মত তাঁর আচরণটাও হয়ে যাচ্ছে।কাজেই আর কথা বলা হয়নি।
সে হাসিবের নামটাও শুনেছে এটেন্ডেন্সে নাম ধরে ডাকার সময়। তবে আগের থেকে তাঁর মনের খচখচানিটা সামান্য কমেছে। কারন ছেলেটা শুধু তাঁর সাথেই কথা বলেনা এমন না। সে ক্লাসের কারো সাথেই যেচে কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞাসা করলে নিচু মাথায় সংক্ষেপে উত্তর দেয়। বেশিরভাগ উত্তর হয় হ্যাঁ অথবা না দিয়ে। মাঝে মাঝে হু অথবা উহু দিয়েও কাজ সারে। ক্লাসের সময় পেছনের দিকে এককোনে চুপচাপ বসে থাকে। স্যাররা তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে হা করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেও কখনো স্যারদের কিছু জিজ্ঞাসা করে না।
এসব কিছু খারাপ ছাত্রের বৈশিষ্ট্য। খারাপ ছাত্র হয় ২ প্রকার। একপ্রকার হয় হাসিবের মত গোবেচারা টাইপ। নড়িলেও ন নেই, মারিলেও রা নেই টাইপ। আরাক প্রকার উশৃংখল টাইপ। সবসময় মারপিট ধুমধাড়াক্কা নিয়ে তাঁরা পরে থাকে। অবশ্য ভালো ছাত্রদের ভেতরেও এরকম ২টি ভাগ থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো ভালো ছাত্ররা পেছনে বসে না। তাঁরা ক্লাসের শিক্ষকদের সবসময় প্রশ্ন করে ব্যাতিব্যাস্ত রাখে। কাজেই হাসিবের খারাপ ছাত্র হবার সম্ভাবনা সবথেকে বেশী।
প্রথম দিকে জয়াও তাই ভেবেছিলো। কিন্তু মিডের রেসাল্ট দেখে সবাই টাসকি খেয়ে গেলো। হাসিব সবকয়টা সাবজেক্টে ২৫ এ ২৫ পেয়েছে। স্যারেরাও অভিভূত। স্যারেরা এরপর থেকে মাঝে মাঝেই তাঁকে বিভিন্ন ব্যাপারে প্রশ্ন করে। একটু বেশীই কদর করে। কিন্তু সে বিব্রতভঙ্গিতে ব্যাপারটা সবসময় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে। ক্লাসের ফাঁকে সবসময় জানালা দিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করে। রাস্তা দিয়ে যাবার সময় একা একা বিড়বিড় করে। এসবই হাসিবের নৈমত্তিক রুটিন।
তবে এরবাহিরেও সে একটা কাজ করে। সন্ধ্যা সন্ধ্যা সময়ে নিরিবিলি রাস্তায় হাটে। হাঁটার সময় দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে চমৎকার কন্ঠে এন্ড্রু মারভেলের কবিতা আবৃত্তী করে।
My love is of a birth as rare
As ’tis for object strange and high;
It was begotten by Despair
Upon Impossibility.
হরতালের কারনে একদিন বিকেল ৫টায় জয়াদের মেক-আপ ক্লাস করতে হয়েছে। সেদিন জয়া বাসায় ফেরার পথে নিজ চোখে ব্যাপারটা দেখেছে। আচ্ছা ছেলেটা কি তাহলে কবি? ঢাকা শহরে কবি এবং কাকের সংখ্যা সমান। কাজেই কবি হওয়াটা অস্বাভাবিক না। কিন্তু বেশিরভাগ কবিরা লুচ্চা প্রকৃতির হয়। কিন্তু হাসিবকে দেখে লুচ্চা মনে হয় না।হাসিব সবুজ রঙের ঢিলেঢালা টি-সার্ট আর জিন্স প্যান্ট পড়ে এসেছে। প্রতিদিনই সে এরকম পোশাক পড়ে আসে।আজকেও হাসিব জানালার গ্রিল ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কি ভাবছে কে জানে!
জয়া প্লান করেছে আজ যেকরেই হোক হাসিবের সাথে কথা বলবে। যে ছেলে যেচে কারো সাথেই কথা বলে না তারসাথে কথা বলা মুশকিল। প্রসঙ্গ লাগবে। কথা বলার কোন প্রসঙ্গ জয়ার কাছে নেই। প্রসঙ্গের জন্য সে তাই এন্ড্রু মারভেলের কবিতার বই The complete poems নিয়ে এসেছে। ভেবে রেখেছে আজকে সে কবিতার বইটি হাসিবকে দেবে। ফাঁকা রাস্তায় এন্ড্রু মারভেলের কবিতা আবৃতি করার অর্থ নিশ্চয়ই মারভেল ওর প্রিয় কবি। বইটি দিয়ে হাসিবকে চমকে দেয়া যাতে পারে। এমনিতে তো হাসিবের মুখ থেকে হু, উহু ছাড়া কিছু বেড় করা মুশকিল। বই পেয়ে বিস্মিত হয়ে যদি কিছু বেশী বেড় হয় এই চেষ্টা আরকি।
কিন্তু সমস্যা হল সে কখন দেবে, কোথায় দেবে সেটা ঠিক করা হয়নি। ক্লাসে সবার সামনে দিলে সবাই, কি না কি মনে করে! আচ্ছা তবে কি ক্লাস শেষে বাড়িতে ফেরার পথে দেবে? হাসিব তাঁর বাসার সামনে দিয়েই হেটে হেটে বাসায় যায়। পথে ফাঁকায় পেলে হাতে গুজে দেবে। কিন্তু বইটা কি দিতেই হবে? কথা কি বলতেই হবে? না বললেই বা কি হবে! যখন সেই হাসিব এসে ওর সাথে যেচে কথা বলছে না। তখন ওর এত আগ বাড়িয়ে পিরিত দেখানোর মানে কি? তাছাড়া ফাঁকা রাস্তায় পেলে যদি হাসিব ওর ক্ষতি করার ট্রাই করে! যতই হাসিব একগুয়ে আর ঘরকুনো গোবেচারা হোক, পুরুষতো? প দিয়ে শুরু কোনকিছু বিশ্বাস করতে নাই। পুলিশ, পত্রিকা, পুরুষ। এমনিতেও এরকম গোবেচারা পুরুষেরা ভেজা বিড়াল টাইপের হয়।
জয়া এসব সাতপাঁচ ভাবছে এমন সময় হঠাত সে চমকে দেখলো হাসিব তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে।- দাও বইটা দাও। হাসিব জয়ার ব্যাগের দিকে ইশারা করে বই চাচ্ছে। এটা কি স্বপ্ন না বাস্তব? এটা কি হাসিব নাকি জয়ার মনের কল্পনা? জয়া সাথেসাথে জানালার দিকে তাকালো। নাহ সেখানে হাসিব নেই! তাহলে কি এটাই হাসিব! জয়া ভ্যাবাচেকা খেয়ে হা করে হাসিবের দিকে তাকিয়ে থাকল।
- হা বন্ধ কর। নতুবা মাছি ঢুকবে। আর বইটা দাও। হাসিব নিরস গলায় বইটি আবার চাইলো। জয়া ঘোরলাগা কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলো কি বই?
- যেটা দিয়ে তুমি আমাকে চমকে দেয়ার কথা ভাবছিলে! এন্ড্রু মারভেলের The complete poems। হাই তুলতে তুলতে বলল হাসিব। জয়া অবাক বিস্ময়ে হাসিবের দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা হাতে বইটা বেড় করে দিলো।
হাসিব বইটা হাতে নিয়ে আবার জানালার কাছে চলে গেল। জানালার ধারে বইটা রেখে আবারো উদাস চোখে আকাশ দেখতে আর বিড়বিড় করতে লাগলো।
জয়া ঘটনা বুঝে উঠতে পারছে না। কি হল এতক্ষন! হাসিব ওর সাথে এসে কথা বলেছে! তারথেকে বড় কথা হাসিব এসে জয়ার কাছে বইটি চেয়ে নিয়েছে! কিন্তু এই বইটির ব্যাপারে জয়া ছাড়া আরতো কেও কিছু জানে না ! তাহলে হাসিব জানলো কিভাবে? আর মনে মনে বইটা হাসিবকে দিয়ে চমকে দেয়ার কথাটা জয়া যে ভেবেছে সেটা হাসিব জানলো কি করে? হাসিব কি তাহলে অন্তর্যামী? জয়া ওর ব্যাগ খুলে আবার চেক করলো। বইটি হয়তো ব্যাগেই আছে। এতক্ষন হয়তো সে হেলুসিয়েশনের মাঝে ছিলো। কোনকিছু নিয়ে সারাক্ষন ভাবলে হেলুসিয়েশন তৈরি হতেই পারে। তারমানে কি জয়া সারাক্ষন হাসিবিকে নিয়ে ভাবে! জয়া খানিকটা লজ্জাও পেলো। ব্যাগ খুলে দেখা গেল, না হেলুসিয়েশন না বইটি সত্যি নেই। জয়া ঘাড় ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকালো জানালার পাশে বইটি রাখা। পাশেই হাসিব দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। জয়ার ঘোরের মাঝেই সময় কাটতে লাগলো।
এর মাঝেই একটা ঘটনা ঘটে গেল।
ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। শিক্ষক লেকচার দিচ্ছেন। ঠিক এমন সময়, হাসিব দাঁড়িয়ে পড়লো। ক্লাস নিচ্ছিলেন শিমুল কান্তি নাথ। ভাবলেন হাসিব হয়তো কোন প্রশ্ন করার জন্য দাঁড়িয়েছে। তিনি বললেন
–কি সমস্যা বল? হাসিব কিছু বলল না। বরং ধীর পায়ে শিমুল কান্তি নাথের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল,
- স্যার আপনার কপালে এত রক্ত কেনো? বাসায় যান। স্যার, বাসায় চলে যান। স্যার হাসিবের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন!- রক্ত! রক্ত কোথা থেকে আসবে? শিমুল কান্তি নাথ কপালে হাত দিয়ে দেখলেন না ঠিকিতো আছে। রক্ততো নেই। তিনি উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন। কেওই তাঁর কপালে রক্তের কোন চিহ্ন দেখলো না । তাহলে এই ছেলে এই কথা বলছে কেনো? ছেলেটাকি তাঁর সাথে মস্করা করছে? নাকি হুমকি দিচ্ছে? কিন্তু হুমকিই বা দিবে কেন? নিশ্চই ফাজলাইই করছে। তিনি হাসিবকে কষা ধমক দিয়ে নিজের সিটে গিয়ে বসতে বললেন। মনে মনে বললেন ফাইজলামি করার আর জায়গা পায়না। যত্তসব আজাইরা পোলাপাইনের আজাইরা কথাবার্তা। ঠিক সেই মুহুর্তে হাসিব বলে উঠলো
- না স্যার আজাইরা কথা না, ফাজলামিও না। আপনার কপালে রক্ত। লাল রক্ত । চারিদিকে এত রক্ত, এতো চিৎকার । রক্ত , ধোঁয়া .........স্যার হাসিবের কথা শুনে প্রথমে আরাকবার হোচট খেলেন সে মনে মনে যেটা বলল,ছেলেটাকি বুঝে ফেলেছে নাকি! তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে সে হাসিবকে আবার একটা ধমক দিয়ে বসতে বললেন।
- কি পাগলের মত রক্ত, রক্ত করছো? যাও বস গিয়ে।না ছেলেটাকে বসতে বলা উচিত হয়নি , বেড় করে দেয়া উচিত ছিলো। ছেলেটার স্ক্রু ঢিলা আছে নিশ্চই। এমনিতে এই ছেলেটা মোটেই কথা বলে না । আজ এত কথা বলছে কেন? পরীক্ষায় ভালো নাম্বারও পায় ছেলেটা। অবশ্য তাতে কি? ভালো নাম্বার যারা পায় তাঁরা পড়াশোনা বেশী করে। পড়তে পড়তে একসময় তাঁদের মাথা নষ্ট হয়ে যায়। স্ক্রু ঢিলা হয়ে যায়। তখন এরকম উলটা পালটা কথা বলে। যখন তখন পাগলামি এটাক করে।
এখন এই ছেলের মাথায় নিশ্চই পাগলামি এটাক করেছে। সেজন্য স্বভাব বিরুদ্ধ বেশী কথাও বলছে। বের করে না দিলে আবারো উলটা পালটা কথা বলবে। কিন্তু কি করে বের করে দেবেন? তিনিতো বসতে বলে দিয়েছেন। আচ্ছা আরাকটা সূযোগ দিয়ে দেখা যাক ।আরাকটা সূযোগের কথা যখন শিমুল কান্তি নাথ ভাবছিলেন ঠিক তখনই হাসিব পেছন থেকে তাঁর ব্যাগ নিয়ে এসে স্যারের সম্মুক্ষে দাঁড়িয়ে বলল।
- স্যার, আরাকটা সূযোগ লাগবে না। আমি পাগল না আপনাকে বের করে দিতে হবে না। আমি নিজেই বের হয়ে যাচ্ছি। আর সাবধানে থাকবেন। বলেই হাসিব গটগট করে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলো। শিমুল কান্তি ভাবলেন ভালোই হয়েছে। যেটা চাচ্ছিলেন সেটাই হয়েছে। কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলেন , কিন্তু ছেলেটা কি করে জানলো তিনি মনে মনে ওকে বেড় করে দিতে চাইছিলেন! শিমুল কান্তি নাথ ঘামতে শুরু করলেন। এসির ঠান্ডা বাতাসের মাঝেও তিনি কুলকুল করে ঘামছেন। তাকিয়ে আছেন হাসিবের দরজা দিয়ে চলে যাওয়ার দিকে । শুধু তিনি না ক্লাসের প্রত্যেকেই চোখ বড়বড় করে হাসিবের চলে যাওয়া দেখলো।
শিমুল কান্তি নাথ গোটা কয়বার ভাবলেন কাওকে পাঠিয়ে ছেলেটাকে ডেকে আনবেন। জিজ্ঞাসা করবেন ঘটনা কি? কিন্তু ডাকলেন না। ভাবলেন কাঁকতলিও। ছেলেটা তো আর বলেনি যে সে তাঁর মনের কথা ধরতে পেরেছে। এভাবে চলে যাওয়া এক ধরনের বেয়াদবি। সেক্ষেত্রে ছেলেটার শাস্তি হওয়া উচিত। শিমুল কান্তি নাথ হাই-স্কুল টিচার হলে হাসিবকে পরেরদিন ঠেটিয়ে গুনে গুনে তিনটা চড় মারার পরিকল্পনা করতেন অথবা জোড়া বেতের ঘা। কিন্তু ভার্সিটি হওয়ায় সে সূযোগ নেই। তবে পরীক্ষায় নাম্বার কমিয়ে দেয়া যেতে পারে । শিমুল কান্তি নাথ ব্যাপারটা ভেবে আনন্দ পেলেন। তাঁর দুশ্চিন্তা কিছুটা কমলো। ঠিক সাথেসাথে তখনই আবার আবার হাসিব ক্লাসে ঢুকলো।
- স্যার , এভাবে বেড়িয়ে যাওয়া অপরাধ মনে হলে আপনি শাস্তি দিতেই পারেন কিন্তু এক্সামের খাতায় নাম্বার কম দিতে চাওয়াটা কি ধরনের শাস্তি? কথাটা শুনে শিমুল কান্তি নাথ ভিষণভাবে টাস্কি খেলেন। কিছু একটা বলতে চাইছিলেন কিন্তু তাঁর আগেই হাসিব আবার চলে গেলো। শিমুল কান্তি নাথ মিনেট পাঁচেক হতভম্বের চুরান্তটি হয়ে আবার ক্লাসে মনযোগ দিলেন। তাঁকে সিলেবাস শেষ করতে হবে। কিন্তু তাঁর আর পড়ানোয় মন নেই। ক্লাসের কোন স্টুডেন্টেরো ক্লাসে মন নেই। শিমুল কান্তি নাথ ভাবছেন ছাত্রটি এরকম অদ্ভুতভাবে তাঁর মনের কথাগুলো কিভাবে ধরতে পারলো? ছাত্র-ছাত্রিরা ভাবছে হাসিবের মত ছেলে আজকে কেন এরকম অদ্ভুত আচরণ করলো? সবাই কমবেশী অবাক।
সবথেকে বেশী অবাক জয়া।শিমুল কান্তি নাথের কিছুই ভালো লাগছিলো না। তাই পড়ানো শেষ হওয়া মাত্র সে বাসায় ফিরে যাবার ডিসেশান নিলো । জয়াদের আরো একটা ক্লাস ছিলো । সেই ক্লাসের সময়েই তাঁরা খবর পেলো শিমুল কান্তি নাথ ভার্সিটির সামনে রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসের ধাক্কা খেয়েছেন। ক্লাস চলাকালিনই সবাই ক্লাস বাদ দিয়ে ছুটে গেলো রাস্তায়।
জয়া দেখলো সত্যি সত্যি শিমুল স্যারের মাথা ফেটে গেছে। রক্তে গোটা রাস্তা ভেসে যাচ্ছে। গোটা ভার্সিটির স্টুডেন্টরা হুমড়ি খেয়ে ভিড় করতে লাগলো ঘটনা দেখতে। ছাত্ররা এটা দেখে সাথে রাস্তা অবরোধ করে সমানে গাড়ি ভাংতে লাগলো। চোখের সামনে যে গাড়ি পাচ্ছে সেটাই তাঁরা ভেঙ্গে চলছে। গাড়ি ভাঙ্গা যেনো তাঁদের মৌলিক অধিকার। সব গাড়িই ভাঙছে কিন্তু যে গাড়ির সাথে শিমুল কান্তি নাথ ধাক্কা খেয়েছেন সেটি ভাঙতে পারছে না।সে গাড়ি নিয়ে ডাইভার কবেই পগারপার হয়ে গেছে। এদিকে যার জন্য এই ভাঙ্গাভাঙ্গি সে যে সেন্সলেস হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে সেটা নিয়ে তাঁদের কোন মাথাব্যথা নেই। তাঁদের যাবতীও মাথাব্যাথা নিরিহ পাবলিকের গাড়ি ভাঙ্গা নিয়ে।
জয়া স্যারের খুব কাছেকাছি দাঁড়িয়ে আছে , সে চাইলেই গিয়ে শিমুল কান্তিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌছে দেবার ব্যাবস্থা করতে পারে । কিন্তু তাঁর ইচ্ছে করছে না । বরং শিমুল কান্তি নাথের মাথা ফেটে রক্ত বেড় হবার দৃশ্য দেখে তাঁর পেটে মোচর দিয়ে বমি আসতে লাগলো। কিন্তু সে বমিকে প্রানপনে আটকে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো । কেও দেখে ফেললে কি লজ্জার ব্যাপার হবে। একটা মানুষ , যে কিনা তাঁর স্যার , একটু আগেই ক্লাস নিয়েছেন সে রাস্তায় মুমুর্ষ অবস্থায় পড়ে আছে অথচ সে কিনা সেটা দেখে বমি করছে! ভালো দেখায় না , কাজেই সে বমি আটকানোর প্রানপন চেষ্টা অব্যহত রাখলো।
এদিকে রাস্তার অসহায় গাড়ির যাত্রিরা ছাত্রদের এই ভাঙ্গাভাঙ্গি দেখে আতংকে অস্থির হয়ে চিৎকার আর কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। ইতিমধ্যে পুলিশ এসে পড়লো । এসেই ছাত্রদের ইচ্ছাতালে পেটাতে লাগলো। পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ লেগে গেলো। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করলো। চারিদিকে ধোঁয়ায় ভরে গেলো। ধোঁয়ার ভেতরেই একদল পুলিশ এসে রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকেই পেটাতে লাগলো। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে ছুটতে লাগলো রাস্তা ছেড়ে।কাঁদানে গ্যাসের কারনে সবার চোখই জ্বলতে লাগলো। সবার ছোটাছুটির মাঝেও জয়া রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। যেকোন সময় পুলিশ এসে তাঁকে আঘাত করতে পারে সেই সেন্স জয়ার নেই।
জয়ার মনে হচ্ছে তাঁর চোখে কেও যেনো মরিচ ডলে দিয়েছে। চোখ থেকে সমানে পানি ঝরছে জয়ার। এর মাঝেই একটা আম্বুলেন্স এসে শিমুল কান্তি নাথকে তুলে নিয়ে গেলো।জয়া অশ্রুঝরা চোখে চারিদিকে অবাক হয়ে তাকাতে লাগলো। তাঁর আশেপাশে এখন কেও নেই। সবাই পালাচ্ছে পুলিশের পিটুনির ভয়ে। সবকিছুই আজকে খুব দ্রুত ঘটে চলছে। একটু আগে শিমুল স্যার যেখানে পড়ে ছিলেন সেখানে রক্ত ইতিমধ্যেই জমে কালো হয়ে গেছে। জয়া অবাক হয়ে সেই রক্তের দিকে তাকিয়ে ভাবলো হাসিব কি তাহলে স্যারের কপালে এই রক্তই দেখেছিলো? সেটার জন্যই আগেভাগে স্যারকে সতর্ক করছিলো? এই সেই চিৎকার। এই সেই ধোঁয়া ! জয়া আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না , তাঁর নিজের কাপড়েই মুখ ভর্তি বমি করে দিলো।
২
জয়া একা একা রাস্তায় হাটছে। সন্ধ্যা নেমে গেছে। সে হাটছে খুব ধীর পায়ে। রাস্তা ফাঁকা। একটু আগেই তাঁর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাঁর কাছে বিশ্বাসই হচ্ছে না। সবটাই স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে । ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। কিন্তু স্বপ্ন ভাঙছে না। জয়া জেগে উঠছে না। জয়ার নাকে তাঁর জামায় লেগে থাকা বমির গন্ধ এসে লাগছে। উৎকট গন্ধ। আজকে পুরো সময়টা জয়ার এমন কেটেছে , যে কখন ক্লাস শেষ হলো, ক্লাসে কি পড়ানো হলো, কখন সে রাস্তায় নেমে এসে স্যারকে মাটিতে রক্তজড়ানো অবস্থায় দেখলো, আর কখনই বা চোখ হাতমুখ ধুয়ে, হাটতে শুরু করলো বাড়ির পথে, কিছুই সে ঠাহর করতে পারছে না। সবকিছু অনেক দ্রুত ঘটে চলছে। জয়ার অবচেতন মনের ভেতরে শুধু হাসিবের আজকের অদ্ভুত আচরণ নিয়েই কটকট করতে লাগলো। তাঁর মত অবস্থা বোধহয় ক্লাসের মোটামুটি সবারই হয়েছে।
হাসিবের প্রত্যেকটা কথা সত্যি হয়েছে। হাসিব কিভাবে এটা পারলো? তবে কি তখন স্যারের সাথে বাদানুবাদের সময় স্যার যেটা ভাবছিলেন সেটাই হাসিব বলে দিচ্ছিল? স্যার কি হাসিবকে এক্সামে কম নাম্বার দেবার কথা ভাবছিলো? এসব ভাবছে জয়া ঠিক তখন চমকে দিয়ে হাসিবকে তাঁর সামনে লক্ষ করলো জয়া। রাস্তাতো ফাঁকা ছিলো , হাসিব আসলো কোথা থেকে! হাসিব যথারিতি দুইহাত দুই দিকে দিয়ে চোখ বুজে আন্ড্রু মারভেলের কবিতা আবৃত্তি করছে
How wisely Nature did decree,
With the same Eyes to weep and see!
That, having view'd the object vain,
They might be ready to complain.
-হাসিব । এই প্রথম জয়া হাসিবকে নাম ধরে ডাকলো। হাসিব ফিরে তাকালো। শান্তশিষ্ট চোখে।
-হু?
- স্যার একসিডেন্ট করেছেন একটু আগে , স্যারের মাথা ফেটে গেছে। অনেক রক্তপাত হয়েছে মনে হয় বাঁচবেন না। ছাত্ররা গাড়ি ভাংচুর করছিলো , পুলিশ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। প্রচুর ধোঁয়া । ঠিক যেমনটি তুমি বলেছিলে। কথাগুলো হরহর করে বলল জয়া। বলেই মনে মনে ভাবলো তাঁর কি কাঁদো কাঁদো হয়ে বলা উচিত ছিলো? তাঁর স্যার একটু আগে এক্সিডেন্ট করেছেন তাঁর কিভাবে ব্যাপারটা বলা উচিত? হাসিব কথাটা শুনে শুধু আরাকবার বলল,
–হু , বলেই আগের মত হাটতে লাগল । জয়া হাসিবের পেছন থেকে তাঁর ডানপাশে এসে হাসিবের সাথে সাথে হাটতে লাগলো। অবাক হবার ভঙ্গি নিয়ে বলল,
- আমার বিশ্বাস তুমি মানুষের অন্তর্যামী, শুধু তাইনা তুমি ভবিষ্যত দ্রষ্টাও। কিভাবে তুমি এটা পারো? জয়া লক্ষ করলো সে হাসিবের সাথে তুমি তুমি করে কথা বলছে। এভাবে কি তাঁর কথা বলা উচিত? হাসিবও তো জয়ার সাথে প্রথমে তুমি তুমি করে বলেছিলো বই দেবার কথা । কাজেই তুমি বলা যেতেই পারে। হাসিব জয়ার কথার কোন উত্তর দিলো না ।
- কি হলো ? কথা বলছো না কেনো? কিভাবে তুমি এটা পারো?
- জানিনা।
- কি জানোনা?
- কিভাবে এটা পারি। মাথা নিচু করে বলল হাসিব।
- হাসিব প্লিজ , সত্যি করে বল তুমি কি এটা সবসময় পারো? অনুনয়ের স্বরে জয়া হাসিবকে জিজ্ঞাসা করলো। হাসিব একদৃষ্ট কিছুক্ষন জয়ার টানাচোখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল ,
- আলেয়াপক্ষী ।
- কিহ?
- সবসময় পারি না , আলেয়াপক্ষী সামনে এসে যখন কিছু বলে তখন পারি। জয়া হাসিবের কথায় এখন আর অবাক হলো না। হাসিবকে দেখার পর থেকে সে এতবেশী ক্রমগত অবাক হয়েছে, আর বিশেষ করে আজকের ঘটনার পর জয়ার অবাক হওয়ার শক্তি মনে হয় সম্পূর্ণ লোপ পেতে বসেছে।
- আলেয়াপক্ষী কে?
- একটা পাখি। নীল রঙের দেখতে । গাড় নীল । আমার সাথে মাঝে মাঝেই তোতা পাখির স্বরে এসে কথা বলে । পাখিটাকে শুধুই আমি দেখি অন্যকেও দেখে না। মাঝে মাঝে এসে মিলিয়ে যায় বলে আমি এর নাম দিয়েছি আলেয়াপক্ষী। আলেয়া যেমন অস্তিত্যহীন সবার কাছেই এই পাখিটাও অস্তিত্যহীন শুধু আমি দেখি । আলেয়ার মত আমার চোখে ধরা দেয় আবার পাখিটাকে ধরতে গেলেই মিলিয়ে যায় আলেয়ার মতই। জয়া লক্ষ করলো হাসিব খুব সুন্দর করে কথাগুলো বলছে। এত সুন্দর করে যে কথা বলতে পারে সে সব সময় চুপ থাকে কেনো?
- তুমি সবসময় চুপচাপ থাকো কেনো ?
- আলেয়াপক্ষী থাকে তাই। আমি কথা বললে সবাই আমাকে পাগল ভাবে। তাই কথা বলতে ইচ্ছা করে না । আজকে স্যারও আমাকে পাগল ভেবেছিলেন। মানুষের ভাবনা গুলো আলেয়াপক্ষী আমাকে জানিয়ে দেয়।
- তারমানে আমার ধারনাই সত্যি , তুমি জানতে আমি তোমাকে কবিতার বইটা দিতে চেয়েছিলাম।
- জানতাম। হাসিবের মুখ থেকে জানতাম কথাটা শোনার পর জয়ার কেনো জানি খুব কান্না পেয়ে বসলো। একটা ছেলে জানতো যে সে তাঁকে পছন্দ করে অথচ কখনো এসে কিছু বলতো না। কথাটা ভাবার সময় জয়ার মনে মনে আবিস্কার করলো আসলেই সে হাসিবকে দেখার প্রথম দিন থেকে তাঁকে পছন্দ করে। জয়া কপ করে হাসিবের হাতটা ধরে বসলো, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল
- তুমি কি আর কিছু জানো ?
- জানি, এখন তুমি কাঁদতে চাইছো, কারন আমি তোমার সাথে যেচে কথা বলিনি। জয়ার হাতের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে কথাটা বলল হাসিব।
-তোমার সাথে কি এখন আলেয়াপক্ষী আছে? হাসিব জয়ার কথায় মাথা নাড়লো।
- আলেয়াপক্ষী কি তোমাকে আর কিছু বলছে না?
- বলছে । হাসিবের মুখে বলছে কথাটা শুনে জয়া পুরোপুরি কেদে দিলো। চোখে কাঁদানে গ্যাসের ইফেকটটা থাকায় হয়তো সহজেই কেঁদে দিতে পারলো
- কি বলছে ? জয়ার প্রশ্নে হাসিব জয়ার চোখের দিকে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলো । অশ্রুতে জয়ার কালো মাশকারা ভিজে গাল বেয়ে পড়ছে। তাতে মোটেও জয়াকে খারাপ দেখাচ্ছে না বরং আরো সুন্দর লাগছে। শিল্পীর তুলিতে জলরঙ্গে আঁকা ছবির মত। শিল্পীর অসাবধানতার কারনে কিছু হালকা কালোরং চিত্রপটের গাল বেয়ে নামছে। হাসিব জয়ার ২ হাত ধরে তাঁকে কাছে টেনে নিলো। ল্যাম্পোস্টের আলোতে ঠোটের খুব কাছে ঠোট নিয়ে গিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
- যা বলছে তাতো আমার মনেও লিখা আছে। জয়া আমিও তোমাকে ভালোবাসি। যেদিন প্রথম তুমি আমায় দেখে আমার দিকে এগিয়ে এসেছিলে হয়তো সেদিন থেকেই । তুমি বইটি আমায় দিতে চেয়েও দিতে পারছিলে না শেষে তাই আমি গিয়েই বইটি চেয়ে নিয়েছিলাম। বইটি আমার কাছে আগেই ছিলো। এন্ড্রু মারভেল আমার প্রিয় কবি। তবুও আমি তোমার বইটি নিয়েছিলাম । এখন উত্তর মিলিয়ে নাও ।
জয়া উত্তর মিলাতে চাইলো না সে উবু হয়ে ঠোট দিয়ে হাসিবের ঠোট স্পর্শ করলো। হাসিব জয়ার চুম্বন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। শান্ত কন্ঠে বলল
- জয়া , তোমার কাছ থেকে বইটা নেবার পড়েই আমার কাছে আলেয়াপক্ষী এসেছিলো । বলেছিলো তুমি আজকে রোড এক্সিডেন্টে মারা যাবে। এটাই প্রকৃতি ঠিক করে রেখেছে। আমি মেনে নিতে পারিনি। আমি আলেয়াপক্ষীকে বলে ভবিষ্যতটুকু পরিবর্তন করে দিতে চেয়েছি । প্রকৃতি রাজি হয়েছে স্যারের এক্সিডেন্টের বদলে। আমি সেজন্য বারবার স্যারকে সতর্ক করে দিতে চেয়েছি। স্যার আমাকে পাগল ঠাওরেছেন। আমি প্রকৃতির সিদ্ধান্তে বদল আনতে চেয়েছি শুধু তোমার জন্য। তোমাকে এভাবে যাতে আঁকড়ে ধরে থাকতে পারি সেজন্য কিন্তু প্রকৃতির সিদ্ধান্ত বদলালে জরিমানা গুনতে হয় । জয়া আমাকেও জরিমানা গুনতে হবে ।
আলেয়াপক্ষী তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে চলে যেতে বলেছে। এটাও প্রকৃতির সিদ্ধান্ত । আজ তোমার সাথে আমার শেষ দেখা । শেষ দেখায় বলে গেলাম ভালোবাসি বড় ভালোবাসি তোমায়। কথাটা বলে হাসিব নিজেই এবার জয়ার ঠোটে চুমু দিলো । তারপর হাত ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে হাটতে লাগলো।
জয়া নির্বাক হয়ে হাসিবের চলে যাওয়া দেখতে লাগলো। কান্নার নোনা অশ্রুতে জয়ার গলা ভিজে যাচ্ছে জয়ার। ভেতর থেকে আরো কান্না এসে দলামোচরা পাকাচ্ছে বুকের ভেতর । সেই কান্না-জরিত কন্ঠে সে হাসিবকে বলছে
– হাসিব যেও না, হাসিব আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি তোমাকে ভালোবাসি , আমাকে তোমার বুকে আগলে রাখো। আমাকে ছেড়ে যেও না । কিন্তু প্রবল কান্নার বেগে জয়ার কন্ঠে কোন শব্দ হলো না। সে হাটুগেরে কাঁদতে কাঁদতে হাসিবের চলে যাওয়া দেখতে লাগলো । ল্যাম্পোস্টের আলোয় হাসিবের ছায়া হেটে যাচ্ছে। এই ছায়া আর কোনদিন জয়ার দেখা হবে না , হাসিবকে দেখা হবে না। হাসিবের ঠোটে চুমু দেয়া হবে না। জীবনের প্রথম কারো প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি করেও তাঁকে হারিয়ে ফেলল জয়া..................।
রাতে বাসায় ফিরে জয়ার প্রচন্ড জ্বর আসলো। ডাক্তার এসে দেখে গেলো। জ্বরের ঘোরে সে আবলতাবল বকতে লাগলো। বারবার আলেয়াপক্ষী বলে ডাকতে লাগলো। জ্বরের ঘোরে সে দেখলো হাসিবের সমস্ত শরীরে রক্ত। রক্তে হাসিবের সবুজ ট-সার্ট খয়রি হয়ে গেছে। হাসিবের ঠোটেও রক্ত লেগে আছে। সে অবস্থায় হাসিব তাঁকে বলছে জয়া , তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে স্যারকে মেরে ফেলাই বা কেমন কথা। আলেয়াপক্ষীকে বলেছি আবার প্রকৃতির সিদ্ধান্ত বদল করে দিতে । স্যার এখন সুস্থ আছেন বুঝলে? তবে আমাকে আবারো জরিমানা গুনতে হবে। বলেই হাসিব জয়াকে চুমু খেলো। হাসিবের ঠোটের রক্ত এসে জয়ার ঠোটে লাগলো।এই স্বপ্ন দেখে জয়ার জ্বর আরো বেড়ে গেলো । ১০৪ ডিগ্রি জ্বর উঠল। সেন্সলেস অবস্থায় জয়াকে হস্পিটালে ভর্তি করানো হলো ।
জয়ার জ্বর চারদিন থাকলো। চারদিন সেন্সলেস থেকে জয়ার জ্ঞান ফিরলো।পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ২ সপ্তাহ পর ভার্সিটিতে জয়া এসে শুনলো, ঐ ঘটনার পরদিন থেকে হাসিব আর ভার্সিটিতে আসে নাই। শিমুল কান্তি নাথ স্যারও নাকি বেঁচে আছেন। গতকালই হাস্পাতাল থেকে রিলিস নিয়ে বাসায় চলে গেছেন।কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনে জয়া নিভৃতে গিয়ে জানালার পাশে দাড়ালো। এখানে আগে হাসিব দাঁড়িয়ে থেকে আকাশ দেখতো। জয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো । একরাশ হাহাকারের সাথে জয়ার চোখ থেকে কয়েকফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো। জয়ার এই হাহাকারময় অশ্রু কি হাসিব দেখছে?
লেখকঃ আল মুকিতুল বারী।
©somewhere in net ltd.