নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কেমন করে বাঁজাও বাঁশি সুর যেন গো সর্বনাশী থাকতে আমায় দেয়না গৃহ কোনে , ওঝা যেমন বীনের টানে গর্ত থেকে সর্প আনে তেমনি করে টানছো তোমার পানে।
ভূমিকা
তোরা সব জয়ধ্বনি কর !
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখীর ঝড়।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর !
তোরা সব জয়ধ্বনি কর !!
সময়ের যাত্রা চলে নিরবধি, নিরন্তর। মহাকালের রথ সেই পথযাত্রায় সরিয়ে দেয় পুরাতনকে; সাদরে গ্রহণ করে নূতনকে। নতুন বছরের পরিক্রমা শুরু হলো বাঙালির নিজস্ব বর্ষপঞ্জিতে ১৪২২ বঙ্গাব্দ । বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষের জীবনে এলো এক অমলিন আনন্দের দিন। ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের বাঙালি মনস্ক মানুষের মাঝে এক ও অভিন্ন হৃদয়াবেগের সৃষ্টি হয়। এই আবেগ বাঙালির আপন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে জাতিসত্ত্বার পরিচয়কে নতুন তাৎপর্যের উপলব্ধিতে গৌরববোধ করে তোলে। এই গৌরব ও চেতনাই বাঙালিকে প্রেরণা যুগিয়েছে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে।
বাংলা নববর্ষ বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সার্বজনীন উৎসব। সারা বিশ্বের বাঙালিরা এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল ‘বাংলা নববর্ষ’-এর উৎসব পালিত হয়।
ইতিহাস
বাংলা সনের প্রবর্তন কবে হয়েছিলো বা কে ইহার প্রবর্তক, তা’ নিয়ে পন্ডিত মহলে আছে নানা বিতর্ক। কেউ কেউ মনে করেন, রাজচক্রবর্তী রাজা শশাঙ্ক, কেউ বলেন, বাংলার স্বাধীন সুলতান হোসেন শাহ; আবার এমনও শোনা যায়, তিব্বতের রাজা স্রংসন বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তবে, বেশির ভাগ মনিষিদের মতে, মোগল সম্রাট মহামতি আকবর বাংলা সনের প্রবর্তক। তিনি ‘তরিক-ই-ইলাহি’ নামের যে নতুন সনের প্রবর্তন করেছিলেন দিল্লীতে; তার ধারাবাহিকতাই বাংলা সনের সৃষ্টি। এখানে উল্লেখ্য যে, ‘সন’ শব্দটি আরবি আর ‘সাল’ শব্দটি ফারসি। এই দু’টি শব্দের কারনে বাংলা সন বা সাল মুসলিম শাসকদের প্রবর্তিত বলে পন্ডিতজনেরা মনে করেন। বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা, নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন এবং বিহারের ঐতিহাসিক অধ্যাপক কাশীপ্রসাদ জয়সোয়াল প্রমূখ প্রখ্যাতজনেরা মনে করেন, বাংলা সনের উদ্ভাবক সম্রাট আকবর।
ভারতবর্ষে মুঘল সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাটরা হিজরী পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের উপর নির্ভলশীল হওয়ায়, তা’ কৃষি ফলনের সাথে মিলতো না। চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। একারণে চান্দ্র বৎসরে এ অঞ্চলের ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। কিন্তু চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এতে অসময়ে কৃষকদেরকে খাজনা পরিশোধ করতে বাধ্য করা হতো। খাজনা আদায়ে সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর তাঁর নবরত্নের ইরানীয় বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদ আমির ফতেহউল্লাহ শিরাজীকে প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। সম্রাটের আদেশ মতে ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরী সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ১১ই মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় ঊনত্রিশ বছর পূর্বে সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় থেকে। সেই তারিখটি ছিলো ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ সাল। তা’ ছিলো ৯৬৩ হিজরী সালের প্রথম মাস ‘মুহররম মাস’ আর বাংলায় বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়। প্রথমদিকে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
বছরের প্রথম দিনে আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার রীতি-রেওয়াজ সুপ্রাচীনকাল হতে চলে আসছিলো। সেই ধারাবাহিকতায় সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন শুরু হয়। সুবেদার মুর্শিদ কুলি খানের সময়ে বৈশাখ মাসের শুরুতে এক ধরনের আর্থ-সামাজিক আনন্দ উৎসবের সূচনা হয়েছিলো বলে গবেষকরা মনে করেন। কৃষি প্রধান বাংলায় খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বছরের প্রথম দিনে পুণ্যাহের আয়োজন করতেন রাজা বা জমিদারগণ। প্রজারা বছরের প্রথম দিন খাজনা দিয়ে নতুন বছরের জন্য জমির পত্তন নিতেন। এ উপলক্ষ্যে রাজা বা জমিদারগণ প্রজাদের জন্য খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতেন। এইসব অনুষ্ঠানে কৃষিজ ও কারুপণ্য নিয়ে মেলার আয়োজন করা হতো এবং চিত্ত বিনোদনের বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করা হতো। এই উৎসবটি একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। যার রূপ পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে এই পর্যায়ে এসেছে।
পুণ্যাহ অনুসরনে ব্যবসায়ীদের মাঝেও আরেকটি অনুষ্ঠানের সংযোগ ঘটেছিলো। তা হলো, ‘হালখাতা’। হালখাতা মূলতঃ অর্থনীতিনির্ভর অনুষ্ঠান। এ দিনের উপলক্ষ্যে ব্যাবসায়ীরা তাদের দোকান বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধুয়ে মুছে পরিস্কার করতেন। সোনা-রূপার পানি বা পঞ্চবটির পাতা ভেজানো পবিত্র জল ছিটায়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে পবিত্র করতেন। সংবৎসর যারা বাকিতে মালপত্র ক্রয় করতেন, তাদেরকে নিমন্ত্রন করা হতো। খাতকেরা পুরনো বাকি পরিশোধ করে, নতুন খাতায অগ্রিম অর্থ জমা করতেন। ব্যাবসায়ীরা তাদেরকে বিভিন্ন উপাদেয় খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়াতে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং হালখাতার অনুষ্ঠানের জৌলসও ক্রমান্বয়ে হারাতে থাকে।
আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের তথ্য প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
বাঙালিদের বৈশাখী উৎসব একেবারেই আধুনিক কালের। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে পহেলা বৈশাখ উৎসবের তেমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। বিশেষ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গান ও কবিতায় বৈশাখকে তুলে ধরেছেন নানান রূপের নতুন আঙ্গিকে। খরতপ্ত বৈশাখের অন্তর্নিহিত শক্তিকে আহ্বান করেছেন জীর্ণ ও পুরাতনকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য। তিনিই বৈশাখকে চিরকালের জন্য বাঙালি চেতনায় স্থান করে দিয়ে গেছেন সৃজন, নবীনতা, প্রেরণা ও আনন্দের অনিঃশেষ শক্তির উৎস হিসেবে। ফলে, বাংলা নববর্ষ হয়ে উঠে মানুষের স্বতঃস্ফুর্ত আন্তরিক মিলনমেলা। স্বার্থহীন মানবমৈত্রির গভীরতর দ্যোতনায় বৈশাখের এ অনুষ্ঠান হয়ে উঠে সর্বসম্প্রদায়ের সম্প্রীতি ও ঐক্যচেতনার প্রতীক। অতীত ঐতিহ্যের গৌরব, সংস্কৃতির অনুরাগ আর জাতিসত্ত্বার চেতনায় পহেলা বৈশাখের উৎসব আজ নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিণত হয়েছে বাঙালির জীবনের প্রধান উৎসবে।
বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপন
নতুন বছরের উৎসবের সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর কৃষ্টি ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। গ্রামের মানুষ ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, নতুন অথবা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরিধান করে আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে যায়। বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হয় এবং মোটমুটি সুন্দর করে সাজানো হয়। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থাও থাকে। কয়েকটি গ্রামের মানুষ-জন মিলিত হয়ে এলাকার কোন খোলা মাঠে বা কোন বৃহৎ গাছের নিচে আয়োজন করতেন বৈশাখী মেলার। নববষর্ উপলক্ষ্যে উৎসবমূখর বৈশাখী মেলা মূলতঃ একটি সর্বজনীন লোকজ মেলা। এ মেলা অত্যন্ত আনন্দঘন হয়ে থাকে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য, কারুপণ্য, লোকশিল্পজাত পণ্য, কুটির শিল্পজাত সামগ্রী, সকল প্রকার হস্তশিল্প ও মৃৎশিল্পজাত সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের সাজ-সজ্জার সামগ্রী এবং বিভিন্ন লোকজ খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যায়। শিশু-কিশোরদেও আকর্ষণের জন্য বায়োস্কোপ, পুতুলনাচ, নাগরদোলা, সার্কাস ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। আর থাকে পিঠা-পুলির আয়োজন। এই দিনের একটি পুরনো সংস্কৃতি হলো গ্রামীণ ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন। এর মধ্যে থাকে নৌকাবাইচ, লাঠি খেলা কিংবা কুস্তি ইত্যাদি।
গ্রামীণ মেলা
নববর্ষের গ্রামীণ উৎসব অনুষ্ঠান ও মেলা এখনো কিছু পরিমান চালু আছে। কুষ্টিয়া, নড়াইল ও কিশোরগঞ্জ জেলায় লাঠিখেলা বা কাঠি নাচ। ময়মনসিংহের কেন্দুয়ায়, নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলে যাড়ের লড়াই; ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় মোরগ লড়াই; মুন্সিগঞ্জে গরুর দৌড়; মানিকগঞ্জসহ অন্যান্য স্থানে হা-ডু-ডু খেলা। বাংলাদেশে এরকম কুস্তির সবচেয়ে বড় আসরটি হয় ১২ বৈশাখ, চট্টগ্রামের লালদিঘী ময়দানে। এটি ‘জব্বারের বলি’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশের যেসকল স্থানে এখনো বৈশাখী মেলার আয়োজন করা হয়, উল্লেখযোগ্য হলোঃ নারায়নগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সাভার, রংপুরের পায়রাবন্দ, দিনাজপুরের ফুলছড়িঘাট এলাকা, মহাস্থানগড়, কুমিল্লা লাঙ্গলকোট, চাঁপাই নবারগঞ্জ, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চল, সিলেটের জাফলং, মণিপুর, বরিশালের ব্যাসকাঠি, বাটনাতলা, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, টুঙ্গিপাড়া, মুজিবনগর এলাকা ইত্যাদি। এছাড়াও ঢাকার নিকটবর্তী শুভাঢ্যার বৈশাখী মেলা, টঙ্গীর স্নানঘাট মেলা, মিরপুরের দিগাঁও মেলা, সোলারটেক মেলা, শ্যামসিদ্ধি মেলা, ভাগ্যকুল মেলা, কুকুটিয়া মেলা এবং রাজনগর মেলা উল্লেখযোগ্য। দিনাজপুরের ফুলতলী, রাণীশংকৈল, রাজশাহীর শিবতলীর বৈশাখী মেলা বর্তমানেও বিরাট উৎসবের সাথে পালিত হয়।
ছায়ানটের বর্ষবরণ
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে পহেলা বৈশাখের মূল অনুষ্ঠানের কেন্দ্রবিন্দু সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট-এর গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে আহ্বান করা হয়। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা রমনার বটমূলে সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। স্থানটির পরিচিতি ‘বটমূল’ হলেও প্রকৃতপক্ষে যে গাছের ছায়ায় মঞ্চ তৈরি হয়, সেটি বট গাছ নয়, অশ্বত্থ গাছ। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা।
মঙ্গল শোভাযাত্রা
ঢাকায় বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ১৯৮৯ সালে এই শোভাযাত্রার প্রথম প্রচলন শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে। পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় রং-বেরঙের মুখোশ ও বিভিন্ন পশু-পাখির মুখাকৃতির ছবিসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের নানা অনুসঙ্গকে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা পহেলা বৈশাখের উৎসবের একটি অন্যতম আকর্ষণ।
বউমেলা
নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁয়ে ব্যতিক্রমী এক মেলা বসে, যার নাম ‘বউমেলা’। জয়রামপুর গ্রামের মানুষের ধারণা, প্রায় ১০০ বছর ধরে পহেলা বৈশাখে শুরু হওয়া এই মেলা পাঁচ দিনব্যাপী চলে। প্রাচীন একটি বটবৃক্ষের নিচে এই মেলা বসে, যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর পুজো হিসেবে এখানে সমবেত হয়। বিশেষ করে কুমারী, নববধূ, এমনকি জননীরা পর্যন্ত তাঁদের মনস্কামনা পূরণের আশায় এই মেলায় এসে পূজা-অর্চনা করেন। সন্দেশ-মিষ্টি-ধান দূর্বার সঙ্গে মৌসুমি ফলমূল নিবেদন করে ভক্তরা। একদা পাঁঠাবলির রেওয়াজও ছিলো। এখন কপোত-কপোতি উড়িয়ে শান্তির বার্তা পেতে চায় ভক্তরা দেবীর কাছ থেকে। বউমেলায় কাঙ্খিত মানুষের খোঁজে নারীরা প্রার্থনা করে থাকেন।
ঘোড়ামেলা
এ ছাড়া সোনারগাঁ থানার পেরাব গ্রামের পাশে আরেকটি মেলার আয়োজন করা হয়। এটির নাম ‘ঘোড়ামেলা’। লোকমুখে প্রচলিত, জামিনী সাধক নামের এক ব্যক্তি ঘোড়ায় করে এসে নববর্ষের এই দিনে সবাইকে প্রসাদ দিতেন এবং তিনি মারা যাওয়ার পর ঐ স্থানেই তাঁর স্মৃতিস্তম্ভ বানানো হয়। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে স্মৃতিস্তম্ভে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা একটি করে মাটির ঘোড়া রাখে এবং এখানে মেলার আয়োজন করা হয়। এ কারণে লোকমুখে প্রচলিত মেলাটির নাম ঘোড়ামেলা। এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে নৌকায় খিচুড়ি রাখা হয়। উপস্থিত সকলেই কলাপাতায় আনন্দের সঙ্গে তা’ ভোজন করে। সকাল থেকেই এ স্থানে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। শিশু-কিশোররা সকাল থেকেই উদগ্রীব হয়ে থাকে মেলায় আসার জন্য। যদিও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ মেলার আয়োজন করে থাকেন; তথাপি, সব ধর্মের লোকজনেরই এ মেলায় ভিড় করে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের ভিড় বেশি থাকে। মেলায় নাগরদোলা, পুতুল নাচ ও সার্কাসের আয়োজন করা হয়। নানারকম আনন্দ-উৎসব করে, যখন সন্ধ্যায় লোকজন অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখনই এ মেলার ক্লান্তি দূর করার জন্য নতুন মাত্রায় যোগ হয় কীর্তন। এ কীর্তন চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। এভাবেই শেষ হয় বৈশাখের এই ঐতিহ্যবাহী ঘোড়া মেলার।
পান্তা ইলিশ:
বাংলাদেশের প্রাচীন একটি সংস্কারমূলক উৎসব ছিলো, যার নাম ‘আমানি’ উৎসব। পরিবারের কল্যাণ ও পারিবারিক কৃষির সম্মৃদ্ধি কামনার্থে এ উৎসব পালন করা হতো। এই পারিবারিক উৎসবের আচার সম্পন্ন করতেন বাড়ির মহিলাকর্ত্রী ‘আমানি’ বা পান্তা খেয়ে। হয়তো, তার ধারাবাহিকতয় আধুনিককালের বর্ষবরণের অন্যতম অনুসঙ্গ হল পান্তা-ইলিশ। যেন এই পান্তা-ইলিশ না হলে আর পহেলা বৈশাখের কোন আমেজই থাকে না। আর এই সুযোগে রমনার লেকের পাড়েই অনেকে বসে পড়েন পান্তা-ইলিশ খেতে। সাথে থাকে কাঁচা লঙ্কা। মানে সম্পূর্ণ ভাবেই বাঙালিয়ানার পরিচয় দিতে যেন ব্যস্ত সবাই।
পার্বত্য জেলার আদিবাসীদের বর্ষবরণ
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান তিনটি ক্ষুদ্রজাতিসত্ত্বা রয়েছে। যাদের প্রত্যেকেরই বছরের নতুন দিনে উৎসব পালন করে থাকে। এ উৎসবটি ত্রিপুরাদের কাছে ‘বৈসুক’ বা ‘বৈসু', মারমাদের কাছে ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের কাছে ‘বিজু’ নামে পরিচিত। বর্তমানে তিনটি জাতিসত্ত্বা একত্রে মিলিত হয়ে নববর্ষের এই উৎসবটি পালন করে। যৌথ এই উৎসবের নাম ‘বৈসাবি’। বৈসাবী নামকরনও করা হয়েছে এই তিনটি উৎসবের প্রথম অক্ষর গুলো নিয়ে। ‘বৈ’ ত্রিপুরাদের বৈসুক বা বৈসু থেকে, ‘সা’ মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং ‘বি’ চাকমাদের বিজু থেকে। এই তিনটি অক্ষরের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’। এ উৎসবের নানা দিক রয়েছে। এটি তাদের প্রধান সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর একটি বৃহৎ অনুষ্ঠান। ‘বৈসাবি’ অনুষ্ঠানের মধ্যে একটি হলো মারমাদের পানি উৎসব। পানি উৎসবটি প্রতিটি এলাকাতেই কমবেশি জনপ্রিয়। এ উৎসবে আদিবাসীরা সবাই পরস্পরের দিকে পানি ছুঁড়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন যেন গত বছরের সকল দুঃখ-গ্লাণী, পাপ ধুয়ে যায়। মারমা যুবকরা তাদের পছন্দের মানুষটির গায়ে পানি ছিটানোর মাধ্যমে সবার সামনে ভালোবাসা প্রকাশ করে। ভালোবাসার এমন বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস, এমন বর্ণাঢ্য অনুভূতি আর কোথাও দেখা যায় না।
পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখ উদযাপন
ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা পহেলা বৈশাখ উদযাপনে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। নববর্ষ উপলক্ষে শহরের বিভিন্ন পাড়ার অলিতে গলিতে নানা সংগঠনের উদ্যোগে প্রভাতফেরি আয়োজিত হয়। পশ্চিমবঙ্গে মহা সমারোহ ও সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় বাংলা নববর্ষারম্ভের পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিনটিতে বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার সাথে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়ে থাকে সমগ্র পশ্চিম বাংলায়। বাংলার গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের মেলবন্ধন সাধিত হয়ে সকলে একসূত্রে আনন্দে মেতে উঠে নতুন বছরকে বরণ করার জন্য। গ্রামাঞ্চলে এবং কলকাতা শহরের উপকণ্ঠে পহেলা বৈশাখ থেকে আরম্ভ হয় বৈশাখী মেলা। এই মেলা সমগ্র বৈশাখ মাস জুড়ে চলতে থাকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পয়লা বৈশাখ
পৃথিবীর যে সকল দেশে বাঙালিরা বসবাস করে, সে সকল দেশে বিপুল আনন্দ উৎসাহের সাথে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষেরা একত্রিত হয়ে নাচ, গান, ফ্যাসন শো ইত্যাদি মাধ্যমে নববর্ষকে জাঁকজমকের সাথে বাঙালি সংস্কৃতির এ ধারাকে আনন্দময়তায় পালন করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরা এবং সুইডেনে বিপুল উৎসাহের সাথে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়। ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী প্রবাসী বাঙালিরা ‘স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল’ (পথ উৎসব) পালন করে। এই উৎসবটি লন্ডনে করা হয়। এটি ইউরোপে অনুষ্ঠিত সর্ববৃহৎ এশীয় উৎসব। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সর্ববৃহৎ বাঙালি উৎসব।
শেষকথা
কালের বিবর্তনে নববর্ষের সঙ্গে সম্পর্কিত অনেক পুরনো উৎসবের বিলুপ্তি ঘটেছে। আবার সংযোগ ঘটেছে অনেক নতুন উৎসবের। বর্তমানে নগরজীবনে নগর সংস্কৃতির আদলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উৎযাপিত হয়। এদিন সাধারনতঃ সকল শ্রেণীর এবং সকল বয়সের মানুষ ঐতিহ্যবাহী বাঙ্গালি পোষাক পরিধান করে। নববর্ষকে স্বাগত জানাতে তরুণীরা লালপেড়ে সাদা শাড়ি, হাতে চুড়ি, খোপায় ফুল, গলায় ফুলের মালা এবং কপালে টিপ দেয়। আর ছেলেরা পাজামা ও পাঞ্জাবি পরে, কেউ কেউ ধুতি পাঞ্জাবিও পরে। এদিন সকালে পান্তা- ইলিশ ও নানারকম ভর্তা খাওয়া একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। বর্ষবরণের চমকপ্রদ ও জমজমাট আয়োজন ঘটে রাজধানী ঢাকায়। রমনার বটমুলে বৈশাখী উৎসবের অনুষ্ঠান মালা এক মিলন মেলার সৃষ্টি করে। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে রমনা উদ্যান ও এর চারপাশের এলাকায় উচ্ছল জনস্রোতে সৃষ্টি হয় জাতীয় বন্ধন। ছায়ানটের উদ্যোগে জনাকীর্ণ রমনার বটমূলে (অশ্বত্থ তলে) রবীন্দ্রনাথের বৈশাখী আগমনী গান গেয়ে নতুন বর্ষকে বরণ করা হয়-
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক
এসো এসো…
১২/০৪/২০১৫
মিরপুর, ঢাকা।
তথ্যসূত্রঃ নেট
©somewhere in net ltd.