নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বাংলা অামার তৃষ্ণার জল

কয়েস সামী

i m nothing in this huge world...

কয়েস সামী › বিস্তারিত পোস্টঃ

কী ভাবিয়া মনে এ দুটি নয়নে উথলে নয়নবারি- ষষ্ঠ পর্ব

২২ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:০৪


৯.
জয়ীতা মেসেজ দিয়েছে-

‘চিলেকোঠার উন্মাদিনী। লেখক, চিন্ময় গুহ। বইটা ভীষণ দরকার। কালকের মধ্যেই।’

জয়ীতার মেসেজগুলো পড়লে আগের দিনের টেলিগ্রামের কথা মনে পড়ে যায়। বাবার কাছ থেকে শুনেছি, টেলিগ্রাম নাকি এভাবেই সংক্ষিপ্তভাবে লেখা হতো। শব্দ গুনে বিল আসতো, তাই যতটা সম্ভব কম শব্দ ব্যবহার করা হত। সেই বার্তা এক ঘন্টার মধ্যে গিয়ে পৌছে যেতো প্রাপকের কাছে। টেলিগ্রামের কথা শুনলেই প্রাপকের বুকটা দুরু দুরু কেঁপে উঠতো। না জানি, ওটা কী শোক বার্তা নিয়ে এসেছে তার জন্য! হয়তো বা, কারো মা অসুস্থ। বাবা ছেলের কাছে লিখেছেন,

Mother ill. Come Sharp.

সংবাদ পেয়েই ছেলে বুঝে নিতো মা যেমন তেমন অসুস্থ না। খুব বেশি অসুস্থ। নয়তো চিঠি আসতো। টেলিগ্রাম আসতো না। সব কাজ ফেলে রেখে ছেলে ছুটে যেত বাড়িতে।

বাড়ি থেকে অফিস ফিরতে হয়তো দেরী হচ্ছে। অফিস প্রধানের কাছে টেলিগ্রাম আসতো-

One day leave solicited.

ঠিক টেলিগ্রামিক ভাষায় জয়ীতার মেসেজ পেয়ে আমার বুকের ধুক-ধুকানিটাও বেড়ে গেল মুহুর্তে। জয়ীতার একটা বই দরকার। সে জানে আমাকে কোন দায়িত্ব দিলে আমি তা ঠিক ঠিক পালন করি। সে সবার চেয়ে বেশি নির্ভর করে আমার উপর। তার এ নির্ভরতা খুব ধীরে ধীরে অর্জন করতে হয়েছে আমাকে। সে তখন ক্লাস এইটে পড়ে। একটা রচনা শিখতে গিয়ে সে আটকে গিয়েছিল। রাচনাটা কোথাও খুঁজে পাচ্ছিল না। ভাগ্যক্রমে আমি তখন রাজের সাথে বসে দাবা খেলছিলাম। সে রাজকে এসে ব্যাপারটা বলল। রাজ তখন চেক মেট থেকে বাঁচার প্রাণপন চেষ্টা করছে। জয়ীতার কথায় কান দেয়ার সময় তার নাই। আমি রাজকে চাল দিতে বলে উঠে গেলাম। আমার কাছে তখন অনেকগুলো রচনার বই ছিল। আমি দৌড়ে বাসায় গিয়ে সবগুলো বই ঘেঁটে রচনাটা খুঁজে বের করলাম। জয়ীতা রচনাটি হাতে পেয়ে আমার দিকে যেভাবে তাকিয়েছিল তা আমার আজো মনে আছে। এর পর থেকে কোন দরকার হলেই জয়ী আমাকে জানাতো। আমি তো ততোদিনে জয়ীর প্রেমে পাগলপারা। তার যে কোন দরকার পূরনে আমার সাধ্যমতো চেষ্টায় কোন কার্পণ্য করি নি। আজও করবো না। যদিও কাল আমার এফসিপিএস পার্ট ওয়ান পরীক্ষা। পড়বো বলে ছুটি নিয়েছি। পড়াশুনা চুলোয় যাক। জয়ীর চাওয়াটা আগে পূরণ করি। বেঁচে থাকলে পড়াশুনার অঢেল সময় পাওয়া যাবে। জয়ীকে পাওয়া যাবে না।

ইদানিং বই খোঁজার সবচেয়ে সহজ মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। ঘরে বসেই যে কোন ধরনের বই খুঁজে পাওয়া যায়। কিনে নেয়া যায়। রকমারি.কম এদেশে অনলাইন বইয়ের ব্যবসায় রীতিমতো বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে। এখন রকমারিকে দেখে অবশ্য অনেকগুলো ইন্টারনেট ভিত্তিক লাইব্রেরী তৈরী হয়ে গেছে। চিলেকোঠার জবানবন্দী। নাহ! রকমারী.কমে নাই। একে একে অন্য সাইটগুলোতেও খুঁজলাম। না। পাওয়া গেল না। দেখা যাক পিডিএফ কোন ভার্সন পাওয়া যায় কি না। গুগলে সার্চ করলাম। না। তাও নাই। জয়ী অবশ্য পিডিএফ একদম পছন্দ করে না। ওর কথা কোন নতুন বই শুরুর আগে তার গন্ধ নিতে হয়। তবেই না সেই বই হৃদয়ে প্রবেশ করবে! তাহলে কী করা যায়? আমাদের চট্টগ্রামে বেশ বড় একটা লাইব্রেরী আছে। নাম- বই মেলা। বাংলাদেশে সেরা সেরা লাইব্রেরীগুলোর মধ্যে এটা অন্যতম। তবে এটাতে নিশ্চয়ই বইটা খোঁজা হয়েছে। জয়ী বইমেলা থেকেই বই কেনে। বইমেলাতে না পেয়ে তবেই হয়তো আমার কাছে চাওয়া হয়েছে। তাহলে কী করা? সময় তো বেশি নাই। আজকাল আগের মতো আর কেউ বই পড়ে না। যদি পড়তো বন্ধুদের কাছেও হয়তো পাওয়া যেত। যে বয়সে আমরা প্রচুর বই পড়তাম, সে বয়েসের ছেলেমেয়েরাতো বই পড়া যে একটা অবসর কাটানোর দুর্দান্ত মাধ্যম, নিজের দুঃখ ভুলে যাওয়ার একটা কার্যকর উপায়, সেটাই জানে না। কিছুদিন আগে কলেজ রোড নামের লিটল ম্যাগ হাতে পেয়েছিলাম। সেখানে কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন রাখা হয়েছিল- একসময় আমরা এতো এতো গল্পের বই পড়তাম। তোমরা পড় না কেন?
প্রায় সবাই একরকম উত্তর দিয়েছিল। বলেছিল, আপনাদের সময় তো সময় কাটানোর জন্য মোবাইল গেমস বা ফেসবুক, ভাইবার, ইমো, ইউ টিউব এগুলো ছিল না। থাকলে আপনারাও পড়তেন না।
তাদের উত্তর দেখে অবাক হয়েছিলাম। হয়তোবা তাদের কথাই ঠিক। কী জানি! কিন্তু এই মুহুর্তে আমার এসব চিন্তা করার সময় নেই। বইটা তাড়াতাড়ি আমাকে পেতেই হবে। পেতেই হবে। জয়ীর মায়া আর কৃতজ্ঞতায় ভরা সেই চাহনি আমাকে পেতেই হবে। এখন বাজে রাত বারোটা। একটু পরেই একটা নাইট কোচ ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়বে। এখনই যদি রওনা দেই কাল নীলক্ষেত থেকে বইটা নিয়ে সন্ধ্যার আগে ঠিক পৌছে যেতে পারবো জয়ীর সামনে। এফসিপিএস পরীক্ষার জন্য তো এমনিতেই আজ রাতে যাওয়ার কথা। তাই মা কোন বাঁধা দিল না। উপরন্তু দোয়া দুরুদ শুরু করে দিল তার ছেলের পরীক্ষা যেন ভাল হয়। আমি বের হয়ে গেলাম-

ঢাকার উদ্দেশ্যে,

নীলক্ষেতের উদ্দেশ্যে,

জয়ীর সেই অবাক চোখগুলো দেখার উদ্দেশ্যে,

জয়ীকে এটা বুঝাবার উদ্দেশ্যে যে, আমি তার জন্য এ বিশ্ব সংসার তন্ন্ তন্ন করে নিয়ে আসতে পারবো একশো একটা নীল পদ্ম।

পরদিন দুপুরবেলা বাসে উঠলাম। হাতে তখন চিলেকোঠার জবানবন্দী বইটা। বিজয়ীর বেশে আমি। নীলক্ষেতে দুই ঘন্টা হাটতে হাটতে বইটা পেলাম। কী যে আনন্দ মনে! আহ! ছোট বেলায় ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছন ছুটতে ছুটতে একসময় সবাইবে পরাজিত করে ঘুড়িটা ধরতে পেলে যে আনন্দ পেতাম. এ যেন ঠিক সেই রকম অনুভূতি। যদিও বা এফসিপিএস ভর্তি পরীক্ষাটা মিস হয়ে গেল। চুলোয় যাক পরীক্ষা। পরীক্ষা তো আজীবন আমার জন্য অপেক্ষা করবে। জয়ী কি করবে? তার তো বিয়ে সামনে। সে চলে যাবে। আমাকে ছেড়ে সে কোন দূরে চলে যাবে। আর কি ওমন করে আমার কাছে কিছু চাইবে সে? তার জন্য কিছু করে যে আনন্দ পাওয়া- তার তো আর কোন সুযোগ থাকবে না আমার। তাই এ সুযোগ মিস করাটা আমার উচিত হতো না। যা করেছি ঠিক করেছি। মা-বাবা তো জানবেই আমি পরীক্ষা দিয়ে ফিরছি। দ্বিতীয় পরীক্ষার দিন না হয় আবার এসে ঢাকা ঘুরে যাব। তবু তাদেরকে কষ্ট দেয়া যাবে না। তাদেরকে বলা যাবে না, তোমাদের ছেলে পরীক্ষা না দিয়ে একটা মেয়ের জন্য বই খুঁজে বেরিয়েছে সারাদিন।

সবাই বলে ট্রেন জার্নি রোমান্টিক ও আরামদায়ক। কিন্তু আমার কাছে বাস জার্নিটাই ভাল লাগে। বাসে উঠলে বাসের দুলুনিতে প্রথমে আমার ঝিমুনি আসে। তারপর ধীরে ধীরে ঘুম লেগে যাবার মতো একটা অবস্থার তৈরী হয়। খুব গভীর ঘুম না। ঘুমের মধ্যে সচেতন একটা ধারণা থাকে আমি বাসে বসে আছি। কন্ট্রাকটর টিকেটের জন্য ডাকলেই চোখ খুলে টিকিট দেখাই তারপর আবার ঘুমে তলিয়ে যাই। ঘুম একেবারে কেটে গেলে দেখি চট্টগ্রাম শহরে বাস ঢুকে গেছে। আর মাত্র কিছুক্ষণ। আর কিছুক্ষণ পরেই বাস থামবে। নেমেই রিক্সায় উঠে যাব। রিক্সা করে সোজা আমাদের পাড়া। তারপর হেটে হেটে জয়ীতাদের বাসা। তারপর জয়ীতার অদ্ভুত সেই কৃতজ্ঞতা ভরা চোখ, কণ্ঠ, হাসি। ভাবতেই মনটা ভরে যাচ্ছে আমার।

হঠাৎ মোবাইলের মেসেজ টোন। এই ‘দারুন অফার’ মেসেজগুলো আমাদের সাথে দারুন মস্করা করা শুরু করেছে ইদানিং। মেসেজ আসলে আপনি খুব আগ্রহ নিয়ে মেসেজ ইনবক্সে যাবেন। ভাববেন, কেউ হয়তোবা কোন গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়েছে। ইনবক্স খুলে দেখবেন ‘দারুন অফার’! আপনার তখন কী করতে ইচ্ছে করে জানি না। কিন্তু চরম ব্যস্ত সময়ে মেসেজগুলো পেলে ইচ্ছে করে মোবাইল ব্যবহার একেবারে বাদ দিয়ে দিই। হে গ্রামীন ফোন, এয়ার টেল কিংবা বাংলালিংক, তোমাদের নেটওয়ার্ক আমরা ব্যবহার করি বলে, যা ইচ্ছে তাই করতে পার না তোমরা। ভোক্তাদের জ্বালা-যন্ত্রনা যদি সার্ভিস প্রোভাইডাররা না বুঝে, তবে বুঝবেটা কে? মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি, না! এটা তো ‘দারুণ অফার’ না! এ যে জয়ীতার মেসেজ। তাড়াতাড়ি মেসেজ পড়া শুরু করলাম।

‘ভাইয়া, বইটা লাগবে না। আমার এক বান্ধবীর কাছে পেয়ে গেছি। আপনার আর কষ্ট করার দরকার নাই।‘

আমার বাবা আমাকে বলেছিল, কান্না ব্যাপারটা কেবলই মেয়েদের। ছেলেদের কান্না একদম মানায় না। তুমি ধীরে ধীরে বড় হচ্ছো। কান্না পেলেও কাঁদবে না। যখন মন খারাপ হবে। হাসবে। জোর করে হাসবে। আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করি। তবু চোখ থেকে কোথা থেকে জানি জল বের হয়ে আসে। আমি আটকাতে চাই। পারি না। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে চোখের জল আটকাবার কোন সুযোগ দেন নি। জলের ফোঁটাগুলো গাল গড়িয়ে পড়তে থাকে। হাতে নেয়া বইটি আমি বাসের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেই। বইটি কোথায় গিয়ে পড়ল তা জানার কোন দরকার বোধ করি না। (চলবে)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ১২:৩৯

তাহ্ফীর সাকিন বলেছেন: শেষটা অসাধারণ ছিল.... :)

২২ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:৪৩

কয়েস সামী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.