নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কবি। কবিতা লিখি আর মানুষের সুন্দর কবিতা গুলো দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছাই হই।

রুবাইয়াত নেওয়াজ

কবিতা লিখি গান গাই মাঝে মাঝে গীটার বাজাই

রুবাইয়াত নেওয়াজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

সব কটি জানালা খুলে দাও না

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৩২


আমার মেঝো মামা শেখ মিজানুর রহমান (জাহাঙ্গীর)। প্রচন্ড ডানপিটে আর এক রোখা স্বভাবের মানুষ ছিলেন আমার এই মামা। লেট নাইট শো সিনেমা দেখে রাতের বেলা ঘুট ঘুটে অন্ধকার রাস্তায় শিষ বাজিয়ে বাজিয়ে ঘরে ফেরা, ঘরে ফিরেই পেছনের দরজা দিয়ে সাবধানে বাড়িতে প্রবেশ করা, এর গাছের আম পারা, ওর গাছের জাম পারা, পাশের বাড়ির বৌদির খোয়ারের মুরগী চুরি করে রাত ভর বার বি কিউ নাইট, পরদিন বাসায় নানা জানের কাছে বিচার শালিশ বসা তার কাছে এগুলো ছিল নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। পড়া শোনায় মন না থাকায় আজীবন নানাজানের নানা শাসনের মধ্যে থাকা আমার এই মামা ছিলেন ঘরপালানোতে বিশেষ পারদর্শী। কিছু হলেই তিনি ঘর পালাতেন। আজকের খাবার পছন্দ হয় নি ? ওকে থাকবো না আর এখানে। চলে গেলাম। আবার তিন চার দিন পর যেন কিছু হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে ঘরে ঢোকা আমার মামার জন্যে কোন ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আমার এই মামাটি কিন্তু আমার মাতুলালয় পরিবারের সবচাইতে অনুভুতি প্রবণ মানুষ ছিলেন। মায়ের প্রতি, পরিবারের প্রতি, আদরের ছোট বোনু বেবীর (আমার আম্মা তিনি আদর করে বোনু ডাকতেন) প্রতি তার আদর ছিল সীমাহীন। আমার মামা ছিলেন নানা নানির আট ছেলে মেয়ের মাঝে তৃতীয়। কৈশোর থেকেই তার ডানপিটে স্বভাব আর ভৌতিক কর্মকান্ডে আমার নানা ছিলেন অতীষ্ট। কিন্তু কে জানতো নানা জানের এই সন্তানটিই তার বাবা মাকে সবচাইতে আনন্দের ক্ষণ এনে দেবে কোন একদিন।
আমার নানা পেশায় ছিলেন একজন কাস্টমস অফিসার। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুর সময় তার পোষ্টিং ছিল নাটোরে। এত বড় সংসার নিয়ে তিনি মুভ করতে পারলেন না। তাই নানিজান তার সন্তান সন্ততি নিয়ে রইল লাল মনির হাট। আর নানাজান নাটোর। এর মাঝে শুরু হল স্বাধীনতা যুদ্ধ। লাল মনির হাট ছিল বিহারী অধ্যুসিত এলাকা, মানুষদের নাকি ঐ সময় কচুকাটার মত করে জবাই করে ফেলা হচ্ছিল। নানী ঐ সময় ঠিক করেন তিনি তার এত্ত বড় সংসারের মায়া ত্যাগ করবেন। আর কী বা করতেন? ছেলেমেয়েদের মাঝে তখন বড়মামা ২৬, মেঝো মামা ২১, আমার মায়ের বয়স ৯, সেঝো মামা ১২, ছোট খালা ৩, ছোট মামা কয়েকমাস। প্রাণ বাঁচাতে তার সন্তান সন্ততি নিয়ে পারি দিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। নিতান্ত দূরের আত্মীয়জনের ভরসায়। সাথে যদিও তার দুই যুবক ছেলে আমার বড় মামা আর আমার মেঝো মামা, কিন্তু বড় মামা বুদ্ধির দিক দিয়ে সমবয়সীদের থেকে অনেক পিছিয়ে ছিলেন। অনেক জটিল সমস্যা থেকে শুরু করে সাধারণ সমস্যাগুলোও তিনি সামলে উঠতে পারতেন না। তখন নানি জানের একমাত্র আশা ভরসা ছিল তার এই মেঝো ছেলে। মা, ভাই, বোনদের একটা নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে তোলার জন্যে তিনি কী না করেছেন। নৌকা ভারী হয়ে গেছে তাই তিনি সাতরে নৌকার সাথে সাথে থেকেছেন, দূর থেকে গানবোট দেখা মাত্র নৌকা ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন আঁধারের দিকে। এভাবে একটু একটু করে একসময়, মেঝো বোনের শ্বশুরবাড়িতে পৌছেন, মা বোন দের সাথে নিয়ে।
প্রথমদিকে আতিথেয়তা থাকলেও ধীরে ধীরে তা বিলীন হতে থাকে। খুবই স্বাভাবিক তখন সবারই ইয়া নফসি অবস্থা। অত্যন্ত রাশভারী স্বভাবের আমার অতি রূপবতী নানিজান অসহায় ভাবে জায়নামাজে বসে তখন শুধু কাঁদেন আর আল্লাহর কাছে চাইতে থাকেন তার স্বামীর ও তার হারানো সংসার ফিরিয়ে দেবার দোয়া। ধীরে ধীরে নানির জমানো টাকা সব শেষ হতে থাকে, একসময় তার মায়ের শেষ সম্বল অতি যত্নের গলার হারটাও বিক্রি করে দিতে হয়। সংসারে অভাব, বাড়ন্ত শরীরের এত গুলো মুখ অথচ কোন খাওয়া নেই। এদিকে আমার মেঝো মামাও কিন্তু বসে নেই, সংসারের চাকাটা চালু রাখতে যেখান থেকে যা পারছেন করতে চেষ্টা করছেন। একসময় বাজারে ফেরী করা শুরু করলেন, কিন্তু বুকের ভেতরে তো তার আগুন জ্বলে। এভাবে থাকলে তো হবে না, তাকে যুদ্ধে যেতে হবে। কিন্তু এক মা কে বাঁচাতে আরেক মা বিসর্জন কিভাবে দেবেন? দুজনই তো সংকটে।
নানির কাছে নানার কোন খবর নেই। এদিকে নানাও নাটোরে কিছুই বুঝতে পারছেন না। পরিচিত জনের মুখে শোনেন লালমনিরহাট শেষ, কোন বাঙ্গালী বেঁচে নাই। সব শেষ। নানার মন তবু মানে না। তিনি হয়তো মনে মনে ভাবেন আল্লাহ এতটা নির্দয় হবেন না নিশ্চয়ই। অবশ্যই সবাই ভালো আছে লিলি (আমার নানী) অবশ্যই কোথাও ভালো আছে সন্তানদের নিয়ে।
এদিকে মামা একদিন বারান্দায় বসে আছেন, তার কিছুই ভালো লাগছে না। চুপ করে বসেও থাকতে পারছেন না। হঠাত যেন তার ঘাড় শক্ত হয়ে গেলো। কী যে মনে হল!! গোসল সেরে প্যান্ট আর শার্ট পরে ব্যাগ গুছিয়ে সাইকেল নিয়ে তার মা কে বললেন মা আসি, যাই আব্বাকে নিয়ে আসি। ব্যাস তারপর তাকে থামানো তো আমার নানির পক্ষে সম্ভব না।
বের হয়ে পরলেন মামা। উত্তাল সময়ে উত্তাল দেশে, মৃত্যুর কুপ চোখে আর মৃত্যুর দেবতা কাঁধে। বাবাকে খুঁজতে। দিনের পর দিন সাইকেল চালিয়ে, পথে, প্রান্তরে, লাশের মাঝে, রক্তের মাঝে, গুলি আর বারুদের মাঝে। শুধু বুকের সাহস আর দুই পায়ের শক্তিতে ছুটিয়ে চললেন তার পাগলা ঘোড়া। ঠিক যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বীরপুরুষ। ছুটে চলেছে বাবার খোঁজে।
পথে কত না ঘটনা, কত দূর্ঘটনা। কত মানুষের সাহায্য, কত দুগ্রহ তাকে সইতে হয়েছে। তার মুখ থেকে শোনা সে গল্পের কথা মনে পরলে এখনও গাঁয়ে কাটা দেয়। একজন বৃদ্ধা নাকি পথে এক রাত মামাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁর আবার মামার মত এক সন্তান ছিল, যে যুদ্ধে হারিয়ে গেছে। ঐ বৃদ্ধার অনুনয় ছিল মামা যেন আর না আগায়। বৃদ্ধার ছেলে হয়ে যেন থেকে যায়। কিন্তু মামা তো কারও কথা শুনবার নয়, সে তো বড্ড বেয়াড়া।
মৃত্যুকে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে আর পাক বাহিনীর দোসরদের চোখে বার বার গাঁদা গাঁদা ধুলো ছিটিয়ে শেষ মেষ তিনি নানা জানের কাছে পৌছুতে পেরেছিলেন। তারপর দুজনের মিলন দৃশ্য কেমন ছিল তা নিয়ে অবশ্য নানাজান বা মামা কেউই কখনও কিছু বলেন নি। হয়তো নানাজান তার পূত্রকে জড়িয়ে খুব কেঁদেছিলেন অথবা নিতান্ত স্বভাবগত ভাবেই বলেছেন "গাধাটা কী করছে এইটা?" যাই করেন না কেন সেইদিন দুইজনের চোখ ভর্তি যে পানি ছিল একথা আমি বাজি ধরে বলতে পারি। নানার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কথাটি "আব্বা সবাই ভালো আছে" শোনার সৌভাগ্য এই ছেলের মুখ থেকেই তিনি অর্জন করেন। তার চির ডানপিটে কথা না শোনা এই ছেলেটি দুটো বিচ্ছিন্ন পরিবারকে আবার এক করে দিয়েছিল।
সেই ভয়ংকর সময়ে লক্ষ লক্ষ পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। অনেক সাজানো সংসার ভেঙে গিয়েছিল কিন্তু আমার নানার ভেঙে যাওয়া সংসারটা কিন্তু আবার জোড়া লেগে গিয়েছিল। আর এটা করে দেবার জন্যে পরম করুণাময় আল্লাহ বেছে নিয়েছিলেন এই মানুষটিকে যার নাম শেখ মিজানুর রহমান (জাহাঙ্গীর), যিনি বাবা মার দেয়া এই নাম পছন্দ করতে না পারায় নিজের নাম নিজেই দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। পাগলা মামা আমার। হাহাহাহাহা কয়জন পারে এমন?
শেষ পর্যন্ত তিনি অবশ্য যুদ্ধে যাননি। আমি প্রশ্ন করেছিলাম কেন? তিনি বলেছিলেন ঐ সময় তার মনে হয়নি তিনি যুদ্ধ করছেন না। হ্যা হয়তো মর্টার হাতে শত্রুর মোকাবেলা করেন নি কিন্তু তিনি একসাথে অনেক গুলো অনিশ্চয়তার মাঝে বেঁচে থাকা মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। এখন আমার মনে হয় তিনি হয়তো ঠিক কাজটিই করেছেন। তার ছোট ছোট ভাই বোন গুলো বড় হয়েছে, বাবা মা'র মুখ উজ্জ্বল করে দেশের সবচাইতে নামী বিদ্যাপিঠ গুলোতে দাবড়ে বেড়িয়েছে, এটাই তার জন্যে হয়তো অনেক। তিনি তার সমস্ত জীবন গোপালপুর নর্থবেংগল সুগার মিলে ছোট একটা চাকুরী করে কাটিয়ে দিয়েছেন। বিধাতা আমার এই নিঃসন্তান মামাকে সন্তানের মুখ দেখবার সৌভাগ্য দেননি। আমাদের প্রতি তার ভালোবাসার কোন কমতি দেখি নি কখনও। ছোট ছোট উপার্জন দিয়ে তিনি গ্রামে ছোট একটা বাড়ি করেছেন, অবসরের পর সময় কাটাবেন ভেবে, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস, অবসরের মাত্র ৫ দিন আগে ধুম করে নিজের শরীরের সমস্ত সুগার শেষ হয়ে গেলো। এত্ত বড় চিনির মিলে মামাকে বাঁচিয়ে রাখবার মত একটু চিনিও কম পরে গেলো? ঢাকার পথে এম্বুলেন্সে করে আসতে আসতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেন তিনি।
আমার বার বার মনে হচ্ছে মৃত্যুর ঠিক আগ মুহুর্তে হয়তো মেঝো মামা স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি সেই ২১ বছরের টগবগে যুবক আর পাগলা হাওয়ার মত ছুটে চলেছেন তার পাগলা ঘোড়া সাইকেল নিয়ে, টুং টুং করে বেইল বাজিয়ে তিনি ছুটে চলছেন তার মা বাবার কাছে। নানাজান, নানিজান বেহেস্থের দরজায় উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, ঐ তাদের পাগলা আসছে, ঐ তো দেখা যায়। আহা! কত্ত দিন পর, কত্ত রাতের পর।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১০:৫৯

আজমান আন্দালিব বলেছেন: চমৎকার!
লেখাটা দুবার এসেছে। এডিট করে দিন।

০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:২২

রুবাইয়াত নেওয়াজ বলেছেন: ধন্যবাদ এডিট করে দিয়েছি।

২| ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:৪৯

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: পুরোই হিরো!
তার অভিজ্ঞতা লিখে যাননি? লিখলে তা একটি অমূল্য সম্পদ হতে| তাকে নিয়ে একটা পাঁচশো পৃষ্ঠার উপন্যাস লেখা যায়!
প্রথমদিকের অংশটা পড়ে মজা পেয়েছি|

০২ রা জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:২৬

রুবাইয়াত নেওয়াজ বলেছেন: না লিখে যাননি, লেখা পড়ার মধ্যে তিনি ছিল না কখনও।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.