নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি এখনও পড়াশুনা করছি। তার সাথে বেশ কিছু দিন ধরে লেখালেখির সাথে যুক্ত আছি। বাবা মায়ের ছোট ছেলে। ঘোরাঘুরি এবং খাওয়া দাওয়া করতে বেশ পছন্দ করি।

কাল্পনিক আমি

আমি এখনও পড়াশুনা করছি। তার সাথে বেশ কিছু দিন ধরে লেখালেখির সাথে যুক্ত আছি। বাবা মায়ের ছোট ছেলে। ঘোরাঘুরি এবং খাওয়া দাওয়া করতে বেশ পছন্দ করি।

কাল্পনিক আমি › বিস্তারিত পোস্টঃ

আগন্তুক

১৮ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:২৭

কোন ধরণের আগমনী বার্তা না দিয়ে হুট করে কারোর বাসায় পৌঁছে তাকে চমকে দেওয়াটা আমার পুরনো দিনের অভ্যাস। আজ পর্যন্ত যতবারই কারোর বাসায় না বলে গিয়েছি, প্রতিবারই তাদের মাঝে এক ধরণের অস্বস্তি বোধ লক্ষ করেছি। এই চমকে দেওয়াটা আমার বেশ লাগে। এবারও সেরকমই প্ল্যান। ময়মনসিংহে এবার যাচ্ছি আমার ছোটখালাকে দেখতে। ক্যান্সারের রোগী। ক্যান্সারটা হয়েছে ওভারীতে। রোগটা কবে হয়েছে জানতে জানতেই সেটা ছড়িয়ে পড়েছে কিডনীতে, লিভারে। ছয়টা কেমো দেওয়া রোগীর শারীরিক অবস্থা তেমন সুবিধার হয় না। শরীরের পাশাপাশি মনও ভেঙে পড়ে। কিন্তু আমার খালা নাকি এদিক দিয়ে একেবারেই উল্টো। বরং শুনেছি ক্যান্সার হওয়ার পর নাকি তিনি আরো বেশি সতেজ হয়ে গেছেন। পার্থক্য শুধু এটুকুই; আগে মাথায় চুল ছিল, এখন নেই। অপরিচিত কোন লোক রাস্তায় দেখলে একটু চমকে তাকায়। খালা নাকি এতে বেশ মজা পান। অন্যেরা হলে নিশ্চিত অস্বস্তিবোধ করতো।



ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে গেলে প্রতিবারই আমি শেষ বিকেলের ট্রেন যমুনা এক্সপ্রেসকেই বেঁছে নেই। শেষ বিকেলে বাতাস কেটে ছুটে চলা ট্রেনের জানালার পাশে বসে আলো-আধারের মিলন দেখতে আমার বড় ভালো লাগে। ট্রেনটা ঢাকা থেকে ছাড়ে পৌনে পাঁচটায়। ময়ময়নসিংহে পৌছতে রাত আটটা বেজে যায়। কিন্তু আজ কয়টা বাজবে কে জানে? হাতঘড়ি বলছে এখন বাজে পৌনে ছয়টা। এখনো ট্রেন ইঞ্জিন পায়নি। তাছাড়া শীতের সময় দিন ছোট, রাত বড়। আর যাই হোক, এবার বুঝতে পারছি যে জানালার ধারে বসে ঘুটঘুটে অন্ধকারই দেখতে হবে। গোধুলী আর দেখা হবে না। এরমাঝে টিপ টিপ করে বৃষ্টিও পড়ছে। শীতকালেও যে বৃষ্টি পড়ে আমার জানা ছিলো না। সবই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফল।



অবশেষে ট্রেন ইঞ্জিন পেলো। ঘড়িতে বাজে ছয়টা। এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে পড়েছে। ঢাকায় কোন ঋতুতেই রাত নামে না। চিরদিবার শহর ঢাকা। কিন্তু এই ট্রেন ময়মনসিংহে পৌঁছতে পৌঁছতে যে রাত দশটা বেজে যাবে এটা বুঝতে আর বাকী নেই। ঢাকার বাইরে রাত দশটাই অনেক রাত। তারমাঝে শীতকাল। শীতকালে যেকোন শহরই নিশুতি রাত।





(২)

যে আশঙ্কা করেছিলাম তা আর হয়ে উঠেনি। ট্রেন কোন ক্রসিংয়ে পড়েনি। বলা যায় একটানেই চলে এসেছে। মাঝে জয়দেবপুরে আধা ঘন্টার মতো দাঁড়িয়েছিলো। বাংলাদেশের ট্রেনে এটা এমন কোন সমস্যা না। ট্রেন ময়মনসিংহে এসে থামে রাত সাড়ে নয়টায়। চারদিক থেকে দোকানের শাটার নামানোর ঝাপঝাপ শব্দ আসছে। ময়মনসিংহে আসলে প্রতিবারই স্টেশন থেকে বেড়িয়ে মোস্তফা টি স্টলের বেঞ্চিতে বসে গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের সাথে একটা গোল্ডলীফ না খেলে পুরো শহর ঘুরে বেড়াবার কেন যেন এনার্জি পাই না। অভ্যাসবশত সেই দোকানে চা-সিগারেট খেয়ে একটা রিকশা নিয়ে বেয়াইয়ের একাডেমী রোডের মেসের দিকে রওনা দিলাম। মেজো বোনের বিয়ের পর থেকে ময়মনসিংহে আসলে এই মেসেই বেশিরভাগ সময় ওঠা হয়। আগে মেজো খালা বা ছোটখালা কিংবা সেজো ফুফুর বাড়িতে ওঠা হলেও এখন আর সেসব জায়গাতে উঠি না। রাতজেগে জ্ঞানগর্ভ আড্ডা, মাঝরাতে কলেজ রোড রেলক্রসিংয়ের পাশের হোটেল গুলোতে গরম পরোটার সাথে ডিম ভাজি খেতে বেশ লাগে আমার। আর তাছাড়া প্রায়ই তার মেসের বাকী ছেলেদের সাথে রাতজেগে সিনেমাও দেখা হয়। খালা-ফুফুদের বাড়িতে গেলেই কেমন যেন একটা পারিবারিক ভাব চলে আসে। টাইমলি খাওয়া, টাইমলি ঘুম থেকে ওঠা। কি দরকার দুইদিন বেড়াতে এসেও এরকম পারিবারিক পরিবেশে থাকার?



রিকশায় করে জিলা স্কুলের মোড়ে আসার পরপরই ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়া শুরু করলো। বার কয়েক বিজলীও চমকে উঠলো, তার পরপর মেঘের ডাক। শীতের সময় নিম্নচাপের জন্য হয়তো বা গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়তে পারে। কিন্তু তাই বলে একেবারে আষাঢ় মাসের মতো আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি? ছোটবেলায় যখন মামার সাথে ময়মনসিংহে আসতাম, তখন মামা বলতেন,



-বুঝলি রে? ময়মনসিংহ হলো মেয়েদের শহর। এখানে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু এখানে মেয়েগুলো বেশিদিন এখানে থাকে না। এদের দৌড় ভার্সিটি কোচিং পর্যন্তই। ভার্সিটিতে উঠলে এরা চলে যায় একেকজন একেক ভার্সিটিতে।



-বুঝলাম।



-তুই কি এখানকার মেয়েদের বিয়ে করবি?



-কিভাবে বলি? আমার তো সবাইকেই ভালো লাগে, কিন্তু ওরা কি আমাকে বিয়ে করবে? ওরা যে বড়।



-আরে ব্যাক্কল। তোকে এখন বিয়ে করতে কে বলেছে? বড় হলে বিয়ে করবি।



-তাহলে বড় হয়ে ভেবে দেখবোনি।



-ব্যাটা হতচ্ছাড়া বেয়াদব। মুখে মুখে কথা বলিস। যা তোর সাথে আর কথাই বলবো না।



মামার কথা মনে হতেই সিগারেট খেতে মন চাইলো। যতদূর মনে পড়ে, মামা যতবারই আমাকে নিয়ে রিকশায় করে ঘুরে বেড়াতেন, প্রতিবারই বাম দিকে বসতেন, আর রিকশায় ওঠা মাত্রই বাম হাতে সিগারেট খেতেন। আমিও বাম হাতেই সিগারেট খাই। বাম হাতে সিগারেট খাওয়ার ফজিলত অনেক। কেউ হাত চেক করলে প্রথমে ডান হাতটাই চেক করে। বাম হাতটা না। আর আঙ্গুল দিয়ে পানের বোঁটা ঘষতে থাকলে সিগারেটের গন্ধ চলে যায়। আমাদের গার্জিয়ানরা সিগারেট খাওয়াকে গুরু অপরাধ হিসেবে দেখেন। পান খাওয়াকে না। এটাকে লঘু অপরাধ হিসেবেই দেখেন তারা।



হাতের সিগারেট শেষ হওয়া মাত্রই রিকশাটাও বেয়াইয়ের মেসের সামনে এসে দাঁড়ালো। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে মেসের গেটে নক করতে থাকলাম। ওপাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই। পনেরো-বিশ মিনিট নক করার পর হার মেনে বেয়াইকে ফোন করলাম,



-হ্যালো রনি ভাইয়া। কোথায় তুমি?



-আরে মেহেদী! কি খবর?



-এই আছি। তা কোথায় তুমি? তোমার মেসের সামনে নক করলাম এতক্ষণ। কেউ তো খুলে না।



-ওহ হো। একটা সমস্যা হয়েছে যে।



-কি?



-আমি তো এখন হালুয়াঘাটে। আর মেসে যারা আছে, ওরাও সব ছুটিতে বাসায় গেছে।



-ওহ। আচ্ছা সমস্যা নাই। আমি তাহলে নাহয় ফুফুর বাড়িতেই উঠি। কাছেই তো।



-তুমি যে আসবা, এইটা আগে বলবা না? বললে তো আমি থাকতাম। এই চমকে দেওয়ার অভ্যাসটা বাদ দিবা কবে?



-আচ্ছা দেখি বাদ দেওয়া যায় কি না।



-আচ্ছা রাখি। সাবধানে থেকো। ময়মনসিংহে কিন্তু ছিনতাই বেড়েছে।



-আচ্ছা সমস্যা নেই। সাবধানেই থাকবো।



বিনা আগমনী বার্তায় মানুষের বাসায় চমকে দেওয়ার সাধ আমার কিছুটা হলেও মিটলো। মনে মনে বেশ বিরক্তও হলাম। এরমাঝে প্রচণ্ড বৃষ্টিতেও প্রায় ভিজে চুপচুপা হয়ে যাচ্ছি। ঘড়িতে প্রায় এগারোটা বাজে। ফুফুর নাম্বারে কল করে যাচ্ছি। ফুফু কল রিসিভ করছেন না। অনেক্ষণ পর যখন কল রিসিভ করলেন, তখন জানতে পারলাম, তারাও বাড়িতে নেই। জামালপুর গিয়েছেন। মনে মনে ভাবলাম, ময়মনসিংহে কি যুদ্ধ লাগলো নাকি? সবাই তল্পিতল্পা নিয়ে গ্রামের দিকে যাচ্ছে? একবার ভাবলাম ছোট খালার বাসাতে গিয়েই উঠি। কিন্তু আরেকবার ভাবলাম, এমনিতেই ক্যান্সারের রোগী। হয়তো বা মুখে কিছু বলবেন না। তবে এই শরীরে তাঁকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না। এমনিতেই আমার মা-খালারা অতিরিক্ত ভালোবাসা দেখিয়ে ফেলেন আমাদের উপর। এরমাঝে অতর্কিত আগমনে অসুস্থ শরীর নিয়ে রান্নাবান্নার ঝামেলাতেও বসে পড়তে পারেন মাঝরাতে। কাল নাহয় একবার দেখে আসা যাবে। নিজের উপরে রাগ ঝাড়তে ঝাড়তে রওনা দিলাম মেজো খালার বাসার দিকে।





(৩)

মেজো খালার বাসাটা হলো কলেজ রোড গোরস্থানের পাশেই। ছোটবেলায় তাদের বাসায় যেতে বেশ ভয় পেতাম। রাতের বেলায় জীবনেও কোন দরকারেই তাদের বাসায় যেতাম না। যা আলাপ সব দিনের বেলায়। কিন্তু সেই ছোট তো এখন আর নেই। আর তাছাড়া ভূত বা অতিপ্রাকৃত কোন কিছুর অস্তিত্বেও আর বিশ্বাসী না। যে যুগে মানুষ ফেসবুক চালাচ্ছে, সে যুগে অযৌক্তিক ভয় পাওয়াটা বোকামী ছাড়া বেশি কিছু না।



আজ কি হয়েছে জানি না। মেজো খালার বাড়িতেও বোধহয় আজ কেউ নেই। কম করে হলেও আধা ঘন্টা ধরে কল বেল বাজালাম। এমনিতেই পৌনে বারোটা বাজে, নিশ্চয়ই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। এরমাঝে কল বেলটাও মনে হয় নষ্ট। অনেকবার তাদের ফোনে কল করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। কি মনে করে দরজার নবটা ঘোরালাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে নবটা ঘুরে দরজাটা খুলে গেল। নিজের মাথায় জোড়ে একটা চাটি মেরে লজ্জায় জিভ বের করে ভাবতে লাগলাম, এতটা বোকা কেন? আগে কেন নব ঘোরালাম না?



মেজো খালার বাসাটা বেশ বড়। ড্রয়িং রুমটা অন্ধকার। লাইট নেভানো আছে। রুমটা কম করে হলেও আড়াইশো বর্গফুট তো হবেই। এত বড় বাড়ি অথচ পুরো বাড়িতে থাকেন মাত্রে দুইজন। দুই খালাতো বোনের একজনের বিয়ে হয়ে গেছে। সে এখন ঢাকাতেই থাকে। আরেকজন রাজশাহী মেডিক্যেলে ইন্টার্নি করছে। খালু গৌরীপুর কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। সেখান থেকে রিটায়ার্ড করেছেন তাও প্রায় আট বছর হলো। বিশাল বাড়িতে বয়স্ক দুইজন লোক মাত্র থাকেন। কিভাবে তাদের সময় কাটে কে জানে?



ড্রয়িং রুম ধরে সোজা হেঁটে একেবারে বারান্দার কাছের গেস্ট রুমটায় গিয়ে আলো জ্বেলে ব্যাগ চেয়ারে রেখে কাপড়-চোপড় পাল্টে নিয়ে খালুদের বেডরুমের কাছে গেলাম। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ ছিলো। এমনিতেই শীতের রাত। তারমাঝে এখন প্রায় সোয়া বারোটা বাজে। কি দরকার মানুষকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বিরক্ত করার? কাল সকালে ঘুম ভাংলে এমনিতেই জেনে যাবেন যে আমি এসেছি। আবার গেস্ট রুমে ঢুকে ব্যাগ থেকে গামছা বের করে বাথরুমে গোসল করতে গেলাম।



গোসল সেরে বের হতেই দেখি খালা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একটু আগেই তাদের রুমের দরজা বন্ধ দেখেছিলাম। আমি যে এসেছি, সেটা তাহলে টের পেয়ে গেছেন। মনে মনে লজ্জা পেলাম মাঝরাতে এরকম বিরক্ত করবার জন্য। খালা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,



-মেহেদী কখন এসেছো?

-আসসালামুয়ালাইকুম আন্টি। এই তো কিছুক্ষণ আগে।



-ওয়ালাইকুমআসসালাম। তা আসবা যে আগে বলবা না?



আমার মুখে স্বলজ্জ হাসি। হাসিহাসি মুখেই জবাব দিলাম,



-জ্বি আসলে হুট করে আসা হয়েছে তো। তাই জানিয়ে রাখতে পারিনি।



-আচ্ছা। গোসল তো করছো। খেয়ে আসছো?



-জ্বি না, আন্টি। তবে খাবো না। ক্ষিধে নেই।



-আরে কি বলে? সেই কখন রওনা দিছো খাবা না মানে? আসো খাও।



-জ্বি আচ্ছা।



-ফ্রিজে খাবার আছে। আর ডিপ ফ্রীজে তরকারি আছে। ওভেনে গরম করে খেয়ে নিও। আমার নামাজ পড়তে হবে।



-জ্বি আচ্ছা আন্টি। আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। আমি নিজেই করে নিবো। তা এত রাতে কিসের নামাজ পড়বেন?



-আমরা এখন সারারাতই নামাজ পড়ি। একেবারে ফজরের নামাজ শেষে ঘুমাই।



-ও আচ্ছা। আপনি তাহলে নামাজ পড়ুন।



-আচ্ছা আমি গেলাম।



দরজা বন্ধ করে দিয়ে খালা তাঁর ঘরে ঢুকে পড়লেন। আমি খাবারগুলো গরম করে খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে বাম হাত দিয়ে নিজের মাথায় আরো একবার চাটি মেরে নিজেই নিজেকে গালি দিতে থাকলাম। মনে মনে সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেললাম, আর কখনোই এরকম না জানিয়ে কারোর বাসায় যাবো না।



খাওয়া শেষে গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খাতা-কলম বের করে একটা গল্প লিখতে বসে পড়লাম। কিছুক্ষন পরে দরজায় নক পড়লো। দরজা খুলে দেখি খালু দাঁড়িয়ে আছেন।



-আসসালামুয়ালাইকুম খালু। কেমন আছেন।



-ওয়ালাইকুমআসসালাম। আছি আলহামদুলিল্লাহ। তুমি?



-জ্বি খালু আলহামদুলিল্লাহ।



-তা কখন আসলে?



-এই তো কিছুক্ষণ আগে?



-খাওয়া-দাওয়া করছো?



-জ্বি খালু মাত্রই করলাম।



-আচ্ছা ঘুমায় পড়ো। রাত অনেক হয়েছে।



-জ্বি আচ্ছা।



-লাইট অফ করে ঘুমিও।



-জ্বি আচ্ছা।



-নাকি ভয় পাবা?



-না না! খালু। কি বলেন? ভয় পাবো কেন?



-ও আচ্ছা। জ্বিন ভূতে তাহলে আর ভয় করো না?



-ওসবে ভয় পেয়ে লাভ কি? যা নাই, তা নিয়ে ভয় পাবো কেন?



-ভূত না থাকতে পারে। জ্বিন তো আছে।



-ভূত আর জ্বিনে পার্থক্য কি? একটা প্রচলিত শব্দ, আরেকটা আরবী শব্দ। জ্বিনে বিশ্বাস আছে, তবে তারা তো আর মানুষের সামনে আসে না।



-কি জানি? তোমরা লেখক মানুষরা শুনেছি নাস্তিক টাইপের হও। তোমাদের এসব বুঝিয়ে লাভ কি?



-না না খালু। আস্তিক নাস্তিকের ব্যাপার না। কোরআনের আলোকেই তো বলছি, জ্বিনে বিশ্বাস আছে, কিন্তু ওরা তো আমাদের সামনে আসতে পারবে না।



-আচ্ছা যা বুঝো। জলদি ঘুমিয়ে পড়ো। আর কোন দরকারে আমাদের ডেকো।



-জি আচ্ছা খালু।



খালু চলে যাওয়ার পর দরজা আবার বন্ধ করে লিখতে বসলাম। আগে মিডল ক্লাস ফ্যামিলির জীবন কাহিনী নিয়েই গল্প লিখতাম। বাজারে ওসব চলে না। পাঠকের চাই রগরগে রসালো প্রেমের গল্প কিংবা বেদম হাসির ইন্টেলেকচুয়াল রম্য গল্প। তবে সায়েন্স ফিকশন বা রক্তহীম করা হরর গল্পেরও বেদম চাহিদা। দুর্ভাগ্যবশত এর কোনটাই আমার দ্বারা হয় না। পাঠকদের উপর মাঝে মাঝে বিরক্ত হই। অবশ্য এদের উপর বিরক্ত হয়েও লাভ নেই। আমরা সবাই মিডল ক্লাস ফ্যামিলির। নিজেদের জীবনে ঘটে যাওয়া কাহিনী নিয়েই যদি একই জিনিস বইয়ের মাঝেও পায়, তাহলে ভালো না লাগাটাই স্বাভাবিক। লোকে চায় এন্টারটেইনমেন্ট। কিন্তু বুঝি না, একই জিনিস বইয়ের পাতায়, আবার একই জিনিস টিভির চ্যানেলে। লোকে টিভির চ্যানেলের হিন্দি সিরিয়ালগুলো তাহলে এতো বেশি খায় কেন?



যে কারণেই হোক, এবার একটা মশলাদার প্যাকেজ গল্পের প্লট ট্রেন দিয়ে আসার সময় ঘুরছিলো। সায়েন্স ফিকশনের মধ্যেই ভৌতিক গল্প। তারই মাঝে থ্রিল, সাসপেন্স, আবার তারই মাঝে রগরগে রোমান্স। অনেকটা গরম মশলা টাইপ গল্প। গরম মশলা নাম শুনলেই চোখের সামনে তরকারিতে দেয়ার, গরম মশলার ছবি ভেসে ওঠে না। ভেসে ওঠে অক্ষয় কুমার আর জন আব্রাহামের গরম মশলা সিনেমার গানের দৃশ্য। ছোটবেলায় হিন্দি সিনেমার প্রভাব যে আমাদের মনে কিভাবে দাগ কাটে, আমরা নিজেরাই তার বড় প্রমাণ।



লেখা শেষে বেশ রিল্যাক্স লাগছিলো, মাথা থেকে এবারের মেলার চাপটা গেলো। লিখতে লিখতে কখন যে ভোর হয়ে গেছে টের পাইনি। প্রকাশক ভাই পাণ্ডুলিপি হাতে পেলে বেশ খুশি হবেন। তার হাসিমাখা মুখ আর পাঠকের তৃপ্তির কাছে আমার লেখক স্বত্তা দুমড়ে মুচড়ে যাবে। সে খবর কেউ রাখবে না। এই বিরক্ত বোধ কারোর কাছে প্রকাশ পাবে না। ভেতরে ভেতরে মেজাজ খিটখিটে হবে। লোকে কথা বলতে আসলে সেই বিরক্তের ঝাল মেটাবো। লোকে বলবে অহংকারী।



পুরোটা সন্ধ্যা জার্নি করে আর সারারাত জেগে লিখে শরীর বেশ ক্লান্ত হয়ে এসেছে। বিছানায় যাওয়ার আগে শেষবার বাথরুম সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।



ঘুম ভাংলো একেবারে দুপুর বারোটায়। পাক্কা ছয় ঘন্টার ঘুম। ঘুম শেষে বেশ ফ্রেশ লাগছে। তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়েই কাপড় পাল্টে ছোট খালাকে দেখতে যাবো বলে ভাবলাম। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে মেজো খালাকে ডাকতে গেলাম। তারাও বোধহয় যাবেন ছোট খালাকে দেখতে। দরজার কাছে গিয়ে বেশ কয়েকবার নক করলাম। কিন্তু দরজা এখনো বন্ধ। অনেকক্ষণ নক করার পরেও যখন দেখি দরজা খুলে না, তখন নিজেই বের হয়ে পড়লাম। নাস্তা নাহয় হোটেল থেকেই সেরে নিবো।





(৪)

ছোট খালার বাসায় গিয়ে দেখি একেবারে হুলস্থূল কাণ্ড। কেউ দেখে বলবেই না যে কেউ ক্যান্সার রোগীকে দেখতে এসেছে। ঘরে ঢোকা মাত্রই পোলাও আর মাংস রান্নার ঘ্রাণ পেলাম। সেখানে দেখি সবাই আগে থেকেই আছে। বড় মামা, ছোট মামা, আমার দূর সম্পর্কের এক খালারা এসেছেন। আমার বাবা-মাও এসেছেন আজ ভোরে। ছোট খালা আমাকে দেখেই বললেন,



-কি ভাইগ্না মিয়া, কেমন আছো?



-আসসালামুয়ালাইকুম। এই তো। তুমি কেমন আছো?



-ওয়ালাইকুমআসসালাম। আর আছি কোনরকম। তুমি বলে কালকে আসছো?



-হ্যাঁ। কালকেই তো আসলাম।



-কিসে আসছো?



-যমুনায়।



-কোথায় ছিলা?



-এইটা তো একটা বিরাট কাহিনী।



-কেন?



-প্রথমে রনি ভাইয়াদের মেসে গিয়েছিলাম। ও নাকি হালুয়াঘাট গেছে। তারপর সাজেদা ফুফুর বাসায় গেলাম। উনারাও নাকি জামালপুর গেছে।



-তা আমাদের বাসায় আসতা।



-তুমি এমনিতেই অসুস্থ। তারমাঝে তোমাকে ডিস্টার্ব করার দরকার কি?



-আরে এটা কোন সমস্যা না। তা তাহলে কালকে ছিলে কোথায়?



-তারপর মেজো আন্টিদের বাসায় গেছিলাম।



-মেজো আপার বাসায়!



আমার কথায় ছোট খালা চমকে উঠলেন। ঠিক যেমনটা কারোর মারা যাওয়ার খবর শুনলে মানুষ যেভাবে তাঁকায়।



-হ্যাঁ। কেন?



-মেজো আপারা তো তিনদিন ধরে রাজশাহীতে গেছে। মিশুকে একেবারে নিয়ে আসবে।



-আরে কি বলো? আমি কালকে আন্টি-খালুর সাথে দেখাও করলাম।



-তুমি কি নেশাপানি কিছু করতাছো নাকি? সত্যি সত্যি বলো তো দেখি?



-হ্যাঁ। সত্যিই তো বলছি। আন্টি ফ্রিজ থেকে খাবার গরম করে নিয়ে খেতে বললো। কালকে সারারাত নামাজও পড়লো।



-কি কউ। দাঁড়াও তো মেজো আপারে ফোন দেই। আসছে নাকি?



ছোটখালা মেজো খালার সাথে ফোনে কথা বলছে। তার কথা বলা শেষে আমার কাছে ফোনটা ধরিয়ে দিলেন। মেজো খালা আমার সাথে কথা বলছিলেন রাগী স্বরে,



-হ্যালো আন্টি আসসালামুআলাইকুম।



-ওয়ালাইকুম আসসালাম। এই তুমি বলে কালকে আমাদের বাসায় ছিলা?



-জ্বি আন্টি। আপনার সাথে তো দেখাও করলাম।



-কি বলো? সত্যি কথা বলো। চাট কম মারো।



-না না আন্টি। মিথ্যা বলবো কেন? আপনারা সারারাত ধরে নামাজও পড়বেন বলছিলেন। সারারাত পড়লেনও।



-আমাদের কিয়ের ঠেকা যে সারারাত নামাজ পড়তে যাবো?



-খালুর সাথেও তো দেখা করলাম। খালুকে দেন নাহলে। উনি তো কখনো মিথ্যা বলেন না।



মেজো খালা ফোনটা খালুর হাতে ধরিয়ে দিলেন, আমি খালুকে বললাম,



-খালু আসসালামুয়ালাইকুম।



-ওয়ালাইকুমআসসালাম। মেহেদী কেমন আছো?



-জ্বি খালু। আছি। আপনি কেমন আছেন?



-এই আছি কোনরকম। তা তুমি বলে কালকে আমাদের বাসায় গিয়েছিলে? আমরা তো এখনো রাজশাহীতে আছি। মিশুকে একেবারে নিয়ে আসবো। তুমি সত্যি কোথায় ছিলে?



-কেন আপনাদের বাসায়।



-তা দরজা কে খুলে দিলো?



-আমি তো একা একাই খুলেছিলাম। নব ঘুরিয়েই চলে এসেছিলাম।



-আহ হা! নবটার একটা সমস্যা আছে। জোরে মোচড় দিলে খুলে আসে। ঠিকমতো লক হয় না। তাই মনে হয় তুমি ঢুকতে পারছো। কিন্তু আমাদের দেখলা কিভাবে?



-খালু আপনি এসব কি বলছেন? আপনার সাথে তো কালরাতে কথাও বললাম।



-না না তুমি কোন ভুল করতেছো। আমরা তো এখন রাজশাহীতেই আছি। তুমি বিশ্বাস না হলে মিশুর সাথে কথা বলো?



খালু মিশু আপুর হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন,



-হ্যাঁ মিশু আপু। আন্টিরা তো আমার সাথে মজা করছে। তুমি বলো তো সত্যিই কি আন্টিরা তোমার সাথে রাজশাহীতে?



-হ্যাঁ আম্মারা তো আমার সাথেই। নাহলে আমাকে ফোন ধরায় দিলো কিভাবে?



মিশু আপুর কথা শোনার পরপরই আমি চমকে উঠলাম। একটা জিনিস কোনমতেই বুঝতে পারছি না, মেজোখালারা যদি রাজশাহীতে থাকেই তাহলে কাল রাতে কাদের সাথে তাহলে আমি দেখা করলাম। একটা জিনিস এখন সত্যি সত্যিই মাথায় ঢুকছে না, সারাদিন পার করে সারারাত ধরে তারা তাহলে নামাজই বা পড়তে যাবেন কেন?



প্রচণ্ড শীতের মাঝেও আমি ঘামতে লাগলাম। কোন ব্যাখ্যাই তো মেলাতে পারছি না। কোন ব্যাখাই না।



মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.