![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হূমায়ুন আহমেদের দেয়াল ও কিছু কথা
সৈ য় দ কা ম রা ন আ হ মে দ
বঙ্গভবনে প্রেসিডেন্ট সাহেব জোহরের নামাজ শেষ করে চোখ বন্ধ করে জানামাজে বসে আছেন । .........।
মোশতাক সাহেবের একাগ্র মনোযোগ ব্যাহত হল। মেজর রশিদের গলা-
'আপনি দেখি বঙ্গভবন কে মসজিদ বানিয়ে ফেলেছেন! সারাক্ষণ নামাজ কালাম পড়লে রাষ্ট্র কার্য্য পরিচালনা করবেন কিভাবে? ....
আপনার নামাজ শেষ হয়েছে? আমি জরুরী কাজ নিয়ে এসেছি। .........
- সেনাবাহিনী প্রধান জিয়াউর রহমান কে যে আটক করা এটা জানেন?
- জানি না। ডিজিএফআই আমাকে কোনও খবর দেয় না। তারা আমাকে ভাসুর জ্ঞান করে। ভাসুর কে সব কথা বলা যায় না।
মেজর রশীদ বিরক্তির সঙ্গে বললেন রসিকতা করবেন না, সময়টা রসিকতার জন্য উপযুক্ত না।
খন্দকার মোশতাক বললেন, অবশ্যই, অবশ্যই।
_______________________
হুমায়ুন আহমেদের সর্বশেষ উপন্যাস 'দেয়ালের' কিছু অংশ হচ্ছে উপরিউক্ত অংশ। বইটির অধিকাংশ তথ্যই ঐতিহাসিক সত্য। আর প্রিয় লেখক তার 'হুমায়ুনি স্টাইলে' সেই তথ্যগুলোকে করেছেন আরও আকর্ষণীয়।ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন 'ঘড়ুয়াভাবে'।
অনেকদিন পর প্রিয় লেখকের বইটি হাতে পেয়ে যুগপৎ আনন্দ আর বেদনা, দুটোই ছুঁয়ে গেছে। আরও কিছুদিন কি পারতেন না এই মহা পুরুষ আমাদের মধ্যে থাকতে? না, থাকলেন না, জীবনের চরম সত্যকে মেনে নিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। স্রষ্টার ইচ্ছাই আমাদের শিরোধার্য।
_____________________________________
বইটি পড়ে ভালোলাগার চেয়ে দুঃখবোধটা ছিল প্রবল। কে চায় হৃদয় খুড়ে দুঃখ কে জাগাতে। তেমনি আমাদের ১৫ই আগস্ট ও পরবর্তী সামরিক অভ্যুত্থান গুলো যেভাবে রক্তের স্রোত প্রবাহিত করেছিল, সেটা কতটা ভয়ংকর আর ধ্বংসাত্মক ছিল সেটা আজকের বাস্তবতায় অনুধাবন কিছুটা কষ্টসাধ্যই। ১৫ই আগস্ট পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ক্যান্টনমেন্ট ও বংগভবন কেন্দ্রিক হওয়ার সাধারণ জনগণের উপর এর প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল অনেকটা লঘু, কিন্তু ছিল সুদূর প্রসারী। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাই মনে করি। আমি মনে করি ঐ সময়গুলো স্বাধীন বাংলাদেশের ‘পারসোনালিটি’ নির্ধারণ করে দিয়েছে। এবং সেই পারসোনালিটি এখনো বিদ্যমান। আমার কাছে সে পারসোনালিটির একটা বিশেষ দিক হচ্ছে পারষ্পরিক অবিশ্বাস। এছাড়া আরও অনেক গুলি দিকও রয়েছে এই পারসোনালিটির যে গুলো আবার কয়েকটি স্ববিরোধী। যদিও সামরিক বেসামরিক অনেক লেখকই লিখেছেন আমাদের ঐ বিশেষ ক্রান্তিকাল নিয়ে তবুও আমি মনে করি এইসব বিষ্যের উপর গবেষনামুলক লেখার ঘাটতি রয়েছে।
জানি এই বইয়ের উপর শত শত রিভিউ লেখা হবে। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিবেন যে যার মত। আমি যেই যোগ্যতা রাখিনা তবে আমি আমার ‘পাঠক রিয়েকশন’ হিসেবে বলব বইটিতে লেখক নিজে একজন দ্রষ্টা ছিলেন, তাই ঘটনা বর্ণনায় তিনি ছিলেন শতভাগ সৎ। তাই বইটি ইতিহাসের টেক্সট বুক হতে না পারলেও ইতিহাস বর্ণনায় বিশুদ্ধ নিঃসন্দেহে ।
বইতটি ঐতিহাসিক উপন্যাস’ টাইপের হলেও আসল এটা একটা নির্দিষ্ট ৫-৬টি বছরের সংক্ষিপ্ত ‘নোট বুক’ বলা চলে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের চারিত্রিক দূষণের ঐ কয়েকটি বছর সম্পর্কে উদাসীনদের আলসেদের জন্য তুলনামূলক অল্প পৃষ্ঠার নোটবুক হাসি ফোটাবে বলে আমার মনে হয়। আর চাপাবাজ সুযোগসন্ধানী সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদ দের কাছে এটা হতে পারে একটি বাইবেল।
লেখক নিজে মন্তব্য বা নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়ার কোন চেষ্টাই করেন নি এই বইয়ে। সেটাই এই বইয়ের অন্যতম সৌন্দর্য। দু এক জায়গায় মনে হতে পারে তিনি করেছেন তবে আমি মনে করিনা সেটা চাপিয়ে দেওয়া, বরং সেটা তাঁর লেখক হিসেবে মানব মনের অনুভূতিকে জাগিয়ে দেওয়া। আশা করি ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারবেন অনেকেই।
বইটিতে বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এসেছে। এসেছে বঙ্গবন্ধু কে ঘিরে চাটুকার আর সুবিধাভোগী শ্রেণীর কথা। সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে রক্ষিবাহীনীর অপকর্ম। সে রক্ষীবাহিনীর দ্বারা লেখকের পরিবার তাদের বরাদ্দকৃত শহিদ পরিবারের বাড়ী বেদখল হয়েছিল এবং অনেক দেন দরবার করে বাসার দোতলাতে থাকার সুযোগ পেয়েছেন এবং নীচের তলা রক্ষীবাহিনীর একজন সুবেদারের জন্য ছেড়ে দিতে হল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর নিগৃহীত সে রক্ষীবাহিনীর সুবেদার পালিয়ে গেলেন। তাঁর দুটি মেয়ে এসে লেখকের মাকে অনুরোধ করছে তাদের কে আশ্রয় দেয়ার জন্য। কারণ ‘এখন তাদের পাবলিক মেরে ফেলবে’। এই পরিমাণ ঘৃণা ছিল মানুষের রক্ষিবাহিনীর প্রতি। ক্ষোভ ছিল তুখোড় ছাত্র নেতা হিসেবে খ্যাত তোফায়েল আহমেদ কে নিয়েও। তিনিও ছিলেন রক্ষিবাহীনির সাথে।
এসেছে খন্দকার মোশতাকেরও যেটা একেবারে প্রথমে বর্নিত সংলাপে বুজা যায় কেমন আমোদি ছিলেন তিনি। ছিলেন ক্ষমতা মসনদে বসার সুযোগ সন্ধানী । এসেছে প্রেসিডেন্ট জিয়ার সাধারণ সৈনিক জীবনের উল্লেখ।
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাব, প্রথম অস্থায়ী প্রসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহ কামরুজ্জামান সাহেব ও ক্যাপ্টেন মনসুর সাহেবের মত চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের এক নির্মম ঘটনা, যা অশ্রু শিক্ত করবে চোখ।
কর্নেল তাহেরের মৃত্যুর (ফাঁসির)জন্য সামরিক প্রশাসক জিয়া দায়ী, এ সু প্রতিষ্ঠিত সত্য বইটিতে উল্লেখ থাকলেও জিয়ার এ ভিন্ন যে অন্য কোন উপায় ছিলনা, সেটা বইটিতে উল্লেখ করলে ভাল হত। ‘বিপ্লবের নামে অফিসার হত্যার কাজ সিপাহীরা করত’ এবং সেই রেশ তখনও কিন্তু কাটেনি। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন বলে যে অভিযোগ জিয়ার প্রতি সেটা মনে করি সত্য নয়। কর্নেল ফারুক, মেজর রশীদ, মেজর ডালিম কে দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে নয়, বরং নিজেকে খুনিদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য। তবে তিনি নিজের সামরিক ক্ষমতা প্রয়োগে বাড়াবাড়ি করেছেন এবং তাঁর মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে চট্টগ্রামে।
আর অবধারিতভাবে অবন্তি ও শফিকদের হাহাকার মিলিয়ে যায় মিলিটারীদের বুটের কর্কশ শব্দের মাজে আর শাসকের খেয়ালী ইচ্ছায়।
বইটি এক বৈঠকেই পড়ার মত বই। অবশ্য এটা ঘটনার চেয়ে ঘটনা লেখকের কৃতিত্বই বেশি। আশা করি ভালো লাগবে সবার। তবে এক এক করে স্বীয় জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিভে যাওয়া গল্পে পড়ে বিষাদের ছায়া পিছু নিবে, দীর্ঘশ্বাস পড়বে নিজের অজান্তেই ।।
____________X_____________
©somewhere in net ltd.