![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ক’দিন আগেও ফেইসবুকে শুধু ‘তুই রাজাকার’ তুই রাজাকার’ শব্দের জয়জয়কার ছিল। ‘তুই রাজাকারের টুইন টাওয়ার’ গড়তে সময় নিলেও ভেঙ্গে পড়তে সময় বেশি নেয়নি কিন্তু। এখন আবার ‘নাস্তিক’ বা ‘তুই নাস্তিক’ বাক্যের জয়জয়কার। এটার স্থায়িত্বও যে খুব বেশি হবে সেটাও আমার মনে হয় না। বোধ ও যুক্তিহীন কোন কিছুই টিকে থাকেনা বেশি দিন।
(তবে হুমায়ূন আহমেদের ‘তুই রাজাকার’ শব্দের এই অপব্যবহার আর করুন পরিণতি দেখে তিনি স্বয়ং কি ভাবতেন আমি জানিনা, তবে এই গ্যাঁড়াকল নিয়ে ফাটাফাটি ধরনের লেখা বা নাটক পেতাম, সেটা নিশ্চিত বলা যায়। মিস ইউ হুমায়ূন আহমেদ)
যাই হোক, বর্তমানে আসি। আমিও আগ থেকেই ‘নাস্তিক’ বা তুই নাস্তিক’ শব্দ ব্যবহারে বিরোধিতা করেছি, এখনো করছি। এখন কথা হচ্ছে ‘নাস্তিক’ শব্দ দ্বারা আসলে কি বুজানো হয়? কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাস কে নাকি একটি গোষ্ঠীকে? অথবা ‘ওরা আমাদের রাজাকার বলে, তাই আমরাও তাদের নাস্তিক ডাকি’ এই টাইপের ব্যাখ্যা হলেআপনার আর এই লেখা কষ্ট করে পড়ার প্রয়োজন নেই।
ব্যক্তিগত বিশ্বাস নিয়ে ‘নাস্তিক’ বলাটা আমি ঠিক সমর্থন করিনা।করিনা নাস্তিক বলে কাউকে গালি দিতে। যদি এমনই বলতে হয়, তবে এতটুকু হয়ত বলা যায় নাস্তিকতা বা নাস্তিক্যবাদের সমর্থক। এর বাহিরে গিয়ে কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসের নাড়ি নিয়ে টিপাটিপি অন্যায় ই শুধু নয় বোকামিও বটে। কেন? সেটা একটু পর ব্যাখ্যা করছি। তার আগে যেটা বলে নেয়া প্রয়োজন আমাদের বর্তমান বাংলাদেশ ও অনলাইন এ যে ব্যাপারটা বলা হচ্ছে সেটা নাস্তিকতা নয় কোনভাবেই, এটা স্রেফ ধর্ম বিদ্বেষ, কোন নির্দিষ্ট ধর্মের প্রতি ঘৃণার প্রকাশ। এই ব্যাপারটাকে নাস্তিকতার সাথে মিলানো ঠিক মেনে নেওয়া যায়না।তাছাড়া নাস্তিকতা ব্যাপারে সবার ধারনাও ঠিক পরিষ্কার নয়। ‘আল্লাহ্’ ‘নবী’ ‘ঈশ্বর’ ইত্যাদি শব্দের বিরোধিতা করা কিংবা ধর্মীয় নিয়মসিদ্ধ অনুশাসনের বিরুদ্ধে কথা বললে বা লিখলেই কেউ কিন্তু নাস্তিক হয়ে যায়না। এটা যারা বলেন তারাও একধরনের ভুল করেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে যেটা হয়েছে সেটা অনেকটা ‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী’ টাইপের চিন্তার ও ভাবনার বিশৃঙ্খলা। এদের আরেকটি সীমাবদ্ধতা হচ্ছে একটি particular type চিন্তা আর ভাবনার পড়াশুনা। নাস্তিক হতে হলে অন্তত সর্বনিম্ন যে গুন প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ‘উন্নত রুচির’ অধিকারী হওয়া। ওয়েস্টার্নে যেটা ‘Culture’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়।(Culture এর Definition & Explanation দেখে নেয়ার অনুরোধ।) আমাদের বাংলাদেশে যারা ‘ঈশ্বর তত্ত্ব’ খুঁজতে গিয়ে ধর্মের দোষগুণের থিসিস করতে লেগে যান তারা নিজেরাও জানেন না যে তারা কখন নাস্তিক হতে গিয়ে ‘anti religious/religion হয়ে গেছেন যেমন একজন কল গার্ল জানেন না কখন তিনি ‘প্রস্টিটিউট’ হয়ে গেছেন। সত্যি কথা বলতে কি সব কিছুর জন্যই ‘শিক্ষক’ বা ‘ইন্সট্রাকটর’ এর প্রয়োজন। দর্শন নিয়ে একাডেমিক শিক্ষা কিছুটা রুচিশীল হলেও এর বাহিরে বাংলাদেশের ঈশ্বর তত্ত্বে যারা আগ্রহী হয়েছেন তারা কোন সৎ উন্নত রুচির শিক্ষক পান নি। তাই ‘আরজ আলি মাতব্বর রচনাবলী’র মত দর্শন পাঠ নিয়ে তাদের রুচির শানিত করতে হয়েছে। (ব্যতিক্রম স্বীকার্য।) ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শানিত কি হবে, পুরো রুচিই নষ্ট হয়ে গেছে। একটু আভাস দিলেই সেটা বুজা যাবে। বাংলাদেশে ‘মুসলমানি ব্যাকগ্রাউন্ড’ নাস্তিকতার চর্চা আজ কিন্তু নতুন নয়, ডঃ আহমদ শরীফ বা ডঃ হুমায়ুন আজাদ-দের নাম সর্বাগ্রে আসলেও কিন্তু এরাই শেষ নয়, সেই ‘পাকিস্তান আমল’ থেকেই সেটা চলে আসছে, আবুল ফজল, আবুল হাসানাত, বযলুর রহমান, বেগম রোখেয়া, মোতাহের হোসেন চৌধুরী সহ অনেকেই নাস্তিকতা চর্চা করে গেছেন।(কাজী মোতাহেরহোসেন শেষের দিকে স্রষ্টায় বিশ্বাস স্থাপন ও ধর্মচর্চা করতেন বলে পড়েছি।) আপনি যদি তাদের রচনাবলী বা সাহিত্য কর্ম পড়েন এবং আজকের তথাকথিত ‘নাস্তিকতা চর্চা কারীদের’ লেখা পড়েন খুব সহজেই নাস্তিকতা আর ধর্ম বিদ্বেষ এর পার্থক্য বুজতে পারবেন।মুল কথা হচ্ছে নাস্তিকতা একটি উচ্চ মাপের ব্যাপার যা সাধারণ কয়েকটি ‘চটি’ বই পড়ে শেখা যায় না, কথাবলাও পাগলামি। এখানে (ইংল্যান্ডে) আমি অনেকের সাথে মিলেছি যারা নিজেকে ‘ Atheist’ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। কিন্তু পরক্ষনেই যখন তাদের কে লটারির টিকেট বা ‘Scratch Card’ কিনতেদেখি তখন আর বুজতে অসুবিধা হয়না যে আসলে তারা প্রচলিত কোন নির্দিষ্ট ধর্মাচার পালননা করা অর্থে ‘এথিষ্ট’ বা নাস্তিক। এমন কি Christmas এতাদের উচ্ছ্বাস অনেক ‘Priest’ এর উচ্ছ্বাসকেও হার মানায়।এই যখন বাস্তবতা তখন কাউকে নাস্তিক বা স্রষ্টায় অবিশ্বাসী বলাটা কথটা যুক্তি সংগত ভেবে দেখা উচিৎ। এই ভুলটাই আজকাল আমরা করছি। তাছাড়া কারো চূড়ান্ত বিশ্বাস বা অবিশ্বাস কি সেটা আমাদের জানাওতো সম্ভব নয়। শুধু বাহ্যিক কথা বা কাজ দেখে অনেকটা হয়ত ধারণা করা যায় কিন্তু ধারনাই যে চূড়ান্ত, তা তোনা, আর ধারনার উপর জোর না দেয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে।
এতো গেল সাধারণ কথা বাজি। এবার একটুবৈজ্ঞানিকতা ফলাই। আমরা ইচ্ছা করলেই কিন্তু নাস্তিক বা স্রষ্টায় অবিশ্বাসী হতেপারব না। কেননা আমরা সৃষ্টিগতভাবেই বিশ্বাসী। আমাদের অসহায়ত্ব আমাদেরকে স্রষ্টার বিশ্বাসকে আরও পাকাপোক্ত করে, তাই অনেক দার্শনিক এই মতব্যক্ত করেন যে ভয় থেকে ঈশ্বর বিশ্বাস জন্মলাভ করেছে। বিস্ময় থেকেও ধর্ম চিন্তা বা ঈশ্বর বিশ্বাস এসেছে বলে কেউ কেউ বলেছেন। সে যাই হোক কথাটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্য মেনে নিয়েই বলা যায় মানুষের প্রাথমিক যাত্রায় সে ছিল একা, নিঃস্ব, বৈরী প্রকৃতি ছিল তার ‘ঈশ্বর জপের’ অন্যতম কারণ। আজকের মঙ্গলগ্রহে ‘কিউরিসিটি’রযুগেও সেই কাজটিই চালিয়ে যাচ্ছি। মানা না মানা সেটা আপনার নিজস্ব পছন্দ।
এরকারণ কিন্তু আমরা নিজেরাই। আমাদের সৃষ্টিতেই সেটা, মৃত্যু ভিন্ন অন্য কিছু সেটা মুছে ফেলতে পারবেনা। যারা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং জানেন তাদেরকাছে ব্যাপারটা খুবই সরল। আমরা প্রকৃতই হাজার হাজার বছর ধরেই ‘ঈশ্বর বিশ্বাসী’ জিন বয়ে বেড়াচ্ছি। সেই জিন সুযোগ পেলেই আমাদের কে স্রষ্টার উপস্থিতিকে জানান দিতে ভুল করে না একদণ্ড। আমাদের জিনোম সিস্টেম আমাদের কে ঈশ্বর বিশ্বাসী করে রাখে এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। ‘জেনেটিককোড’ কে তো আমরা চাইলেই মুছে ফেলতে পারবনা। সে ক্ষমতা আমাদের এখনো হয়নি। হবে কিনা জানিনা। যদিও বিজ্ঞানের ভাষায় ‘জেনেটিক ট্রান্সফর্মেশন’ কিংবা ‘জেনেটিক মিউটেশন’ সম্ভব এবং সেটা হচ্ছেও। আর সে ট্রান্সফর্মেশন বা মিউটেশন যে ঈশ্বর বিশ্বাসের মাত্রার পারদ কে উপরের দিকে ঠেলে দিবেনা, আরও মজবুত করবে না, তারইবা কি নিশ্চয়তা? তাই যতদিন এই পৃথিবীতে মানুষ থাকবে, ততদিন ঈশ্বর বিশ্বাসী মানুষও থাকবে। এখানে যুক্তি খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারবে বলে মনে হয়না, যুক্তি তাঁকে সংশয়বাদী করবে, এটা হয়ত মেনে নেয়া যায়। সেক্ষেত্রে ‘কাউন্টার যুক্তি’ই হতেপারে প্রভাবক, তাঁকে ‘রিভার্ট’ করতে; পরকালের কষ্ট বা আনন্দের সংবাদ খুব বেশি যে ফলপ্রসূ হবে তা মনে হয়না, ক্ষেত্রবিশেষে ‘ব্যাক ফায়ার’ এর সম্ভাবনা বেশি।
তো এই হচ্ছে আমার কথা। ছাত্র থাকাকালীন যে অল্প শিখেছিলাম আর কিছু বই পত্র পড়ে আমার যে অনুধাবন হয়েছে সেটাই এখানে এতক্ষণ প্যাঁচাল করেছি। এর বেশি বলতে গেলে তালগোল পাকিয়ে ফেলব, তাই আর এগুচ্ছিনা। সবশেষে একটি গল্প বলে লেখাটির সমাপ্তি টানব। যদিও গল্পটা আমার নিজেরনা, ধাঁর করা। ডাঃ মোহিত কামলা; বাংলাদেশের অন্যতম একজন সাইক্রিষ্ট বা মনোবিজ্ঞানী। উনার একটি বইয়ে এইগল্পটা পড়া। তিনি ‘জেনেটিক কোড’ এর অস্তিত্য ও চেতনে কিংবা অবচেতনে সেটার প্রভাব বলতে গিয়ে এই ঘটনাটি এনেছেন। হুবহু তার লেখায়:
‘শক্তিমান লেখিকা তসলিমা নাসরিনের সাথে একবার সমুদ্র পেরিয়ে সেন্টমার্টিন এ যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। ফিরে আসার সময় বাতাসের গতি গেল বেড়ে। ঢেও হল এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত, বোটের দুপাশ থেকে পানি ছিটকে এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের।
নাসরিন হঠাৎ চিৎকার দিয়ে বলছে, ‘আল্লাগো মরে যাব নাকি! মাগো! একি! একি! সংগে ছিল একটি শিশু। রিশাদ ময়ূক।তার মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে চিৎকার দিয়ে বলছে ‘আম্মু, সমুদ্রকে থামতে বল, সমুদ্রকে থামতে বল।
বিপদে পড়লে মানুষ তাঁর প্রিয়তম মানুষের কথা স্বরন করে, ছোট শিশুর মত আচরন করে কিংবা সবচেয়ে ক্ষমতাধর নির্ভরশীল কারো কাছে প্রার্থনা করে। কোনও বিকৃতি ছাড়াই তার অবচেতন মনের চিরন্তন সত্যের প্রকাশ ঘটে। নাসরিনের অবচেতন চিন্তাধারা থেকেও সৃষ্টিকর্তার প্রতি প্রচ্ছন্ন অনুভূতি অই সময়ে বেড়িয়ে এসেছে’।(মানব মনের গতি প্রকৃতি)
তিনি এই ঘটনার উপসংহারে লিখেছেন: সমুদ্রে বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়েছে নাস্তিক্যবাদ তার শক্তিমান কলমের ডগা থেকে নিঃসৃত শব্দমালার শৈল্পিক কারুকাজ মাত্র, অন্তরের গভীর থেকে উথ্বিত অনুভূতির পুরোপুরি বহিঃপ্রকাশ নয়। অতলে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তারপ্রতি ভালোবাসা বোধ জমা হয়ে আছে, সময় ও সুযোগ তার বিচ্ছুরণ ঘটাবেই’।
একজন মনোবিজ্ঞানী যদি একজন স্বঘোষিত ঈশ্বর অবিশ্বাসী সম্পর্কে এই রকম আশা রাখতে পারেন তবে আমরা কেন স্রষ্টায় বিশ্বাসীরা সেই আশা রাখতে পারব না। আমাদের নবী যদি আরবের তায়েফ বাসীদের কাছ থেকে আঘাত ও অপমান পেয়েও ভবিষ্যতে তাদের এক স্রষ্টায় বিশ্বাসী হবার আশা পোষণ করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে আমাদের ধর্মীয় নেতাদেরও এই বিষয়ে আরও সচেতন ও সুক্ষ দৃষ্টি দেয়া উচিৎ হবে বলে আমি মনে করি।
আশা করি – আমাদের সংশয়বাদী ভাইরা, বোনরা, নিজেদের সংশয় কাটানোর জন্য চেষ্টা করবেন, আপনাদের‘সংশয়’ ধর্মবিদ্বেষে জড়িয়ে নিজেদের ‘ব্যক্তিত্ব’কে কলুষিত করবেন না, করবনে না মানবতার অপমান। তা নাহলে আমাদের প্রতিবাদ, প্রতিরোধ যতটা না, তার চেয়ে হাজার-গুন ঘৃণা আপনাদের দংশন করবে। সেটা থেকে কে রক্ষা করবে আপনাদের?
©somewhere in net ltd.