![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সাহিত্য আড্ডা জমে। সবাই আমন্ত্রিত।
নন্দলাল শর্মা
বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব সীমান্তবর্তী সিলেট বিভাগ একটি প্রাচীন ভূখণ্ড এবং ইতিহাসের বহু ভাঙ্গাগড়ার ফল। এই ভূখণ্ডের আয়তন বারবার পরিবর্তিত কখনও সংকুচিত, কখনও স¤প্রসারিত হয়েছে। বর্তমান রূপ সংকোচনের ফল। প্রাচীন সিলেটের কিছু অংশ কিশোরগঞ্জ এবং কিছু অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় সিলেটের করিমগঞ্জ মহকুমার রাতাবাড়ি, বদরপুর ও পাথারকান্দি থানা সহ করিমগঞ্জ থানার অংশবিশেষ সিলেট থেকে বিচ্যুত হয়ে আসাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সিলেট বিভাগ ছাড়াও আসামের করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি ও কাছাড় জেলা, ত্রিপুরার ধর্মনগর, কৈলাসহর ও কমলপুর এবং মেঘালয়ের শিলং অঞ্চলে প্রচলিত। তাই সিলেটের লোক ঐতিহ্য সিলেটেই সীমাবদ্ধ নয় বাইরেও স¤প্রসারিত।
একটি জাতি বংশ পরম্পরায় মুখেমুখে যে সাহিত্য সৃষ্টি ও লালন করে তাকেই লোকসাহিত্য বলে। লোকসাহিত্য মৌখিক সাহিত্য। ধারণা করা হয় মানব সভ্যতার উষালগ্লেই লোকসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। তখন হয়তো তা ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। ‘লোকসাহিত্য অত্যন্ত প্রাচীন, আদিম সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে এর উৎপত্তি।’ ( সিদ্দিকী ১৯৯৪:২১) লোকসাহিত্য ‘মুখে মুখে রচিত হয়ে লোক থেকে লোকান্তরে এবং স্থান থেকে স্থানান্তরে পরিভ্রমণ করার পর কালান্তরেও জীবন্ত থেকে যায়। লেখাপড়ার আওতার বাইরে অসংখ্য পল্লীর জন জগতটাই হলো লোকসাহিত্যের বিচরণ ত্রে বা লীলাভূমি।’( আলী ১৯৯৫:১৪) লোকসাহিত্যের জন্ম পল্লীর সাধারণ মানুষের মুখে। বংশানুক্রমে লোকপরম্পরায় এ সাহিত্য শ্র“তির মাধ্যমে শত শত বছর ধরে টিকে আছে। লোক সাহিত্যই প্রাচীন সাহিত্য। অলিখিত সাহিত্যই লোক সাহিত্য। তাই এটি টহৎিরঃঃবহ ষরঃবৎধঃঁৎব ড়ভ ধহু মৎড়ঁঢ়, যিবঃযবৎ যধারহম ৎিরঃঃবহ ড়ৎ নবরহম রিঃযড়ঁঃ রঃ.( ভট্টাচার্য ২০০৪: ১৭)
সিলেট বিভাগ লোকসাহিত্যের খনি। ‘লোকসাহিত্য সাধনায় সিলেটের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল। বিষয়ের বৈচিত্র্য, ভাবের গভীরতায় এবং পরিমাণের বিশালতায় সিলেটের লোকসাহিত্য আমাদের সংস্কৃতির এক অমূল্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের পুনর্গঠনের স্বার্থে এই রতœভাণ্ডারের সুশৃঙ্খল সংগ্রহ সংরণ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।’( খান ১৯৯২)
সিলেটে লোকসাহিত্যের এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা কেবলমাত্র সিলেটেই আছে অন্য কোথাও এর প্রচলন নেই। এ প্রসঙ্গে মালসি গান, ধুরাগান, ভট্ট কবিতা , ত্রিনাথের গান, গোবিন্দ ভোগের গান, ডরাইপূজার গান, ঘাটুগান, আরিগান, মালজোড়া গান ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। ধামাইল গানের উদ্ভব সিলেটেই। বর্তমানে তা বাইরে স¤প্রসারিত হয়েছে। লোকগীতিকা, বারমাসী গান, প্রবাদ-প্রবচন প্রভৃতি কয়েকটি েেত্র সিলেটের অবদান অত্যন্ত গৌরবজনক।
মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সাহিত্যরতœ সিলেটের লোকসাহিত্য সম্পদকে সাঁইত্রিশ ভাগে ভাগ করেছেন। যথা Ñ ১. বারমাসী, ২.গীত বা লাছাড়ি গান, ৩. ছাইয়া (ছড়া), ৪. দৃষ্টান্ত, ৫.পই (ছোট ছোট পদ্য), ৬. বাউল গান, ৭. মারফতি গান, ৮. প্রবাদ, ৯. কথার কথা (কথার সঙ্গে যে কথা আসে), ১০. ধামালি (ধামাইল), ১১. ডোরা (ধুরা) গান, ১২. সারি গান, ১৩. গাজির গান, ১৪. জারি গান,১৫. হাজিরাত গান, ১৬. ঘাটু গান, ১৭. উলী (হোলী বা দোল গান), ১৮. দুঃখের গান, ১৯. ফাঁকি কথা (ঠেকান কথা), ২০. মুর্ছিয়া গান (মর্সিয়া), ২১. বান্ধাগান, ২২.হেঁয়ালি শ্লোক, ২৩. চুটকি গান, ২৪. ভারত (বিচরণ) গান, ২৫. ভাঙ্গানি শিল্লক, ২৬. বয়ান (বর্ণনা), ২৭. রংচং, ২৮. ডাক (খেলার), ২৯. ফাঁকি কথা (ঠকান কথা), ৩০. আউল কথা ( একটা পদ আবৃত্তি করতে করতে কথা এলোমেলো বা আউলা জাউলা হয়ে পড়ে), ৩১. প্যাচের কথা (কঠিন উত্তর, চিন্তাপূর্ণ বাক্যাবলী, ৩২. টক্কর কথা ( উত্তর দানে প্রার্থীকে প্রার্থনায় বঞ্চিত করা),৩৩. ইশারা কথা (ইঙ্গিতে বিষয় প্রকাশক প্যাচের কথা), ৩৪. হেঁয়ালি অঙ্ক বা হিসাব (কঠিন স্তরের চিন্তাযুক্ত হিসাব), ৩৫. লোক গল্প বা চরিত্র গঠন ও শিামূলক গল্প, ৩৬. ভাট কবিতা (ভট্টকাব্য), ৩৭. জনসাহিত্য। (হোসেন ১৯৯০: ৫৬-৫৭) অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী এই সাঁইত্রিশ ভাগের অতিরিক্ত সিলেটের লোকসাহিত্যের আরও আটাশটি উপবিভাগের নাম উল্লেখ করেছেন ‘লোকসাহিত্যে জালালাবাদ’গ্রন্থে। যথাÑ ১. আরি গান, ২. বিয়ের গান, ৩. রূপকথা, ৪. উপকথা, ৫. মালজুড়া, ৬. ধরাট গান, ৭. পীর মুর্শিদি গান, ৮. ভাটিয়ালি গান, ৯. মেঘর গান, ১০. ফকিরালি গান, ১১. মন্ত্র, ১২. হাপড়িয়া গীত, ১৩. ধামাইল গান, ১৪. বেংগাই পুতর গান, ১৫. বেজ বাইদ্যার গান, ১৬. হিরালির গান, ১৭. বিরহ-বিচ্ছেদের গান, ১৮. গজল গান, ১৯. প্রভাতি গান, ২০. ঝুমুর গান, ২৬. পাঁচালি গান, ২৭. রাখালর গান, ২৮. ধান কাটা, ধানভানা ও চিড়াকুটার গান। এই পঁয়ষট্টি উপবিভাগের বাইরে রয়েছে নির্বাণ সংগীত, মালসি গান, ত্রিনাথের গান, ঝুমুর গান, গোবিন্দ ভোগের গান, ডরাই পূজার গান, ছাদ পেটানোর গান ইত্যাদি। এই শ্রেণীকরণ বিজ্ঞানভিত্তিক না হলেও সিলেটের লোকসাহিত্যের বিশাল ত্রে এতে চিহ্নিত হয়েছে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে সিলেটের লোকসাহিত্য আমাদের সাংস্কৃতিক বলয়ে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। একটি প্রবন্ধে এর পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তোলে ধরা অসম্ভব ব্যাপার। এজন্য প্রয়োজন এক বৃহদায়তন গ্রন্থ রচনা। তাই সংেেপ সিলেটের লোকসাহিত্যের বিশেষ বিশেষ কয়েকটি ধারার সংপ্তি আলোচনা করে প্রবন্ধের সমাপ্তি টানা হবে।
১. ধামাইল গান
ধামাইল গান ও ধামাইল নাচ সিলেটের নিজস্ব সম্পদ। লোকসাহিত্যের এ শাখাটি এখনও সজীব ও সতেজ। ‘যে কোন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে এ গানের প্রচলন সমধিক। বিয়ের শুরুতেই স্ত্রী আচারের সঙ্গে সঙ্গে এ গান মেয়েদের কন্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে। বিয়ের পরও এ গান চলতে থাকে। যুবতীরা দু’ হাতে তালি বাজিয়ে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে এ গান পরিবেশন করে।’ ( খান ১৯৮৫:১১০) ধামাইল গান বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবেশে বিচিত্র বিষয়কে অবলম্বন করে গীতও রচিত হয়ে থাকে। বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন ছাড়াও মাঘমাসে সূর্যব্রতের সময় ধামাইল সারাদিন ধরে চলে। সে সময় ‘সূর্যোদয়ের পূর্বেই এই উৎসবের আরম্ভ। সমস্ত দিন দাঁড়িয়ে থেকে নৃত্য সহযোগে শ্রীকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক গান গাওয়া হয়, সূর্যাস্তের পর রাধাকৃষ্ণের মিলনের গান গেয়ে এই উৎসবের সমাপ্তি হয়।’ (ভৌমিক ১৯৬৫:১৬৫) রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থের গানই ধামাইল-এ গীত হয়। অন্য কবির গান তুলনামূলকভাবে কম প্রচলিত।
২. ঘাটু গান
ঘাটুগান সিলেটের নিজস্ব সম্পদ। ষোড়শ শতকে হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ অঞ্চলে ঘাটুগানের উদ্ভব। তখন কোনো এক বৈষ্ণবাচার্য কৃষ্ণপ্রেমে মোহিত হয়ে বিবাগী হয়ে রাধিকাভাবে প্রেমাভিনয় করতে থাকেন। ক্রমে তাঁর শিষ্যদল গড়ে ওঠে। বালকদের সখী বেশে সাজানো হত। তারা নেচে গেয়ে প্রেমভাব প্রকাশ করত। আধ্যাত্মিক চেতনা দিয়ে ঘাটুগানের শুরু হলেও তা লোকসমাজে প্রবেশ করে লোকচৈতন্য দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে এর আদর্শচ্যূতি ও রুচিবিকৃতি ঘটে। (আহমদ ১৯৭৪: ১০৮) ক্রমে ঘাটুগান অবলুপ্ত হতে থাকে। এখন এর ব্যবহার সম্ভবত নেই। সামাজিক মর্যাদা নিম্নগামী হওয়ায় অশ্লীলতার অভিযোগে ঘাটুগান বর্জিত হয়েছে। আধ্যাত্মিক গানের একটি শাখা পরিবর্তিত হয়ে জনচুর অগোচরে চলে গেল।
৩. হাইড় গান
সারি গান সিলেটে হাইড় গান নামে প্রচলিত। এটি আসলে শ্রম সংগীত। হাইড় গান প্রধানত নানা ধরনের-যথা
৩-ক. নৌকা বাইচের গান
ভাটি অঞ্চলে বর্ষাকালে নৌকা বাইচ হয়। এটি সিলেটে নাও দৌড় নামে প্রচলিত। সারিবদ্ধভাবে অনেকটি নৌকা হাওরে বা নদীতে সমবেত হয়ে একটি নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা শুরু করে। গন্তব্যে পৌঁছার সময় একজন গায়েন নৌকায় দাঁড়িয়ে গান করে। করতাল ও ঢোল জাতীয় বাদ্য এতে ব্যবহৃত হয়। মাঝিরা সমবেত কন্ঠে নির্ধারিত একটি কলি পুনরাবৃত্তি করে। এককালে বহু লোক নৌকা বাইচ দেখতে সমবেত হত। সিলেটের একটি বারমাসীতে আছে-‘ হাতঘাট মানুষ দলা অইছে নাও দৌড় দেখতো করি।’ মাঝিমাল্লাগণ হাইড় গান বা নৌকা বাইচের গান গেয়ে মনের আনন্দে নৌকা দৌড়ান।
৩. খ- ছাদ পেটানোর গান
দালানের ছাদ পেটানোর সময় শ্রমিকরা শক্তি সঞ্চয় ও মনের প্রফুল্লতার জন্য এক ধরনের সারি বা হাইড় গান গেয়ে থাকে। যন্ত্রের সাহায্যে সিমেন্ট ও কংক্রিট মিশ্রণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় ছাদ পেটানোর গান অবলুপ্তির পথে।
৪. আরি গান
আরি গান সিলেটের নিজস্ব সম্পদ। অন্য কোনো অঞ্চল থেকে আরিগানের নিদর্শন এখন পর্যন্ত আবি®কৃত হয়নি। আরি গান এক শ্রেণীর বিরহ সংগীত। গভীর রাতে এই গান গীত হয়ে থাকে। অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর মতে ফারসি আহাজারি শব্দ থেকে আরি শব্দের উৎপত্তি। ‘ভাব ভাষা প্রকাশভঙ্গি এবং সুর ও ছন্দের বিবেচনায় অনবদ্য আরী গানগুলো সিলেটের গ্রাম গ্রামান্তরে, হাওরে বাওরে রাতের একটা বিশেষ সময়ের ভেতর ব্যাপকভাবে গীত হত আগেকার দিনে।.... মধ্যরাতের পর দিনের আগমন বার্তা হিসেবে প্রকৃতি জেগে ওঠার আগ পর্যন্ত নীরব নিস্তব্ধ রাতের গভীরতা যতই বাড়তে থাকে ততই, আরী গানের চমৎকার আবহ সৃষ্টি হতে শুরু করে। .... সিলেটের আরী গানকে খাঁটি প্রকৃতির গান কিংবা মৌন নিথর ও নীরব নিস্তব্ধ প্রকৃতির করুণতম বিরহ সংগীত বলা যেতে পারে। গভীর নিবিড় মৌন নিথর প্রকৃতিই যেন এ গানের সুর তাল লয় বাদ্য সবকিছু। অতৃপ্তি জনিত হতাশা নিরাশা এবং অনন্ত বিরহ সংক্রান্ত কারুণ্যের গভীরতম অভিব্যক্তিই আরী গানের মূল সুর হিসেবে গণ্য। ধূয়া পদটিকে অতিমাত্রায় প্রলম্বিত করে কারুণ্য ফুটিয়ে তোলা হয় আরী গানে।’ (আলী ২০০৩: ২৭০)
৫. বিয়ার গীত
সিলেটে হিন্দু সমাজে বিয়ে উপলে নানা লোকাচার পালিত হয়। প্রতিটি লোকাচার সংগীতকেন্দ্রিক। বিয়ে সংক্রান্ত লোকাচার বা স্ত্রী আচার পালিত হওয়ার সময় নারীগণ সমবেতকন্ঠে বিয়ের গীত গেয়ে থাকেন। বিয়ের সময় ধামাইল ছাড়াও নানা পর্যায়ের গান গীত হয়। কিছু গান নৃত্য সহযোগে (ধামাইল) আবার কিছু গান বসে বসে গাওয়া হয়।
সিলেটের মুসলমান সমাজেও একদা বিয়ের গীত কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে এর ব্যবহার প্রায় নেই। চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ বালাগঞ্জ উপজেলা থেকে এ ধরনের গীত সংগ্রহ করেছিলেন। সা¤প্রতিক কালে সাদিয়া চৌধুরী পরাগ, তরফদার মুহাম্মদ ইসমাইল ও প্রফেসর জাহান আরা খাতুন এ বিষয়ে কাজ করছেন।
৬. বান্ধাগান
সিলেটে গ্রামাঞ্চলে কোথাও কোথাও হিন্দু সমাজে বিয়ের পর দিন ও চতুর্থ দিনে বান্ধাগান গীত হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম আলোকপাত করেন মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন। তাঁর ভাষায়, ‘বিবাহ উপলে বরের বাড়িতে বরের মা, মাসি, পিসি প্রভৃতিকে উপল করিয়া গ্রাম্য মেয়েরা অবশ্য সম্পর্কানুসারে শ্লেষমূলক তুলনা উপমা ও কল্পিত নব সম্পর্ক রচনাক্রমে যে সব গান গাহিয়া থাকেন তাহাই বান্ধা গান নামে পরিচিত। বান্ধা গান হেঁয়ালিমূলক ও আক্রমণাত্মক।’’ (হোসেন ১৯৯০:৬০)
৭. রূপসী ব্রতের গান
রূপসী ব্রত কেবল সিলেট অঞ্চলের হিন্দু সমাজে উদযাপিত হয়। সন্তান জন্মের একমাস পর, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, সাধভণ প্রভৃতি পর্ব উপলে এই ব্রত উদযাপিত হয়। এই ব্রত উপলে রূপসী ব্রতের গান নারীরা গেয়ে থাকেন। রাধারমণ দত্তও রূপসী ব্রতের গান রচনা করেছেন।
৮. ধুরা গান
সিলেটের হিন্দু সমাজে কীর্তন বা মহোৎসব অন্তে মহাপ্রসাদ গ্রহণ কালে এক ধরনের পদ গীত হয়। মূল পদ একজন গেয়ে থাকেন। পংক্তিভোজনে অংশগ্রহণকারী সকলেই আনন্দ ধ্বনি দিয়ে থাকেন। এ সব গানের বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণ ও গৌরাঙ্গ বিষয়ক। মোহাম্মদ আশরাফ হোসেনের মতে এসব গান নিম্নশ্রেণীর হিন্দু সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল। এই তথ্য সঠিক নয়। ধুরা গান উচ্চ শ্রেণীর হিন্দু সমাজেও প্রচলিত ছিল এবং এখনও আছে। কেবল গ্রামে নয়, শহরেও ধুরা গান প্রচলিত।
৯. হাজিরাত গান
‘আসরেতে রংবাদ্য বাজে গো বারৈয়া চা’- সিলেটে প্রচলিত একটি জনপ্রিয় হাজিরাত গান। গ্রামীণ বৈদ্য বা কবিরাজ বা ওঝাগণ ভৌতিক উপদ্রব নিবারণ কল্পে ভূতে ধরা বলে কথিত কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে ভূতকে হাজির করানোর জন্য এই গান গীত হয়ে থাকে। অন্য সময় এ গান গাওয়া নিষেধ। লোকবিশ্বাস এতে ভূত প্রেত উপস্থিত হয়ে তি সাধন করবে। বর্তমানে হাজিরাত গান আর শোনা যায় না। চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ হাজিরাত গানের পাঁচটি ক্রম উল্লেখ করেছেন। প্রথম থেকে পঞ্চম ক্রম পর্যন্ত গান ধারাবাহিকভাবে গীত হয়। ক্রমগুলোর নাম হচ্ছে- দোহাই গান, আসর গান, ভূত সাজার গান, ভূত আসার গান এবং নাচনের গান। (চৌধুরী ২০০৭:১৮৬)
১০. উল্টা গান ও অচরিত গান
‘অচরিত বাউল ও অচরিত ফকিরের গানগুলি উল্টা গান ও অচরিত গান নামে পরিচিত। এ শ্রেণীর গানে মূল উদ্দিষ্ট বিষয় অন্য বিষয়ের আড়ালে রাখিয়া আশ্চর্যজনক ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। আধ্যাত্মিক তত্ত্ব বা ভেদকে প্রকাশভাবে প্রচার না করিয়া মারপ্যাচের মারফতে প্রকাশ করাই ঐ শ্রেণীর গানের উদ্দেশ্য।’ (হোসেন ১৯৯০: ৬২-৬৩)
১১. হিরালির গান
হাওর অঞ্চলে চৈত্র মাসে পাকা বুরোধান কাটা হয়। তখন শিলাবৃষ্টি হলে তে নষ্ট হয়। শিলাবৃষ্টি থেকে ফসল রার জন্য এক শ্রেণীর ওঝা একদা মাঠে দাঁড়িয়ে গান করত। এই গান হিরালির গান নামে পরিচিত। বর্তমানে হিরালি সম্ভবত আর নেই।
১২. ভট্ট সংগীত
ভট্টসংগীত সিলেটের নিজস্ব সম্পদ। ভট্ট পদবিধারী জনগোষ্ঠির অনেকে লৌকিক বা পারলৌকিক বিষয়ে মৌখিক এই গান রচনা করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তা জনসমে প্রচার করতেন। ভট্টসংগীত স্বতঃস্ফুর্ত ও ফরমায়েসি দু’ধরনেরই হতে পারে। ‘ ভট্টকবিদের দ্বারা নানা প্রকারের লোক শিার প্রচার হয়। ... ইহাদের বিষয় কেবল প্রাচীন উপাখ্যানেই নিবদ্ধ নহে। কোনও রূপ অভিনব ঘটনায় সমাজে আন্দোলন আলোচনার তরঙ্গ উঠিলে তাহাও ভট্টকবিতায় প্রকাশ পাইয়াছে।...দেশে যখন খবরের কাগজ ছিল না, ভট্টগণ ঐ রূপে নানা ঘটনা সাধারণ্যে প্রচারের কাজ করিয়াছেন।’( পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা বৈশাখ ১৩৪৪) ভট্ট কবিতায় যেমন সমকালীন বিষয় Ñ যেমন ময়মনসিংহের ডাকাতি, ভাওয়াল রাজার কাহিনী, থাকাবস্থার জরিপ ইত্যাদি-স্থান পেয়েছে; তেমনি পৌরাণিক কাহিনীও-যেমন দযজ্ঞ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ,যযাতির নরমেধ যজ্ঞ ইত্যাদি বর্ণিত হয়েছে। বর্তমানে এই ধারা অবলুপ্ত । ভট্ট কবিতার পরিবর্তিত রূপ পথুয়া কবিতা। বিশ শতকের ষাটের দশকেও সিলেট অঞ্চলের গ্রাম্য বাজারে কবিরা গেয়ে গেয়ে ষোলো পৃষ্ঠার পথুয়া কবিতা বিক্রি করতেন। সমকালীন মুখরোচক ঘটনাই এতে বর্ণিত হত।
১৩. বারোমাসি গান
বারোমাসি গান মধ্যযুগেও প্রচলিত ছিল। এটি বাংলাদেশের সর্বত্র, ভারতের অন্যান্য ভাষায়ও দেখা যায়। সা¤প্রতিককালে সম্ভবত কেবলমাত্র সিলেটের লোককবিগণ এটিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সিলেটের বারোমাসি গানে কেবল নায়িকার বিরহই প্রকাশিত হয়নি। আধ্যাত্মিক বিষয়ও আলোচিত হয়েছে। যেমন ইছলামোর বারোমাসিতে বলা হয়েছে।
মাগ না মাসের শীতে কাঁপাই তুলে ইয়া
শয়তানর দাগাতনে রইবায় বাঁচিয়া।
শয়তান মুমিনর দুশমন অয়, কামো দেয় বাধা
হেষে দেখবায় ফান্দো ঠেকছো মজায় মজায় দাদা....
বাংলা একাডেমী সিলেটের ৬৯টি লোক বারোমাসি ও সা¤প্রতিক কালে রচিত ১২টি বারোমাসির এক বৃহদায়তন সংগ্রহ প্রকাশ করেছে। কেবল সংখ্যার দিক থেকে নয়, গুণগত দিক থেকেও বারোমাসিগুলো আমাদের লোকসাহিত্যে অমূল্য সম্পদ। সিলেটের বারোমাসিগুলোকে আটভাগে বিভক্ত করা হয়েছে-
১. প্রবাসী স্বামীর জন্য নায়িকার বিরহমূলক বারোমাসি, ২. নায়িকার বিরহ এবং বিরহ শেষে মিলন, ৩. নায়িকার সতীত্ব পরীা, ৪. নায়কের প্রেম নিবেদন, নায়িকার প্রত্যাখান, ৫. ইসলাম ধর্ম বিষয়ক বারোমাসি, ৬. পৌরাণিক বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত বারোমাসি, ৭. সমাজচিত্রমূলক বারোমাসি এবং ৮. বিবিধ।
১৪. নির্বাণ সংগীত
নির্বাণ সংগীত সিলেটের লোকসংগীতের একটি প্রাচীন ধারা। এ ধারাটি সিলেটের নিজস্ব সম্পদ। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পূর্বে হবিগঞ্জের জগন্মোহন গোসাঞি জগন্মোহিনী স¤প্রদায় গড়ে তোলেন। ‘ভারত বর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১ম ভাগ ১৮৭০) গ্রন্থে অয়কুমার দত্ত একে বৈষ্ণব ধর্মের এক উপ স¤প্রদায় বলে নির্দেশ করেছেন। নির্বাণ সংগীত গান করা এই স¤প্রদায়ের উপাসনার অঙ্গ বলে বিবেচিত। এখনও জগন্মোহিনী স¤প্রদায়ের আখড়ায় নির্বাণ সংগীত সকাল সন্ধ্যায় গীত হয়।
১৫. গাজন
‘গাজনের বাজনা বাজা, কে মালিক কে সে রাজা’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই পংক্তিটি সুপরিচিত। গাজন বাংলাদেশের একটি প্রাচীন উৎসব। চৈত্রমাসে এ উৎসব উপলে হয় গাজনের গান ও নৃত্য। সিলেট বিভাগের নানা স্থানে এখনও গাজনের গান গীত হয়। চড়ক উৎসব ছাড়া এ গান গাওয়া হয় না।
১৬. পাঁচালি
পৌরাণিক ও লৌকিক দেবদেবীর লৌকিক পূজাচারকে কেন্দ্র করে পাঁচালি গান গীত হয়। এই গানের পয়ার অংশ একজন গায়েন একসুরে ধীরলয়ে গান করেন। লাছাড়ি বা ত্রিপদী অংশ সমবেত কন্ঠে গীত হয়। সাধারণতও সন্ধ্যার পর নানা বার তিথি উপলে পাঁচালি পঠিত হয়। সিলেট বিভাগে এখনও পাঁচালির ব্যবহার আছে। তবে কয়েকটি পাঁচালি বিলুপ্ত হয়েছে। যেমন- ঘোর চণ্ডীর পাঁচালি, হাস্যনাথের পাঁচালি, বাবাহরের পাঁচালি ইত্যাদি।
১৭. মরমি গান
সিলেটে লোক সংগীতের যে ধারাটি সবচেয়ে সবল সেটি হল মরমি গান বা তত্ত্ব সংগীত। সুফি তত্ত্বের উৎপত্তি ইরানে। কিন্তু বাংলার মাটিতে এর বিকাশ ঘটেছে প্রবল স্রোতে। মরমি কবিরা খোদাপ্রেমিক। আধ্যাত্মিক চিন্তায় তাঁরা মশগুল থাকতেন। ‘অন্তরের গহীনে রতি আলোর অনির্বাণ শিখা জ্বালিয়ে তাঁরা খুঁজেছেন স্বীয় স্রষ্টাকে। স্রষ্টা খুঁজতে গিয়ে সাধক মন কঠোর সাধনার মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে তার প্রেমে বিভোর হয়ে আপন মনে ভাব জগতে বিচরণ করে স্রষ্টাকে ঘিরে যে ভজন বা সঙ্গীত রচনা করেছেন তাই মরমী সাহিত্য হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।’ (হারূন ২০০২ঃ ৬৪) মরমি সাহিত্যে শিতালং শাহ, শেখ ভানু, হাছন রাজা, দীন ভবানন্দ, সৈয়দ শাহনুর, ভেলাশাহ, আব্দুল ওহাব চৌধুরী, আরকুম শাহ, ইয়াছিন শাহ সহ শত শত কবির নাম উল্লেখযোগ্য।
লোকসাহিত্যের বহু শাখা প্রশাখা। এতণ সিলেটের যে কয়টি ধারা সম্পর্কে বলেছি সবই লোক সংগীতের অন্তর্ভুক্ত। লোকসাহিত্যের সবল শাখা লোক সংগীত। তাই একে প্রাধান্য দিতেই হয়। সংেেপ সিলেটের গৌরবজনক অন্য কয়েকটি ধারার উল্লেখ করব।
প্রবাদ
লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম শাখা প্রবাদ। লোকজীবনে এর ব্যবহার যে কোন সময় যে কোন ভাবে ঘটে থাকে। এজন্য লোকসাহিত্য চর্চার প্রাথমিক অবস্থায় প্রবাদ গুরুত্ব লাভ করেছে। সিলেটে প্রবাদের ব্যবহার খুব বেশি। এ পর্যন্ত সংগৃহীত সিলেটি প্রবাদ সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের শীর্ষে। ড. সুশীল কুমার দে-এর বাংলা প্রবাদ গ্রন্থে ৯,১০০টি এবং ড. আশুতোষ ভট্টাচার্য-এর‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে ১২,৫০৭টি প্রবাদ সংকলিত হয়েছে। বাংলা একাডেমী সংগৃহীত প্রবাদের সংখ্যা ৫,৯৩০। সিলেটের প্রবাদ বিষয়ক অনেকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদ্দর আলীর ‘ছিলটি প্রবাদ প্রবচন’ (১৯৯৯) গ্রন্থে ১৬,৫৪৯টি প্রবাদ সংকলিত হয়েছে। অন্যান্য সংকলন থেকে বাছাই করলে এই সংখ্যা আরো বর্ধিত হবে। কাজেই প্রবাদ সাম্রাজ্যে সিলেট সম্রাজ্ঞী। সিলেটের নিজস্ব প্রবাদ যেমন আছে, তেমনি বহুল প্রচলিত বাংলা প্রবাদের সিলেটি রূপও আছে।
ছড়া
লোকসাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা ছড়া, সিলেটের লোক ছড়ার পরিমাণ বিপুল। ছড়ার বিষয় নানাবিধ। যেমন খেলাধুলা সংক্রান্ত ছড়া, শিশুতোষ ছড়া, বিবাহ বিষয়ক ছড়া,সমাজ বিষয়ক ছড়া, ইতিহাস বিষয়ক ছড়া। চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ সংগৃহীত ৪৮২টি ছড়া বাংলা একাডেমীর লোকসাহিত্য সংকলন গ্রন্থের চারটি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী সংগৃহীত ছড়ার সংখ্যা ১৮৮। সিলেটের লোকছড়া আরও সংগ্রহের প্রয়োজন।
ধাঁধা
লোকসাহিত্য ভাণ্ডারের পরিণত মনন চর্চার এক কুশলী দিক ধাঁধা। ধাঁধাতে প্রহেলিকাময় একটি প্রশ্ন থাকে। বিচার বিশ্লেষণ করে এর উত্তর খুঁজে বের করতে হয়। সিলেটের ধাঁধা সম্পর্কে অভিসন্দর্ভ রচনা করে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন শ্রীদিলীপ কুমার লাহিড়ী। ইংরেজিতে লেখা এ অভিসন্দর্ভটি প্রকাশিত হলে সিলেটি ধাঁধার শ্রেষ্ঠত্ব অনুধাবন করা যাবে। অধ্যাপক মুহম্মদ আসাদ্দর আলী সিলেটের ধাঁধাকে চৌদ্দটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন। তাঁর ‘লোকসাহিত্য জালালাবাদ গ্রন্থে সংকলিত ধাঁধার সংখ্যা ২,২০১টি।
লোকগীতিকার েেত্র সিলেটের শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য। সিলেট অঞ্চলের অনেক গীতিকা ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের মৈমন সিং গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকায় সংকলিত হয়েছে। ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ ‘সিলেট গীতিকার বৈচিত্র্যঃ সমাজ ও সংস্কৃতির নিরিখে’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তাঁর অভিসন্দর্ভে স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছে মৈমন সিংহ গীতিকার অধিকাংশ গীতিকাই সিলেট গীতিকা। এ প্রসঙ্গে মুহম্মদ আসাদ্দর আলীর একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ আছে- ‘ময়মনসিংহ গীতিকা বনাম সিলেট গীতিকা।’ চৌধুরী গোলাম আকবর সংগৃহীত গীতিকার সংখ্যা ৮৮টি।
লোককথা কিসসাসহ সিলেটের লোক সংগীতের অনেক শাখার উল্লেখ করা সম্ভব হল না। সিলেটের লোক সাহিত্যের গৌরবোজ্জ্বল ধারা সংগ্রহ ও বিচার বিশ্লেষণ সম্পর্কে উপসংহারে সামান্য একটু ধারণা দেব। সিলেটে লোকসাহিত্যের ভাণ্ডার যে অফুরন্ত তা স্বীকার করেছেন লোকবিজ্ঞানী ড. আশরাফ সিদ্দিকী, শামসুজ্জামান খান সহ অনেকেই। সিলেটের লোকসাহিত্যের অনেক উপাদান সংগৃহীত হলেও সামগ্রিকভাবে কয়েক শতাংশ মাত্র। আর ‘যা সংগৃহীত হয়েছে সেগুলোর ভিত্তিতে সিলেটকে কেবলমাত্র বাংলাদেশের মধ্যেই নয়, অসংখ্য লোক সংগীত সহ লোকসাহিত্য সম্পদের অন্যান্য েেত্রও সমগ্র উপমহাদেশের মধ্যে বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না।’ (আলী ১৯৯৬ ঃ ১১)
সিলেট অঞ্চলে লোক সাহিত্য সংগ্রহ ও আলোচনা শুরু হয়েছে উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে। এর বিকাশ সাধিত হয়েছে বিশ শতকের সূচনা লগ্নে। এ ব্যাপারে যারা পথিকৃৎ এর ভূমিকা পালন করেছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেনÑঅচ্যুতচরণ চৌধুরী, পদ্মনাথ ভট্টাচার্য, কৃষ্ণবিহারী রায় চৌধুরী, তারিনী চরণ দাস, জগন্নাথ দেব, গুরুসদয় দত্ত, মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, আব্দুল আজিজ মাষ্টার, ব্রজেন্দ্র নাথ অর্জুন, রাজ মোহন নাথ, মতিন উদদীন আহমদ, মুহাম্মদ আবদুল বারী, সৈয়দ মুর্তাজা আলী, যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য, আবদুল গফফার দত্ত চৌধুরী, আবদুল জব্বার প্রমুখ। পরবর্তীকালে এই ধারাকে বেগবান করেছেন চৌধুরী গোলাম আকবর, দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা, মুহম্মদ আসাদ্দর আলী, গোলাম কাদির ও অন্যান্যরা।
‘বাংলাদেশের ফোকলোর চর্চার ইতিহাস’ রচিত হয়েছে। এই গ্রন্থে সিলেটের লোক সাহিত্য চর্চার তথ্য সামান্যই। আগামী সংস্করণে এটি স¤প্রসারিত হবে বলে লেখক ড. মুহম্মদ আবদুল জলিল জানিয়েছেন। তাঁর লেখা ‘বাংলার ফোকলোর মনীষা’ গ্রন্থে সিলেটের চারজন ফোকলোরবিদ স্থান পেয়েছেন। ‘ফোকলোর চর্চায় সিলেট’ গ্রন্থ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী দেখিয়েছে অঞ্চল ভিত্তিক লোক সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস প্রণয়ন ও প্রকাশনে সিলেট পথিকৃৎ।
সিলেটের লোক সাহিত্য বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও একাডেমিক গবেষণা শুরু হয়েছে। ড. আবুল ফতেহ ফাত্তাহ ও ড. শরদিন্দু ভট্টাচার্য অভিসন্দর্ভ রচনা করে ডিগ্রি লাভ করেছেন।
আমাদের এই গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের আলোয় বিভাসিত হোক বিশ্বের ফোকলোর জগৎ। তরুণ গবেষকদের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
তথ্যপঞ্জি
আশরাফ সিদ্দিকী, ড.
১৯৯৪ লোক সাহিত্য, প্রথম খণ্ড। পরিমার্জিত সংস্করণ,ঢাকা।
আশুতোষ ভট্টাচার্য, ড.
২০০৪ বাংলার লোকসাহিত্য, প্রথম খণ্ড । ৫ সংস্করণ,কলকাতা।
ওয়াকিল আহমদ, ড.
১৯৭৪ বাংলার লোক সংস্কৃতি। ঢাকা।
চৌধুরী গোলাম আকবর
২০০৭ চৌধুরী গোলাম আকবর: রচনা ও সংগ্রহ সম্ভার, প্রথম খণ্ড, নন্দলাল শর্মা সম্পাদিত। সিলেট।
নন্দলাল শর্মা
১৯৯৯ ফোকলোর চর্চায় সিলেট। ঢাকা।
২০০২ সিলেটের বারমাসী গান। ঢাকা।
২০০৬ সিলেটের জনপদ ও লোকমানস। যুক্তরাজ্য।
নির্মলেন্দু ভৌমিক, ড. ও গুরুসদয় দত্ত সম্পাদিত
১৯৬৫ শ্রীহট্টের লোকসঙ্গীত। কলকাতা
পদ্মনাথ ভট্টাচার্য
১৩৪৪ (বাং) ভট্টকবিতা সংগ্রহ (প্রবন্ধ)। শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা
মুহম্মদ আসাদ্দর আলী
১৯৯৫ লোকসাহিত্যে জালালাবাদ। সিলেট।
১৯৯৬ সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় জালালাবাদ। সিলেট।
২০০৩ আসাদ্দর রচনা সমগ্র, দ্বিতীয় খণ্ড। লন্ডন।
মোবারক হোসেন খান
১৯৮৫ বাংলাদেশের লোকসংগীত (প্রবন্ধ)। শামসুজ্জামান খান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের লোক ঐতিহ্য’। ঢাকা।
মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন
১৯৯০ শিলহটের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড। সিলেট।
শামসুজ্জামান খান
১৯৯২ শুভেচ্ছাবাণী, স্মারকগ্রন্থ,‘৯২; হারূন আকবর সম্পাদিত। সিলেট।
হারূন আকবর
২০০২ সিলেটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য : মরমী সাহিত্য (প্রবন্ধ), আল ইসলাহ ৬৮ বর্ষ, ৪র্থ-৬ষ্ঠ সংখ্যা।সিলেট।
২| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৯:১০
শুভ্র দেব রায় বলেছেন: ভালা লেখা
©somewhere in net ltd.
১|
২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ৮:৫৮
পারাবত বলেছেন: প্রিয়তে।
ভাল লেখা