নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

জন্মসূত্রে মানব গোত্রভূক্ত; এজন্য প্রতিনিয়ত \'মানুষ\' হওয়ার প্রচেষ্টা। \'কাকতাড়ুয়ার ভাস্কর্য\', \'বায়স্কোপ\', \'পুতুলনাচ\' এবং অনুবাদ গল্পের \'নেকলেস\' বইয়ের কারিগর।

কাওসার চৌধুরী

প্রবন্ধ ও ফিচার লেখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। পাশাপাশি গল্প, অনুবাদ, কবিতা ও রম্য লেখি। আমি আশাবাদী মানুষ।

কাওসার চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভিলেজ পলিটিক্স (গ্রামীণ সংস্কৃতি)

০৫ ই এপ্রিল, ২০১৮ ভোর ৪:৪২


ভিলেজ পলিটিক্স বা গ্রাম্য রাজনীতি; নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত এ কথাটি শুনেনি কিংবা ভিলেজ পলিটিক্সের দুষ্ট চক্রের কবলে পড়েনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া আমাদের গ্রামে-গঞ্জে খুবই বিরল। নামের সাথে পলিটিক্স যুক্ত থাকলেও বাস্তবে এটা এমন এক রহস্যময় রাজনীতি যার কুল কিনারা করা সত্যি দুষ্কর। এই পলিটিশিয়ানদের জাতীয় রাজনীতিতে ভিন্ন নীতি-আদর্শ থাকলেও গ্রামের রাজনীতিতে এদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রায় এক ও অভিন্ন। ধারণা করা হয় খৃষ্টপূর্ব প্রায় সাড়ে তিন'শো বছর পূর্বে প্রাচীন ভারতে মাওরা সম্রাজ্যের (Maurya Empire) সময়ে লৌহ সভ্যতা (Iron age) থেকে ভারত উপমহাদেশে গ্রামীণ বসতির ইতিহাস পাওয়া যায়। আর তখন থেকে আজ অবধি আমাদের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় ভিলেজ পলিটিক্স পাল্লা দিয়ে চলছে। তবে যুগের পরিক্রমায় এ পলিটিক্সের ধরণ ও প্রক্রিয়া কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।

আমাদের দেশে ভিলেজ পলিটিক্সের ফাঁদে পড়ে অনেক লোক নিঃস্ব হয়েছে যুগে যুগে। এমনকি কাউকে কাউকে হামলা-মামলা ও মানহানির ভয়ে গ্রাম পর্যন্ত ছাড়তে হয়েছে। কত মানুষ যে এ কুট-কৌশলে পরাস্ত হয়ে বছরের পর বছর একঘরে থেকেছেন তার কোন হিসাব নেই। কত শত নারী এদের কুদৃষ্টিতে পড়ে সম্ভ্রম হারিয়েছেন কেউ খবর রাখে না। গ্রাম-গঞ্জের হাজারো সাধারন মানুষ এদের খপ্পরে পড়ে ভীটে মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন।

বিশিষ্ট ব্রিটিশ সাংবাদিক Sir Simon Jenkins ভিলেজ পলিটিক্সের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, "In village politics, as elsewhere, what matter's is not agreement but conflict. অর্থাৎ 'গ্রামে যা ঘটবে তা ভাল-মন্দ যাই হোক এটা কোন বিষয় নয়, তবে প্রতিটি কাজে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত থাকবে।'


বিশদভাবে বলতে গেলে গ্রামে এক ধরনের চতুর ও নেতিবাচক মানসিকতার লোক থাকে, যারা নিজেদের স্বার্থের উর্ধে উঠে সমাজের জন্য ভাল কিছু করে না। অন্য কেউ ভাল কাজের উদ্যোগ নিলে পরোক্ষভাবে এর বিরোধিতা করে। উদ্দেশ্য একটাই যাতে তিনি সফল হতে না পারেন, গ্রামে প্রভাব বিস্তার করতে না পারেন, নিজে সম্মানী হতে না পারেন। এরা সব সময় গ্রামে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লাগিয়ে রাখে, আবার নিজেরাই এর সমাধানের জন্য লোক দেখানো বিচার সালিশি বসায়। কেউ তাদের কথার অবাধ্য হলে অথবা তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলে তাকে অপমানিত হতে হয়।

গ্রামে সাধারণত তিন ধরনের মানুষ বসবাস করে। একটা অংশ হচ্ছে সুশিক্ষিত; তবে অনেকে আছেন যাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম কিন্তু জ্ঞানে আর অভিজ্ঞতায় বেশ পরিপক্ব, এরাও এই দলভুক্ত। আরেকটি পক্ষ হলো অল্প শিক্ষিত ও নিরক্ষর; এরা চলাফেরা ও আচার-আচরণে ভদ্র, পরোপকারী ও নিরীহ প্রকৃতির। সবশেষ অংশটি শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মানুষের সমন্বয়ে গঠিত। এরা অত্যন্ত চতুর, স্বার্থপর, হিংসা পরায়ন ও নেতিবাচক মানসিকতার অধিকারী। এরাই হচ্ছে গ্রামের সব অঘটনের কারিগর, নাটের গুরু। এক কথায় ভিলেজ পলিটিশিয়ান। তবে এরা সংখ্যায় হাতেগোনা।

গ্রামের সহজ-সরল, দরিদ্র এবং নিরীহ প্রকৃতির সাধারণ মানুষেরা মূলতঃ সবচেয়ে বেশি ভিলেজ পলিটিক্সের চক্রে পড়ে হাবুডুবু খায়। গ্রামে কি হচ্ছে না হচ্ছে এটা নিয়ে তাদের কোন আগ্রহ নেই, অনেকটা আত্মকেন্দ্রিক। হতদরিদ্র এসব মানুষ পরিবারের অন্ন-বস্ত্র যোগাতেই দিনরাত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কায়িক শ্রম করে। এরাই সত্যিকারে গ্রামের খাঁটি মানুষ। সোনার মানুষ। এরা সব সময় উপরে উল্লেখিত দুই পক্ষকে সমীহ করে চলে, প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সহযোগিতা ও পরামর্শ গ্রহণ করে।


ভিলেজ পলিটিক্সের নেপথ্যে সাধারণত দুষ্ট প্রকৃতির নেতিবাচক মানসিকতার লোকজন জড়িত থাকে। এরা এতই চতুর যে, মারাত্মক অপরাধ করেও সব সময় ধরা ছোয়ার বাইরে থাকে। বেশিরভাগ সময় তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করে না কিংবা প্রতিবাদ করার সাহস পায় না। এদের বিরোধিতা করলে উল্টো ফাঁদে পড়তে হয়, বিপদে পড়তে হয়, ইজ্জত হারাতে হয়। এজন্য গ্রামের শিক্ষিত ও ভদ্র মানুষ সব সময় এদের এড়িয়ে চলেন। আত্ম সম্মানের ভয়ে কোন সংঘাতে যেতে চায় না। আর নিরীহ ও দরিদ্র মানুষ মামলা-হামলার ভয়ে এদের সমীহ করে। দুষ্ট লোকদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত বা আঘাত প্রাপ্ত হলেও অনেক সময় এরা মুখ বুজে সহ্য করে।

ভিলেজ পলিটিক্সের নায়করা সব সময় সমাজের কাছে ভালো মানুষ হিসাবে পরিচিতি লাভ করতে চায়। এজন্য বেশিরভাগ সময় তাদের সমাজ বিরোধী কর্মকাণ্ড সাধারন মানুষের চোখে পড়ে না। এরা খুব চতুর হওয়ার সতর্কতার সাথে বুঝে শুনে পা ফেলে। গ্রামে থাকে এদের একদল তোষামোদকারী ও শক্তিশালী লাটিয়াল বাহিনী। বেশিরভাগ সময় চেষ্টায় তারা সফলও হয়। গ্রামের সাধারণ মানুষ অনেকটা বাধ্য হয়ে সামনা সামনি এদের সমীহ করলেও প্রকৃত পক্ষে ভিলেজ পলিটিক্সের নায়কদের সবাই অবিশ্বাস ও ঘৃণা করে।

এরা নানা ছল-ছাতুরির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি লাভ করতে চায়। স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা এমন কোন কঠিন ও সমাজ বিরোধী কাজ নেই যা করতে পারে না। এই ভিলেজ পলিটিশিয়ানরা যদি দেখেন গ্রামে অন্য কেউ প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তাদের চেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে বা ধন-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষায় প্রভাবশালী হয়ে উঠছে তাহলে এরা নানা ছল-ছাতুরির আশ্রয় নিয়ে তাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে। এমন চতুরতার আশ্রয় নেয় যাতে লোকটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অপমানিত হয় এবং নিরুৎসাহী হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়।


এরা মূলত শিক্ষিত, অশিক্ষিত ও দালালদের সমন্বয়ে গঠিত একটি সংঘবদ্ধ চক্র। বেশিরভাগ সময় এই চক্রের চতুর শিক্ষিত ও প্রভাবশালী লোকটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষোভাবে এ চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করে। তবে তার এক বা একাধিক প্রতিনিধি থাকে যারা সার্বক্ষণিক গ্রামে অবস্থান করে। এদের অনেকেরই প্রাতিষ্টানিক ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলেও বেশিরভাগ সময় এরা টুপি ও পাঞ্জাবি পরে। প্রভাব খাটিয়ে মসজিদ ও স্কুল পরিচালনা কমিটির প্রধান হয়। কেউ না চাইলেও গ্রামের সালিশের মধ্যমণি হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য দুই পক্ষকে দিয়ে ঝগড়া-বিবাদ লাগায়, এমনকি তাদের দিয়ে মামলা-মোকদ্দমা পর্যন্ত করায়। আবার কখনো খুন-খারাবির মত জঘন্য কাজ করতেও কোন কোন পক্ষকে উৎসাহ যোগায়।

এরা দালাল শ্রেণী দিয়ে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে সাধারণ মানুষকে মামলা-হামলা ও পুলিশের ভয় দেখায়। অন্য ধর্মের পূজা-পার্বণ, বিয়ে-সাদী এমননকি গানের আসরেও এরা প্রধান পৃষ্টপোষক ও অতিথি হয়। আবার মসজিদ, মাদ্রাসা পরিচালনায়ও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। ওয়াজ মাহফিলের আয়োজক হয়। কিন্তু নিজ ধর্মের কেউ কোন উপলক্ষে সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের আয়োজন করলে ধর্মের দোহাই দিয়ে এ উদ্যোগকে বানচাল করে। এরা সব সময় সতর্ক থাকে যাতে গ্রামে কোন বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা না হয়।

এদের চাল-চলন ও আচার-আচরণ এত রহস্যময় হয় যে, সাধারণ মানুষ সব সময় তাদের ব্যাপারে আতঙ্কিত থাকে। এরা প্রতিটি ভালো কাজের পেছনে নেতিবাচক এক বা একাধিক কারণ খুঁজে বেড়ায়। মনে করা যাক, গ্রামে আপনি একটি পাঠাগার খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন মানুষকে জ্ঞানের পথে আহ্বান করতে। আপনার উদ্দেশ্যের মধ্যে বিন্দু পরিমাণ নেতিবাচক কিছু না থাকলেও এরা ঠিকই একাধিক নেতিবাচক কারণ খুঁজে পাবে। এরা বাইরে বাইরে আপনাকে সহযোগিতার আশ্বাস ও বাহবা দিলেও ভেতরে ভেতরে ঠিকই আপনার বিরোধিতা করবে। আপনার উদ্যোগের রহস্য ও নেতিবাচক উদ্দেশ্য খোঁজার চেষ্টা করবে।


ধীরে ধীরে গোপনে গ্রামে আপনার বিরোধী একটি পক্ষ দাঁড় করাবে। একটা সময় এরা আপনার অথবা পরিবারের ব্যাপারে এমন কিছু মিথ্যা কুৎসা রটাবে যাতে আপনি ভালো কাজের উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তবে শিক্ষিত ও নীতিবান মানুষকে এরা খুব ভয় পায়, এজন্য বেশিরভাগ সময় তাদের ভাল ও সমাজ পরিবর্তন করার সকল উদ্যোগকে ভেস্তে দেওয়ার নীল নকশা করে। তবে শিক্ষিত নীতিবান মানুষদের সাথে সব সময় পেরে উঠে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরা আর্থিক নয়-ছয় করলেও মূলত গ্রামে প্রভাব বিস্তার করাই এদের প্রধান উদ্দেশ্য থাকে।

আসুন সবাই মিলে ভিলেজ পলিটিক্সের দুষ্ট চক্র থেকে সমাজকে রক্ষা করি। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াই, অভয় দেই। যাতে তারা এ চক্রটি ভেদ করার সাহস পায়। সবাই মিলে চেষ্টা করলে সমাজ পরিবর্তন করা খুবই সম্ভব। শুধু প্রয়োজন সৎ সাহস, দক্ষ নেতৃত্বগুণ আর একতাবদ্ধ সমাজ ব্যাবস্থা। আর যারা গ্রামে এসব নোংরা পলিটিক্স নিয়ে ব্যস্ত তাদেরকে বুঝাতে হবে তারা যা করছেন তা মোটেও ভাল কাজ নয়। এতে তার পরিবারও কোন না কোন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হবে, নিজেদেরও মানহানি হবে। সবার সহযোগিতা ও ইচ্ছা না থাকলে গ্রামকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।।



ফটো ক্রেডিট,
গুগল।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৯:৩৫

খায়রুল আহসান বলেছেন: ভিলেজ পলিটিক্স নিয়ে আপনার এ আলোচনাটি ভাল লাগলো। সাধারণতঃ অল্প শিক্ষিত গ্রাম্য মোড়লগণ গ্রামবাসীদের উপর তাদের ক্ষমতা ও আধিপত্য বজায় রাখা এবং বিস্তার করার উদ্দেশ্যে ভিলেজ পলিটিক্সের কলকাঠি নেড়ে থাকে।

৩০ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ১:১০

কাওসার চৌধুরী বলেছেন:



ভিলেজ পলিটিক্স নিয়ে আমাদের গ্রামে-গঞ্জে অনেক নেতিবাচক কথা প্রচলিত আছে। আমি চেষ্টা করেছি বিষয়টির একটি সাম্যক ধারণা দিতে। মূলত গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করে নিজেদের আখের গোছায় এরা।

ধন্যবাদ, স্যার।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.