নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কাজী হাসান সোনারং

আমি একজন নিসর্গচারী। সোনারং তরুছায়া নামে আমার একটি বাগান ও বৃক্ষরোপণ সম্পর্কিত একটি কার্যক্রম আছে।

কাজী হাসান সোনারং › বিস্তারিত পোস্টঃ

নাট্যজন তাপস সেন : প্রথম স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এশিয়ার শ্রেষ্ঠ আলোকসম্পাতশিল্পী

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৮:২৫


তাপস সেন : ৯৮তম জন্মবাষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

কাজী হাসান

ফ্রান্সের আলোর ধারায় ঝলমলিয়ে ওঠা আইফেল টাওয়ার দর্শন বহু মানুষের কাছে স্বপ্ন। রাতের অন্ধকার ম্লান হয়ে যায় আইফেল টাওয়ার এর জৌলুসের কাছে। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকরা ক্যামেরাবন্দি করেন সেই দৃশ্য। কিন্তু আকাশ ছোঁয়া লোহার টাওয়ারকে রঙিন আলোর জাদুতে আরও দৃষ্টিনন্দন করে যিনি প্রথম সাজিয়ে তুলেছিলেন, সেই নেপথ্যের শিল্পী আজীবন অন্ধকারেই থেকে যান। কেউ তেমনভাবে মনে রাখেনি তাঁকে। বিদেশ তো বটেই এমনকি তাঁর নিজের শহর, পূর্বপুরুষের ভিটের বাংলাদেশও।
বিশিষ্ট অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন একবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এ নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, “এইসব খবর কি তবে যথেষ্ট ‘সেনশেসনাল’ নয় বলেই এভাবে দেশের মানুষের উপেক্ষার শিকার হতে হয় শিল্পীকে! দেশ তাঁকে মনে রাখে না। এমন অনন্য প্রতিভা যথাযথ সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়!” উত্তরটা এভাবেই খুঁজে নিয়েছেন তিনি।

তাপস সেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় আলোকসম্পাতশিল্পী। আমৃত্যু তিনি তাঁর আলোর ছটায় শুধু বাংলা থিয়েটার বা ভারতীয় রঙ্গমঞ্চ নয় বিশ্ব রঙ্গমঞ্চ আলোকিত করেছেন। আলোক বিজ্ঞানকে নিয়ে গেছেন শিল্পের স্তরে। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম, প্যারিসের গর্ব, আইফেল টাওয়ারকে রঙিন আলোর মায়ায় মুড়ে দিয়েছিলেন যেমন তিনি, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া ব্রিজকেও তিনিই প্রথম সাজিয়েছিলেন অপূর্ব আলোকমালায়। হাওড়া ব্রিজের সেই আলো আজ আর নেই। শিল্পীও নিভে গেছেন। প্রিয় শহর মনে রাখেনি তাঁকে। তিনি আলোর জাদুকর তাপস সেন। যাঁর পূর্বপুরুষের ভিটে আমাদের মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার ‘সোনারং’ গ্রামে। ওই গ্রামের ‘সেনবাড়ি’তে অনেক কৃতিসন্তানের জন্ম হয়েছে। অনেক কৃতিসন্তানের পূর্বপুরুষের ভিটে ওই বাড়িতে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’ এ নিজের জীবদ্দশায় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন সেই সেনবাড়ির কৃতিসন্তান পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনকে। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র উদীচী’র একজন প্রতিষ্ঠাতা, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সত্যেন সেন। ওই গ্রামের আরেকজন কৃতিসন্তান প্রফুল্লনাথ সেন পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমিয়েছিলেন। যিনি নিজ গ্রামের ওপর ‘সোনারঙ্গ’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শান্তি নিকেতনের যে বাড়িতে থাকতেন, সেই বাড়ির নাম রেখেছিলেন ‘সোনারং’। যে বাড়িতে জ্ঞানে প্রজ্ঞায় বেড়ে উঠেছিলেন তাঁর দৌহিত্র নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।

বহু বছর আগে ভারতের ব্রহ্মপুত্রের ধারে অন্ধকার আকাশের প্রান্তে টিমটিম করা এক বিন্দু আলো এক বালকের ভ্রূ’র মধ্যে গেঁথে গিয়েছিলো। তাঁকে ভীষণ বিস্মিত করেছিলো সেই আলো আঁধারির দৃশ্যপট! সেটা ছিলো প্রমথেশ বড়ুয়াদের গৌরীপুর রাজবাড়ির আলো। তাঁদের সেই অবিভক্ত গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়িতেই ছিলো সেই ছেলেটার দাদার ভিটে। তাঁর জবানিতে, “ঠাকুরদা ভাগ্যের অন্বেষণে বাংলাদেশের ‘সোনারং’ গ্রাম ছেড়ে এসেছিলেন ভারতের পূর্ব প্রান্তে আসামে। ...তারপর গদাধর নদীর পাড়ে নিজের বাড়ি করলেন, জায়গাটার নাম ছিলো ছাতিয়ানতলা। ...বাবা-মায়ের বিয়ের দশ বছর পরে নতুন ঘরে নতুন শিশু হয়ে এলাম আমি।’’

তাপস সেন এর জন্ম ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বর্তমানে ভারতের আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়িতে। তাঁর পিতার নাম মতিলাল সেন, মায়ের নাম সুবর্ণলতা সেন। প্রচণ্ড ঝড়ের দিনে শিশুটি জন্মেই মরতে বসেছিলো। তাঁকে ঘরের চালে অঝোরধারার মধ্যে শুইয়ে রাখা হয়েছিলো। বেঁচে যায় সে। মায়ের মুখে তাপস সেন শুনেছেন, “যে ছেঁচা বেড়ার ঘরে তিনি জন্মেছিলেন, তাতে কাচের জানালার বাইরে ছিলো ব্রহ্মপুত্র নদ। গভীর রাতে স্টিমার চলতো, তার সার্চলাইটের আলোয় গাছপালা বাড়িঘর মূর্ত হয়ে উঠে ভেসে ভেসে সরে যেতো।” পরে তিনি নিজেও দেখেছেন। তখন থেকেই মনে হয়তো বসে ছিলো আলোর ওই মায়াচলনই।

পিতার চাকরিসূত্রে এক বৎসর বয়সে তাপস সেনদের ধুবড়ি হতে চলে যেতে হয় দিল্লির ১১ নম্বর সিকান্দর প্লেসের তিন কামরার কোয়ার্টারে। তাঁর বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা সবটাই ওই গালিবের শহরে। ১৯৪১ সালে রাইসিনা বেঙ্গলি হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পর দিল্লির পলিটেকনিক কলেজে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন তিনি। ছাত্রাবস্থাতেই আলো নিয়ে তাঁর সৃজনশীল কল্পনা বিকশিত হতে থাকে। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র কিন্তু প্রবল টান ছবি আঁকা, নাটক আর আলোর প্রতি। হাতেখড়ি হয়েছিলো স্কুল জীবনেই ড্রইং শিক্ষক প্রতাপ সেনের কাছে। তাঁর উৎসাহেই আলোর আকর্ষণে নাট্যজগতে প্রবেশ করেন। তাপস সেন মাত্র ১৫ বছর বয়সে ১৯৩৯ সালে ‘রাজপথ’ নাটকে আলোকসম্পাতের দায়িত্ব পান। তখন তাঁর স্কুল জীবন প্রায় শেষের দিকে। নাটকটিতে রাস্তার দৃশ্যে ল্যাম্পপোস্টের আলো তৈরি করেছিলেন তিনি। সেই দিনই নির্ধারিত হয়ে যায় তাঁর বাকি জীবনের নিয়তি।

১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে 'ভারতীয় গণনাট্য সংঘ'র শাখা খোলা হয়। তাপস সেন ছিলেন তার একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। আর সেখানেই সেই মাস্টারমশাই প্রতাপ সেনের সঙ্গে করেন জীবনের প্রথম নজরকাড়া কাজ—পরশুরামের গল্প নিয়ে ছায়ানাট্য ‘ভূশণ্ডীর মাঠে'। প্রথমে স্কুলের মাঠে, পরে দিল্লির সাউথ ইন্ডিয়া ক্লাব এ।

তাপস সেন প্রথমে নিউ দিল্লি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনে, তারপর আরউইন হাসপাতালে, সবশেষে দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে সিপিডব্লিউডির ইলেকট্রিক বিভাগে চাকরি করেন। বেতন সেই সময়ের তুলনায় ভালোই ছিলো। কিন্তু চার দেয়ালে বন্দি থেকে কাগজ- কলমের চাকরিতে তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসতো। সেই টানাপোড়েনের জীবনে বেশিদিন থাকলেন না তিনি। ক্যামেরা ও আলোর কাজ শেখার জন্য চাকরি ছেড়ে পাড়ি দেন তখনকার বম্বে অর্থাৎ মুম্বাইতে। বিখ্যাত ফটোগ্রাফার দিলীপ গুপ্তর কাছে ফটোগ্রাফির কাজ শেখা শুরু করেন।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর চলে আসেন কলকাতায়। সেখানে এসে কষ্টকর জীবনযাপনের দিনগুলিতে তিনি শিল্পসৃষ্টির মঞ্চ খুঁজতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, বহুরূপী, এল.টি.জি. ও অন্যান্য কিছু সংস্থায় কাজে যুক্ত হন। পাশাপাশি বামপন্থী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে এসইউসি’র সার্বক্ষণিক কর্মী হন এবং শেষে ‘নিউ থিয়েটার্স’ এ কাজ পান। সেখানে শিল্প-নির্দেশক সৌরেন সেনের সহকারী হিসেবে ‘রূপকথা’ ছবির কিছু কাজ করেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, বিজন ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, সলিল চৌধুরীর মতো সাংস্কৃতিক দিকপালদের সঙ্গে। তিনি ১৯৪৯ সালে কলকাতায় প্রথম আলোক নির্দেশনা দেন শম্ভু মিত্র’র ‘পথিক’ ও ঋত্বিক ঘটকের ‘জ্বালা’ নাটকে। তারপর করেন নাট্যচক্র প্রযোজিত বিজন ভট্টাচার্য পরিচালিত ‘নীলদর্পণ’ এর আলোক পরিকল্পনা। উৎপল দত্তের এল.টি.জি’র সঙ্গে প্রথম কাজ করেন ‘সাংবাদিক’ নাটকে। এরপর ওই গ্রুপেই শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ নাটকে কাজ করেন। ইতোমধ্যে তিনি প্রখর নৈপুণ্যে আর স্বকীয় পরিকল্পনার আলোক বিজ্ঞানকে এক শিল্পের স্তরে নিয়ে এসেছেন। তাঁর আলোক প্রয়োগ কুশলতায় স্মরণীয় হয় ‘রক্তকরবী’, ‘চার অধ্যায়’, ‘রাজা, ‘রাজা অয় দিপাউস’, ‘পুতুল খেলা’, ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘কল্লোল’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘দশচক্র’, ‘সেতু’, ‘আরোগ্য নিকেতন’ প্রভৃতি মঞ্চ সফল নাটক। তাঁর চিন্তার জগৎ এতো বিস্তৃত, শিল্পভাবনার প্রতি এতো আগ্রহ, প্রযুক্তিগতভাবে তিনি এতো শক্তিশালী, মঞ্চ স্থাপত্য, রঙ, অভিনয় কম্পোজিশন সম্পর্কে তাঁর প্রখর জ্ঞান, তার সাথে কল্পনা ও সৃজনীশক্তির প্রয়োগ করার অসীম ক্ষমতার কারণে অনুল্লেখযোগ্য নাটকও শিল্পের গুণাবলীর রূপ ধারণ করে কালোত্তীর্ণ হয়েছে তাঁর আলোর বিচিত্রতায়। বিশ্বরূপা নাট্য উন্নয়ন পরিষদ আয়োজিত পূর্ণাঙ্গ নাটক প্রতিযোগিতায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’র ‘সংক্রান্তি’ নাটকটি প্রদর্শিত হয়। নাটকটি আলোকসম্পাতসহ এগারোটি পুরস্কার লাভ করে তখন। এটিই ছিলো তাঁর প্রথম পুরস্কার প্রাপ্তি। নিজেকে ‘আড়ালের মানুষ’ ভাবলে কি হবে, তিনি এক কিংবদন্তীতে পৌঁছে গেছেন ততোদিনে। তাছাড়া শুধু নাটক নয়, নৃত্যের আসরে, যাত্রার মঞ্চেও তাঁকে দেখা গেছে। ভারতী অপেরা, নট্ট কোম্পানির বেশ কিছু যাত্রাপালায় আলোক প্রক্ষেপণ করেছেন তিনি। মূলত আলোর নানা এফেক্ট তৈরির জন্য তাঁর ডাক পড়ছিলো সিনেমাতেও। ১৯৬৯ সালে ভি শান্তারামের ‘জল বিন মছলি নৃত্য বিন বিজলি’। তার পর মৃণাল সেনের ‘কলকাতা ৭১’ আর ‘খণ্ডহর’, তপন সিংহের ‘সফেদ হাতি’, অর্ধেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাবা তারকনাথ’, প্রফুল্ল রায়ের ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ’, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বীকারোক্তি’, অপর্ণা সেনের ‘পরমা’য়।

১৯৬০ সালে রাশিয়া, পূর্ব জার্মানি এবং ১৯৬৯ সালে তিনি বার্লিন সঙ্গীত নাটক উৎসবে যোগদান করেন। চলচ্চিত্রের বিশেষ মুহূর্তের আলোক পরিকল্পনায় ভি. কান্তারাম, মৃণাল সেন তাঁর সাহায্য নিয়েছেন। আলোকধ্বনির সমাহারে ঐতিহাসিক স্থানের স্মৃতিচারণে সন-এৎ-লুমিয়ের একাধিক বিন্যাসে তিনি সঙ্গীত স্রষ্টা ভাস্কর চন্দরভরকর ও বি ভি করন্থের সঙ্গে যৌথ ভূমিকা নিয়েছেন। নাটক, চলচ্চিত্র ছাড়াও নৃত্যনাট্য, পুতুলনাটক, ছায়ানাটক, যাত্রার আসর, মেলাপ্রাঙ্গণ, প্রেক্ষাগৃহ—সর্বত্রই তাঁর অসামান্য শিল্পপ্রতিভার নিদর্শন রয়েছে। একাধিকবার কাজের সূত্রে বিদেশেও গেছেন। প্যারিস ও মস্কোয় ভারত-উৎসবে আলোক পরিকল্পক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে লন্ডনের ব্যাডফোর্ডে ফিল্ম, থিয়েটার ও টিভির আলোকশিল্পীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি হাজির করেন তাঁর দৃশ্য-অভিজ্ঞতা। সম্মেলনে তিনি একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। উপস্থিত সকলকে অভিভূত করেন। পেয়ে যান অ্যাসোসিয়েশন অব লাইটিং ডিজাইনার্স এর সাম্মানিক সদস্যপদ, পরে অনারারি ফেলোশিপ।

তাপস সেন মনে করতেন, ছায়া বা আঁধার না থাকলে আলোর মর্ম পরিস্ফুট হয় না। তিনি আড়ালে থাকতে ভালোবাসতেন। নিজেকে বলতেনও ‘আড়ালের মানুষ’। তবু তাঁর আলোর কাছে অবনত হতে হয়েছিলো সারা পৃথিবীকে। তাপস সেন ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে পান এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘লাইট ডিজাইনার’ এর স্বীকৃতি। ১৯৭৪ সালে পান ‘সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি’ পুরস্কার। গত দু’বছর আগেও ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন আমাদের মুন্সীগঞ্জের ‘সোনারং’ গ্রামের আরেক কৃতিসন্তান ভারতের পদ্মশ্রী পদকপ্রাপ্ত নাট্যকার, অভিনয় ও সঙ্গীতশিল্পী শেখর সেন। যাঁর দাদা কৃতার্থ কমল সেন যুবক বয়সে ‘সোনারং’ গ্রাম থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান। আর কোনওদিন ‘সোনারং’ এ যান নি। এমনকি তাঁর বাবা ভারতের ছত্তিশগড় রাজ্যের খইরাগড়ে অবস্থিত ‘ইন্দিরা কলা সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয়’ এর ভাইস চ্যান্সেলর ডঃ অরুণ কুমার সেন এরও যাওয়া হয়নি। ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ সংস্কৃতিজন শেখর সেনকে আমি প্রথম তাঁদের পূর্বপুরুষের ভিটে ‘সোনারং’ গ্রামে নিয়ে যাই। Click This Link ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাপস সেনকে দীনবন্ধু পুরস্কার এ সম্মানিত করে। ২০০৫ সালে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় করে ‘এমেরিটাস ফেলো’। শেষে মধ্যপ্রদেশ সরকার প্রদান করে ‘কালিদাস সম্মান’। ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব হিসেবে সংবর্ধিত করে। অমিত বসু ও ভদ্র বসুর পরিকল্পনায় ২০০০ সালে তাঁর ওপর তথ্যচিত্র 'Let there be light' নির্মিত হয়। নাট্যনির্দেশক কুন্তল বড়ুয়া তাঁর কাজের ওপর পিএইচডি করেছেন।

আমেরিকার প্রবাদপ্রতিম আলোকশিল্পী রিচার্ড পিলব্রো তাপস সেন এর কাজ দেখে উচ্ছ্বসিত হন। তাঁর মতে—
“তাপস সেনের কল্পনাশক্তি যন্ত্রের শক্তিকে ছাপিয়ে গেছে... অবিশ্বাস্য রকমের সামান্য কিছু উপকরণ, কয়েকটি ল্যাম্প, আমাদের নিত্য ব্যবহার্য কয়েকটি জিনিস আর ছায়া—এই দিয়ে তিনি আলোর জাদু দেখাতেন।” আলো ও তাঁর জীবন নিয়ে তার লেখা কয়েকটি গ্রন্থে র মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘অন্তরঙ্গ আলো’, ‘দ্বিতীয় অঙ্ক’,
‘প্রথম দৃশ্যের আলো’, ‘আলোছায়ার পরে’।

কিংবদন্তী আলোকশিল্পী তাপস সেনের স্ত্রী ড. গীতা সেন ছিলেন বাংলা নাটকের গানের এক জীবন্ত আর্কাইভ। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে স্নাতকোত্তর গীতাদেবী পিএইচডি করেছিলেন নাট্যগান ও তার বিবর্তন নিয়ে। গবেষণার পাশাপাশি নিজে নাট্যগান পরিবেশন করতেন। কণ্ঠশিল্পী হিসেবেও বাংলা নাট্যগানের পথিকৃৎ বলা যায় তাঁকে। তাপস সেন লিখেছেন, “দীর্ঘদিন আলোছায়ার জগতে মানুষের হাসি কান্নার পালায় নাট্য জগতে কাজ করলাম... দেখছি আলোকে জানাই হল না।’’

তাপস সেন বেশ স্পষ্টভাষী ছিলেন। তাঁর যেচে অন্যের ‘ভালো’ করতে যাওয়ার প্রবণতা আর ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ ও নীতি নির্ধারকদের মুখের উপরে কথা বলাকে সবাই ভালোভাবে নিতেন না। ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে বিধানসভায় কংগ্রেস ল্যাজে-গোবরে অবস্থায়। সরকার গড়ার সুবর্ণসুযোগ পেয়েও বামপন্থীরা দ্বিধাবিভক্ত। বৌবাজার ট্রেড ইউনিয়ন অফিসে জ্যোতি বসুরা বৈঠক করছেন। তাপস সেন সেখানে হাজির হয়ে বললেন, “আপনারা যদি মিলিত না হন, কংগ্রেস আবার আসবে।” তাঁর কথায় কী কাজ হয়েছিলো অজানা, কিন্তু পরে দু’পক্ষ একত্রিত হয়ে রাজ্যে প্রথম অকংগ্রেসি সরকার গঠন করে।

বাম জমানাতেও তিনি ছিলেন সেই একই রকম আপসহীন। বিভিন্ন মঞ্চের দুর্দশা ও নাট্যকর্মীদের অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে এবং বহুবিধ প্রস্তাব দিয়ে একের পর এক চিঠি লিখেছেন সরকারের কাছে। কখনও দু’লাইনের উত্তর এসেছে, বেশির ভাগ সময়েই আসেনি। এ নিয়ে তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিতণ্ডা হয়েছে তাঁর। খবরের কাগজে খোলা চিঠিও লিখেছেন তাপস সেন।
অগ্নিকাণ্ডে ভস্ম হয়ে যাওয়া ‘স্টার থিয়েটার’ ২০০৪ সালে যখন নব কলেবরে খুললো, রবাহুত তাপস সেন সেখানে গিয়ে ঠেলেঠুলে মঞ্চে ওঠেন। মাইক টেনে সটান প্রশ্ন করেন, “স্টার তো খুললো, পুরনো কর্মীদের পাওনার কী হবে?” শুনে কর্তাব্যক্তিরা পড়ে যান চরম অস্বস্তিতে!

সেই সময় স্ত্রী গীতা ঘোরতর অসুস্থ, টানা ভুগছেন মেয়ে জয়ন্তীও। ওষুধের পেছনে টাকা যাচ্ছে হু হু করে। নতুন আলোকশিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য তাঁর ছেলে জয় সেন। তাপস সেন এর কথায়, “আমার চেয়েও প্রতিভাবান কিন্তু তিনি বেহিসেবি, সুরাসক্ত।” নানা টানাপোড়েনে তাপস সেন তখন বিধ্বস্ত। তবুও প্রায় রোজই বেরোন, খানিক কাজে আর খানিক অকাজে, মনের খিদে মেটাতে। একদিন তাঁর দীর্ঘদিনের সহকারী গৌতম ঘোষ বলেন, ‘‘হেমা মালিনী নাচের অনুষ্ঠান নিয়ে ওয়ার্ল্ড টুরে গেলেন, খুব চেয়েছিলেন যাতে তাপসদাকে নিয়ে যাওয়া যায়। ডাক্তার মত দিলেন না।’’

দিন সাতেক আগে বন্ধু জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়কে শেষ বিদায় জানিয়ে রবীন্দ্র সদন থেকে ২৬ এইচ, নাকতলা লেনের বাড়িতে ফিরেছিলেন তাপস সেন। আর বেরোতে পারেননি। ২০০৬ সালের ২৮ জুন তাপস সেন কলকাতায় নিজ বাসভবনে প্রয়াত হন। মরণোত্তর দেহদানে তাঁর দেহটি চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহারের জন্য অর্পিত হয়।

শেষ দিনগুলোয় অশক্ত শরীরে দুই শহরের মাঝে ঝুলে থাকা হাওড়া সেতুকে স্থায়ীভাবে আলোয় সাজিয়ে তুলছিলেন তাপস সেন। সব আঁক কাটা হয়ে গিয়েছিলো। আলো বসানোর আগেই নিজের জীবনের আলো নিভে যায়। কাজ শেষ করেন পুত্র জয় সেন।

আজ আন্তর্জাতিক আলোকসম্পাতশিল্পী তাপস সেন এর ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। আজ তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধাভরে।

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, মাহুল মৃণালিনী রাই, আনন্দবাজার পত্রিকা

[email protected]

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৩/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৯:৫১

ইমরোজ৭৫ বলেছেন: নাট্যজন তাপস সেন এর স্মরণে গাছের চাড়া উপহার দিবেন কি?

২| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:১৮

ইমরোজ৭৫ বলেছেন: উনার স্মরনে কাকে কাকে গাছ দিয়েছেন সেটা যদি জানাতেন...। বৃক্ষ রোপনের আপনার অবদান আমাদের ব্লগ জানতে চায়। আমরা চাই শিশুদের মনে গাছ রোপনের ইচ্ছে জাগুক। আপনার এই উদ্যেশ্য সফল হউক।

আপনার ‍উন্নতি ও সাফল্য কামনা করি।

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ৯:০৫

কাজী হাসান সোনারং বলেছেন: এটা আমার সাহিত্যকর্ম। চারাকর্ম নয়।

৩| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ২:৪৪

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
নাট্যজন তাপস সেন এর জন্মদিনে শুভেচ্ছা।

১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০২২ সকাল ৮:২৭

কাজী হাসান সোনারং বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.