নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কাজী হাসান সোনারং

আমি একজন নিসর্গচারী। সোনারং তরুছায়া নামে আমার একটি বাগান ও বৃক্ষরোপণ সম্পর্কিত একটি কার্যক্রম আছে।

কাজী হাসান সোনারং › বিস্তারিত পোস্টঃ

জন্মদিনে জানাই শুভেচ্ছা : চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছটকু আহমেদ

০৬ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৫৪


কাজী হাসান
আজ বরেণ্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছটকু আহমেদ এর ৭৬তম জন্মবার্ষিকী। যিনি নিজে একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। কিন্তু সেই অর্থে তাঁকে নিয়ে তেমন আলোচনা নেই, নেই উচ্ছ্বাস। মুন্সীগঞ্জ জেলার এই কৃতি সন্তানকে নিয়ে আমি ভীষণ গর্বিত। তিনি চলচ্চিত্র পরিচালক, কাহিনীকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, পরিবেশক প্রকৌশলী ছটকু আহমেদ।

১৯৯৭ সালের ঈদ-উল-ফিতরে ছটকু আহমেদ এর লেখা চারটি চলচ্চিত্র একই দিনে সিনেমা হলে মুক্তি লাভ করে, যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি রেকর্ড। আবার একই মাসে তাঁর কাহিনী, চিত্রনাট্যে সাতটি সিনেমা মুক্তি পায়। চলচ্চিত্র বিষয়ে বিশ্বের কোথাও কারও এমন অনন্য রেকর্ড নেই। যা গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস এ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মতো।

ছটকু আহমেদ এর প্রসঙ্গ অবতারণার আগে এ দেশের চলচ্চিত্রে আমাদের মুন্সীগঞ্জ জেলার সন্তানদের অবদানের কিয়দংশ একটু আলোচনা করে নিই। পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে আমাদের মুন্সীগঞ্জ জেলার উদ্যোগী ও কৃতি সন্তানদের অবদান অগ্রগণ্য। মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার উত্তর মসদগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল জব্বার খান। যাঁর পরিচালনায় তৈরি পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ পরিচালনা করেন মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার সমষপুর গ্রামের কৃতি সন্তান চাষী নজরুল ইসলাম। ছবিটি এ দেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম পূর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র। ‘ওরা ১১ জন’ মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট। মুন্সীগঞ্জ জেলার এই দু’জন কৃতি সন্তান উদ্যোগী না হলে এদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হতো।

তখন বাংলাদেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। ঢাকা নিবাসী মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার নাগেরহাট গ্রামের কৃতি সন্তান একজন স্বপ্নবান যুবক হাবিবুর রহমান খান তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। পরিচালক হিসেবে নয়, একজন প্রযোজক হিসেবে তাঁর প্রিয় একটি উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ন করে তাঁর চলচ্চিত্র যাত্রা শুরু করবেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান কৃতি ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ এর কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ তিনি নির্বাচন করেন ছবির জন্য। পরিচালক হিসেবে বেছে নেন কলকাতার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিচালক ঋত্বিক ঘটককে। বাংলাদেশে কোনও বিদেশী পরিচালককে দিয়ে ছবি তৈরির উদ্যোগ সেটিই প্রথম। হাবিবুর রহমান খান ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ওই ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে স্কুল জীবনের সহপাঠী সাংস্কৃতিক সহযাত্রী মুন্সীগঞ্জ জেলার আরেক মেধাবী ও স্বপ্নবান যুবক ছটকু আহমেদকে যুক্ত করে নেন। হাবিবুর রহমান খান এর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘আশীর্বাদ চলচ্চিত্র’ থেকে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই মুক্তি পায়। ৮ লক্ষ ২৪ হাজার টাকায় নির্মিত ছবিটি সে সময় ১ লক্ষ ২৩ হাজার টাকা ব্যবসা করে। ২০০৭ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দর্শক, চলচ্চিত্র সমালোচকদের ভোটে ছবিটি সবার সেরা ১০টি বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের তালিকার মধ্যে শীর্ষস্থান লাভ করে।

চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছটকু আহমেদ এর জন্ম ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ অক্টোবর, রবিবার। আজ তিনি ৭৭ এ পা রাখলেন। তাঁর পিতা মরহুম সরফুদ্দিন আহমেদ ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। সিভিল ডিফেন্স এন্ড ফায়ার সার্ভিসের ট্রেনিং অফিসার। দাদা মুন্সী নওয়াব আলী ছিলেন এসডিওর কোর্টের নাজির। তাঁদের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের রামপালের পানহাটা গ্রামে। ‘মৃধাবাড়ি’ নামে বাড়িটি পরিচিত। তাঁর মাতা মরহুমা জোহরা সরফুদ্দিন নারায়ণগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। মায়ের বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলায়। ছটকু আহমেদরা চার ভাই দুই বোন। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি মেজো।

চট্টগ্রামের পাথরঘাটার জলিলগঞ্জে ছটকু আহমেদের শিশুকাল থেকে কৈশোরের শুরু পর্যন্ত কেটেছে। প্রথম বিদ্যালয় চিটাগাং কোর্ট পাহাড় সংলগ্ন মিউনিসিপাল স্কুল। পরে তিনি বাবার চাকরির বদলির সুবাদে নারায়ণগঞ্জে এসে নারায়ণগঞ্জ হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ওই স্কুল থেকেই এসএসসি পাশ করেন। মাঝে এক বছরের জন্য ক্লাশ নাইনে জয়গোবিন্দ হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এরপরে তিনি ১৯৬৮ সালে ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন।

ছটকু আহমেদ খুব স্বল্প সময়ের জন্যে সরকারি চাকরি করেন। ইরিগেশান মিনিস্ট্রির ইরিগেশান ডিভিশানে সাব এ্যাসিসটেন্ট ইঞ্জিনিয়ার কাম সেকশান অফিসার হিসেবে প্রথমে রাজশাহী পরে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও হয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেচ প্রকল্পে (ডিএনডি)তে কর্মরত থাকা অবস্থায় চলচ্চিত্রে এসে চাকরি ছেড়ে দেন।

স্কুল জীবনে বাবার সাথে শিকারে যাবার ঘটনা নিয়ে ছটকু আহমেদ এর প্রথম লেখা ‘আমার প্রথম শিকার’ দৈনিক আজাদের মুকুলের মাহফিলে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর শ্বেত কপোতের মিছিল, ভালোবাসার তারা, জনতার আদালত, সত্যম শিবম সুন্দরম, চেতনা, এই যুদ্ধ সেই যুদ্ধ নয়, মৃত সূর্যের সংলাপ, মানি প্ল্যান্ট, আলো চাই, ছটকু মিয়ার ডায়রি ১৯৭২ ও অনীহা প্রকাশ পায়। তিনি অনেক নাটক রচনা করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম ইস্পাত, কম্পাস, জয় স্বাক্ষরতা ও আলোকিত অন্ধকার। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা প্রচুর প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানেও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও অনলাইন পত্রিকায় নিয়মিত ফিল্ম রিভিউ ও চলচ্চিত্র বিষয়ক নিবন্ধ লিখে যাচ্ছেন।

ছটকু আহমেদ ১৯৬২ সালে প্রথম নাটক পরিচালনা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’। সেই থেকে অসংখ্য মঞ্চ নাটক পরিচালনা করেছেন তিনি। ১৯৬৪ সালে ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে তিন রাতব্যাপি মঞ্চায়িত নাটক ‘পরিণতি’র পরিচালনা ও ১৯৭৪ সালে বেইলি রোডে মহিলা সমিতিতে দর্শনীর বিনিময়ে মঞ্চায়িত হয় তাঁর রচিত ও পরিচালিত নাটক ‘আলোকিত অন্ধকার’।

তিনি পাকিস্তান টিভির শুরুর দিকে ১৯৬৬ সালে প্রচারিত ধারাবাহিক নাটক ‘অমর জীবন’ রচনা করেন। রেডিও পাকিস্তান এর ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর লেখা অসংখ্য জীবন্তিকা প্রচারিত হয়েছে এবং তিনি অনেক স্বরচিত গল্প পাঠ করেছেন। বিটিভিতে প্রচারিত, শাহরিয়ার নাজিম জয় রচিত ও ফাল্গুনী হামিদ প্রযোজিত ‘দিঠি’ নাটকটি পরিচালনা করেন। চ্যানেল আইতে তাঁর রচনা ও পরিচালনায় ১৬ পর্বের ধারাবাহিক নাটক ‘শিকড়’ প্রচারিত হয়েছে।

চলচ্চিত্রের নানা অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “চাকরিতে সেকশন অফিসার পদে আমার যখন ঠাকুরগাঁওয়ে পোস্টিং, ওখানেও অনেক নাটক করেছি। সে সময়ই একদিন ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় একটি বিজ্ঞপ্তি দেখি, ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে বন্ধু হাবিবুর রহমান খান একটি ছবি বানাবে, সেই ছবির জন্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর লাগবে। পরের দিন হাবিব আমাকে ফোন করে বলে, “তুই চলে আয়, অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হবি।” চলে এলাম। প্রথম সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক ঘটককে বললাম, “আমি তো ফিল্মের কিছু জানি না...।” তিনি বললেন, ‘জানা লাগবে না! কাজ করতে করতে সব শিখে যাবে।” কাজ করতে গেলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীতে। একটা লঞ্চ ভাড়া করে পুরো ইউনিট ছিলাম। আমি যেহেতু সরকারি চাকরি করি, বাইরে কাজ করতে হলে অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি তো নেওয়া হয়নি! আমার প্রাতিষ্ঠানিক নাম সৈয়দউদ্দিন আহমেদ। চাকরিস্থলে অনুমতি না নিয়ে এই নাম তো চলচ্চিত্রে ব্যবহার করতে পারবো না! কী করবো? বাবা আমাকে ‘ছোটকা’ ডাকতেন। সবাই মিলে আমার নাম ঠিক করলেন ‘ছোটকা আহমেদ’। কিন্তু শুনতে ভালো লাগে না। তাই সৈয়দ হাসান ইমাম নামের সংশোধন করে দিলেন ‘ছটকু আহমেদ’। ওই নামেই চলচ্চিত্রে ঢুকলাম। চাকরি করি আর চলচ্চিত্র করি। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ এর পুরো কাজটি অবশ্য আমি করতে পারিনি। প্রথম লটের শুটিং শেষ হওয়ার পর চাকরিতে ফিরে যাই। কারণ অস্থির মানসিকতার ঋত্বিক ঘটকের অগোছালো কাজ আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। আমি তো শেখার উদ্দেশ্যে এসেছিলাম, শেখাটা ঠিকমতো হচ্ছিলো না।

এরপর হাবিব খান আরেকটি ছবি শুরু করলো বেবী ইসলামকে দিয়ে ‘চরিত্রহীন’। সেই ছবিতে আমাকে আবার ডাকলো। ততদিনে আমি ঢাকায় বদলি হয়ে এসেছি ডিএনডি (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ- ডেমরা) প্রজেক্টের সেকশন অফিসার হিসেবে। ওই সময় হাবিব খান একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো ‘শাওন সাগর লিমিটেড’ নামে। আমি, ফখরুল হাসান বৈরাগী, তমিজউদ্দীন রিজভী, আখন্দ সানোয়ার মোরশেদ, শমসের আহমেদ, আওলাদ হোসেন চাকলাদার, এ জে মিন্টু-এই সাতজন ছিলাম এর ডিরেক্টর। চলচ্চিত্রকার মহিউদ্দিন ছিলেন চেয়ারম্যান। সৈয়দ হাসান ইমামের তখন আলাদা একটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও আমাদের সঙ্গে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন। আমরা পরিকল্পনা করলাম, সাতজন ডিরেক্টরের প্রত্যেকেই বাই-রোটেশনে ছবি ডিরেকশন দেবো। বাকি ছয়জন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর হিসেবে সব ছবিতে কাজ করবো। প্রথম সিনেমা বানানো হলো বৈরাগীকে দিয়ে। নাম ‘সেয়ানা’। অলিভিয়া আর প্রবীর মিত্র নায়ক-নায়িকা। বিখ্যাত ফিল্ম এডিটর আতিকুর রহমান মল্লিক সেই ছবির স্ক্রিপ্ট রেডি করেছিলেন। আমরা একটা হোটেলে বসে সেটি পড়লাম। ততদিনে অনেক নাটক লিখেছি, কিন্তু সিনেমার স্ক্রিপ্ট করিনি। সেই প্রথম আমি দেখলাম-ফিল্ম স্ক্রিপ্ট কী জিনিস!

‘সেয়ানা’ ফ্লপ করার পর হাবিব খান বললো, “আরেকটা ছবি করার মতো টাকা নেই। কী করি?” আমি বললাম, “নাটক করি?”, মহিলা সমিতিতে নাটক করলাম ‘আলোকিত অন্ধকার’। যথারীতি নির্দেশনার দায়িত্ব আমার ওপর। এ জে মিন্টু, বৈরাগীসহ আমাদের লোকেরা সবাই অভিনয় করবে। রোজিনা নামের একজন নায়িকাকে নিয়ে আসা হলো। দর্শনীর বিনিময়ে আমার প্রথম নাটক। পাঁচ রজনী নাটকটি করতে পেরেছিলাম। কারণ রোজিনা তখন ছবি করবে। হাবিব খান বললো, “চল্, আবার ছবি করা যাক।” দুই হাজার, তিন হাজার করে নিজেদের হাত খরচের টাকা জমিয়ে আমরা আবার ছবি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। বৈরাগীর পর এ জে মিন্টুর পালা। তিনি একটি ছবির আইডিয়া দিলেন। নাম ‘মিন্টু আমার নাম’। ‘জনি মেরা নাম’ নামের একটি বলিউডি ছবি থেকে নামটি নিয়েছিলেন। আমাকে গল্পের আইডিয়া শুনিয়ে বললেন, “আপনি স্ক্রিপ্টটা লিখে দেন।” বললাম, “আমি তো কখনও স্ক্রিপ্ট লিখিনি।” বললেন, “আপনাকেই লিখতে হবে। অন্য কাউকে দিলে সে হয়তো ইন্ডিয়ান ছবিটা দেখে এসে নকল করবে। আমি নকল চাচ্ছি না।” লিখলাম। ছবিটা বাম্পার হিট হলো। আমাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একটু আলোর মুখ দেখলো। যাই হোক, সেই ছবিতে শুরুতে রোজিনাকে নায়িকা করা হলেও তাঁকে যাঁরা চলচ্চিত্রে এনেছিলেন, সেই ‘গড ফাদার’রা চুক্তিবদ্ধতার দোহাই দিয়ে আটকে দিলেন তাকে। আমরা রোজিনার বদলে ববিতাকে নিলাম।

এরপর আরেকজনের ছবি করার কথা থাকলেও এ জে মিন্টুকে দিয়েই আরেকটি ছবি করানো হলো। নাম ‘প্রতিজ্ঞা’। ওটাও আমার লেখা। ওটাও বাম্পার হিট হলো। তারপর সৈয়দ শামসুল হকের স্ক্রিপ্টে তমিজউদ্দীন রিজভী বানালেন ‘ছোট মা’। বিধায়ক ভট্টাচার্যের লেখা বিধবা বিবাহের ওপর একটি গল্প অবলম্বনে ১৯৮২ সালে আমি বানালাম আমার জীবনের প্রথম ছবি ‘নাতবৌ’। রাজ্জাক-ববিতা তখন সুপার কাস্ট। সুধীজনরা খুবই প্রশংসা করলেন। ততদিনে ছবির লাইনে মোটামুটি চলে এসেছি। আমার স্ক্রিপ্টের খুব ডিমান্ড। কিন্তু ‘শাওন সাগর লিমিটেড’ এর নিয়ম ছিলো, এই ইউনিটে থাকাকালীন বাইরে কোনও কাজ করা যাবে না। তাই স্ক্রিপ্ট লেখার অনেক অফার পেলেও ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম। কিন্তু এ জে মিন্টু ইউনিট ছেড়ে চলে গেলেন মির্জা খালেকের ‘প্রতিহিংসা’ ছবিটি পরিচালনা করতে। বৈরাগীও বের হয়ে গেলেন। কারণ তিনি ডিরেক্টর হয়ে যাওয়ার পর অ্যাসিস্ট্যান্সি করাটাকে সমুচিত মনে করেননি। রয়ে গেলাম আমি, তমিজ উদ্দীন রিজভী। আমরাও এক সময় মুক্তভাবে কাজ করা শুরু করি।

সালমান শাহকে নিয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা জানান ছটকু আহমেদ, “এফডিসির এক নম্বর ফ্লোরে ফেলা হয়েছে ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবির ফাঁসির দৃশ্যের সেট। সালমান শাহ বললো, “আমার স্ত্রী, পরিবারের লোকজন আসবে শুটিং দেখতে।” বললাম, “আসুক। তোর গলায় রশি পরালেই হবে, সামনে থেকে শট নেবো।” শুনে সালমান বললো, “আপনি তো ফাঁসি দেখেননি। ফাঁসির আগে আসামির হাত পেছন থেকে বেঁধে দেয়, দুই পা একসঙ্গে বেঁধে দেয়, তা না হলে তো সে রশি খুলে ফেলতে চাইবে।” আমি বললাম, “ক্যামেরার সামনে থেকে তো দেখা যাবে না। তুই হাত দু’টো পেছনে রাখলেই তো চলবে। বাঁধার কী দরকার? পা তো ফ্রেমে থাকছে না।” সে বললো, “না, না, আমার তাহলে এক্সপ্রেশন আসবে না।” আমি ভয় পাচ্ছিলাম, যদি কোনও কারণে ফাঁস লেগে যায়? বললাম, “সালমান, আমি তো সাহস পাচ্ছি না!” সে বললো, “আপনি বসেন তো! ওনাকে কেউ চেয়ার দাও!” এরপর সে নিজে রশি এনে হাত-পা বাঁধালো। তারপর প্রস্তুত হয়ে বললো, “এবার শট নেন।”

সালমান শাহ সব সময়ই এ রকম পারফেকশন খুঁজতো। দৃশ্যটির প্রতি ওর এতো বেশি প্রেম কেনো হয়েছিলো, আমি তখন বুঝিনি। পরে যখন শুনলাম, এভাবেই গলায় ফাঁসি দিয়ে ও মারা গেছে, তখন খুব খারাপ লেগেছে। সালমান শাহ অভিনীত শেষ ছবি আমার পরিচালিত ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ তার মৃত্যুর সাতদিন পর ১৯৯৬ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়েছিলো। আর ওর মৃত্যুর আগে আমার ‘বুকের ভিতর আগুন’ ছবির মাত্র অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছিলো। ছবিটির বাকি অংশে সালমান শাহের চরিত্রে অভিনয় করেছিলো নবাগত চিত্রনায়ক ফেরদৌস।”

পরিচালক ছটকু আহমেদ এর হাত ধরে চলচ্চিত্রে আসেন অমিত হাসান, মিশা সওদাগর, ফেরদৌস আহমেদ। তাঁর ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবিতে সালমান শাহের মায়ের ভূমিকার মধ্যদিয়ে চিত্রনায়িকা শাবানা প্রথম কোনও নায়কের মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন।

মুক্তিপ্রাপ্ত আনুমানিক ৩০০টি ছবির কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনা করেছেন ছটকু আহমেদ। যার মধ্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি-সত্যমিথ্যা, বাংলার বধূ, লালু মাস্তান, পিতা মাতা সন্তান, ঘাতক ও চেতনা। বাংলাদেশ ভারত যৌথ প্রযোজনার ছবি স্বামী কেন আসামী, মেয়েরাও মানুষ, জবাবদিহি, শেষ যুদ্ধ, রাজা রানী বাদশা ইত্যাদি। অনন্ত জলিল প্রযোজিত ইরান বাংলাদেশ জয়েন্ট প্রডাকশনের ছবি ‘দিন-দ্যা ডে’ মুক্তি পেয়েছে। বদিউল আলম খোকন পরিচালিত ‘মা আমার বেহেস্ত’, মুস্তাফিজুর রহমান বাবু পরিচালিত ‘হৃদয় ছোঁয়া ভালোবাসা’, সোহানুর রহমান সোহানের ‘স্বপ্নের রাজকন্যা’ ছবির স্ক্রিপ্ট, আবদুস সামাদ খোকন ইমদাদুল হক মিলনের ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্না’ গল্প নিয়ে ছবি করবেন, তার স্ক্রিপ্টসহ আরও কিছু কাজ করছেন ছটকু আহমেদ।

এ পর্যন্ত ১৫টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনা করেছেন ছটকু আহমেদ। ছবিগুলো হচ্ছে-১. নাতবৌ (১৯৮২), ২. রাজদণ্ড (১৯৮৪) ৩. গৃহবিবাদ (১৯৮৬), ৪. অত্যাচার (১৯৮৭) ৫. চেতনা (১৯৯০), ৬. মায়া মমতা (১৯৯৪), ৭. সত্যের মৃত্যু নেই (১৯৯৬) ৮. বুকের ভিতর আগুন (১৯৯৭) ৯. মিথ্যার মৃত্যু (১৯৯৮), ১০. বুক ভরা ভালোবাসা (১৯৯৯), ১১. বর্ষা বাদল (২০০০), ১২. শেষ যুদ্ধ (২০০২, ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ছবি), ১৩. মহাতাণ্ডব (২০০২), ১৪. আজকের রূপবান (২০০৫, চ্যানেল আই প্রযোজিত) ১৫. প্রতিবাদী মাস্টার (২০০৫)।

তিনি পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (বিএফডিসি) ও বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রযোজিত আমার সংসার, ঘোড়ার ডিম, মুক্তিযুদ্ধ ও জীবন ও জন্মজয়ন্তী নামে ৪টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি পরিচালনা করেছেন। বতর্মানে তিনি চারটি ছবি পরিচালনা করছেন। ডিপজল প্রযোজিত ‘এক কোটি টাকা’ ও ‘পাথরের মন’ ও মনামী ক্রিয়েশান প্রযোজিত ‘দলিল’ এবং জ্যোতি চলচ্চিত্র প্রযোজিত ‘তোমাকে খুঁজছে বাংলাদেশ’।

রাস্ট্রীয় সামাজিক ও বিভিন্ন সংগঠনের কাছ থেকে প্রাপ্ত ছটকু আহমেদ এর বিভিন্ন স্বীকৃতি-জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-১৯৮৯, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) এর তিনটি পুরস্কার-১৯৮৬, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক সমিতি পুরস্কার-১৯৯৯, চলচ্চিত্র দর্শক ফোরাম পুরস্কার-১৯৮৮, কালচারাল রিপোটার্স মিলিনিয়াম এ্যাওয়ার্ড-২০০৪, শহীদ মতিউর রহমান পুরস্কার-১৯৯৭, লিজা একাডেমী পুরস্কার-২০০৩, সালমান শাহ স্মৃতি পরিষদ সম্মাননা পুরস্কার-২০০৯, নাট্যসভা পুরস্কার, সবুজ বাংলা আজীবন সম্মাননা ২০১৫সহ আরও অসংখ্য পুরস্কার। তিনি গণভবনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে একজন প্রকৌশলী হিসেবে চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদান রাখার জন্যে ‘আইডিইবি’র গোল্ড মেডেল লাভ করেন।

ছটকু আহমেদ তিন মেয়াদে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি’র সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। চলচ্চিত্র লেখক সমিতির প্রথম নির্বাচিত মহাসচিব ছিলেন তিনি। বতর্মানে তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি ও শিল্পী ঐক্যজোটের সম্মানিত আজীবন সদস্য এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহ-সভাপতি।

ছটকু আহমেদ ১৯৭৯ সালের ১৮ নভেম্বর মসরুরাহ আহমেদ এপি’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্ত্রী কক্সবাজার জেলার চকরিয়ার ডেপুটি বাড়ির মেয়ে। প্রযোজিকা ও গৃহবধূ। তাঁরা ৪ কন্যা সন্তানের জনক-জননী। চার মেয়েই মাস্টার্স পাশ করেছেন। বড় মেয়ে সাদিয়া আহমেদ স্নিগ্ধা, মেজো মেয়ের নাম ফারিয়া আহমেদ স্থীরা, সেজো মেয়ে শাহরিয়া আহমেদ স্নাতা ও ছোট মেয়ে নাজিয়া আহমেদ শ্বেতা।
২০২০ সালে শুরু হওয়া মহামারী কোভিড-১৯ চলাকালে ১৬ আগস্ট তিনি করোনা টেস্ট করান। রিপোর্ট পজিটিভ আসে। নিজ আত্মবিশ্বাস ও নিয়ম নিষ্ঠার জোরে সংস্কৃতি অঙ্গনের বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব ৭৪ বছরের ছটকু আহমেদ করোনা জয় করে সুস্থ জীবনে ফিরে আসেন এবং আজ গৌরব ও সাফল্যময় জীবনের ৭৭তম বছরে পা রাখলেন। এই মাহেন্দ্রক্ষণে তাঁকে জানাই অগণন শুভেচ্ছা।

তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ, প্রযোজক হাবিবুর রহমান খান, চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব ছটকু আহমেদ ও দৈনিক কালের কণ্ঠ

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ৮:১২

কামাল৮০ বলেছেন: উনার বয়স প্রায় আমার সমান।আমার জন্মও মুন্সিগঞ্জে।উনি কৃতি সন্তান আমি অধম সন্তান।মুন্সিগঞ্জ অনেক কৃতি সন্তানের জন্ম দিয়েছে।তাদের নিয়ে আমাদের অনেক গর্ভ।

০৯ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৯

কাজী হাসান সোনারং বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা!

২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ৯:৫২

মোহাম্মদ গোফরান বলেছেন: বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

০৯ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৯

কাজী হাসান সোনারং বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ।

৩| ০৮ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ৮:৪৩

কল্পদ্রুম বলেছেন: স্বাধীনতার পর বাংলা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র তৈরির ইতিহাস অথবা গল্প আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। ছটকু আহমেদের প্রতি শ্রদ্ধা রইলো। এইসব মানুষেরা নিঃসন্দেহে অন্যরকম স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন।

০৯ ই অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৮

কাজী হাসান সোনারং বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা!

৪| ২১ শে অক্টোবর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩৫

নাহল তরকারি বলেছেন: আপনার লেখা সুপার হিট।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.