নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্য কথা বলা এবং সুন্দর করে লেখা অভ্যাসের উপর নির্ভর করে
১৯৭১ সালে, ঢাকা শহরের ২২টা মুক্তিযোদ্ধা-আশ্রয়বাটি ঘেরাও করে। জাহানারা ইমামের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায় রুমীকে, তার ছোট ভাই জামিকে, ধরে নিয়ে যায় রুমী-জামির বাবা ইঞ্জিনিয়ার শরীফ সাহেবকে।
আজাদদের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের ট্রাক আসে মধ্যরাতের পর। সেখানে কাজী কামাল (পরে বীর বিক্রম), যিনি কিনা ছিলেন দেশের একজন শ্রেষ্ঠ বাস্কেটবল খেলোয়াড়, জুয়েল (তখনকার দিনের মারকুটে ক্রিকেটার, যার নামে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে গ্যালারি আছে, শহীদ জুয়েল স্ট্যান্ড), আজাদ প্রমুখ গেরিলারা রাত জেগে খালি গায়ে ক্যারম খেলছিল। পাকিস্তানি সেনা বাড়ি ঘেরাও করে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। কাজী কামাল একজন সেনাকর্তার অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায়। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে তার একমাত্র পরিধেয় খুলে গেলে সে এই অবস্থাতেই দৌড় দেয়, আজাদদের মগবাজারের বাড়ি থেকে দৌড়ে গিয়ে নক করে হাবিবুল আলম (বীর প্রতীক)-এর বাড়িতে। তার বোনের কাছ থেকে চাদর নিয়ে পরে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
জুয়েল, আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ছিল ওই সময়ে ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় তারকা ক্রিকেটারদের একজন। এর আগে একটা গেরিলা অপারেশনের সময় তার হাতে গুলি লেগেছিল। হাতে ব্যান্ডেজ ছিল। তাকে ধরে নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের টর্চার সেলে তার ভাঙা আঙুলের ওপরে প্রচণ্ড নিপীড়ন চালিয়েছিল।
আর রুমী। অসম্ভব ভালো ছাত্র। কেবল ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, পেয়েছে বিদেশেও ভর্তির সুযোগ। সেই সব সোনার ছেলে, অতি অল্প বয়সে, দেশের ডাকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। আগরতলা গেছে, মেলাঘরে গেরিলা ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়েছে, মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন সেই ক্যাম্প, দুই নম্বর সেক্টর। সদ্য গোঁফ ওঠা কিশোর যুদ্ধে যেতে চায়, কিছুতেই মায়ের মানা শোনে না। মা জাহানারা ইমাম শেষে বলেই ফেললেন, যা, তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে দিলাম। পরে, জাহানারা ইমাম, সারা জীবন আফসোস করতেন, কেন তিনি কোরবানি কথাটা বলতে গেলেন। এরা সবাই ৪৪ বছর আগের আগস্ট মাসের সেই আর্মি অভিযানে ধরা পড়ে। এদের অনেকেই আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি।
আজাদ ছিল তাদের মা-বাবার একমাত্র সন্তান। আজাদদের ইস্কাটনের বাড়ি ছিল প্রকাণ্ড। আজাদের বাবা আরেকটা বিয়ে করবেন। মা প্রতিবাদে একমাত্র ছেলে সেন্ট গ্রেগরিতে সিক্সে পড়া আজাদকে নিয়ে বের হয়ে প্রথমে একটা বস্তিঘরে আশ্রয় নেন। অনেক কষ্ট করে আজাদকে লেখাপড়া করান। আজাদ মাধ্যমিক পাস করে, ইন্টারমিডিয়েট পাস করে, করাচি থেকে ডিগ্রি পাস করে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স পাস করে। ১৯৭১ সাল। আজাদের বন্ধু রুমী। আজাদের বন্ধু জুয়েল। তারা আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছে, দেশের ভেতরে গেরিলা অপারেশন করছে। তারা বলল আজাদকে, তুই তো অস্ত্র চালাতে জানিস, তোর বাবার রাইফেল ছিল, রিভলভার ছিল, চল আমাদের সঙ্গে অপারেশনে। আজাদ বলল, এই জগতে মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই, মায়েরও আমি ছাড়া আর কেউ নেই। মা যদি অনুমতি দেন তাহলেই কেবল আমি যুদ্ধে যেতে পারি। আজাদ মাকে জিগ্যেস করল, মা, আমি কি যুদ্ধে যাব? ওরা সবাই আমাকে ডাকছে। মা বললেন, নিশ্চয়ই, আমি তো আমার প্রয়োজনে লাগবে বলে তোমাকে মানুষ করিনি, তুমি লাগবে দেশের প্রয়োজনে, দশের প্রয়োজনে। যাও। আজাদ দুটো গেরিলা অপারেশনে তার বন্ধুদের সহযাত্রী হয়। তাদের বাড়িতে গেরিলারা আশ্রয় নেয়। অস্ত্রশস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়।
এই সেই শরৎকাল। এই সেই আগস্ট। আগস্ট আসলেই কালো মাস এই বাংলাদেশের জন্য। পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেল আজাদকে, জুয়েলকে, বদিকে, বাকেরকে, রুমীকে।
আজাদের মা আজাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন রমনা থানায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের দালালেরা বলল, আজাদ তো বড়লোকের ছেলে, ওকে ছেড়ে দেওয়া হবে, ওকে বলুন রাজসাক্ষী হতে, বন্ধুদের নাম-ঠিকানা বলে দিক। আজাদের মা ছেলের সঙ্গে দেখা করে বললেন, শক্ত হয়ে থেকো বাবা, কোনো কিছু স্বীকার করবে না। আজাদ বলল, মা, কদিন ভাত খাই না। কালকে যখন আসবে আমার জন্য ভাত নিয়ে আসবে। আজাদের মা বহু যত্ন করে ভাত নিয়ে এলেন ছেলের জন্য টিফিন ক্যারিয়ারে সাজিয়ে। এসে দেখলেন, ছেলে নেই। এই ছেলে আর কোনো দিনও ফিরে আসেনি, আর এই মা ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, আরও ১৪ বছর, ১৪ বছরে তিনি নিজে আর এক দানা ভাতও মুখে তোলেননি কোনো দিনও। জুরাইন গোরস্থানে আজাদের মায়ের কবর আছে, আর তাতে লেখা আছে—শহীদ আজাদের মা।
আমাদের মায়েরা তাঁদের সন্তানকে হাসতে হাসতে উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের ভালো থাকার জন্য। ১৯৭১ সালে আমেরিকানরা বলত, পরেও বলেছে, এই দেশ কেন স্বাধীন হতে চায়, এটা তো ইকোনমিক্যালি ভায়াবল হবে না। আজকে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরে আমরা প্রমাণ করেছি, আমরা কেবল ভায়াবল হব না, আমরা উন্নতি করব। এখনই আমরা মধ্য আয়ের দেশের ক্লাবের পেছনের বেঞ্চে বসে পড়েছি। আর সারা দেশে মানুষের মধ্যে এগিয়ে চলার কী টগবগে কর্ম-উদ্দীপনা। ধানমন্ডির বয়েজ স্কুলের জাহিদ হাসান আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারমিয়ন কণা আবিষ্কার করে পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাস আর ইলেকট্রনিক শিল্প ও বাজার পাল্টে দিচ্ছেন। ইউটিউবের প্রবর্তকদের মধ্যে বাংলাদেশি আছে। এমনকি নাসা যাদের মঙ্গলে পাঠাবে ওয়ানওয়ে টিমে, তাদের মধ্যেও আছে এক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নারী। আমাদের সাকিব আল হাসান পৃথিবীর এক নম্বর অলরাউন্ডার। আমাদের ৯৮ শতাংশের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়। ২০ বছর পরে এই দেশের কৃষক হবে শিক্ষিত কৃষক, শ্রমিক হবে শিক্ষিত শ্রমিক।
শহীদ আজাদের মা, আপনার ছেলের আত্মোৎসর্গ আর আপনার সন্তানকে বিলিয়ে দেওয়া দেশের জন্য—বৃথা যায়নি। জননী জাহানারা ইমাম, আপনার ছেলে রুমীকে দেশের জন্য উৎসর্গ করেছেন, তা নতুন প্রজন্ম বৃথা যেতে দিচ্ছে না। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশ এগিয়ে যাবে।
অমর্ত্য সেন বারবার করে বলছেন, বাংলাদেশ ভালো করছে। ভারতের চেয়েও বহু ক্ষেত্রে ভালো করছে। আমরা জানি, আমরা ভালো করছি। অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বলেছেন, যে দেশে গণতন্ত্র আছে, যে দেশে বাক্স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেন, আপনাকে একটা উদাহরণ দিতে চাই, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে প্রতিবছর আশ্বিন-কার্তিক মাসে প্রায়-দুর্ভিক্ষ দেখা দিত, খেতে কাজ থাকত না বলে ওই সময় কৃষকেরা না খেয়ে থাকত। আমি এই ক্ষুদ্র লেখক—দিনের পর দিন মঙ্গা নিয়ে কলাম লিখেছি, গল্প ও নাটক লিখেছি। অন্য অনেক সাংবাদিক লিখেছেন, মোনাজাতউদ্দিন থেকে শুরু করে বেলাল বেগ পর্যন্ত—আমরা প্রথম আলো থেকে কুড়িগ্রামে গিয়ে মঙ্গা বিষয়ে সেমিনার করেছি, ঢাকায় করেছি—সরকার উদ্যোগ নিয়েছে, বিশেষ করে শেখ হাসিনার সরকার, আগের দুই টার্মে বিশেষ তহবিল করেছেন। এনজিওগুলো তৎপর হয়েছে, কৃষি গবেষকেরা মঙ্গায় ফলে এমন ধানের বীজ আবিষ্কার করেছেন, যমুনা ও ধরলায় ব্রিজ হয়েছে, গার্মেন্টস হয়েছে, বিদেশে কর্মসংস্থান হয়েছে, নির্মাণকাজে যজ্ঞ লেগেছে—এখন আর কেউ না খেয়ে থাকে না, উত্তরবঙ্গে মঙ্গা আর নেই।
আমাকে যদি বলেন, ২৬ বছরের সাংবাদিকতা আর লেখকজীবনে কী পেয়েছেন, কী দেখেছেন? আমি বলব, আমি দেখেছি উত্তরবঙ্গের মানুষের মুখে মঙ্গা জয়ের হাসি। আমি তো গিয়েছিলাম রংপুরের তারাগঞ্জের গ্রামে, সাদেকা নামের এক গ্রাম্য নারীর তৈরি বেগম রোকেয়া নারী সমিতি দেখতে। তাঁদের পুরুষেরা বলেছেন, আমাদের গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরু, আমাদের সব ছেলেমেয়ে স্কুলে যায়, আমাদের গ্রামে বাল্যবিবাহ হয় না, কারণ সে রকম লক্ষণ দেখা দিলে সমিতির মেয়েরা গিয়ে বিয়েবাড়ি ঘেরাও করে, সবাই স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে এবং সবার বাড়িতে টিউবওয়েল আছে—আমরা আর কী চাই। নারীদের আমরা সহযোগিতা করি। কারণ, তারা আমাদের কুঁড়েঘরে টিনের ঘর তুলে দিয়েছে। বেগম রোকেয়ার নারীস্থান নারী-পুরুষের মিলিত স্বর্গভূমি রচনা করেছে তারাগঞ্জের গ্রামটিতে। শ্রদ্ধেয় অমর্ত্য সেন, আপনার তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ দেখছি এই বাংলাদেশে, গণতন্ত্র আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা মিলেমিশে এখানে কেবল দুর্ভিক্ষ দূর করেনি, মানুষের উন্নতি ঘটিয়েছে, নারী-পুরুষের সমমর্যাদা এখানে জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে।
আমাদের তাই গণতন্ত্র চাই, আমাদের তাই সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই। আর সবকিছুর মূলে আছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ১৯৪৭ সালেই কলকাতার হোস্টেলে তাঁর বন্ধুদের ডেকে বলেছিলেন, পূর্ব বাংলায় যেতে হবে, এই স্বাধীনতা স্বাধীনতা নয়, আমাদের আসল স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। ১৯৪৮ সালেই ভাষা আন্দোলন শুরু করে জেলে গিয়ে তিনি সেই কাজ শুরু করে দেন। বছরের পর বছর ধরে এই দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্নে উজ্জীবিত করে তোলেন। রুমী, আজাদ, বদি, বাকের, জুয়েলের মতো ৩০ লাখ মানুষ সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার ডাকে সাড়া দেয়।
আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। গণতন্ত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আমাদের আরেকটা স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করছে—উন্নত দেশ, আলোকিত সমাজ, মানবিক রাষ্ট্র। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গণতন্ত্র আর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়, পরস্পরের সহায়ক। এই মন্ত্রেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। ক্রিকেটার মুস্তাফিজের বাংলাদেশ, ক্রিকেটার সালমার বাংলাদেশ, এম জাহিদ হাসানের বাংলাদেশ। মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি... মায়ের মুখে হাসি দেখলেও আমাদের চোখে আনন্দাশ্রু ঝকমক করে, আমার সোনার বাংলা, আমরা তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসি। এই দেশ ছেড়ে আমরা কোথাও যাব না, আমরা আমাদের বাংলাদেশের মুখে হাসি ফোটাবই। তাতে বাধা আসবে, আসছে, সে বাধা জয়ও আমাদেরই করতে হবে।
লেখকঃ আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:২৫
রাখালছেলে বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার পোষ্টের জন্য । আনিসুল হককেও ধন্যবাদ।