![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গরমের দিনে রাস্তাঘাটে চলার সময় তেষ্টা পায় আমাদের। মাঝে মধ্যেই গলা শুকিয়ে কাঠ। পথেঘাটে অতো বাছবিচার করার সময় এবং সুযোগ কোথায়? যা পারছি তাই গলায় ঢালছি। আখের রস, ডাবের পানি কিংবা পকেট গরম থাকলে কোল্ড ড্রিংক।। কোনটা ভালো, কতোটা ভালো, কেন ভালো-এসব নিয়ে ভাবনাচিন্তার কোনো দায় নেই আমাদের। অথচ এসব পানিবাহিত হয়েই পেটের রোগের নানা জীবাণু ঢুকছে শরীরে। ঠান্ডা পানীয় গলায় ঢাললে সত্যিই শরীর জুড়োয়। কিন্তু ক্ষতি কি কিছুই হয় না?
আখের রস
রাস্তার আখমাড়াইয়ের কল থেকে যারা আখের রস কিনে খান তারা বিষপান করেন। নোংরা পানিতে ভেজানো নোংরা আখ, নোংরা বরফ এবং নোংরা ন্যাকড়ায় ছাঁকা আখের রসে কিলবিল করছে আন্তিকের জীবাণু সালমোনেলা, সিগেলা, ভিবিও কলেরি, ই কোলাই। রস যদি খেতেই হয়, তাহলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটা সিট বুক করে বরং আখের রস খান। তাছাড়া আখের রসে তো আহামরি পুষ্টিও নেই। শর্করা থাকে শতকরা মাত্র ৯.১ গ্রাম, প্রোটিন ০.১ গ্রাম, ফ্যাট ০.২ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস ১০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন-এ ১০ ইউনিট। শক্তি কেবল মাত্র ৩০ ক্যালরি। আখের রসের চেয়ে শুধু আখ বরং বেশি পুষ্টিকর। শর্করা থাকে ২০.৫ গ্রাম এবং শক্তি মেলে ৮৩ ক্যালরি। তবু যদি খেতেই হয় আখ কিনে এনে ঘরে শরবত তৈরি করে লেবুর রস আর বরফ কুচি মিশিয়ে সামান্য বিটলবণ ছড়িয়ে খান। জন্ডিসের পথ্য হিসেবে আখের রস অনেকেই পছন্দ করেন। জন্ডিস কিন্তু কোনো রোগ নয়, রোগের উপসর্গ। লিভারের প্রদাহ বা হেপাটাইটিস নানা কারণে হতে পারে যার প্রকাশ ঘটে খিদে কমে যাওয়া, ক্লান্তিভাব, গা বমি বমি ভাব, পেটে ব্যথা এবং দেহত্বক, মত্র ইত্যাদি হলুদ বর্ণ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে, যাকে বলে জন্ডিস। নেপথ্যের কারণ অনুযায়ী এ রোগের চিকিৎসা হওয়া উচিত। আর জন্ডিসের বেলায় ‘রেস্ট ইজ দ্যা বেস্ট ট্রিটমেন্ট’। এ ভাইরাসজনিত জন্ডিস শুধুমাত্র বিশ্রাম এবং সহজপাচ্য খাদ্যগ্রহণেই ঠিক হয়ে যায়। সহজপাচ্য বলতে কার্বোহাইড্রেট থাকবে বেশি, প্রোটিন ও ফ্যাট কম এবং অল্প তেলমসলায় তা রাঁধতে হবে। আগেই জেনেছেন আখের রসে কর্বোহাইড্রেট থাকে মাত্র ৯.১ গ্রাম। কাজেই জন্ডিসে আখের রস খাওয়া আবশ্যিক কিছু নয়। খেলে খাবেন, তবে রাস্তার আখের রস নয়। জন্ডিসে বরং গ্লুকোজ খেতে পারেন। কার্বোহাইড্রেট থাকে বেশি, শক্তিও মেলে বেশি।
ডাবের পানি
ডাবের পানির ওপর আমাদের ভীষণ দুর্বলতা আছে। পেট ঠান্ডা রাখতে, পেট আইটায় করলে তা কমাতে ডাবের পানির নাকি জুড়ি নেই!। কিন্তু সত্যিই কি তাই? প্রথমেই জানানো যাক, প্রকৃতির বিশুদ্ধতম পানীয় হচ্ছে ডাবের পানি এবং এতে দষণের কোনো সম্ভাবনাই নেই। শতকরা হিসেবে ১০০ গ্রাম ডাবের পানিতে প্রোটিন থাকে ১.৪ ভাগ, ফ্যাট ০.১ ভাগ, শর্করা ০.৪ ভাগ, ক্যালসিয়াম ২৪ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ১০ মিলিগ্রাম। এছাড়া থাকে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স ইত্যাদি। কাজেই ডাবের পানি পুষ্টিকরও বটে। তবে দাম তো কম নয়, ১০-১২ টাকার কমে ভালো ডাব মেলে না এবং এই টাকায় যে পুষ্টি মেলে তা ১টাকা থেকে ১.৫০ টাকা খরচ করে ফুটিয়ে ঠান্ডা করা এক গ্লাস পানিতে ১ চামচ চিনি, একটু লবণ আর আধখানা লেবুর রস মিশিয়ে খেলেই পাওয়া যায়। পেটের অসুখে এই মিশ্রণটিকে বারেবারে খাওয়ানোর জন্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সুপারিশ করেছেন। কাজেই পেটের অসুখ আটকাতে, পেট ঠান্ডা রাখতে বা পেটের অসুখ হলে তা সারাতে ডাবের পানির কোনো সরাসরি ভূমিকা নেই। তবে পকেট গরম থাকলে মাঝে মধ্যে খাওয়া যেতেই পারে, বিশেষ করে পথেঘাটে তেষ্টা মেটাতে এমন ১০০ ভাগ বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক পানি আর কোথায় পাবেন?
গ্লুকোজ না ইলেক্ট্রোলাইট
গরমে ভীষণ ঘাম হয়। শরীর থেকে এর ফলে অনেক পানি বের হয়ে যায়, সঙ্গে বের হয় বিভিন্ন লবণ, এসিড, ইউরিয়া, প্রোটিন, অ্যামোনিয়া ইত্যাদি। ফলে ক্লান্তি লাগে। তবে এটা সাময়িক। এই ক্লান্তি দর করতে শুধু পানি খেলেই হলো, সঙ্গে গ্লাসে ১ চামচ গ্লুকোজ মিশিয়ে খেতে পারেন। তবে ইলেক্ট্রোলাইট অর্থাৎ যাতে সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়ামসহ নানা লবণ থাকে সেগুলো খাবার প্রয়োজন নেই। কারণ ঘামের সঙ্গে এতো সামান্য পরিমাণে এগুলো বের হয়ে যায় যা সাধারণ খাওয়া-দাওয়া থেকেই পূরণ হয়ে যায়। খুব বেশি বমি-পায়খানা, যেখানে খুব বেশি পরিমাণে এগুলো বের হয়ে যায়, একমাত্র সেসব ক্ষেত্রেই ইলেক্ট্রোলাইট পানিতে গুলে খাবার প্রয়োজন হয়। ১ গ্লাস পানিতে ১ চামচ চিনি, এক চিমটি লবণ এবং আধখানা পাতিলেবুর রস মিশিয়েও এই শরবত বাড়িতে তৈরি করা যায়। গরমকালে যাদের অতিরিক্ত ঘাম হয় এবং অতিরিক্ত পরিশ্রম করেন তারা মাঝে মধ্যে গ্লুকোজ পানিতে গুলে খেতে পারেন। ক্লান্তি দর হবে, শক্তি মিলবে। ডায়াবেটিস-এর রোগীরা গ্লুকোজ খাবেন না। অকারণে ইলেক্ট্রোলাইট খেলে শরীরে অতিরিক্ত সোডিয়াম ও পটাশিয়ামসহ নানা লবণ ঢুকবে, যা শরীরের পক্ষেসব সময় ভালো নাও হতে পারে।
ঘোলের শরবত
দই বা ঘোলের শরবত দারুণ উপকারী। দইয়ে থাকে দেহের পক্ষেঅতি প্রয়োজনীয় জীবাণু ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস, যা আমাদের অন্ত্রণালীতে থাকা ল্যাকটোব্যাসিলাসের সঙ্গে মিলেমিশে-
কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে।
অন্ত্রনালীতে ক্ষতিকর জীবাণুর বৃদ্ধি বন্ধ করে।
খাদ্যের পচন রোধ করে।
মাছ-মাংসের জটিল প্রোটিন ভেঙ্গে তাকে সরল করে ফলে সহজেই হজম হয়।
অন্ত্রনালীতে বি-গ্রুপের ভিটামিন তৈরি করে।
এতসব গুণের জন্য এই পেটটাকে ঠিক রাখেতে দই-এর কোনো বিকল্প নেই। তবে বাজারি রং করা দইয়ে যেন এতো গুণ আশা করবেন না। সাদা দই বা টক দই যা আপনি ঘরেও পাততে পারেন। তাতেই মিলবে এতসব উপকার। তাছাড়া দই আমাদের শরীরের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণ করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। দইয়ের ফসফরাস শিশুদের মস্তিষ্কও হাতের গঠনে সাহায্য করে। দই খেলে ঠান্ডা লাগে বা এসিড হয় এমন কথা অনেক বিকল্প প্যাথিস্টই বলে থাকেন। এগুলো স্রেফ কথার কথা, সত্য কথা নয়। ফ্রিজের ঠান্ড দই না খেলে ঠান্ডা লাগবে কেন? আর পাকস্থলিতে হাইড্রোক্লোরিক এসিডের অতিরিক্ত ক্ষরণে অম্বল হয়, দইয়ের ল্যাকটিক এসিড এর জন্য দায়ী নয়। খাবার পাতে অনেকেই দই না খেয়ে ঘোল করে খান। দইয়ের সঙ্গে পানি মিশিয়ে মাঠা বা মাখন তুলে নিয়ে তার মধ্যে চিনি, লবণ আর লেবু মিশিয়ে তৈরি হয় ঘোলের শরবত। ফ্রিজে রেখে খান। গরমে লা জবাব। খেতেও সুস্বাদু আর দইয়ের মতো পুষ্টিকরও। তবে যে পানিটা মিশাবেন তা যেন দূষণমুক্ত হয়। ২০ মিনিট ধরে ফোটাবার পর ঠান্ডা করা অথবা ফিল্টারে পরিস্রম্নত পানি ব্যবহার করবেন।
আইসক্রিম
আইসক্রিম খেতে পছন্দ করেন অনেকেই, বিশেষ করে গরমকালে। কি থাকে আইসক্রিমে? দুগ্ধজাত নানা পদার্থ, কর্ন সিরাপ, সুগন্ধি পানি, বাতাস, রং ইত্যাদি। শতকরা হিসেবে থাকে ১৫ ভাগ চিনি, ১২ ভাগ ফ্যাট, ১১ ভাগ ফ্যাট নয় এমন দুগ্ধজাত পদার্থ, ভিটামিনি-এ ও অন্যান্য উপাদান। ১ কাপ আইসক্রিম থেকে শক্তি মেলে প্রায় ২০০ ক্যালরি, প্রোটিন প্রায় ৪ গ্রাম। এছাড়া ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লোহা ইত্যাদি খনিজ লবণ। কাজেই আইসক্রিম কিছুটা পুষ্টিকরও বটে। কিন্তু্তু সস্তার আইসক্রিমে এতসব গুণপনা থাকে না। যে দষিত পানি দিয়ে এগুলো তৈরি হয় তাতে ‘ই-কোলাই’ জাতীয় মারাত্মক আন্তিকের জীবাণু শতকরা ৩৭ ভাগ ক্ষেত্রেই।
তাছাড়া ডায়মন্ড গ্রিন, কঙ্গো রেড, অরেঞ্জ টু, রোডোমিন-বি কেশরি রং (মেটানিল ইয়েলো)সহ যে নিষিদ্ধ রং আকছার মেশনো হয় আইসক্রিমে সেগুলো শরীরের পক্ষে ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। দীর্ঘদিন শরীরে প্রবেশ করলে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। রাস্তাঘাটে, অফিস পাড়ায়, স্টেশনে লাল-নীল যেসব ঠান্ডা শরবত বিক্রি হয়, সেগুলোতেও দষিত পানি আর বিষাক্ত রং মেশানো হয়।
কোল্ড ড্রিংক
কোল্ড ড্রিংক-এর দুর্বলতা কমবেশি আমাদের সবারই। টিভির পর্দায় প্রতিদিনই প্রিয় খেলোয়াড় আর চিত্র তারকাদের কোল্ড ড্রিংক খেতে দেখে এই লিপ্সা আরো বাড়ছে। ক্রিকেট, পুটবল ছেড়ে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সপন্সরও এখন ঠান্ডা পানীয়। এর ফাঁদ পাতা তাই ভুবন জুড়েই। কিন্তু কতটা নিরাপদ এরা আমাদের জীবনের পক্ষে? কোল্ড ড্রিংকের শতকরা ৯৫ শতাংশই হলো পানি। ৪ শতাংশ চিনি বা অন্য কোনো মিষ্টি। টক স্বাদ আনার জন্য এতে মেশানো হয় সাইট্রিক এসিড,সুস্বাদু করার জন্য সামান্য পরিমাণে ফসফোরিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সোডিয়াম ক্লোরাইট, পটাসিয়াম ক্লোরাইট ইত্যাদি। এছাড়া থাকে নানা সুগন্ধি রং। অনেক ড্রিংকে টাটকা ফলের রস থাকে বলে দাবি করা হয়, বাস্তবে যা সম্ভব নয়, কারণ ফলের রসকে অবিকৃত রাখতে যে পরিমাণ পচনরোধক রাসায়নিক পদার্থ মেশাতে হবে সে পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ মেশাতে গেলে কোল্ড ড্রিংকের স্বাদ কটু লাগবে। শরীরের পক্ষেও ক্ষতিকর হবে। গুরুপাক খাওয়ার পর অনেকেই সোডা ওয়াটার খান। এতে থাকে উচ্চচাপে পানিতে দ্রবণীয় কার্বন-ডাই-অক্সাইড। এর ফলে হজমে যে সাহায্য হয়, তা নয়। তবে পাকস্থলীর ভেতরের শ্লেষ্মা ঝিলিস্ন বা মিউকাস মেমব্রেনে একটা আরামবোধ হয়, যাকে বলে সুদিং এফেক্ট, পেটের আইটাই ভাবটাও এর ফলে কমে। তবে এতে ক্ষতির আশঙ্কাও থাকে। যাদের টনসিলাইটিস বা ফ্যারিনজাইটিসের ধাত আছে, কোল্ড ড্রিংকের অতিরিক্ত ঠান্ডা তাদের গলার ক্ষতি করে। মাঝে মধ্যে দু একটা কোল্ড ড্রিংক খেতেই পারেন, তবে নিয়মিত নয়।
বারো মিশালি শরবত
রাস্তাঘাটে প্রায়ই শরবত বিক্রি হতে দেখা যায়। এসব শরবতে তালমাখনা, তোকমা, ঘৃতকুমারী, ওলটকম্বল, ইসবগুলের ভুসি...এমনি বেশ কয়েক পদের মিশ্রণ থাকে। নিঃসন্দেহে এগুলো বেশ উপকারি ভেষজ। একসঙ্গে মিশিয়ে শরবত করে খেলে পেট ঠান্ডা থাকে, কোষ্ঠ পরিষকার হয়। কিন্তু্তু রাস্তার ধারের ধুলাবালি আর জীবাণু মাখা শরবতে? তাতেও পেট পরিষকার হবে ভালোই। আর সেই পেট পরিষকারের ঠেলায় টয়লেটকেই বানাতে হবে স্থায়ী ঠিকানা।
কি দাঁড়ালো তাহলে? এতো ঝামেলায় তো দেখছি রাস্তাঘাটে গলাই ভেজানো যাবে না-তাইতো ভাবছেন? কে বললো যাবে না, আমার প্রেসক্রিপশন নিন। রাস্তাঘাটে তেষ্টা পেলে বিভিন্ন রসালো ফল ভালো করে ধুয়ে খান। তবে সবচেয়ে ভালো হয় বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় এক বোতল ফুটানো পানি সঙ্গে নিয়ে বের হলে। ভাবছেন, পানির বোতল নিয়ে ঘোরা ঝামেলার হবে! কিন্তু.. বারে বারে অসুস্থ হয়ে পকেটের স্বাস্থ্য খারাপ করে ডাক্তারি ঝামেলায় পড়ার চেয়ে এই অল্প ঝামেলা টুকুই মেনে নেয়া ভালো নয়কি?
©somewhere in net ltd.