নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাষাহীন বাবুই

খেয়া ঘাট

ভাষাহীন বাবুই

খেয়া ঘাট › বিস্তারিত পোস্টঃ

তোমরা আমাকে চিনতে পেরছো কি?

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৫৫

তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?
- আরিফ মাহমুদ

ধূসর সময়ের প্রান্তরে প্রান্তরে-
গহীন সময়ের আলো আর অন্ধকারে,
এক অশথ বটের নীচে আমি শুনি শাশ্বত শতাব্দীর নিঃশ্বাস-
শুনি নিভৃত কুহকের ডাক,আর দেখি সজল বিলের গাঙ্গচুর জলা হাঁস
হৃদয় মন্দিরে খুঁজি চারহাজার বছরের মাটির আঘ্রাণ-
কত সাধু আর তাপসীর প্রান আকুল করা হাজার বছরের গান,
আজ আমি সেই হৃদয় মথিত সুর
আর রাখালির বাঁশীর কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

ফাগুনের ছায়া মাখা রোদে,
ঝরনার চঞ্চলতায়- চক্রবালের নীরব জনপদে-
বিলীন পটভূমির ইতিহাসের প্রথম উৎস থেকে-
কত খন্জনার নাচ, কত ধূলো গায়ে মেখে
কত নদী জন্মালো, ভেঙ্গে গেলো কত তীর
মনে পড়ে আজ সেই আর্য আর দ্রাবিড়,
আমি আজ সেই খুঁজে ফেরা শৈশবের কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

দুহাজার ছয়শত আট সাল আগে,
অঙ্গ,বঙ্গ,মগধের নিরজনে,
সুজলা,সুফলা,শশ্য,শ্যামলা,গিরি ,কুন্তলায়,
নির্ঝর বহমান নদী আর হ্রদে, পাখীর কলতানে,
অবারিত নীলের বিস্তৃত আকাশের ঠিকানায়,
জনপদের সেই অবিস্মরণীয় সূর্য পরিক্রমায়
ধীরে ধীরে আমার বেড়ে ওঠার কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

আমি ছিলাম রামায়ণে,মহাভারতে,
যেখানে বিম্বিসারের,অজাতশত্রুর,শাসনের দীপ্তিতে
আশ্চর্য্য প্রশান্তিতে ভরিয়ে রেখেছিলো আমার মন,
যতিহীন জীবনের সেই প্রাণের স্পন্দন,
আজ আমি সেই স্মৃতি আর সহস্র লগনের কথা বলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

তারপর হঠাৎএকদিন-
বুকের উপর ছুটে চলা স্রোতস্বিনী গঙ্গার ঢেউ
উন্মত্ত ক্রোধে তেজী অশ্বের লাগাম টেনে দাঁড়িয়ে কেউ
২৩৩৪ বছর আগে-নন্দ রাজ্যের রুপালী জোছনায়,
আমার সূর্যনদীর পাড়ে সেই সূর্যসন্তানেরা সূর্যপরিক্রমায়-
গেয়েছিলো সেদিন রামধুনর সাতরঙ্গা বিজয়ের গান
আর আমি মহাবিস্ময়ে দেখেছিলাম তোমার ভীরু প্রস্থান-
মহাবীর আলেকজান্ডার ,তুমি গুটিয়ে নিলে তোমার চরণ-
আমার গৌরব,আমার অহংকার ,আমার চির দীপ্তিমান সেই স্বপন
আমি আজ সেই তেজোদীপ্ত বিজয়ের কথা বলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

তারপর ছায়া ঢাকা, পাখী ঢাকা, শান্ত ,সূর্যে চন্দ্রে সুনিবিড়
কেটে যায় কত বছর ,কত যুগ-কত রঙের আবীর,
মৌর্য,গুপ্ত রাজ্যের ইতিকথা,কত তমালের আর পিয়াল
মনে পড়ে চন্দ্র, গুপ্ত, মৌর্য, অশোক, মহান শশাংক, ধর্মপাল।
খিলজি আসে, সালতানাত হয়, আফগান,মুঘল,তূর্কির অধিকার-
শের শাহ ছুটে চলে সোনারগাঁ থেকে পেশোয়ার,
কত ইট কত সুড়কি,স্মৃতির সেই গ্রান্ড ট্রাংক রোড,আর সুউচ্চ মিনার,
আমি যেন এই পৃথিবীর স্বর্গভূমি, প্রাচুর্য্যের সমাহার,
আজ আমি সেই হারানো ঐশ্বর্য্যের কথা বলছি
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

সেই ঐশ্বর্য্যের লোভে আসে ধূর্ত শিয়াল,স্বপ্ন হননের ছল,
অন্ধ কুটিরে আমার দীপ্তি নিঃশেষিত হয়,কাঁপে আমার অন্চল,
বাণিজ্য বেসাতিতে বিবস্ত্র আমার সবুজ আঁচল, দেখি ডাকুর পাল
বিশাল আকাশের নীলিমায় স্বপ্নহরণের সময় সেতো ১৬৭৩ সাল,
শিয়ালের পর আসে হায়েনার দল, তাদের গোপন পদধ্বনি
১৬৯০ সাল-শুরু হয় আমার বুকে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়ার গ্লানি ।
শুরু হয় আমার অশ্রুপাত, বিষাদের নিরালায় হাহাকার করে প্রাণ
সিরাজ পলাশীতে, আর কাশিম বক্সারে নির্মমভাবে হেরে যান।
কাঁদে বাংলা, বিহার ,উড়িষ্যা-এই ছিলো আমার ললাটে
আমার দুঃখ, আমার আলো বাতাসে মীরজাফরেরা বেড়ে ওঠে
আজ আমি সেই স্বর্ণীল আকাশে, বেদনাবিধুর
ক্রন্দনভরা মেঘাচ্ছন্ন দিনলিপির কথা বলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

শতেক বছর পরে আবারো ১৮৫৭ সাল,
দাম্ভিক ব্রিটিশ রাজ,চলে শোষনের কূটচাল
কৃষ্টি ,সভ্যতা, হাজার বছরের এক মিলিত ঐকতান।
সূর্য ,চন্দ্রের আলো সব যে আমারই সন্তান,
১৯০৫ সালে শুরু হয় ভাঙ্গন মাতার অশ্রুজল
আবার মিলিত হয় একি মহীমায় ১৯১২ সাল।
আমার নীলিমায় উড়ে কত দেশী,বিদেশী শকুন-
রক্তলাল হয় কত মাঠ, বোনের কত অশ্র আর ভাইয়ের খুন।
আকাশ নক্ষত্র খচিত হয় কত হাজারো নাম
মুক্তির মন্দিরে বলি হতে থাকে কত ক্ষুদিরাম,
দীপান্তর ঘটে কত মহান বীর সেনানীর , কাঁদে ভাইয়ের প্রাণ
ফাঁসীর মন্চে ঝুলে কত সূর্যসেন,কত সূর্যসন্তান।
কত তিতুমীর, কত শাহ মখদুম, কত পূণ্যমানুষের রক্তপাত
কত বীরের লাল রক্তে ভিজে রক্তের দরিয়া হলো এই ক্ষেত মাঠ।
আমি আজ সেই বীরের শোণিত ধারার কথা বলছি,
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

এরপর হানা দেয় ধর্মের কূটকৌশল, রাজগ্লানি
নীল আকাশে অবিরাম গাঙ্গচিলের গোঙ্গানি
আমি আবারো ভাঙ্গনের ক্রন্দন শুনি
বিবেধের বিষময় শঙ্কচূড় শব্দধ্বনি-
দ্বিখণ্ডিত হই আরেকবার সেতো ১৯৪৭ সাল।
এবার রক্তচোষা ব্রিটিশ বেনিয়ার সম্পদ লুন্ঠন ও প্রস্থান।
১৯৫৮সালে আমার কলঙ্কিত নাম চাপিয়ে দেয়া হয়,
আমি হই ভাগ্য বিড়ম্বিত ইস্ট পাকিস্তান।
শূণ্য হতে থাকে আজন্মলালিত আমার মাতৃত্বের বুক-
সন্তান হারা আমি-শোকে শোকে পাথর হয়ে যাই, মাতম আর শোক।
স্ফীত চর্বির সারমেয় শাবকের দাঁতালো নখরে
৬৮হাজার বর্গমাইলের সবুজ ভূমি কেঁপে ওঠে শকুনের বিষাক্ত আঁচড়ে।
এরপর আমার শস্য, আমার বসতভাটি,আমার উচ্ছ্বাস,
আমার কণ্ঠ ,আমার অধিকার ,আমার সুখ, আমার নিঃশ্বাস,
আমার স্বপ্ন,আমার আহলাদ, আমার কৃষ্টি,আমার তৃষ্ণা,
আমার সভ্যতা,আমার সংগীত,আমার আরতি, আমার জোছনা,
আমার শ্যামলিমা, আমার নদী, আমার ঘাস, আমার হাসি, আমার তিথি,
আমার জীবন,আমার বেড়ে ওঠা, আমার স্বাচ্ছন্দ্য, আমার মাটি
আমার জল ,আমার পাঠাগার,আমার শিল্প,তিলে তিলে লুণ্ঠিত হয়।
আজ আমি সেই জুলুমের ,নিপীড়নের ,নির্যাতনের, বণ্চণার,শোষণের,নিস্পেশণের,ছলনার,কথা বলছি
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

তারপর একদিন এক কালো রাতে আমি দেখলাম-
বুকে আমার বয়ে চলেছে রক্তগংগা অবিরাম।
রক্তাক্ত পদ্মা ,মেঘনা,যমুনা,কুশিয়ারা ,আড়িয়াল খা,
লাশের ভরা নদী, বিরান মাঠ,রক্ত লাল কর্ণফুলী, সুরমা
মৃতের অরণ্যে লাশের পাহাড়,
মূমুর্ষু জোছনা-চারপাশে নিদারুন নিস্তব্ধ ভয়াল অন্ধকার।
আমার সন্তানের লাশের গন্ধে ভারী হলো আমার নিঃশ্বাস।
১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর নেই আর জীবনের আশ্বাস
সেদিন বিজয়ের সেই লগনে আবার আমার নব জন্ম প্রাপ্তি,
শকুন,হায়েনা, ধূর্ত, নরপিশাচের কবল থেকে আমার মহা মুক্তি।
আমি হলাম ধরণীর এক বীর প্রসুতি মা, নেই কোনো সংশয়
পুরো পৃথিবী শুধু অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে রয়।

মায়ের জন্য জীবন দেয়া সেই সব সূর্যসন্তান আজ কোথায় ?
দোয়েলের সুরে,রাখালীর বাঁশীতে,নৌকার পালে, আম্র মুকুলে?
নক্ষত্রালোকিত আকাশে -সোঁদা মাটির সবুজ শ্যামলিমায়?
আজ আমি সেই হারিয়ে যাওয়া চির দীপ্তিমান নক্ষত্রদের কথা বলছি-
তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছো কি?

না,না পারোনি। তোমরা আমাকে এতুটুকু চিনতে পারোনি?
আমার দুঃখ, আমাকে চেনার সেই সূর্যসন্তানেরা আর নেই ।
ওরা আজ পরম শান্তিতে আমার বুকে-
ঘুমিয়ে আছে,
ঘুমিয়ে আছে,
ঘুমিয়ে আছে।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:৩৫

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন: অসাধারণ একটি কবিতা। ++++++++++++++


কবিতায় প্রিয় স্বদেশের ইতিহাস সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আমি সবসময় এমন একটি কবিতার স্বপ্ন দেখতাম।

শুভকামনা জানবেন ভাই।

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৫

খেয়া ঘাট বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ ভাইজান। তবে কবিতাটি আমি প্রথম পেজে প্রকাশ করিনি। নিজের জন্য শুধু আমার ব্লগের পাতায় রেখে দিয়েছিলাম।

২| ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ৭:২৬

হাসান মাহবুব বলেছেন: প্রথমদিকে কাব্যিকতা ভালো ছিলো। কিন্তু মাঝখানে ইতিহাস বয়ান করতে গিয়ে কাব্যভাবে কিছুটা ভাটা পড়েছে। তবে সব মিলিয়ে সুন্দর কবিতা।

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:৫৬

খেয়া ঘাট বলেছেন: কিন্তু মাঝখানে ইতিহাস বয়ান করতে গিয়ে কাব্যভাবে কিছুটা ভাটা পড়েছে।
+++++++++++++++++++++++++++++++++++++++
আপনাকে ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.