নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ভাষাহীন বাবুই

খেয়া ঘাট

ভাষাহীন বাবুই

খেয়া ঘাট › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন

১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:৪৬

"ইতি তোমার ভ্যালেণ্টাইন"

আমাদের সম্রাটের তখন মাথাপাগল বেহাল অবস্থা। দিনরাত তার মনে শুধু যুদ্ধ আর যুদ্ধ। সে চায় পুরা দুনিয়াটা কব্জা করতে। এজন্য তার দরকার বিশাল এক সেনাবাহিনী। কিন্তু সেনাবাহিনীতে কেউ সহজে যোগ দিতে চায়না। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। জীবনের শেষ আছে কিন্তু যুদ্ধের কোনো শেষ নাই। একটা যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই আরেকটার শুরু।জীবন শেষ হয় যুদ্ধতে আর যুদ্ধের যবনিকা ঘটে মৃত্যুতে।
সম্রাট চিন্তা করে বের করলেন- রাজ্যের যুবক ছেলেরা বিয়েশাদী করে, ঘর সংসার করে, বউ বাচ্চা হয়। এজন্য সংসারের প্রতি তাদের মায়া জন্মে যায়। এই মায়া বড় খারাপ জিনিস। মায়ার ফলে তারা আর যুদ্ধে যেতে চায়না। তাছাড়া, যুদ্ধে গিয়ে মারা গেলে তাদের বউ-বাচ্চার কি হবে-এই চিন্তায়ও অনেকে যুদ্ধ এড়িয়ে চলে।

ফলে সবকিছু চিন্তাভাবনা করে মহা বেকুব রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস একদিন ঘোষণা দিলেন- যে বিয়ে করবে তাকে শূলে ছড়িয়ে প্রাণদন্ড দেয়া হবে। নাইসুসের যুদ্ধে বার্বারিয়ানদের পরাজিত না করা পর্যন্ত রাজ্যে সব বিয়ে সাদী নিষেধ।

ব্যাপারটা আমার খুবই উদ্ভট আর জঘন্য মনে হলো।" যে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে চায় সে যুদ্ধে যাবে। যে চায় সংসার ধর্ম পালন করতে সে তা করবে।"এই সত্য, সহজ, সুন্দর কথাটাই গোপনে গোপনে আমি রোমে প্রচার করা শুরু করলাম। যুবকদের খুব মনে ধরলো কথাটি। আর আমি শুধু প্রচার করেই ক্ষান্ত হলাম না। সবাইকে গোপনে একটা বুদ্ধি দিলাম। আমার ঘরের দেয়াল ফাঁক করে -একটা গোপন বাক্স রাখলাম। সেই বাক্সের ভিতর কেউ যদি লাল একটা কাপড়ে দুটো ফুলের কুঁড়ি অথবা দুটো পাতা একসাথে রেখে দেয়-তাহলে বুঝে নিবো-আজ তাদেরকে বিয়ে করাতে হবে। আর বিয়েতে টাকা-পয়সা, খানা-দানা কিছুই লাগবেনা। কোনো মানুষজনও না। শুধু পাত্র- পাত্রী ঠিক সময়ে এসে হাজির হলেই মোমবাতির আলোয় তাদের বিয়ের কাজ সুসম্পন্ন হবে।

বলতে গেলে প্রতিরাতেই একটা-দুটো বিয়ে হতে লাগলো। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরকম একটা দুঃসাহসিক কাজে নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করায় আমার প্রতি যুবক-যুবতীদের এক অভূতপুর্ব ভালোবাসা তাদের হৃদয়ে জন্ম নিলো। এমনি এক নিশিরাত। ঘরের ভিতরে মোমের আলো জ্বলছে। বিয়ের কাজ সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এমন সময় শুনি-বাইরের ঘোড়ার আওয়াজ।কিছু বুঝে ওঠার আগেই সম্রাট ক্লডিয়াসের সৈন্যরা আমার চোখ-হাত বেঁধে ঘোড়ার সাথে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো।

যখন আমার চোখ খোলা হলো। দেখি-এক ছোট নিভু নিভু আলো অন্ধকার ঘরে আমি বন্দি। বুঝতে পারলাম-এটা সম্রাটের জেলখানা।হাত-পা কিছুতেই নাড়াতে পারছিনা। সমস্ত শরীরে অসংখ্য চাবুকের আঘাত। মাথা দ্বিখন্ডিত করে আমার মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা পাঠ করা হলো। চোখ দিয়ে যখন আমার বিরামহীন অশ্রু বইছে ঠিক সে মুহুর্তেই দু চোখের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হলো আগুনে উত্তপ্ত গরম লৌহ দণ্ড।মুহুর্তেই আমার চোখের মনি গলে, পুড়ে অঙ্গার হলো। আমি সাথে সাথেই জ্ঞান হারালাম। পৃথিবী দেখার সৌন্দর্য্য দূরে থাক, একটু মোমের আলোও আর আমার চোখে আসলোনা।ফলে দিন আর রাত আমার সমান হয়ে গেলো।কারাগারের ভিতর দৃষ্টিহীন চোখে আমি মৃত্যুর প্রতীক্ষায় একাকী দিনরাত পার করতে লাগলাম।

একদিন হঠাৎ করে শুণি বন্দী সেলের বাইরে একটা মিষ্টি নারী কন্ঠ। প্রহরীর সাথে কথা বলছে। ওদের কথোপকথনে বুঝতে পারলাম- ওরা দুজন বাপ আর মেয়ে। মেয়েটি-বাপের কাছ থেকে আমার সাথে কথা বলার অনুমতি চাইলো।এরপর থেকেই মেয়েটি প্রতিদিন একবার করে আসে। জেলারের মেয়ে। আমার মন ভালো করে দেয়ার জন্য নানা হাস্য রসের কথা বলতো। ওর একটা আদরের লিলিয়ান ভালোবাসার পাখি আছে আর আছে একটা মহাপাজি বানর। বানরটাকে সে লোহার শিকল দিয়ে বন্দী করে রাখে। চিন্তা করছে একদিন খবিস বানরটার চোখে উত্তপ্ত গরম লৌহ দণ্ড ঢুকিয়ে দেবে।
চুপি চুপি বলে-খবিস বান্দরটার নাম রেখেছে ও "সম্রাট ক্লডিয়াস"।
আমি বলি- আর তোমার আদরের লিলিয়ানের নাম কি রেখেছো?
ওর মিষ্টি হাসি কানে এসে লাগে। বলে- ওর নাম রেখেছি "ভেলেন্টাইন"।

তাছাড়া ও জেলখানার বাইরে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব বলতো। সম্রাট ক্লডিয়াস শীঘ্রই প্লেগে মারা যাবে-সেকথাও বলতো। ওর বাগানে কী সুন্দর সব ফুল ফুটেছে।নানা রঙের পাখীরা ফুলের বাগানে এসে বসে। প্রজাপতি ওড়ে যায়। অনেকগুলো ফুল নিয়ে এসেছে আমার জন্য। সেদিন ওড়তে ওড়তে একটা বুলবুলি পাখীর লাল পালক ওর গায়ে এসে পড়েছে। সেই লাল অদ্ভুত সুন্দর পালকটা ও আমার জন্য নিয়ে এসেছে।
এসব গল্প করতে করতে একসময় ওর চলে যাওয়ার সময় হয়। আমি সেলের বাইরে শেষপদ শব্দ মিলিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত দুকান খাড়া করে থাকি। ও চলে যাওয়ার পর, আবার শুরু হয় অপেক্ষা। ডিয়ানা আবার কখন আসবে। প্রতিদিন ঘুম থেকে ওঠেই আমি আমার দীর্ঘশ্বাস গুণি। গুণে গুণে ১ হাজার হলেই ডিয়ানার পদশব্দ শুণতে পাই। এর কোনো ব্যতিক্রম হয়না। সারাদিনরাতের অপেক্ষার পর ও মাত্র দশমিনিটের জন্য কথা বলার সময় পায়। কিন্তু ঐটুকু সময় মনে হয়-আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। ও চলে গেলেই-শুরু হয় আবার দূর্বিষহ অপেক্ষা।

এখন ডিয়ানা আর আমি ছোট একটা ডিঙ্গি নৌকায় বসে আছি। চাঁদের আলো পড়েছে ওর মুখের ওপর।আহা! কী অপূর্ব শ্বাসত সৌন্দর্য্য। সেই আলোতে দেখি ওর চোখে অশ্রুবিঁদু চকচক করছে। আমি ওর অশ্রুদানাগুলো শার্টের আস্তিন দিয়ে মুছে দেই। ডিয়ানা বলে- আমি কোনোদিন হারিয়ে গেলে তুমি কি আমায় চিনতে পারবে? তুমিতো কোনোদিন আমায় দেখোনি।
আমি বললাম- আমি না দেখলে কি হবে? তুমিতো আমায় চেনো। তুমি আমায় চিনে নিবে। পারবেনা?
ও হাসে। হেসে হেসে বলে- বারে- কণ্ঠ শুণেই আমরা একজন আরেকজনকে চিনে নিবো-বলেই ও আমার হাত দুটো আলতো করে ধরে মুখের ওপর রাখে। আমরা অনন্তকাল পাশাপাশি থাকবো।

এমন সময় দেখি বিরাট আকারের ভয়ঙ্কর একটা হাঙ্গর। বিশাল হা করে এগিয়ে আসছে। পুরো নৌকাটাই যেন মুখে নিয়ে নিবে।হাঙ্গরের দাঁতাল দাঁতগুলো আমার মুখ কামড়ে ধরেছে।আমি দুহাত দিয়ে মুখ ঢাকি। না,হাঙর না, সৈন্যের পায়ের বোট জুতার চাপ পড়েছে আমার মুখের ওপর। ওহ! তাহলে এতোক্ষণ আমি ঘুমের মাঝে একটা ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। আমি চীৎকার দিয়ে ঘুম থেকে ওঠি। সেলের ভিতরে তখন শুনতে পাই আরো অনেকগুলো বোটের শব্দ।

বুঝলাম-আমার মৃত্যুর সময় খুব কাছে চলে এসেছে। ওরা আমাকে টানতে টানতে নিয়ে চলে। হায়! আজকে আর ডিয়ানার সাথে কথা বলা হলোনা।
আমি বললাম- ডিয়ানার সাথে কি একটা শেষ কথা বলতে পারি? এইতো সকালে ঘুম থেকে ওঠার ১ হাজার নিঃশ্বাসের পরপরই ও আসে। তোমরা আমাকে আমার নিঃশ্বাসগুলো গুনার এতোটুকু সময় দাও। দয়া করে ডিয়ানা আসুক। তারপরে আমার মৃত্যু হোক।
ওরা হাসতে হাসতে বলে- তুমি আর সেই সময় পাবেনা।
তবে আমাকে দুলাইন ওর জন্য লিখার সময় দাও।
ওরা বলে- না । তোমাকে কিছুই দেয়া হবেনা।
তবে- অল্পক্ষণের জন্য আমার একটা হাত খুলে দাও ভাই।
জেলে থাকতে থাকতে আমার নখগুলো তখন অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি জানিনা, পৃথিবীতে কেউ এতো সুন্দর করে তার নখগুলো কাজে লাগাতে পেরেছে কিনা। আমি খুব সহজে নখদিয়ে শরীরে একটা অংশ কাটি। রক্ত বের হচ্ছে। এবার, শরীর থেকে নিজের জামাটা খুলে একটা অংশ ছিড়ে ডিয়ানার দেয়া পাখীর পালক রক্তে ভিজিয়ে লিখি-
প্রিয়তমা ডিয়ানা ,
আমি কিছুক্ষণের মাঝে মারা যাবো। আমার মাথা দ্বিখন্ডিত হয়ে যাবে। স্বর্গদুয়ারে তোমাকে আমি প্রথমবার দেখে নিবো।তখন আমার চোখ ভরা আলো থাকবে।সেই চোখের আলোর মাঝে থাকবে তুমি। পাজি বানরটাকে ওযথা মেরোনা।খামোখা ওকে শিকলে বন্দি করে লাভ কি? ওরতো কোনো দোষ নেই।সত্যিকারের সম্রাটরা কখনো বানর হয়না। তবে সত্যিকারের বানররা সম্রাট হয়। ওকে তুমি মুক্ত করে দিও। আর তোমার আদরের ভ্যালেন্টাইন মানে লিলিয়ান পাখিটার যত্ন নিও।
-ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন।

না। ডিয়ানার এই চিঠি কোনোদিনই পড়া হয়নি। ভ্যালেন্টাইন নামক ওর কোনো লিলিয়ান পাখী ছিলোনা। আবার ক্লডিয়াস নামক ওর কোনো পাজি বানরও ছিলোনা। ওর বাবা ওর দেখাশুণা করতেন। খাইয়ে দিতেন, জামা-কাপড় সব পরিয়ে দিতেন।কারণ ডিয়ানা নিজেই অন্ধ ছিলো। বাপের কাছ থেকে বন্দী ভ্যালেন্টাইনের কথা শুণতে শুণতে ডিয়ানা মনে মনে ভ্যালেন্টাইনকে ভালোবেসে কারাগারে আসতো, তার সাথে গল্প করে সুখদুঃখের ভাগী হতো। কারাগারের ছোট প্রকোষ্ঠে ভ্যালেন্টাইনের সময়গুলো আনন্দে ভরিয়ে দেয়ার জন্য ও পৃথিবীর নানা সৌন্দর্য্যের কথাগুলো বানিয়ে বানিয়ে বলতো।


ডিয়ানা আসার অপেক্ষায় দীর্ঘশ্বাস গুণতে গুণতেই মুহুর্তেই আমার মাথা দ্বিখণ্ডিত হয়।রোমের সেন্ট মারিয়া বাসিলিকা চার্চে আমার খুলিটি একটা কাঁচের গ্লাসের ভিতর এখনো সংরক্ষিত আছে। আজো আমি সেদিনের মতো এক হাজারটা দীর্ঘশ্বাস গুনি। আর অপেক্ষায় থাকি,এই বুঝি শুণতে পেলাম অদেখা ডিয়ানার রিনরিনে মিষ্টি কণ্ঠ। আজ কতদিন হয়ে গেলো- আমিও নাই ,ডিয়ানাও নাই। কিন্তু সেরাতের সেই স্বপ্ন যেন সত্যি হলো। আমরা এখনো একসাথে আছি।এই অদ্ভূত ব্যাপারটা খেয়াল করেছেন-আমাদের স্বর্গীয় প্রেমের স্মৃতি স্মরণে পালিত হয় ভ্যালেন্টাইনস ডে।
ভ্যালেন্টাইনের ভি আর ডিয়ানার ডি- এদুয়ে মিলেইতো ভিডে বা ভ্যালেন্টাইনস ডে।

আরিফ মাহমুদ, আটলান্টা
০২/১৪/২০১৬

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ২:২১

হাসান মাহবুব বলেছেন: অতি সুন্দর রূপকথা। নাকি ইতিহাস?

২| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:০৭

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: ইতিহাসের পাঠে রোমাঞ্চ আর প্রেম দুইই উঠে এসেছে। খুব সুন্দর।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.