নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
খৃষ্ঠপূর্ব ৩৯৯ সালে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসকে হ্যামলক বিষ দিয়ে মারা হয়েছিল- এ কাহিনী আমাদের সবার জানা। শোনা যায় নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় জর্জসহ আরো অনেক নামকরা ব্যক্তি আর্সেনিকের বিষে ঘায়েল হয়েছেন। যিশুখৃষ্ঠের মৃত্যুর প্রায় অর্ধশতাব্দি পর রোমান সম্রাট ক্লাউডিয়াসকে তার স্ত্রী একোনাইট বিষসহ মাশরুম খাদ্যের মাধ্যমে হত্যা করেছিল। এরপর পেরিয়ে গেছে বহু যুগ। বিষের ধরনেও এসেছে বিভিন্নতা। বটুলিনাম, সায়ানাইড, মারকারি, পোলোনিয়াম, টেট্রোডোটক্সিন, ডাইমিথাইল-মারকারি, বেলাডোনা, অ্যানথ্রাক্স, বিভিন্ন ধরনের বিষাক্ত গ্যাস প্রভৃতি যুগেযুগে ব্যবহৃত হয়েছে বা হচ্ছে মানুষ মারার কাজে। সম্রাট ক্নাউডিয়াসকে মারার ঘটনা থেকে খাদ্যে বিষ (ভেজাল) মেশানোর আইডিয়া মানুষ (বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ) পেয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে সার্বিক ক্ষতির বিবেচনায় উল্লেখিত বিষের চেয়ে খাদ্যপন্যে ভেজাল আরো অনেক বেশী মারাত্বক। কেননা খাদ্যে ভেজালের মাধ্যমে কোন একজন ব্যক্তি নয় বরং গোটা জাতি তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়। চার, পাঁচ বা ছয়স্তর বিশিষ্ট কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনি বা গ্রীন জোনের মধ্যে থেকেও ভেজালের কবল থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। বাংলাদেশে খাদ্যপন্য উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ ব্যাক্তি সবাই ভেজাল পন্য দ্বারা কোন না কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মৌসুমি ফল, শাক-শবজি, খাদ্যশস্য, শিশুখাদ্য, পানীয়, মুড়ি, বেকারি পন্য, জিলাপি, ফার্স্ট ফুড, পশুখাদ্য, ঔষধ- কোথায় নেই ভেজাল। এ এক ভয়াবহ অবস্থা! অবস্থা এমন যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হলেও ভেজাল খাদ্যপন্যের সুবিস্তৃত জাল থেকে রক্ষা পাবার যেন কোন উপায় নেই।
আমরা কি খাচ্ছি- খাদ্যমিশ্রিত বিষ না বিষমিশ্রিত খাদ্য?
কিছুদিন আগে কলাতে বিষাক্ত কেমিকেল মেশানোর উপর নির্মিত একুশে টিভির একটি প্রতিবেদন দেখে রীতিমত আঁতকে উঠি। নিজ হাতে জমিতে বিষ প্রয়োগরত কর্মচারীর ভাষ্যমতে- “এতো বিষ খাওয়াই বলে…….মন্ত্রী-মিনিস্টার প্রধানমন্ত্রী পর্যন্তও খাচ্ছেন”।
জমিতে চাষ থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত পরতে পরতে মারাত্বক সব বিষ মেশানো হয় কলাতে। অন্যান্য ফল বা শাক-শবজির উপর এরকম বিস্তারিত প্রতিবেদন জানা না থাকলেও ধাঁপে-ধাঁপে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর কেমিকেল মেশানো হয়- এটা অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়। আম, কলাসহ অন্যান্য ফল দ্রুত পাঁকানো ও আকর্ষনীয় রংয়ের জন্য কার্বাইড এবং পচন রোধে ফরমালিন ব্যবহার হয়। মৃত মাছ ও দুধে মেশানো হয় ফরমালিন। সম্প্রতি জীবিত মাছেও ফরমালিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। পোকারোধে শুটকি মাছে ব্যবহার হয় ক্ষতিকর ডিডিটি। শাক-শবজিতে কীটনাশক ও ফরমালিন দেওয়া হচ্ছে। মুড়িকে ধবধবে সাদা ও আকারে বড় করার জন্য বিষাক্ত হাইড্রোজ ও ইউরিয়া মেশানো হচ্ছে। দীর্ঘক্ষন মচমচে রাখার জন্য জিলেপি ও চানাচুর তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে পোড়া মবিল। আকর্ষনীয় করার জন্য কাপড় ও চামড়ায় ব্যবহৃত রং ব্যবহার হচ্ছে সস্তা মানের আইসক্রিম, বিস্কুট, সেমাই, নুডলস এমনকি মিষ্টি তৈরিতে। বাজারে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত ও নামকরা কোম্পানীর বিভিন্ন ফলের জুস পাওয়া যায় যার বাহ্যিক রং দেখলেই মনে সন্দেহ-ভয় জাগে হয়ত তাতে ভেজাল রয়েছে। জানা যায় আজকাল লবনেও ভেজাল হিসেবে মেশানো হচ্ছে বালু, বিভিন্ন ধরনের মশলার সাথে মিল করে মেশানো হচ্ছে ভুসি, কাঠের গুড়া, বালি বা ইটের গুড়া। নিত্যপ্রয়োজনীয় চাল, ডাল, ভোজ্যতেল ইত্যাদিও ভেজালের আওতামুক্ত নয়। কমলা বা মাল্টার স্বাদই পরিবর্তন হয়ে যায় বিষাক্ত কেমিকেলের জন্য। অনেক সময় দেখা যায় কমলা বা মাল্টা খেলে ঠোঁট জ্বালা করে ও লাল হয়ে ফুলে যায়। বিষাক্ত কার্বাইডের জন্য এরকম হয় বলে জানা গেছে। ফলের দোকানে সাজানো আঙ্গুর দেখলে খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু একটু খেয়াল করলে দেখা যায় কেমিকেলের প্রভাবে আঙ্গুরের ভেতর পর্যন্ত রং পরিবর্তন হয়ে গেছে। অবস্থা এমন যে পঁচা আঙ্গুর খুজে পাওয়া মুসকিল। বাজারের সুদৃশ্য টমেটোর ক্ষেত্রেও অনেক ক্ষেত্রে একই অবস্থা। ফরমালিন মেশানো চিনিযুক্ত রসালো ফলে মাছি বসে না। তাই বলে মাছি বসলেই ফরমালিন দেওয়া নেই এটা এখন নিশ্চিত করে বলা যায় না। শোনা যায় ফরমালিন মিশ্রিত ফল বা অন্যান্য খাদ্যপন্যের উপর মধুর প্রলেপ দেয়া হয় মাছি আকৃষ্টের জন্য। বাজার থেকে কোন ফল কিনে বাসায় রেখে দিলে কয়েকদিনের মধ্যে পঁচে নষ্ট হওয়ার কথা থাকলেও তা নষ্ট হয় না বলে অনেকের মুখে শুনেছি। দোকানে দেখা যায় আমসহ অন্যান্য ফল শুকিয়ে কুঁচকে যায় তবুও কোন এক যাদুর গুনে তা পঁচে না। এ সবই ফরমালিনের কারিশমা। ভেজালের ব্যপ্তি যেন বলে শেষ নেই।
ফল পাঁকার মূলনীতি ও বাংলাদেশে যা করা হয়
ফল পাঁকার জন্য ইথিলিন নামক গাছের নিজস্ব এক প্রকার হরমোন প্রধান ভূমিকা রাখে। গত শতকের শুরুর দিকে প্রথম ইথিলিনের অস্তিত্ব জানা যায়। ফল পাঁকা ও পাতা ঝরার সময় গাছের কান্ড, মুল, পাতা, ফুল, ফলসহ অন্যান্য অংশে ইথিলিন তৈরি স্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায় যার প্রভাবে ফলের অভ্যন্তরে থাকা বেশ কিছু এনজাইম সক্রিয় হয়ে ওঠে- এর মধ্যে অ্যামাইলেজ, হাইড্রোলেজ এবং পেকটিনেজ অন্যতম। এনজাইমগুলোর কোনটা ফলকে নরম করে, কোনটা রং পরিবর্তন করে আবার কোনটা মিষ্টি, সুস্বাদু বা সুগন্ধির জন্য দায়ী। অ্যামাইলেজ ফলের ত্বক নরম করে ও ফলের মাংসে থাকা জটিল শর্করাকে ভেঙ্গে সরল চিনিতে পরিনত করে যার ফলে পাঁকলে ফল খেতে মিষ্টি লাগে। আমরা জানি ক্লোরোফিলের রং সবুজ যে কারনে কাঁচা ফল সবুজ দেখায়। হাইড্রোলেজ অ্যানজাইম সবুজ ক্লোরোফিলকে ভেঙ্গে এ্যানথোসায়ানিনে রুপান্তরিত করে যার কারনে পাঁকা ফল আকর্ষনীয় লালচে, হলদে বা কমলা রং ধারন করে। তাছাড়া এ অ্যানজাইম ফলের মধ্যে সুগন্ধি যৌগ তৈরি করে বিধায় পাঁকা ফল হতে মন মাতানো সুগন্ধ ছড়ায়। কাঁচা ফলে পেকটিন নামক এক প্রকার পদার্থ প্রচুর পরিমানে থাকার কারনে তা পাঁকা ফলের তুলনায় শক্ত হয়। পেকটিনেজ এনজাইম কাঁচা ফলের পেকটিনকে কমিয়ে দেয় ফলে পাঁকা ফল নরম ও কমল হয়। কাজেই ইথিলিনের কম বেশীর সাথে ফলের পাঁকা না পাঁকার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। আর ফল পরিপক্কতার সাথে সম্পর্ক রয়েছে ইথিলিন ও উল্লেখিত এনজাইমগুলোর পরিমানের। অপরিপক্ক অবস্থায় গাছ থেকে ফল পেড়ে কৃত্রিমভাবে পাঁকালে তার রং, স্বাদ কোনটাই আশানুরুপ হয় না। বাজারে কলাসহ বিভিন্ন ফল পাওয়া যায় যার ভেতরে একাংশ নরম তো অন্য অংশ শক্ত এবং স্বাদে বিশ্রী। অপরিপক্ক অবস্থায় ফল পেড়ে কেমিকেল বিশেষ করে কার্বাইড দিয়ে পাঁকানোর কারনে এরকম হয়। জানা যায়- ফলের আড়তে কার্বাইডের পুটলি রেখে বা কার্বাইড মিশ্রিত দ্রবনে চুবিয়ে বা অনেক ক্ষেত্রে স্প্রে করে কৃত্রিমভাবে ফল পাঁকানো হয়।
কৃত্রিমভাবে ফল যেভাবে পাঁকানো উচিৎ
কৃত্রিমভাবে ইথিলিন ব্যবহার করে ফল পাঁকানোর রীতি শুধু বাংলাদেশে নয় সমগ্র বিশ্বে প্রচলিত। বিশেষ করে যে সমস্ত দেশ অন্যদেশ থেকে ফল আমদানী করে তাদেরকে ইথিলিন ব্যবহার করে ফল পাঁকাতে হয় কারন পাঁকা ফল একদেশ থেকে অন্য দেশে নিলে নষ্ট হয়ে যায়। পার্থক্য হলো- আমাদের দেশে অপরিপক্ক ফলে ইথিলিন বা কার্বাইড দিয়ে পাঁকানো হয় আর উন্নত বিশ্বে নিয়ম মেনে পরিপক্ক ফল পাঁকানো হয়। পরিপক্ক ফল পাঁকাতে একটি বদ্ধ কক্ষে সাধারনত ৫০০ থেকে ২০০০ পিপিএম ইথিলিন ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা ব্যবহার করা যথেষ্ঠ। ইথিলিনের ব্যবহারে অনুমতি থাকলেও কোন অবস্থায় অনুমতি নেই কার্বাইড বা ফরমালিন ব্যবহারে। বাংলাদেশের মত বিশ্বের প্রায় সব দেশেই ফল পাঁকাতে কার্বাইডের ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ। তাছাড়া বানিজ্যিকভাবে বাজারে প্রাপ্ত কার্বাইড বিশুদ্ধ নয়। ভেজাল হিসেবে এর সাথে কিছু পরিমান আর্সেনিক ও ফসফরাস থাকে ফলে সুস্বাস্থ্যের জন্য সে কার্বাইড আরো অনেক বেশী ক্ষতিকর।
ভেজাল খাদ্য খেয়ে আমরা যেভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছি
বিষাক্ত কেমিকেলযুক্ত খাদ্য খেয়ে আমরা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি। রয়েছে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি ভয়ঙ্কর প্রভাব। গর্ভবতী মা ও শিশুরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বেশী। বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন রোগ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিষাক্ত কেমিকেল শরীরে স্থায়ী স্ট্রেসের সৃস্টি করে। কেমিকেলযুক্ত খাদ্যের দরুণ নষ্ট হচ্ছে আমাদের শরীরের অত্যবশ্যকীয় অঙ্গ যেমন- লিভার, কিডনি, হৃৎপিন্ড, ফুসফুস, চোখ, কান ইত্যাদি। আক্রান্ত হচ্ছি বিশেষ করে লিভার ক্যানসার, লিভার সিরোসিস, ব্লাড ক্যানসার, কিডনি ফেইলুর, হৃদরোগ, অ্যানিমিয়া ইত্যাদি রোগে। খাদ্যে অরুচি, ক্ষুধামন্দা, গ্যাস্ট্রিক আলসার, পাকস্থলী-অন্ত্রনালির প্রদাহ ইত্যাদি এখন নিত্যনৈমিত্বিক সমস্যা। বন্ধাত্ব, অ্যাবোরসন, হাবাগোবা বা বিকলাঙ্গ সন্তানের জন্ম হওয়া, সন্তানের বৃদ্ধি ব্যহত হওয়াসহ নানাবিধ সমস্যার জন্য ভেজাল খাবার একটি অন্যতম কারন। গবেষনায় জানা যায়, খাদ্যে ভেজালের কারণে দেশে প্রতিবন্ধি শিশুর সংখ্যা দিনদিন বাড়ছে। মারাত্বক এসব রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করেও লাভ হয় না। অকারণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে চিকিৎসার প্রয়োজনে। কাজেই জনস্বাস্থ্যের মারাত্বক ক্ষতির পাশাপাশি ব্যপক চাপ বাড়ছে অর্থনীতির উপর। ভালোমানের চিকিৎসার ব্যয়ও ক্রমেই বাড়ছে। এমতাবস্থায় অর্থাভাবে ভাল চিকিৎসায় অক্ষম মধ্যবিত্ত বা দরীদ্র মানুষের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
আইন ও ভেজাল বিরোধী অভিযান ও তা পুরাপুরি কার্যকর না হওয়ার কারন
বাংলাদেশে খাদ্য সংশ্লিষ্ট প্রায় ১৭টি আইন আছে। নিরাপদ খাদ্য অধ্যাদেশ ২০০৫ অনুযায়ী সব ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক উপাদান (যেমন- ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, ইটেফন, কীটনাশক) খাদ্যে ব্যবহার নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৭২ ও ২৭৩ ধারামতে- খাদ্যে ভেজাল মেশানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার অপরাধে মৃত্যুদন্ডেরও বিধান আছে বলে জেনেটি কিন্তু সে আইন কখনো কারো উপর প্রয়োগ করা হয়েছে এমন শোনা যায়নি। সম্প্রতি ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ নামে একটি আইন পাশ হয়েছে যাতে সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সাজা ও ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এটি একটি ভোক্তাবান্ধব পদক্ষেপ। পত্রিকার সূত্রমতে, ২০০৪ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত নির্বাহী মেজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে ১০ হাজারের বেশী ছোটবড় ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয়েছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা, ৪ হাজারেরও বেশী ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাঁজা দেওয়া হয়েছে। তারপরও দিন দিন ভেজালের ব্যপ্তি বাড়ছে। শোনা যায় শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারনে ভেজাল বিরোধী অভিযান অনেক সময় বন্ধ হয়ে যায়। সাহসী মেজিস্ট্রেট রোকন-উদ-দৌলার কথা আমরা সবাই জানি। তাকে যখন নিস্ক্রিয় করে রাখা হলো তার চোখের অশ্রু আজো অনেকের মনে পড়ে। কাজেই এটা পরিস্কার যে, শুধু আইন করে খাদ্যপন্যে ভেজাল রোধ করা সম্ভব নয়।
বিষাক্ত কেমিকেলের প্রতি সাধারণ মানুষের কনসেপ্ট বা বদ্ধমূল ধারণা
ফল পাঁকার মূলনীতি না জানলেও যুগ যুগ ধরে গ্রামগঞ্জে বিভিন্নভাবে ফল পাঁকানো হয় যা স্বাস্থ্যসম্মত। ছোটবেলায় দেখতাম বড় কোলা, ভুসি বা তুলার মধ্যে কলা, বেল, আম, আঁতা, ছবেদা ইত্যাদি ফল রেখে পাঁকানো হতো। কখনো দেখতাম কলার কাধি বা ছড়া গর্তের ভেতর খড়ের উপর একত্র করে চারপাশ ও উপরে আবারো খড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। কয়েকদিন পর পাওয়া যেত সুস্বাদু ফল। এ ধরনের পদ্বতিতে ইথিলিনের যে কতবড় ভূমিকা রয়েছে তা তাদের জানা না থাকলেও পূর্ববর্তী বংশধরদের কাছ থেকে তারা সঠিক পদ্বতিই শিখেছিল। যুগের সাথে পাল্টেছে পদ্বতিরও। আশ্চর্যের বিষয় প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখন মানুষ নিজেদের অজান্তে খাদ্যে ভেজাল মেশাচ্ছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে না জেনে বিষাক্ত কেমিকেলকে ক্ষতিকারক না ভেবে বরং উপকারী জিনিস হিসেবে বিবেচনা করে ভুল করছে। তাদের ভাষায়- এটা মেডিসিন বা ঔষধ। রোগ সারাতে মেডিসিন বা ঔষধ লাগে সূতরাং এটা খারাপ হয় কিভাবে! দেখা যায় তারা নিশ্চিন্তে এগুলো ব্যবহার করছে। ছোট আকারের এক বোতল ফরমালিন মেডিসিন হিসেবে এক ড্রাম পানিতে মিশিয়ে তাতে চুবিয়ে বাজারজাত করছে তাদের উৎপাদিত পটল, করলাসহ অন্যান্য শবজি। কাজটা একবার করতে পারলেই তারা নিশ্চিত হয় যে তাদের পন্য আর পঁচবে না। এগুলোর ব্যবহারে কি ধরনের ক্ষতি হতে পারে এ ব্যপারে অনেক ক্ষেত্রেই তারা ওয়াকেবহাল নয়। অনেক ক্ষে্ত্রে তারা জানেও না কি মেশাচ্ছে শাক-শবজি বা ফলে। গ্রামের নিরীহ মানুষ অনেক ক্ষেত্রে না জেনে ক্ষতিকর কেমিকেল মেশালেও বিভিন্ন আড়তের ঘটনা একেবারেই উল্টো। সেখানে এগুলো মেশানো হয় অনেকটা জেনে-বুঝে। জানা যায়, অতি মুনাফা লাভের আশায় বিবেক বিবর্জিত হয়ে অসাধু আড়ৎদাররা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মৌসুমি ফল বা কাঁচা শবজি যেমন টমেটো, করলা ইত্যাদি সস্তা দামে কৃষক বা বাজার থেকে কিনে কার্বাইড দিয়ে পাঁকিয়ে তাতে পচনরোধক ফরমালিন ব্যবহার করে গুদামজাত করে থাকে। পরে ধীরে ধীরে চড়াদামে বাজারে বিক্রি করে। তাদের ভাষায়- ফরমালিন একটি প্রিজারভেটিভ।
কীটনাশকের রেসিডুয়াল ইফেক্ট
গত বছর দিনাজপুরে লিচু খেয়ে ১৫ শিশুর মৃত্যুর খবর বেশ আলোড়ন তুলেছিল। শিশুমৃত্যুর কারন আমরা অনেকেই জানি। জানা গেছে কীটনাশক প্রয়োগের সাথে সাথেই বিষযুক্ত লিচু খেয়ে শিশুগুলোর মৃত্যু হয়েছিল। যে বিষয়টা গুরুত্ব দিযে জানতে হবে তা হলো- রেসিডুয়াল ইফেক্ট। উন্নত বিশ্বে প্রচুর পরিমানে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়- এটা সত্য। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হচ্ছে না এর কারন তারা রেসিডুয়াল ইফেক্ট এর নিয়ম মেনে ফল বা শাক-শবজি বাজারজাত করে থাকে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে- কীটনাশক প্রয়োগের এক সপ্তাহ পর ফল বা শাক-শবজি ভালোমত ধুঁয়ে খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে অনেক ক্ষেক্রেই কীটনাশক স্প্রে করে সাথে সাথে বাজারে বিক্রির জন্য নেওয়া হয় বা বাজারে নেয়ার পরও স্প্রে করা হয়। দেখতে টাটকা তাই কেমিকেলমুক্ত ভেবে আমরা ভুল করি। স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ এসব শবজি আমরা ভালো মনে করে কিনছি, খাচ্ছি, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে খাওয়াচ্ছি। তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছি নিশ্চিত ভয়াবহ পরিনতির দিকে।
প্রযুক্তির উন্নয়ন ও প্রয়োজনীয়তা
যুগে যুগে মানুষের প্রয়োজনে প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়েছে জীবনকে আরো সুন্দর ও সহজ করার জন্য। কৃষক, পাইকারী-খুচরা বিক্রেতা, আড়ৎদারদের মধ্যে নতুন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠা বা ইনস্টলেশনের ক্ষেত্রে দুটি দিক বিবেচ্য। প্রথমত- যদি কোন প্রযুক্তি আদৌ না থাকে তাহলে নতুন প্রযুক্তি আয়ত্ব করানো্ খুব সহজ। দ্বিতীয়ত- পূর্বে থেকে যদি কোন প্রযুক্তি ব্যবহার চালু থাকে তাহলে তার স্থলে নতুন প্রযুক্তি চালু করতে হলে তা অবশ্যই পদ্বতি, সময়, মুনাফা সর্বোপরি জনস্বাস্থ্যের বিবেচনায় পূর্বের প্রযুক্তির চেয়ে ভালো হতে হবে। কোন প্রযুক্তি একবার ব্যবহার করে মজা পেলে তা ছাড়া মানুষ আর চলতে পারে না উপরন্তু ভালো প্রযুক্তির আশা করে। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর হলেও ফরমালিন বা কার্বাইডকে প্রযুক্তি বলেই কৃষক-পাইকার-খুচরা বিক্রেতা-আড়ৎদারদের কাছে বিবেচিত হয়েছে কেননা এর ব্যবহারের মাধ্যমে তারা বেশী আয় করতে পারছে ও বাঁচতে পারছে লোকসানের হাত থেকে। এ অবস্থায় নতুন ও সার্বিক বিবেচনায় ভালো প্রযুক্তির প্রয়োজন। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে নতুন খাদ্য সংরক্ষন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি ক্ষেত্র বিশেষে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা যেতে পারে। যে কোন ভাবে ইথিলিন তৈরি হওয়ার মাত্রা নিয়ন্ত্রন করা গেলে ফল বা ফলজাতীয় শবজি কাঁচা রাখার সময়কাল বাড়ানো সম্ভব। সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে- এলইডি (লাইট ইমিটিং ডায়ড) টেকনোলজির মাধ্যমে নির্দিষ্ট রং এর আলো (নীল রং) ব্যবহার করে টমেটোর সবুজ থাকার স্থায়িত্ব বেশ কিছুদিন বাড়ানো সম্ভব। এলইডি এর মত উচ্চপ্রযুক্তি কৃষকদের জন্য সহজলভ্য করা না গেলেও নীল রঙের পলিথিন দিয়ে ঢেকে রেখে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে।
খাদ্যে বিষাক্ত কেমিকেল সনাক্তকরণ ও ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর উপায়
খাদ্যে নিষিদ্ধ ফরমালিন বা কার্বাইডের উপস্থিতি পরীক্ষার উপকরন সহজলভ্য করা জরুরী। সারাদেশে বর্তমানে মাত্র ৮৭ টি ফরমালিন সনাক্তকরণ ‘কিটবক্স’ রয়েছে- যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগন্য। জরুরী ভিত্তিতে এ সুবিধা আরো অনেক বেশী বিস্তৃত করা দরকার। সম্প্রতি খাদ্যদ্রব্যে ফরমালিনের অস্তিত্ব পরীক্ষায় এক অসাধারন সাফল্য পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউটের (বারি) গবেষক ফারুক বিন হোসেন ইয়ামিন- এটা একটি আনন্দের সংবাদ। মাত্র ৫ সেকেন্ড সময়ে ও নামমাত্র মুল্যে ফরমালিনের অস্তিত্ব নির্ণয় করা সম্ভব তাঁর উদ্ভাবিত পদ্বতিতে। জাতীয়ভাবে এ ধরণের পদ্বতি সবার জন্য সহজলভ্য করা গেলে ভোক্তারা দারুণ উপকৃত হবে। খাদ্যে ফরমালিনের উপস্থিতি নির্ণয় করে তা পরিহার করার পাশাপাশি সাধারণ কিছু নিয়ম মেনে চললে ফরমালিনের হাত থেকে অনেকটা বাঁচা সম্ভব। মৌসুমি ফল অন্য মৌসুমে খাওয়া থেকে বিরত থাকা যেতে পারে। খোলাবাজার থেকে কাটা ফল যেমন আনারস, পেঁপে ইত্যাদি না খাওয়াই ভালো। ফল বা ফলজাতীয শবজি রান্নার আগে খোসা ফেলে দেওয়া ভালো। রান্নার আগে মাছ বা শাক-শবজি এবং খাওয়ার আগে ফল কিছুক্ষণ পানিতে ভিজিয়ে রেখে প্রবাহমান পানি দিয়ে ভালো মত ধুয়ে রান্না করা বা সরাসরি খাওয়া যেতে পারে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে লবনাক্ত পানিতে ফরমালিন দেওয়া মাছ ১ ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলে ৯০ ভাগ পর্যন্ত ফরমালিন কমে যায়। ভিনেগার মিশ্রিত পানিতে (১:৯ অনুপাতে) ফরমালিন মেশানো মাছ ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে শতভাগ পর্যন্ত ফর্মালিন দূর করা সম্ভব। শাক-শবজির ক্ষেত্রেও একই পদ্বতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
সার্বিকভাবে ভেজালরোধে করণীয়
সন্দেহাতীতভাবে খাদ্যে ভেজাল একটি জাতীয় সমস্যা, জাতীয় বিপর্যয়- এটা আমাদের সবাইকে বিশেষ করে নীতি নির্ধারকদেরকে সর্বাগ্রে সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে হবে। ফল পাঁকার মূলনীতিকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তা পাঁকানোর সহজ পদ্বতি উদ্ভাবন ও তার ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে হবে। গ্রামবাংলার শত বছরের অভিজ্ঞতাকে বানিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করা যেতে পারে। এজন্য জরুরী ভিত্তিতে ব্যপক গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।
শুধু কঠিন থেকে কঠিনতম আইন পাশ করলেই চলবে না প্রয়োজন তার যথাযথ বাস্তবায়ন। সাথে সাথে প্রয়োজন ব্যপক জনসচেতনতা। অস্বাধু ব্যবসায়ী বা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে এবং তাদেরকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি সুনিশ্চিত করতে হবে এবং তা গনমাধ্যমে ব্যপকভাবে প্রচার করতে হবে। গ্রামবাংলার আপামর জনসাধারণ থেকে শুরু করে শহরের উচ্চশিক্ষিত সবাইকে ব্যপক দ্রুততম সময়ে ব্যপক প্রচার-প্রসার বা অভিযানের মাধ্যমে সচেতন করতে হবে। সরকারী, বেসরকারী, এনজিও প্রতিষ্ঠান সবার সমন্বয়ে বছরে এক বা দুইবার নিরাপদ খাদ্য সপ্তাহ বা পক্ষ পালন করা যেতে পারে। একাজে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদেরকে ব্যবহার করা যেতে পারে এতে করে একদিকে তারা নিজেরা সচেতন হবে অন্যদিকে সমাজের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মনে করে সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে নাটক, সিনেমা, বাউল-সংগীত, আলোচনা ইত্যাদির আয়োজন করা এবং তা ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় ব্যবক প্রচারের ব্যবস্থা করা, মাইকিং করা, সাথে সাথে পত্রিকা, ম্যাগাজিন, লিফলেট, পোস্টার, ফোল্ডার ইত্যাদি প্রকাশের মাধ্যমে সবাইকে সচেতন করা যেতে পারে। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ কাজে নিয়োজিত সবাইকে অন্য অনেকের চেয়ে বেশী প্রেরণাদ্দিপ্ত (মটিভেটেড) হতে হবে।
কৃষক থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ঠ সবার স্বার্থের দিকটাও দেখতে হবে। জোর জবরদস্তি বা শুধু আইন করে তাদেরকে ভেজাল না মেশাতে বাধ্য করলে ক্ষনিকের জন্য কিছুটা সফলতা পাওয়া গেলেও স্থায়ীভাবে ভাল ফল পাওয়া সম্ভব নয়। মাঝে মধ্যে দু’একটি ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে, সাজা দিয়ে বা জরিমানা করলে চলবে না। এতে করে যা হবার তাই হয়। অভিযান শেষ হলে আবার আগের মত চলতে থাকে- এর সত্যতা আমরা সচক্ষে দেখছি। বাস্তবতাকে স্বীকার করে তাদেরকে বিকল্প পথ বাতলে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। গ্রামের মানুষের মধ্যে থাকা ভ্রান্ত কনসেপ্ট বা বদ্ধমুল ধারনা সরানোর মাধ্যমে তাদেরকে সচেতন করে তুলতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নসহ খাদ্যপন্যের প্রবাহ দেশের মধ্যে ত্বড়িৎ ও বাঁধাহীন করতে হবে। সংশ্লিষ্ট সবার মাঝে আত্ববিশ্বাস জন্মাতে হবে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে কৃষক বা আড়ৎদার তাদের উৎপাদিত পন্য বাজারে ন্যায্য মুল্যে বিক্রি করতে পারলে তাদের মধ্যে আত্ববিশ্বাস জন্মাবে। কার্বাইড বা ফরমালিন না মিশিয়েও যদি লাভ করা যায় তাহলে হয়ত তারা একাজ করবে না। সরকারী-বেসরকারী উদ্দোগে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে উৎপাদন করে ফল, শাক-শবজি, মাছ-মাংশ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে সবার মধ্যে আত্ববিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে।
খাদ্য উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত ব্যক্তি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, রাজনীতিবিদ, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, গবেষক- সবাই এ বিপর্যয়কে নিজেদের জীবন-মরণ সমস্যা মনে করলে খুব সহজেই সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভেজাল সম্পর্কিত দূর্নীতিকে অবশ্যই ‘না’ বলতে হবে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত সিন্ডিকেটকে তাদের নিজেদের ও বৃহত্তর স্বার্থে ভেঙ্গে দিতে হবে। উল্লেখযোগ্য হারে আঞ্চলিক পর্যায়ে আধুনিক খাদ্য সংরক্ষনাগার নির্মাণ ও তার ব্যবহার সহজলভ্য করতে হবে যাতে করে কৃষক থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, আড়ৎদার সবাই সহজে ও কম খরচে সে সুবিধা নিতে পারে। যেহেতু খাদ্য মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম এবং সবার স্বার্থ জড়িত তাই এক্ষেত্রে সরকারীভাবে যথাসম্ভব সাবসিডি দেওয়া যেতে পারে। খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বাজারজাতকরণ প্রভৃতি কাজে যারা সরাসরি জড়িত তাদেরকে বিশেষ-ট্রেনিং এর মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। তাদেরকে সর্বোচ্চ সচেতন করে তুলতে হবে। কৃষিজাত পন্যে ভেজাল মনিটরিং করার জন্য ইউনিয়ন পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তার সংখা বাড়ানো যেতে পারে। পাশাপাশি থাকবে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মোবাইল কোর্ট যাতে যে কোন সময় বিনা নোটিশে বাজারের খাদ্যপন্য পরীক্ষা করে তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়।
আমার জানামতে, কোন ধর্মেই অপরকে দুরে থাক নিজের উপর জুলুম করার অনুমতি নেই। একটি ছোট্ট ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) একবার খাদ্য বিক্রেতার গৃহে গিয়ে খাদ্যপণ্যের বস্তায় তার নিজ হাত ঢুকিয়ে দিয়ে আর্দ্রতা অনুভব করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, ভেজা কেন? বৃষ্টিতে ভিজে গেছে- বিক্রেতার উত্তর। এরপর তিনি হাত বের করে বললেন- আপনি কেন আর্দ্রতামিশ্রত খাদ্য বস্তার ওপরের অংশে রাখলেন না যাতে লোকজন তা সরাসরি দেখতে পায়? এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- যে ব্যক্তি আমাদের সঙ্গে ভেজাল করে সে আমাদের সম্প্রদায়ভুক্ত নয়। কাজেই ধর্মীয় অনুশাসন ও শিক্ষা হতে পারে একটা উৎকৃষ্ট সমাধান কেননা সবখানে সৃষ্টিকর্তার নজর রয়েছে এমন বদ্ধমুল ধারনা থাকলে কেউ ভেজাল দিতে পারবে না। নিজেই নিজের পাহারাদার হয়ে যাবে।
সর্বোপরি প্রাইমারি ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে ভেজাল সম্পর্কিত শিক্ষা ও সচেতনতামূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। নৈতিকতার চর্চায় তাদেরকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। মিনা কার্টুন বা জনপ্রিয় অন্য কার্টুনের মাধ্যমে স্কুলপড়ুয়া শিশু থেকে শুরু করে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
শেষকথা
ভয়াবহ এ বিপর্যয় সম্পর্কে দরকার সত্যিকারভাবে ব্যপক প্রচার-প্রসার, জনসচেতনতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ কিন্তু দৃঃখজনক হলেও সত্য যে কাঙ্খিতপর্যায়ে আমরা তা করতে পারিনি। এটা সত্য জনসচেতনতা কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন। ক্ষুধার যন্ত্রনায় যখন একটি শিশু কাঁদে তার মুখে ফিডারভর্তি দুধ দিয়ে কান্না থামাতে পারলেই আমরা স্বস্তিবোধ করি। দুধ কোথা থেকে আসলো বা কি মেশানো আছে তা অনেক সময় ভাবার সময় থাকে না। যে কোন ভাবেই হোক উদর পূর্তি করাই যেন আমাদের মুল লক্ষ্য। ইংরেজীতে একটা কথা আছে- ‘Medicine is not healthcare rather than sickcare. Food is healthcare.’ কাজেই সুস্থ থাকার জন্য ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্যের কোন বিকল্প নেই। ভেজাল খাবার খেয়ে তাৎক্ষনিকভাবে এর ক্ষতিকর প্রভাব বুঝতে পারি না বলেই আমরা বিষয়টাকে তেমন গায়ে লাগাতে চাই না বা অগ্রাধিকারের দিক দিয়ে অনেক পেছনে রাখি। অনেকেই মনে করি আমার তো কিছু হচ্ছে না বরং লাভ হচ্ছে অন্যের কি হলো তাতে আমার কি? আমরা দিন দিন বড় বেশী আত্বকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। আমাদেরকে সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে হবে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে খাদ্যে ভেজালের বিস্তৃত জাল থেকে আমরা কেউ রেহাই পাবো না, পাবার নয়। এমনকি যারা নিজ হাতে ভেজাল মেশায়, বিভিন্ন ক্ষতিকর কেমিকেল বা কীটনাশক ব্যবহার করে, তারাও না। আমাদের চিরাচরিত স্বভাব হচ্ছে- চোখের সামনে দিয়ে পাঁচ টাকা চলে গেলে সহ্য করতে পারি না অথচ অন্তরালে আমাদের কিডনি, লিভার, ফুসফুস, চোখ বা অন্যান্য অমূল্য সম্পদ চলে যাচ্ছে। এ অবস্থায় সবাইকে খাদ্যে ভেজালের ভয়াবহ পরিনতি অনুধাবন করার পাশাপাশি এর ব্যপ্তি ও কারন সম্পর্কে সর্বোচ্চ সচেতন হতে হবে। সাথে সাথে সম্ভাব্য প্রতিকারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। যে কোন মূল্যে ক্রমেই মেধাশুন্য হওয়া থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।
লেখক:
ড. কেএইচএম নাজমুল হুসাইন নাজির
সহযোগী অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি ও হাইজিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।
বর্তমানে গবেষক, ইয়াংনাম ইউনিভাসিটি, সাউথ কোরিয়া।
বিঃ দ্রঃ ফেসবুক হতে কপি-পেস্ট করা।
১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:০৪
সরকার আলী বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকেও।
কিন্তু অতীব দূঃখের বিষয় হলো জাতীর কান্ডারীদেরও বুঝি এ ব্যাপারে কোন মাথাব্যথা নাই। ভেজাল খাদ্যের কুপ্রভাবে যে মানুষের genetic potentiality কমে যায় সব চিন্তা-কর্মে আমরাই তার প্রমাণ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:২৪
অর্থনীতিবিদ বলেছেন: চমৎকার কার্যকরী একটি পোস্ট শেয়ার করার জন্য আমার আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।