![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।
আমার জন্ম আশির দশকে টাঙ্গাইলের কালিহাতি থানার দুর্গাপুর ইউনিয়নের কদিম-হামজানি গ্রামে। আমার গ্রামের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা নদীর শাখা নদী। মুল যমুনা নদীটা আমার গ্রাম থেকে ছয় কিলোমিটার দুরে। বাড়ির আঙিনায় পুকুর ঘাট। পুকুর পাড়ে দাদা দাদির হাতে লাগানো স্বদেশি নানান ফলের গাছ। বাড়ির সীমানার পেরলেই সমতল কৃষি জমি। গ্রীষ্মকালে, চাঁদের আলোয় ভরা রাতে আমি আর দাদা আমাদের ঘরের বারান্দায় ঘুমাতাম। দাদা আমাকে নবীদের কাহিনী শুনাতেন। একদিন শুনিয়েছিলেন হাতেম তাইয়ের কথা।
আমার দাদা শিক্ষিত ছিলেন না। দাদার পেশা ছিল কৃষি কাজ। সকালে দাদা গরু নিয়ে কৃষি কাজ করতে মাঠে যেতেন। আমি দাদার সাথে শৈশবে কৃষি কাজ দেখতে মাঠে যেতাম। মনেপড়ে, একদিন জোর করে গরু দিয়ে জমি হাল দেয়ার মইয়ে চড়ে ছিলাম। তারপর যথারীতি, মই থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। তখন আমাদের একমাত্র ঔষধ ছিল দূর্বা ঘাসের রস। দাদা আমাকে মন্ত্র পড়ে দূর্বা ঘাসের রস পায়ে মেখে, ঝাড়-ফুঁক দিয়েছিলেন। আমার ব্যথা চলে গিয়েছিল।
দাদা তার চাকু দিয়ে আখ টুকরো টুকরো করে কেটে দিতেন, আর আমি ক্ষেতের আলে বসে আখের রস খেতাম। ঘাস ফড়িং আর প্রজাপতির পেছনে ঘুরতাম। একদিন আমি, দাদাকে আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ি দেখিয়েছিলাম। তারপর, দাদা আমাকে কাগজের ঘুড়ি বানিয়ে সেই ঘুড়ি উড়াতে শিখিয়েছিলেন।
আমার জীবনে প্রথম শুনা গান হচ্ছে, লালন ফকিরের “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…”। এই গানটি আমার দাদা প্রায়ই জমি চাষ করতে করতে গাইতেন, আমি বুঝতাম না এই গানটার কি মানে…, এই গানটার মানে আমি এখনও বুঝিনা…! আমার দাদাকে আমি সমসময় তুমি করে বলতাম। যদিও আজ তাকে আপনি বলতেই ভাল লাগছে…
আমার জন্ম গ্রামে হলেও আমি থাকতাম টাঙ্গাইল শহরে। স্কুলের পড়াশুনার জন্য শহরে থাকতে হতো। আমার মন সবসময় পড়ে থাকতো গ্রামে, দাদার বাড়ির মাঠ, আকাশ, পাখি, গাছ, পুকুর আর নদীতে।
স্কুলের ছুটিতে আমরা গ্রামে যেতাম নৌকায় চড়ে। সে সময় যন্ত্র চালিত নৌকা ছিলনা। বৈঠা চালিত নৌকায় টাঙ্গাইল থেকে গ্রামের বাড়ি যেতে অনেক সময় লাগতো। মাঝে মাঝে নৌকাটাতে রশি বেঁধে দুই/তিন জন লোক টেনে নিয়ে যেতো। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হতো, লোকজন এক ঘাট থেকে উঠে অন্য ঘাটে নামত। এক ঘাটের লোক অন্য ঘাটের লোকের সাথে কুশল বিনিময় করতো। আমার ভীষণ ভাল লাগতো।
আমার দাদার বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হলে আমার একমাত্র ফুপু আর ছোট চাচা এসে আমাকে কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে যেতো। দাদি বাড়ির আঙিনা থেকে আমাদের পথের দিকে চেয়ে থাকতো।
আমার বাবা, আমাদের ভাই বোনদের নদীতে নামতে নিষেধ করেছিল। তাই দুপুরে একপাল ছেলে মেয়ের সাথে পুকুরে গোছল করতাম। আম গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়তাম পুকুরের জলে। পুকুরের জলে জবা ফুলের হালকা লাল আর সাদা ফুলেরা ঝুলে পড়ত…
আমার জীবনের প্রথম কষ্টের স্মৃতিটা আজও ভীষণ মনে পড়ে। আমি মানুষের মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর যেভাবে কবর দেয়া হয়, সেটা জানতাম না। আশি
একদিন আশি (৮০) বছর বয়সে আমার দাদার মৃত্যু হল। আমি সেদিন গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সব বয়সের লোকজন আমাদের বাড়িতে এলো। আশেপাশের গ্রামে আমাদের যতো আত্মীয়-স্বজন ছিল, তারাও এলো। বাড়িতে বাচ্চারা আর মহিলারা একটানা কান্নাকাটি করতে থাকল। গ্রামের লোকজন দাদাকে গোছল করিয়ে নতুন সাদা কাপড় পড়াল। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব ধর্মীয়/সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা দেখলাম। তারপর তারা দাদার ইচ্ছে অনুযায়ী তার প্রিয় জমিতে (যে জমিতে তিনি কৃষি-কাজ করে জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন)। সে জমিতে কবর দেয়া শুরু হল।
সবাই দাদাকে কবরে নামিয়ে মুঠো মুঠো মাটি দিতে লাগলো। আমি দাদার কবরে মাটি দেয়া মানতে পারলাম না, সবাইকে থামতে বললাম। ফুপু, চাচাকে বললাম তোমরা লোকদের থামাও দাদা কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না।
দাদার মৃত্যুর পর আমি কাঁদি নাই। কিন্তু যখন আমি দেখলাম কেউ আমার কথা শুনল না।
আমি কাঁদতে লাগলাম…এক সময় মাটিতে গড়া গড়ি দিলাম…
আমি আমার দাদার কবরে মাটি দেই নাই…
আমি আমার দাদার কবরে কি করে মাটি দিবো!?
আমার দাদাতো আমাকে কোনদিন কাউকে কষ্ট দিতে শিখায় নাই…!
©somewhere in net ltd.