![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।
১৯৯৭ সালের গ্রীষ্মকালের কথা, আমি আর মিঠু (Mohammad Anisur Rahman) লায়ন কলেজ, টাঙ্গাইল থেকে সবেমাত্র এইচ.এস.সি. পরীক্ষা শেষ করেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পড়াশুনা নিয়ে একত্রে পরিকল্পনা করছি। সেই সময় গ্রামে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন নিয়ে মাতামাতি চলছিল। এমন সময় মিঠু একদিন আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল মাসুদের সাথে। মাসুদ ঢাকা কমার্স কলেজ থেকে এইচ.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছিল। সেইদিন থেকে মাসুদের সাথে আমার পরিচয়। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ওর গ্রামের বাড়ি ছিল প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে ভুয়াপুর থানার নারিন্দায়।
তারপর, মিঠু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল। এদিকে, আমি আর মাসুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে দুইজন ফিন্যান্স বিভাগে ক্লাস শুরু করলাম। মাসুদ ছিল বঙ্গবন্ধু হলে আর আমি সূর্যসেন হলে। আমরা একসাথে ঘুরে বেড়াতাম, আড্ডা দিতাম। এক সময় মাসুদের প্রিয় বন্ধু ছিল নবী, মুক্তা, পিনটু, সানি, রানা, ফাহিম, রনি, মুন্সি আর মিলন।
আমি আর মাসুদ একসাথে দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধু হলের পাঠাগার, ফ্যাকাল্টির সেমিনার আর কেন্দ্রীয় পাঠাগারে পড়াশুনা করতাম কিংবা আড্ডা দিতাম। ওর প্রায়ই আর্থিক সমস্যা হতো, পড়াশুনায় ও তেমন সচেতন ছিলনা। একদিকে টাকার সমস্যা অন্যদিকে পড়াশুনায় খারাপ ফলাফল নিয়ে মাসুদ ভীষণ বিরক্ত ছিল। আমার রুমমেট নাজমুল (Md. Nazmul Alam) মাসুদকে বলতো, “Frustrated Smoker”। মাসুদ খুব সিগারেট খেত বলে ওকে বন্ধুরা/সহপাঠীরা কেউ কেউ অপছন্দ করতো।
একদিন, মাসুদ শাহজাহান মিনা স্যারের রুমে এসাইনমেনট জমা দিতে গিয়েছিল, তখন স্যার তাকে বলেছিল, “এই তুই কি গাজা খাস”। সেদিন, মাসুদ খুব কষ্ট পেয়েছিল আর আমি খুব অবাক হয়েছিলাম স্যারের এই আচরণে। তারপর থেকে আমি শাহজাহান মিনা স্যারকে আর সম্মান করতে পারিনা।
মাসুদকে আমার সব সময়ই ভাল লাগতো, কেননা ও ছিল প্রথাবিরোধী মানুষ। মাসুদ সব সময় নিজের মতো করে চলতো। মাসুদ আমাকে খুব ভরসা করত কেননা আমি ওর আর্থিক সমস্যায়, পড়াশুনায় নিয়মিত পাশে থাকতাম।
যাই হোক, ২০০৩ সালের শীতে কালের কথা, আমি আর মাসুদ বি.বি.এ. পরীক্ষা শেষ করলাম। একদিন মাসুদ ফোন করে বলল, বন্ধু চল সি.পি.ডি. (Center for Policy Dialogue) যাই। আমি বললাম কেন? ও বলল, চল একটা ইন্টারভিউ আছে। তারপর সি.পি.ডি. আমাদের দুজনকে বিশ্বব্যাংক (World Bank) এর একটা প্রজেক্ট এ তিনমাসের জন্য কাজ দিল। আমি আর মাসুদ একত্রে জীবনের প্রথম চাকুরী নিয়ে ট্রেনে করে সিলেট রওনা হলাম। আমাদের কাজ ছিল তিন মাসের মধ্যে চারটা এন.জি.ও.(Non-Government Organization) এর ক্ষুদ্র-ঋণ কার্যক্রম পরিদর্শন করে তাদের আর্থিক সাহায্যের বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করা।
মাসুদের সাথে সিলেট ভ্রমণ ছিল আমার জীবনে প্রথম সিলেট ভ্রমণ। এখনও প্রতিবছর যখন সিলেট যাই তখন মাসুদকে মনে পড়ে। দেখতে দেখতে একদিন তিনমাস শেষ হল। ২০০৩ সালের কথা, আমি এম.বি.এ. (Master of Business Administration) শুরু করলাম আর মাসুদ পড়াশুনা করতে সুইডেন চলে গেল।
মাসুদের বাবা-মা আমাকে চিনতো। কেননা, আমি টাঙ্গাইল গেলে ওদের গ্রামের বাড়ি যেতাম। আমাদের যোগাযোগ হতো ইমেইল আর ম্যাসেঞ্জারে। দেশে আসলে দেখা হতো। একদিন মাসুদের বোনের ভাল বিয়ে হলো। এক সময় মাসুদের গ্রামে ওদের সুন্দর বাড়ি হলো। তারপর ২০০৯ সালে মাসুদ বিয়ে করল টাঙ্গাইলে। তারপর ০২ ডিসেম্বর ২০০৯ সালের ঈদের ছুটিতে মাসুদ গ্রামের বাড়ি নারিন্দা থেকে স্কুটারে টাঙ্গাইল যাবার পথে এক্সিডেন্টে মারা গেল (ইন্না নিল্লাহি...রাজিয়ুন)। নবী, পিনটু, ফাহিম, রনি ওরা টাঙ্গাইল গিয়েছিল।
আমি ন্যাশনাল ব্যাংকের (বৈদেশিক বাণিজ্য বিভাগে) চাকুরী করার কারনে মাসুদের কবরে মাটি দেবার জন্য টাঙ্গাইল যেতে পারলাম না। এই দুঃখ আমার থাকবে, চিরদিন...।
মাসুদের মামা নজরুল (Mohammad Nazrul Islam) একদিন জানালো, মাসুদের মৃত্যুর পর ওর একটা ছেলের জন্ম হয়েছে। শুনে খুব ভাল লাগলো, কিন্তু মাসুদের সন্তান (ছেলে) তার বাবা মাসুদকে দেখতে পাবেনা ভেবে মনটা খুব খারাপ হলো।
মাসুদ আমার বিশ্ববিদ্যালয় আর চাকুরী জীবনের শুরু থেকে পাশে ছিল। আমরা দুর্দিনে-সুদিনে পাশাপাশি ছিলাম।
এখনও আমার বন্ধুরা যখন আমার সাথে তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলে, আমার ভীষণ একা লাগে। যখন একা থাকি, মনে মনে ভাবি মাসুদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কি হবে (!?)
আমি, আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে ভাবি না, কেননা আমি জানি, এই পৃথিবীতে সবাই একা, ভীষণ একা।
মাসুদ, প্রিয় বন্ধু আমার, আমি জানি, ভেবে ভেবে কোন পথ পাবো না...।
আমি জানি, কোনদিন আর তোকে পাবনা। তবু বন্ধু আমার, যেখানেই থাকিস… তুই ভাল থাকিস…। এই কামনা…।
©somewhere in net ltd.