![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।
আপনাদের নিশ্চয়ই ১৯ মার্চ ২০০৩ দিনটার কথা মনে আছে। মনে নেই? তাহলে মনে করিয়ে দেই, সেদিন আমেরিকা ইরাক আক্রমন করেছিল। আগে বিভিন্ন আক্রমন – পাল্টা আক্রমন সংক্রান্ত বিষয় চললেও অফিসিয়ালি আক্রমণ করবে কিনা আমরা যখন সেটা ভাবছি, তখন ১৯ মার্চ ২০০৩ আমেরিকা আক্রমনটা করলো। না, আমার বিষয় আমেরিকার ইরাক আক্রমন না, যেদিন ঘটনাটা ঘটে সেদিন আমরা একটা দিনব্যাপি কর্মশালায় ছিলাম। আর আমাদের কর্মশালাটি পরিচালনা করছিলেন যারা তাদের দুজনের একজন মহিলা নাম লিসা ডানিয়েল (Lisa Daniels), অন্যজন পুরুষ নাম এরিক নিপার (Eric Knipper), কি ধরতে পারেন নাই? তাহলে বলে দেই যাদের নাম বললাম তাদের বাড়ী আমেরিকা। আর আমরা সেদিন যে ক্লাস করছিলাম...! না, আমেরিকায় না, বাংলাদেশের ধানমণ্ডিতেই। ক্লাস চলাকালীন সময় আমার পাশের জনের মোবাইলে মেসেজ আসে আর সে আমাকে বলে, "ভাই শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ইরাককে আক্রমনটা করলোই।" এবার ভেবে দেখুন, একদিকে আমেরিকা ইরাক আক্রমণ করছে অন্যদিকে আমেরিকার দুই লোক আমাদের পড়াশুনা করাচ্ছে্!
যাই হোক, এই ঘটনার আগের ঘটনাটা বলে নিলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন আমরা সেই ক্লাস করছিলাম?
সেই ৩০ ডিসেম্বর ২০০২ বিবিএ পরীক্ষা শেষ হবার পরে কাজ বলতে তেমন কিছু ছিল না। মার্চ মাসের গরমে যখন সূর্যসেন হলের ৫১০ নম্বর রুমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসছে, সেই অবসরের দিনগুলিতে গল্প/কবিতা আর আড্ডা-বাজি নিয়ে রুমে পরে ছিলাম। এক বিকেলে আমার সহপাঠী পলাশ (Ahmed Shamsul Huda) ফোন করলো, বলল, বন্ধু মাইডাস (MIDAS) অফিস, ধানমন্ডিতে এখনই চলে আয়। একটা ইন্টারভিউ আছে। শেইভ করে, স্নান করে, সিভি-ছবি নিয়ে পৌঁছেগেলাম মাইডাস অফিসে। পৌঁছে জানতে পারলাম, ভ্যাকান্সি (Vacancy) শেষ। যাই হোক, আমি আর একজন বারান্দায় অপেক্ষা করলাম, যদি আমাদের ডাকে...!?
এক সময় আমার ডাক আসলো, ইন্টারভিউ শেষ হল। আমাকে মাইডাস অফিস জানালো, আগামীকাল আহসানিয়া মিশনের অফিসে ট্রেনিং করতে আসার জন্য। ট্রেনিং করতে গিয়ে আমার সহপাঠী পলাশ, হাফিজ, আবেদ, মাসুম, শরীফ, রিফায়েতের সাথে দেখা হল, আড্ডা হল, একসাথে খাবার-দাবার হল। অন্যদিকে আমাদের বিভাগের সিনিয়র লায়লা ম্যাডামের সাথে পরিচয় হল। ট্রেনিং শেষে আমরা জানতে পারলাম, কাজের বিষয়টা হচ্ছে National Private Sector Enterprise Survey, যেখানে মাইডাস (MIDAS) কে এই কাজে USAID, CIDA, DFID, Swiss Contact আর্থিক সাহায্য করছে। Lisa Daniels হচ্ছেন আমাদের প্রজেক্ট ডিরেক্টর আর Eric Knipper হচ্ছেন আমাদের প্রজেক্ট ম্যানেজার। বাংলাদেশের পক্ষে মাইডাসের ডিজিএম খাইরুল বাসার প্রজেক্ট কো-অরডিনেট করবেন।
যাই হোক, বাংলাদেশের উন্নয়ন নিয়ে বিদেশীদের কাজ কারবারে আমরা অংশগ্রহণ করলাম। আমাদের হাতে কলমে শিখানো হল, কিভাবে দেশের হাটে-বাজারে, পথে-ঘাটে, থানা-ঊপজেলার দোকান-পাটে কিংবা মানুষের বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে ইন্টারভিট করতে হবে। কিভাবে জানতে হবে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতে ক্ষুদ্র উদ্যোগ কেন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে...!? আমরা মানুষের সাথে মেশার ট্রেনিং নিলাম, জেন্টার ইস্যু (Gender Issue) নিয়ে ট্রেনিং নিলাম, তারপর আমাদের গ্রুপ করা হল। ৭ জনে ১ টা গ্রুপ। আমাদের গ্রুপ সিলেকশন হল, যেখানে লায়লা ম্যাডাম গ্রুপ লিডার আর আমরা ৬ জন মানে হাফিজ, আবেদ, পলাশ, মাসুম, আমি সহপাঠী আর আফরোজ (যে ইডেন কলেজ থেকে ইকোনমিক্স পড়েছে)। আমাদের একটা নোয়া (NOAH) গাড়ি দেয়া হল, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাবার জন্য। ঢাকায় আমাদের দৈনিক বেতন ছিল ১১০০/- টাকা আর ঢাকার বাইরে ১৭০০/- টাকা। একদিকে অগ্রিম টাকা দিয়ে গাড়িসহ আমাদের ঢাকার বাইরে পাঠাচ্ছে, অন্যদিকে আমরা গাড়ি পেয়ে ঢাকার বাইরে মফসল শহরের সবচাইতে সেরা থাকার হোটেল আর খাবার হোটেল খুঁজে খুঁজে রাতে থাকছি... আর সারাদিন ভাল ভাল খাবার খাচ্ছি...!!! দেখার মতো কোন একটা দর্শনীয় স্থানই আমাদের দেখার বাদ থাকছে না।
আমাদের যাত্রা শুরু হল, ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালি দিয়ে।
আমরা কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্ট, ময়নামতি ঘুরে দেখলাম। নোয়াখালির সোনাগাজি গিয়ে বেতের বাগান আর বেতের পাটি বানানো দেখলাম।
তারপর আমাদের যাত্রা হল, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ।
আমরা সুনামগঞ্জের হাওড়, মৌলভীবাজারের মাধবকুন্ড জল প্রপাদ দেখলাম, সিলেটের শাহজালাল-শাহ পরানের মাজার, জাফলং দেখলাম। হবিগঞ্জ গিয়ে চায়ের বাগান দেখলাম। ছাতক গিয়ে দেখলাম কিভাবে সিমেন্ট কারখানার জন্য ভারত থেকে বাংলাদেশে সীমান্ত পার হয়ে আসছে বেল্টের মাধ্যমে চুনা পাথর।
তারপর আমাদের যাত্রা হল, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার।
আমরা চট্টগ্রামের পতেঙ্গা সৈকত, ফয়েজ লে্ক, বায়েজিদ বস্তামি’র মাজার দেখলাম। কাপ্তাই দিয়ে জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখলাম। তারপর কক্সবাজার গেলাম সেখানে সমুদ্র সৈকত দেখে লবণ শিল্প দেখলাম, হিম ছড়ির বন আর সমুদ্র দেখলাম। টেকনাফ শহরে গিয়ে টেকনাফ সমুদ্র সৈকত দেখলাম আর বার্মিজ জিনিসপত্র কিনলাম। রামুর মন্দির দেখলাম। বান্দরবান শহরে গেলাম, সেখান থেকে নাইক্ষংছড়ি বেড়াতে গেলাম।
তারপর আমাদের যাত্রা হল, বাগেরহাট, খুলনা।
আমরা মানিকগঞ্জের আরিচা দিয়ে যমুনা নদী পার হয়ে রাজবাড়ী হয়ে খুলনা গেলাম। বাগেরহাটের খান জাহান আলীর মাজার আর ষাট গম্বুজ মসজিদ দেখলাম। মংলা গিয়ে ট্রলারে সুন্দর বনের করমজল পয়েন্টে গেলাম। খুলনা শহরের খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় আর রূপসা নদীতে নির্মাণাধীন রূপসা ব্রিজ দেখলাম। খুলনার বিখ্যাত চিংড়ির ঘের পরিদর্শন করলাম। তারপর বাগেরহাটের রাস্তা দিয়ে গোপালগঞ্জ, শিবচর-মাওয়া হয়ে ঢাকায় ফিরলাম।
তারপর আমাদের যাত্রা হল, নাটোর, রাজশাহী।
আমরা ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে যমুনা ব্রিজ পার হয়ে সিরাজগঞ্জ দিয়ে গেলাম চলন বিল। চলন বিলের উপর দিয়ে নাটোর হয়ে গেলাম রাজশাহী। রাজশাহী গিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আর শহরের চিড়িয়াখানা, টি-বাধ, শাহ মখদুমের মাজার দেখলাম। সে সময়টা ছিল আমের মৌসুম। আমরা চারঘাট -সারদা গিয়ে আমের বাগান দেখলাম। বানেশ্বর বাজারে গিয়ে আমের মেলা দেখলাম।
তারপর আমাদের যাত্রা হল, ময়মনসিংহ, হালুয়াঘাট, শেরপুর।
আমরা ঢাকা থেকে গাজীপুর জেলার ভাওয়াল-মধুপুরের গড়ের মধ্যদিয়ে ময়মনসিংহ শহরে গেলাম। সেখানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দেখালাম, বিকেলে ব্রহ্মপুত্র নদীর পাড়ে বসে আড্ডা দিলাম। তারপর গেলাম শেরপুর, সেখানে নালিতাবাড়ি উপজেলার বারোমারিতে গিয়ে গারো উপজাতিদের জীবন যাপন দেখলাম।
শেরপুর থেকে নোয়া মাইক্রোবাসে ময়মনসিংহ আসার পথে ফুলপুর এলাকায় আমাদের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। সেদিন দুপুর ১২.০০ টার দিকে গাড়ি চলছিল প্রায় ১০০ কিলোমিটার গতিতে। আমাদের ড্রাইভার মাইক্রোবাটিকে অপরিচিত রাস্তার একটি মোড় ঘুরাতে গিয়ে দেখেন একটি যাত্রীবাহী বাস সামনে...? উপায় না দেখে ড্রাইভার আমাদের গাড়িটাকে রাস্তার পাশের দিকে নিয়ে গেলে দেখেন পানি ভর্তি পুকুর, পুকুর পার হতেই দেখেন একটি ধানের খড়ের পালা। আমাদের গাড়িটা সেই ধানের খড়ের পালার উপর রাস্তা থেকে আসড়ে পড়ে। আমরা দম বন্ধ করে দেখছিলাম, কি হতে যাচ্ছে...!? যখন গাড়ি ধানের খড়ের পালার উপর গিয়ে একাধারে আওয়াজ করতে করতে থেমে গেলো, আমরা সবাই যেন নতুন জীবন পেলাম। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে গাড়িটাকে ধানের খড়ের পালার উপর থেকে নামালাম সেই গ্রামের লোক জনের সাহায্যে।
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা ৭ জন এইযে বেচে আছি এটা আমাদের দ্বিতীয় জীবন। দ্বিতীয় চাকরী শেষে আমি একটা দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি...!?
আমাদের ৭ জনের বর্তমান অবস্থানঃ ১। লায়লা কানাডা প্রবাসি, ২। মাসুম অস্ট্রেলিয়া প্রবাসি ৩। আবেদ জাপান প্রবাসী, ৪। হাফিজ মারকেন্টাইল ব্যাংকে কাজ করে, ৫। পলাশ বাংলালিংক কে কাজ করে ৬। আমি ইউসিবিএলে আর ৭। আফরোজ, ব্র্যাক ব্যাংকে কাজ করে।
আমাদের সাথে সেই প্রজেক্টের অন্য বন্ধুরা ১। শরীফ ব্যাংক এশিয়া কাজ করে, ২। রিফায়েত আইআইডিএফসি’তে কাজ করে।
আমাদের সাথে Lisa Daniels, (প্রজেক্ট ডিরেক্টর), Eric Knipper (প্রজেক্ট ম্যানেজার), খাইরুল বাসার (প্রজেক্ট কো-অরডিনেটর) কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ নেই।
আমাদের ৩ মাসের প্রজেক্টটি শেষ হয়েছিল ৪ মাস পরে। আমরা ৭ জনে দেশের প্রায় ২৫টা জেলা আর ১০০টা থানা ভ্রমণ করেছিলাম। বাংলাদেশের যে সকল দর্শনীয় স্থান নিয়ে আমাদের ভ্রমণের আগ্রহ ছিল, তা সেই ৪ মাসের চাকরী করতে গিয়েই পূরন করেছিলাম আমরা। এখনও আমাদের ৭ জনের এক জনের সাথে অন্যজনের কথা হলেই সেইসব দিনগুলির কথা মনে হয়। দেশের যে বড় শহরের যাই সেই দ্বিতীয় চাকরী’র স্মৃতি মনে হয়ে যায়।
কি চমৎকার সেইসব দিন ছিল আমাদের; যখন আমরা গোলাপের পাপড়ি খোলার মতো দেশের একটা একটা জেলা/থানা/গ্রামকে ঘুম ভাঙলেই খুঁজে বের করতাম আর সেই অদেখা স্থানটাকে খুলে খুলে দেখতাম। পেয়ে যেতাম দৃষ্টি সীমানায় নতুন জগত তারপর হইচই, আনন্দ, খাবার দাবার আর অমলিন সেই আড্ডা... আহ! সেই দিনগুলি আর পাবো না...!!!
(বিঃ দ্রঃ আমাদের এই ভ্রমণে যেমন আনন্দের সীমা ছিলনা, তেমনি বয়স কম থাকাতে কিছু ব্যাক্তিগত ইস্যু নিয়ে কিংবা পছন্দ/অপছন্দ নিয়ে সমস্যা ছিল, যা সব ভ্রমনেই থাকে। ভেবে দেখলাম, সেই সমস্যাগুলো সেই সময় আমাদের একজনকে অন্যজনের সাথে দূরত্ব তৈরি না করে বরং কাছেই নিয়ে এসেছিল বেশি...!? আমাদের ভ্রমণের বিস্তারিত গল্প/বাস্তবতা লেখা এই ছোট্ট পরিসরে সত্যিই সম্ভব না, কেননা ৪ মাসে ২৫টা জেলা আর ১০০টার বেশি থানার স্মৃতি লেখা সত্যিই দুরহ, কি বলেন?)
২২ শে জুন, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪১
খোরশেদ খোকন বলেছেন: আপনি আমার লেখা পড়েছেন জেনে সত্যিই খুব ভাল লাগছে। আপনার অনুপ্রেরণা পেয়ে ভবিষ্যতে আরও কিছু লেখার ইচ্ছে হচ্ছে...! ধন্যবাদ।
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে জুন, ২০১৫ সকাল ৯:২৬
কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: আপনার লেখা বেশ প্রাঞ্জল। সময়টাকে যে উপভোগ করেছেন, এটাই সবচেয়ে বড়।