![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।
ভূমিকাঃ
শৈশব হচ্ছে এমন রহস্যময় জীবন; যেটা হঠাৎ ঘুম ভেঙে নতুন পৃথিবী দেখার মাধ্যমে শুরু হয়। তারপর আমরা নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করতে থাকিঃ আমি কে? আমি কোথায়? আমি কি? এটা কি? ওটা কি? রাজ্যের সকল বিস্ময় আর অনুভূতির বিহ্বলতা ঘিরে এগিয়ে যায় আমাদের শিশু মন... আমাদের শৈশব জীবন...।
আমি শৈশবকে আবারও দেখতে চাই; এই পরিণত বয়সে চশমার ফাঁক দিয়ে... স্মৃতির জোনাকির ফিকে হয়ে যাওয়া আলোতে...!?
তাহলে, আসুন আমরা এগিয়ে যাই...!!!
--------------------------
আমার দাদা কৃষক ছিলেন। তিনি পড়াশুনা জানতেন না। তার সংসার জুড়ে ছিল নিত্যদিনের অভাব। সেই সময় আমার বাবা ফজরের আযানের ধ্বনি কানে আসতেই ঘুম থেকে উঠতেন। তারপর দাদার সাথে নামাজ আদায় করেই হালচাষ করায় জন্য মাঠে যেতেন। মাঠের কাজ শেষ করে বাড়ী ফিরে সকালের নাশতা মানে পান্তা-ভাত, আলু-ভর্তা ভাত অথবা ডাল-ভাত খেতেন। তারপর পায়ে হেঁটে রওনা দিতেন তিন মাইল দূরের পলসিয়া রানী দিনমণি স্কুলের দিকে...। (সেই সময়টাকে ধরার জন্য বাবার মুখে শোনা স্মৃতি নিয়েই এগিয়ে যেতে চাচ্ছি...)
বাবা বলেছেন, সে সময় রাতে কেরোসিন কুপির বাতি জ্বালানোটা তাদের পরিবারের জন্য ছিল এক প্রকারের বিলাসিতার শামিল। তাই দিনের কাজ দিনের আলোতেই শেষ করতে হতো। সুদীর্ঘ একটি রাত তারা কাটিয়ে দিতো জোনাকির আলো, জ্যোৎস্নার আলো অথবা বৃষ্টি-মুখর রাতে বজ্রপাতের আলো দেখে দেখে...।
দাদার সংসারে ছিল চারছেলে আর একমেয়ে। আমার বাবার বড় দুইভাই (মনসের আলী, আনসের আলী); বাবার ছোট একভাই (আব্দুল আজিজ) আর সবার ছোট একবোন (আমেনা)। বাবার সাথে তার মেজ-ভাইয়ের (আনসের আলী) সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। শুনেছি তারা একত্রে খাওয়া-দাওয়া, পড়াশুনা আর খেলাধুলা করতেন। আনসের চাচা বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী ছিলেন বলে গ্রামের সম-বয়সী ছেলেরাও তাকে খুব মান্য করে চলতেন। তিনি ছিলেন কিছুটা ডানপিটে স্বভাবের আর কথাবার্তায় একদম স্পষ্টভাষী।
১৯৬৯ সালের এক সকালে বাবা বাড়ী থেকে রাগ করে পালিয়ে যান। সেই সময় বাবার সঙ্গী ছিলেন তারই স্কুলের সহপাঠী আমাদের গ্রামের কাশেম চাচা। তারা ময়মনসিংহ গিয়ে চাকরী খুঁজেন। সপ্তাহ খানেক ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ের একটা সস্তা বোর্ডিংএ দিনে দু’বেলা ডাল-ভাত খেয়ে আর রাতে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন, একদিন নিশ্চয়ই সুদিন আসবে...। তারপর, সত্যি একদিন তারা দুজন একটা সরকারী চাকরী পেয়ে যান। সেই চাকরীতে থাকাকালীন অবস্থায় বাবা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন আর পাশও করেন। তারপর আর পড়াশুনা করা হয়নি তার...।
বাবা আর মেজচাচা দুজনেই চাকরীতে থাকাকালীন সময় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধে বাবা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও আনসের চাচা মৃত্যু বরণ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরেও আমার দাদা/দাদি জানতেন না যে, আমাদের চাচা মারা গেছেন। অন্যদিকে আমার মেজ-চাচি (আনসের চাচার স্ত্রী) দাদার বাড়িতেই থাকতেন। মেজ-চাচা বিয়ে করেছিলেন স্বাধীনতার আগে কিন্তু তার কোন সন্তান ছিলনা।
স্বাধীনতার পর এদেশে অভাব-অনটন তীব্র আঁকার ধারন করে। দাদার বাড়ীতে গ্রাম্য ডাকাতেরা লুটপাট চালায়,
তারা চাল-ডাল-তেল-নুন যাই পায় তাই নিয়ে চলে যায়। আর তারা যাবার সময় দাদাকে লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটায়...।
আমার একমাত্র ফুপু ডাকাতদের একজনকে রাতের আঁধারেও চিনতে পারেন। সে ছিল পাশের গ্রামের একলোক যে কিনা ডাকাতদের বাড়ীতে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল। ঐ লোকটিই সে রাতে বাড়ীর কোথায় কি আছে বলে দিয়েছিল। সব চাইতে দুঃখের বিষয় হল, সেই লোকটি ১৯৭১ সাথে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধও করেছিল। সেই রাতে
বাবা বাড়ীতে ছিলেন না। বাবা বাড়ী ফেরার পর ফুপু বাবাকে বলে দিয়েছিল, কারা বাড়ীতে ডাকাতি করেছে আর দাদাকে মারধোর করেছে...।
আমার বাবা ডাকাতদের লুটপাট নিয়ে তেমন রাগ করেননি, তিনি অভাব-অনটনে বড় হওয়া মানুষ তাই জানেন দেশের দুর্দিনে কিছু লোক ডাকাতি করবে এটা অস্বাভাবিক কিছুনা। কিন্তু তিনি রাগ করেছিলেন দাদাকে আঘাত করার জন্য। সে আঘাত তিনি এখনো মনের মধ্যে পুষে রেখেছেন...।
দাদার নিজের জমি-জমা ছিল না বললেই চলে। তিনি গ্রামের অবস্থা সম্পন্ন হিন্দুদের (আমাদের গ্রামের পাল সম্প্রদায়দের) জমি বর্গা চাষ করতেন। যে হিন্দু পরিবারের জমি চাষ করতেন, সেই পরিবারের একমেয়ের নাম ছিল জ্যোৎস্না পাল আর একছেলের নাম ছিল খোকা পাল। দাদার সাথে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক এতো ভাল ছিল যে, দাদা তার নাতনি মানে আমার বোনের নাম রাখেন “জ্যোৎস্না” আর আমার নাম রাখেন “খোকা”...।
দাদা মারা যাবার অনেক পরে, আমাদের দুই ভাইবোনের স্কুলে ভর্তি হবার আরও পরে আমার বোনের নাম “জ্যোৎস্না” থেকে “রোজী” আর আমার নাম “খোকা” থেকে “খোকন” হয়ে যায়...।
কৃষি কাজ ছাড়া দাদার আরও দুটি কাজ ছিল, একটি হচ্ছে গান গাওয়া আর অন্যটি ঝাড়ফুঁক দেয়া।
আমার জীবনে প্রথম শোনা গান হচ্ছে, লালন ফকিরের “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়…”। এই গানটি আমার দাদা প্রায়ই জমি চাষ করতে করতে গাইতেন, আমি বুঝতাম না এই গানটার কি মানে…? এই গানটার মানে আমি এখনও বুঝিনা…! কিন্তু এখনো এই গানটা শুনলেই আমার ভাল লাগে, ভাল লাগার কারনটা দাদার সেই স্মৃতি...।
এবার ঝাড়ফুঁক বিষয়ে বলি, আমি ছেলেবেলায় গ্রামে বেড়াতে গেলেই যখন কোন বৃদ্ধ মানুষের সাথে দেখা হতো, তারা আমাকে বলতো; “এই তোর দাদার নাম কি?” আমি বলতাম, “আমার দাদার নাম ঈমান আলী”।
তখন বৃদ্ধরা বলতো, ঈমান আলীতো খুব ভাল ঝাড়ফুঁক জানতো। নাম যেমন ঈমান তেমনি ঈমানদার লোক ছিল সে। দশ গ্রামের লোকজন তোর দাদাকে সব সময় ব্যাস্ত করে রাখতো। এমন কোন বাড়ী নেই, যেখানে সে ঝাড়ফুঁক দিতে যেতো না। হিন্দুরা পর্যন্ত তোর দাদার কাছে থেকে ঝাড়ফুঁক নিতো। তোর দাদার এই গুনটা তোরা কি কেউ পেয়েছিস? তোর বাবা জামসেদ মনেহয় কিছুটা পেয়েছে, তাই না?
এক সময় বাড়ীতে জানা জানি হয়ে যায় যে, আনসের চাচা যুদ্ধে মারা গেছেন। সরকার থেকে বাড়ীতে যোগাযোগ করা হয়। তখনই দাদার জীবনের একমাত্র ছবিটা তোলা হয় (যে ছবিটা এখনো আমার সংগ্রহে আছে)। দাদা/দাদি শোকটা মেনে নিতে পারলেও মেজ-চাচির জন্য মৃত্যুকে মেনে নেয়াটা খুব কষ্টের হয়ে যায়। মেজ-চাচি কিছুতেই মৃত্যু বিষয়টা মানতে পারেনি। মেজ-চাচা মারা যাবার সংবাদ বাড়ীতে পৌঁছানোর পরেও মেজ-চাচি বহুদিন দাদার বাড়িতেই ছিলেন...।
বাবা তখনও অবিবাহিত ছিলেন। বাবাকে দাদা-দাদি, চাচা-ফুপু, আত্মীয়-স্বজনেরা অনেক অনুরোধ করেছিল, মেজ-চাচিকে রেখে দেয়ার জন্য কিন্তু বাবা আনসের চাচাকে এতোটা শ্রদ্ধা করতো কিংবা ভালবাসতো যে, সে কিছুতেই ভাবীকে অন্যভাবে দেখতে পারেনি...।
আমার মনে আছে, ছেলেবেলায় আমি ভীষণ দুষ্ট ছিলাম। বাড়ীর ছোট বড় সবাইকে খুব যন্ত্রণা দিতাম। এজন্য মা বিরক্ত হয়ে আমাকে বকা-ঝকা দিতেন আবার মাইরও দিতেন মাঝে মধ্যে। মেজ-চাচি আমাকে ভীষণ আদর করতেন। তিনি কোনদিনই মারধর তো দূরের কথা, বকাও দেয় নাই। তিনি শুধু আমাকে একটা কথাই বলতেন, যদি তোর মতো আমার নিজের কেউ থাকতো; তাহলে আমি এই বাড়ীতে থেকে যেতে পারতাম...!?
আমি সে কথার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতাম না। আমি মেজ-চাচিকে বলতাম, আমি কি তোমার ছেলে না? তুমি কি আমাকে মায়ের মতো “বাবা” বলে ডাক না? তাহলে কেন একথা বলছ? আর তুমি বাড়ী ছেড়ে কেন যাবে? আমিতো তোমাকে যেতে দিবো না...।
--------------------------
(বিঃদ্রঃ স্মৃতিকথা ভাল লাগলে জানাবেন। আগামীতে হয়তো কোনদিন... আবারও শৈশব নিয়ে কথা হবে...)
২৫ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:৩০
খোরশেদ খোকন বলেছেন: আপা, আপনার ভাল লাগায়, আমারও খুব ভাল লাগছে, শুভেচ্ছা।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:৪৭
মনিরা সুলতানা বলেছেন: ভাল লাগোছে আপনার লেখা সেই আপনার গল্পের গল্প কথকদের মত মনে হচ্ছে আপনাকে ।
শুভ কামনা