নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার জন্ম টাঙ্গাইলের হামজানি গ্রামে। শৈশব, কৈশোরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ছিলাম; বাবার সরকারী চাকুরীর জন্যে। কলেজ ছিল টাঙ্গাইল জেলায়। তারপর পড়াশুনা ঢাবি\'র ফিন্যান্স বিভাগ। গত নয় বছর যাবত প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মজীবন চলছে। www.facebook.com/khokonz

খোরশেদ খোকন

এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।

খোরশেদ খোকন › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমার বন্ধু প্রদীপ আর কিছু স্মৃতিঃ

১৫ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:০৬

আমার বাবার সরকারী চাকুরীর কারনে ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ ইং দুই বছর আমি আরিচায় ছিলাম। আপনারা হয়তো জানেন; তবুও বলছি মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার যমুনা নদীর পাড়ে অবস্থিত একটি ছোট শহরের নাম আরিচা। এক সময় এই শহরটাকে সবাই এক নামেই চিনতো (এখনও চিনে) এই কারনে যে, বাংলাদেশে পূর্ব আর পশ্চিম একত্র করতে যেখানে যমুনা/পদ্মা নদী পার হতে হতো, তার পাড়েই অবস্থিত এই শহর; যার ওপারের একদিকে রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ/দৌলতদিয়া ঘাট আর অন্যদিকে পাবনা জেলার নগর বাড়ী ঘাট। আমি সেখানকার শিবালয় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম আর ৯ম শ্রেণীতে পড়েছিলাম।
সে সময় স্কুলে আমার এক ক্লাশ উপরে পড়তো প্রদীপ। প্রদীপ, কালা (ভাল নাম মনে থাকে না!) আর লিটনকে আমি বড় ভাই হিসেবেই চিনেছিলাম...।
আমাদের আরিচার বাসার পাশেই ছিল একটা পুকুর, সেই পুকুর পাড় ঘেসে কাঁটা-তাঁরের সীমানা প্রাচীর, প্রাচীর ঘেসে ঢাকা-আরিচার মহা-সড়ক, মহা-সড়কের ওপাশে প্রিন্স স্টুডিও, সেই স্টুডিওর পাশ দিয়ে একটা গলি চলে গেছে পশ্চিম দিকে। যে গলিটা দিয়ে আমি প্রদীপদের বাড়ী যেতাম...।
ওদের বাড়ী মানেই দুধের সুগন্ধে ভরপুর দুই-তিনটা টিনের ঘর। বাড়ীর উঠানে সারাদিন আগুন দিয়ে গরুর দুধ জ্বাল করা হচ্ছে; আর সারা-বাড়ী সুগন্ধ ছড়াচ্ছে...। প্রদীপরা ছিল ঘোষ পরিবার, দুধ-দই-মিষ্টি ছিল ওদের পারিবারিক কাজকর্ম আর ব্যবসা।
আরিচা থেকে বাবার বদলীর কারনে চলে যাই শেরপুর জেলায়, শেরপুরের স্কুল থেকে এসএসসি শেষ করি। তারপর টাঙ্গাইল চলে যাই, সেখান থেকে কলেজের পড়া; মানে এইসএসসি শেষ করি। সেই ১৯৯৭ সালে আমি চলে আসি ঢাকার মিরপুর; তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে মাত্র ভর্তি হয়েছি।
আমার আরিচার সহপাঠী বন্ধু সোহাগ; যার সাথে আমার চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল, সে তখন ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটের চিশতিয়া মার্কেটে মেয়েদের রেডিমেট কাপড়ের ব্যাবসা শুরু করেছে। আমি সোহাগের দোকানে প্রদীপের দেখা পাই। সোহাগের সব চাইতে কাছের বন্ধু তখন ছিল প্রদীপ...।
আমার আরিচার বন্ধুদের মধ্যে সেই সময় সোহাগই সব-চাইতে বেশী টাকা-পয়সা খরচ করতো (বন্ধুদের জন্য)। আমি কোনদিন সোহাগের সামনে কোন খাবার বা অন্যান্য জিনিসের বিল দিতে পারি নাই (এখনও পারি না!?)। প্রদীপের সাথে নতুন করে পরিচয় হবার পরে দেখলাম; সে সোহাগের চাইতেও এক ডিগ্রি উপরে (মানে বেশী)। বন্ধুদের জন্য জীবন দিতে পারে এমন মানুষ আমি একমাত্র প্রদীপকেই দেখেছি...!?
যেহেতু প্রদীপদের ব্যাক-গ্রাউন্ড ছিল ঘোষ পরিবার আর গ্রামের বাড়ী মুন্সিগঞ্জ (বিক্রমপুরে) সেহেতু ওদের বৃহৎ ঘোষ পরিবারের কেউ ব্যাবসার যোগ্য হলেই তাকে নতুন মিষ্টির দোকান করে দেয়া হতো। প্রদীপকে ব্যাবসা করার জন্য সেই সময় বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার (গরুর মাথা মার্কা), মিরপুর-১ এ একটা নতুন দোকান করে দেয়া হল। আমি আর প্রদীপ যেহেতু মিরপুর ছিলাম; সেহেতু সোহাগ গাউছিয়া মার্কেট থেকে মিরপুর আসতো প্রতিদিন প্রদীপের সাথে আড্ডা দিতে।
এদিকে আমার ঢাবি’র সহপাঠী পলাশ আর শিপলুও প্রদীপের খুব ভাল বন্ধু হয়ে যায়। সেই সময় পলাশ আমার মেসের রুমমেট ছিল আর শিপলুদের বাসা ছিল মিরপুর-১ নাম্বারে। আমাদের তিন বন্ধু মানে পলাশ, শিপলু আর আমার প্রতিদিনের একটা নিয়মিত কাজ ছিল প্রদীপের দোকানে গিয়ে সকালে অথবা বিকালে ফ্রি ফ্রি মিষ্টি খেয়ে মিষ্টির কোয়ালিটি ঠিক আছে কিনা; সেটা পরীক্ষা করা...(হা হা হা)
যাই হোক, এক সময় আমার পরিবারের সবাই (বাবা/মা/ভাই/বোন) টাঙ্গাইল থেকে ঢাকায় চলে আসে; আর আমি মিরপুরে পরিবারের সাথে নতুন বাসায় উঠে যাই।
এদিকে, আমার মেসের রুমমেট ও ক্লাসের সহপাঠী পলাশ আমার স্কুলের বন্ধু প্রদীপের সাথে এক ফ্ল্যাটে উঠে যায় মিরপুর-১ নাম্বারে।
যেহেতু মিরপুর-১ নাম্বারে প্রদীপের মিষ্টির দোকান, প্রদীপের/পলাশের ফ্ল্যাট আর শিপলুদের বাড়ী; সেহেতু সোহাগ (গাউছিয়া মার্কেট থেকে), রনি (সিদ্ধেশরী থেকে) আর আমি প্রতিদিন বিকেলে মিরপুর-১ এ আড্ডা দিতে যাওয়া শুরু করি। আড্ডা মানেই প্রিন্স রেস্টুরেন্ট, মিরপুর গভঃ স্কুলের মাঠ, শিপলুর বাড়ী আর প্রদীপের ফ্ল্যাট...।
সেই ১৯৯৯/২০০০ সালের শীতের দিনে প্রদীপ, শিপলু, সোহাগ, সোহাগের কাজিন মামুন আর আমি কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেই কক্সবাজার ভ্রমণ ছিল আমার জীবনের প্রথম চট্টগ্রাম/কক্সবাজার/টেকনাফ ভ্রমণ।
মনে আছে, সেই সময় কক্সবাজার ছিল ছোট একটা শান্ত শহর। সে সময় হোটেল বুকিং দিয়ে কক্সবাজার যাবার নিয়ম সম্ভবতঃ চালু ছিল না, আমরা যেদিন কক্সবাজার পোঁছাই সেদিন সারা বিকেল খুঁজে কোথাও কোন হোটেল পাচ্ছিলাম না।
শেষে কক্সবাজার এয়ারপোর্ট এর বিপরীত দিকে (আগে যেখানে ঝিনুক মার্কেট ছিল, যেখান থেকে ঝাউবনের মাঝ দিয়ে হেঁটে সি-বিচে যাওয়া যেতো), সি-ভিউ নামের একটা হোটেলে আমরা উঠেছিলাম। একটা রুমে আমরা ৬ জন ছিলাম। ২ জন থাকার একটা বেডে আমরা ছিলাম ৩ জন আর ফ্লোরে ছিলাম ৩ জন। হোটেল বয় আমাদের বালিশ আর কম্বল দিয়েছিল এক্সটা (হা হা হা)।
যাই হোক, তারপর দিন আমরা কক্সবাজার শহরেই ছিলাম।
ভ্রমণের দ্বিতীয় দিন আমরা সিদ্ধান্ত নেই সেন্ট-মারটিন যাবার। তাই সকলে উঠে রওনা দেই টেকনাফ (সে সময় সেন্ট-মারটিন যাবার কোন প্রকার জাহাজ ছিল না; প্রতিদিন সকালে টেকনাফ থেকে একটা ট্রলার সেন্ট-মারটিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যেতো)। যথারীতি বেশী বন্ধু একত্রে থাকলে যা হয়, আমরা সেন্ট-মারটিনের ট্রলার মিস করি...(হা হা হা)।
ট্রলার মিস করে, টেকনাফের অবকাস/বিলাশ (এরকমই নাম হবে!) একটা হোটেলে উঠে যাই, যাতে আগামী দিন সেন্ট-মারটিনের ট্রলার ধরা যায়। তারপর হালকা খাবার খেয়ে আমরা চলে যাই টেকনাফ বীচে। অনেক আনন্দ করে গোছল করি আর সমুদ্রের বালিতে দৌড়াই...। (আহ! সেই দিন আর পাবো না!)
সেদিন বিকেলে, কক্সবাজার-টেকনাফ মেইন রাস্তার পাশে পর্যটন বিভাগের নির্মিত নাফ নদীর উপর যে নদী দেখার পয়েন্ট আছে, আমরা সেখানে যাই।
সেই পয়েন্টের আগেই রাস্তাটা খুব উচু পাহাড় থেকে পর্যটন এলাকায় নেমে এসেছে। কে যেন বলেছিল (মনে নাই), পাহাড়ের উপর থেকে নাফ নদী দেখতে খুব সুন্দর। আমরা পাহাড়ের উপর যাই। ঐ পাহাড়টি হচ্ছে টেকনাফ যাবার রাস্তায় টেকনাফ শহরের কাছাকাছি সব চাইতে উচু পাহাড় (নাম জানিনা)।
যাই হোক, আমরা পাহাড় থেকে নাফ নদী দেখে নীচে নামার সময় দুইটা রিক্সা পেয়ে যাই। কে যেন বলেছিল (মনে নাই), চল রিক্সায় পাহাড় থেকে নীচে নামি। আমরা রিক্সায় নামতে থাকি (রিক্সাওলার মনেহয় কাণ্ডজ্ঞান কম ছিল, এদিকে আমাদের তো কাণ্ডই নেই, তার আবার জ্ঞান!? তা না হলে পাহাড় থেকে নীচে নামার ভাড়ার প্রস্তাব আমরা কিভাবে দিলাম আর সে কিভাবে গ্রহণ করেছিল!?)।
পাহাড় থেকে নামার সময়, একটা রিক্সা ঠিক মতোই নামলো। কিন্তু আমি সোহাগ আর শিপলু যে রিক্সায় ছিলাম সেটা নামার সময় একটা ঝামেলা হয়ে গেল (!?),
রাস্তার বিপরীত দিক থেকে আসা একটা মাইক্রবাসকে সাইড দিতে গিয়ে রিক্সাওয়ালা ব্রেক ঠিক রাখতে পারলো না, চোখের নিমিসে কি থেকে কি যে হল...(!?)।
দেখলাম, এক পাশে নাফ নদী (১০০ ফিটের মতো গভীর) অন্যদিকে পাহাড়ের ঢাল (নীচের দিকে নেমে গেছে ২০ ফিটের মতো ঢালু হয়ে)।
আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হবার মতো অবস্থা যখন; তখন দেখি আমরা পাহাড়ের ঢালু দিকে পড়ে আছি... সেখানে রিক্সা উলটা হয়ে পড়ে আছে... শিপলু উপুড় পড়ে আছে... সোহাগ আর আমিও উপুড় হয়ে পড়ে আছি...। (এ যাত্রায়, প্রানে বেঁচে গেলাম...!?)
আমি হাত, পা ঠিক আছে কিনা দেখে তারপর সোহাগ আর শিপলুকে উঠাতে গেলাম। সেদিন মামুন আর প্রদীপ আমাদের ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে গেলো থানা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে (হাসপাতালে)। (হায়রে! জীবনের প্রথম হাসপাতালে ভর্তি তাও আবার রোড এক্সিডেন্ট করে...!?)
সেই এক্সিডেন্টে শিপলুর মাজার একটি হাড় ভেঙে যায়... মামুন/সোহাগ/আমার হাত পা ছিলে যায়। আমাদের একদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল।
সেদিন হাসপাতালের নার্সের ডিউটিতে এক উপজাতি মহিলা ছিল, তার বয়স ছিল আমাদের মা/খালাদের বয়সী। সে আমাদের হাত/পা আর শরীরের অন্যান্য জায়গায় ড্রেসিং করেছিল। সে আমাদের বলেছিল, ঐ পাহাড়ে প্রতি বছর ৪/৫টা এক্সিডেন্ট হয়। আমরা কেন এতোগুলো ছেলে (পড়াশুনা জানার পরেও...!?) রিক্সায় পাহাড় থেকে নীচে নামার মতো কাজ করলাম...? মা/খালাদের বকা শুনার মতো শোনালেও, লজ্জায় আমরা মুখ ঢেকে রাখার উপায় পাচ্ছিলাম না...!
আর সব চাইতে লজ্জার বিষয় ছিল, যখন সেই নার্স শিপলুর পাছায় ইনজেকশন দিতে গিয়েছিল... (হা হা হা)। শিপলুর কথা হল, ভাই ইনজেকশন দিবেন দেন, কিন্তু নার্স কেন? একটা ডাক্তার আনেন, বন্ধুদের সামনে আমার একটা ইজ্জত আছে না! (হা হা হা)।
যাই হোক, আমরা আমাদের ভ্রমণ সেখানেই সমাপ্ত করে; পরের দিন শিপলুর ভাল চিকিৎসার জন্য ঢাকায় চলে আসি।
প্রদীপের ফ্ল্যাটে আরিচার সকল বন্ধুই যেতো। প্রদীপ তার ফ্ল্যাটে দোকানের কর্মচারীদেরও থাকা/খাওয়ার ব্যাবস্থা করেছিল। আমার মনেপড়ে প্রদীপ সারাদিন কোন সিগারেট খেত না। রাতে ঘুমানোর আগে সে দশ মিনিট ধ্যান করতো, তারপর ধ্যান শেষ হলে একটানা পাঁচটা সিগারেট একটার-পর-একটা খেত। কোন কথা বলতো না। আমি কথা বলতে চাইলেও; সে কিছুই বলতো না। (হায়রে, এই জীবনে সেই রহস্যের কোন কুল-কিনারা করতে পারলাম না...!?)
আমার মনে হতো ওর মনে কোন কিছু লুকানো আছে যা আমরা জানিনা! তারপর সে তার মোবাইলটা সুইচড অফফ করতো, আর একটা মেসেজ দেখা যেতো ওর মোবাইলে, সেটা ছিল “বাবা লোকনাথ...”।
প্রদীপের সাথে সব চাইতে বেশী ঝগড়া হতো আমার। সে আমার কোন মতামতই ঠিক মতো মেনে নিতো না। আমি যাই বলতাম, সে তার বিপরীত একটা বলে বসতো।
ওর খুব ঘন ঘন সর্দি আর কাশির সমস্যা ছিল, আমি জানতাম সেটা কেন হচ্ছে... । (এখানে সে সব কথা বলা ঠিক মনে হচ্ছে না...!?)আমি তাকে বার বার সতর্ক করতাম কিন্তু সে মানতই না।
ঢাকায় প্রদীপের পরিবারের কেউ না থাকাতে; সে বন্ধু/বান্ধব নিয়ে ইচ্ছে মতো আড্ডা দিয়ে, টাকা পয়সা খরচ করে, সময় কাটাতো, আর ব্যাবসায় সিরিয়াস না থাকাতে, একদিন ব্যাবসা মানে মিষ্টির দোকানটাও টিকিয়ে রাখতে পারলো না (!?)।
খুব খারাপ লেগেছিল, যখন সে ঢাকা ছেড়ে আরিচা চলে যায়। আসলে আরিচা যাবার মাধ্যমেই আমার সাথে প্রদীপের দূরত্ব বাড়তে থাকে, আমাকে সে কোনদিন মিথ্যা বলতো না। যদি বলতাম, কেমন আছিস, সে ভাল থাকলে "ভাল" আর খারাপ থাকলে "খারাপ" বলতো, কোন ভনিতা করতো না।
কিন্তু আরিচা যাবার পরে দেখলাম আমি যাই বলি, সে বলে "হ্যা ঠিক আছে"।
এদিকে প্রদীপ আরিচা চলে গেল আর আমি মিরপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ চলে আসলাম। ওদিকে পলাশ চলে গেল অন্য মেসে। শিপলু চলে গেল অস্ট্রেলিয়া। শুধু সোহাগ থাকল গাউছিয়া মার্কেট নিয়ে।
একদিন আমি আরিচা বেড়াতে গেলাম, সে সময় আরিচার বন্ধুরা “অধুনা” নামের একটা ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত। সারাদিন চা, সিগারেট আর ২৯ মানে তাস খেলা চলছে।
আমি উঠেছিলাম সোহাগের বাসায় আর দুদিন ছিলাম সেখানে। সোহেল, সোহাগ, টিপু, কালা, লিটন... (অন্যরা সবাই যারা ছিল) প্রদীপের সাথে দেখলাম ভালই দিন কাটাচ্ছে...।
আমি সেদিন একটা খারাপ কাজ করেছিলাম, মনেহলে আজও লজ্জা লাগে। খারাপ কাজটা হল, আমি সে সময় প্রদীপকে রাতে কথা বলার মতো একটা মেয়ের নাম্বার দিয়েছিলাম, সেই নাম্বার ছিল আমার বানানো একটা নাম্বার (ইচ্ছে মতো দশটা সংখ্যা বানানো)। প্রদীপ সেই নাম্বারে ফোন দিয়ে রাতে এক মহিলার কাছ থেকে ইচ্ছে মতো বকা/ঝারি খেয়েছিল...(ভাবলে, এখনও মন খারাপ হয়ে যায়...)।
(গ্রামীণফোন, তখন “রাতের-গল্প-খরচ-অল্প” টাইপ অফার দিয়ে আমাদের উৎসাহী করেছিল, মেয়েদের নাম্বার সংগ্রহ করে রাতভর কথা বলার...!?)
যাই হোক, একদিন সোহাগ আমাকে ফোনে জানায় প্রদীপের বিয়ে ঠিক হয়েছে...। আমি আরিচার সব বন্ধুদের সাথে পুরাণ ঢাকায় দেখা করি, তারপর প্রদীপের বিয়ের বাসে চরে বিক্রমপুর যাই। সেই বিয়ের রাতে প্রচণ্ড শীত পড়ে ছিল। প্রদীপ আর নতুন বউকে একটা পিড়িতে বসিয়ে শুন্যে তুলে নাচানো হয়েছিল মাঝরাতে...। আমার প্রেমিকা (এখন বউ) শিখা তখন সামসুন্নাহার হলে থাকে, আমি সেই রাতে শিখাকে ফোনে বিয়ের ঘটনার বিস্তারিত বলে, অনেক মজা করেছিলাম...।
সেই রাতে আমাদের এক বন্ধু পানির বদনা ছাড়াই গ্রামের টয়লেটে গিয়েছিল। তারপর সে টয়লেট থেকে বার বার সোহাগ আর সোহেলকে ফোন করেছিল পানির জন্য। আমরা হাসতে হাসতে পাগল হয়ে যাই কিন্তু কেউ পানি নিয়ে এগিয়ে যাই না... হা হা হা।
সারারাত বন্ধুরা তাস খেলে আর গল্প করে কাটিয়ে ছিলাম। সকালে উঠে প্রদীপের সাথে দেখা করে আমরা ঘন কুয়াশা আর শীত মাথায় নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে চলে আসি যার যার ঠিকানায়। সেই বিয়ের রাত আর তারপর দিন সকালের শীত আমার আজীবন মনে থাকবে...।
একদিন, যখন আমি ন্যাশনাল ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ শাখায় কাজ করি, আমাকে সোহাগ ফোন দিল।
দিয়ে বলল, দোস্ত একটা খারাপ খবর আছে।
আমি বললাম, কি?
সে বলল, প্রদীপ সুই-সাইড করে মারা গেছে...!?
আমি দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লাম... (বলে কি?) আমার পাশের একজন আমাকে বলল, ভাই কি হয়েছে? আমি বললাম, ভাই আমি জানি না... আমার খুব খারাপ লাগছে... মনে হচ্ছে আমার শরীরটা অবশ হয়ে যাচ্ছে, মাথা কাজ করছে না...।
সোহাগ আমাকে জানায়, প্রদীপের বাবা মারা যাবার পরে সংসারের অনেক ঝামেলা শুরু হয়, একদিকে ঢাকা থেকে ব্যাবসা খারাপ করে বাড়ী ফিরে যাওয়া, একদিনে নতুন বউ আর একটা মেয়ে, একদিকে বাবা মারা যাবার পর মায়ের একা হয়ে যাওয়া। সর্বোপরি সারাদিন বন্ধু বান্ধব নিয়ে পরে থাকা মানুষটা সংসারের প্যাচে পরে নিজেকে সামলাতে পারেনি।
এদিক দিয়ে প্রদীপের বন্ধুরাও বড় হয়ে গেছে; তাদের চাকরী, ব্যবসা, পরিবার আছে তাই তারাও ঠিক সেভাবে প্রদীপকে বুঝতে পারেনি।
যাই হোক, সেদিন নাকি প্রদীপ মা/বউয়ের উপর রাগ করে কিছু একটা খেয়ে ছিল (আত্মহত্যার জন্য)। যখন বুঝতে পারে কাজটা ঠিক হয়নি; মানে সে মারা গেলে মা/বউ দুজনেই পুলিশের ঝামেলায় পরবে; তখন সে শিবালয় (আরিচা) থানায় যায়, গিয়ে পুলিশের ওসি সাহেবকে বিস্তারিত বলতে চায়...। পুলিশের ওসি তখন থানার ছিল না। অন্যদিকে প্রদীপকে পুলিশ পাত্তা না দেয়াতে; সে রিক্সায় নিয়ে যখন থানা থেকে বেড়িয়ে আসছে (থানার গেটের কাছে) এমন সময় সে রিক্সা থেকে পরে যায়।
রিক্সাওয়ালা আর আশেপাশের লোকজন প্রদীপকে ধরে পরীক্ষা করে দেখে, যে সে মারা গেছে...।
আজ, প্রদীপ মারা গেছে অনেক দিন হল, আরিচার কেউ হয়তো প্রতিদিনই ওকে মনে করে। আমার আরিচা যেতে মন চায় না। কেননা আমি এই আরিচার তিন বন্ধুকে এক্সিডেন্টে মারা যাবার খবর পেয়েছি।
প্রথম ছিল অসিউর,
তারপর রেজাউল আর
শেষটা প্রদীপ...।
যে শহরে আমার ছেলেবেলার এতো স্মৃতি...
প্রথম ভাললাগা,
প্রথম দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া,
প্রথম প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পাওয়া...
প্রথম অনেক কিছু...। সে শহরকে ইদানীং ভাবলেই একরাশ বিষণ্ণতা আমাকে গ্রাস করে...আমি আসলে সে শহরে বেড়াতে গিয়ে কি খুঁজে পাবো, তাই জানিনা...!?
........................
আত্মহত্যার পর
- খোরশেদ খোকন
প্রদীপ, তোর আত্মহত্যার পর
আমাদের যাবতীয় পরিকল্পনা ছুঁড়ে ফেলে
মেঘশূন্য দুপুরের রোদে ঘেমে একত্র হলাম।
চায়ের দোকানে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হল
চূড়ান্ত মুহূর্তে কেউ কেউ চোখের জল সামলাতে ব্যার্থ হলো।
আমি জানি,
আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেলে
তুই বিতর্কটাকে মধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো
তোর নিজের দিকে টেনে নিতে পারতি...!
জানি, তর্কের প্রয়োজন কখনই ফুরিয়ে যায়না
তবুও “তোর সাথে আর তর্ক হবে না”
এই ভেবে, আমরা সিগারেটে আগুন ধরালাম
ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় পরিচিত সন্ধ্যাটাও নামলো।
সেদিন হৃদয়ে, যে শূন্যতাটা নামলো
তাকে আর কোনদিন, মুছে ফেলা গেলো না...!
-----------------
(প্রথম ছবিতে বাম থেকে সোহাগ, প্রদীপ আর মামুন।)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.