![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।
পর্বঃ-০৩ (দাদার বাড়ী)
------------------
বাবা তখন জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী থানায় চাকরী করতেন। আমরা বাবা, মা, আপা আর আমি সরিষাবাড়ী পাইলট স্কুলের অপোজিটের একটা টিনের ঘরে ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেখানে থাকতে আমি আর আমার বড়বোন দু’জনে একই প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম।
বাসার পেছনে একটা বড় ডোবা ছিল, সেই ডোবার ওপারে ছিল রেল-লাইন। যখন রেলগাড়ী আসতো, একটা হুইসেল বাজতো। হুইসেল শুনলেই আপা আর আমি ঘর থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে পড়তাম। দেখতাম ডোবার ওপার দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে রেলগাড়িটা দূরে চলে যাচ্ছে...।
আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি, শীতের ছুটি আর বছরের দুইটা ঈদ মানেই ছিল দাদার বাড়ী আর নানার বাড়ী। ছুটি হলে খুব ভোরে পরিবারের সবাই মিলে সরিষাবাড়ী রেলষ্টেশন থেকে লোকাল ট্রেনে রওনা হতাম জামালপুর। তারপর জামালপুর বাস স্ট্যান্ড থেকে টাঙ্গাইলের বাসে রওনা হতাম। আমাদের গ্রামের বাড়ী টাঙ্গাইল শহরের আগেই তাই আমরা এলেঙ্গা স্টেশনে নেমে যেতাম। জামালপুর থেকে টাঙ্গাইলের দিকে আসতে মধুপুরে এসে বাসটা আধা ঘণ্টার একটা বিরতি দিতো। সেই বিরতিতে আমরা দুপুরের খাবারা আর হাটা চলা করে ফ্রেশ হয়ে নিতাম নতুন করে বসা জার্নি শুরু করার জন্য। যাই হোক, বিকেল ৩/৪ টার দিকে আমরা এলেঙ্গা স্টেশনে নেমে ভ্যান গাড়ীতে নদীর ঘাটে যেতাম।
আমার প্রিয় নৌকা ভ্রমণটা শুরু হতো, এলেঙ্গা নদীর ঘাট থেকে...। সে সময় যন্ত্র চালিত নৌকা ছিলনা। বৈঠা চালিত পালতোলা নৌকায় এলেঙ্গা থেকে নদীতে পশ্চিম দিকে যমুনা নদীর দিকে আমরা এগিয়ে যেতাম। মাঝে মধ্যে বাতাসের প্রবাহ বিপরীত দিকে থাকলে নৌকাটাতে রশি বেঁধে দুই/তিন জন লোক টেনে নিয়ে যেতো নদীর পাড় ধরে, যাকে টাঙ্গাইলের লোকেরা বলে গুণটানা।
প্রায় সব ঘাটেই লোকাল বাসের মতোই নৌকাকে ভেড়ানো হতো; লোকজন একঘাট থেকে উঠে অন্যঘাটে নামে যেতো। একঘাটের লোক অন্যঘাটের লোকের সাথে খুব উচ্ছ্বাস নিয়ে কুশল বিনিময় করতো; ঐ গ্রামে তার আত্মীয়-স্বজনরা কেমন আছে তাও জেনে নিতো...। আমার ভীষণ ভাললাগতো এই সব সহজ সরল আর নীবির কথোপথন...।
আমার দাদার বাড়ির ঘাটে নৌকা ভেড়ানো হলে আমার একমাত্র ফুপু (নাম আমেনা) আর ছোটচাচা (নাম আজিজ) এসে আমার বড়বোন রোজী আর আমাকে কোলে তুলে বাড়িতে নিয়ে যেতো। আমার দাদি, বাড়ির আঙিনা থেকে আমাদের পথের দিকে চেয়ে থাকতো...।
আমাদের ভাইবোনদের নদীতে নামা নিষেধ ছিল তাই দুপুরে একপাল গ্রাম্য ছেলেমেয়ের সাথে দাদা বাড়ীর পুকুরে গোছল করতাম। আম গাছের ডাল থেকে পুকুরের পানিতে লাফিয়ে পড়তাম...। পুকুর পাড়ে দুই/তিনটা বড় বড় জবা ফুলের গাছ ছিল, গাছে গাছে লাল-লাল আর হালকা সাদা-লাল ফুলেরা ফুটে ঝুলে পরতো জলের উপর...।
বাড়ির সীমানার পেরলেই সমতল কৃষি জমি। গ্রীষ্মকালে, চাঁদের আলোয় ভরা রাতে আমি আর দাদা আমাদের ঘরের বারান্দায় ঘুমাতাম। দাদা আমাকে নবীদের জীবন কাহিনী শুনাতেন। এখনো মনে আছে সেই হাতেম তাইয়ের গল্প, সোনাভান বিবির গল্প...।
আমার দাদা হুক্কার মাধ্যমে ধূমপান করতেন। আমি দেখতাম তিনি হুক্কায় টান দিচ্ছেন আর একটানা শব্দ হচ্ছে, রিদমের মতো লাগতো সেই শব্দগুলো...। তিনি পায়ে খড়ম পরতেন আর কাঁধে সব-সময় একটা গামছা ঝুলিয়ে রাখতেন...।
ফজরের আযানের আগেই দাদা ঘুম থেকে উঠতেন, তারপর নামাজ আদায় করে গরু নিয়ে কৃষি কাজ করতে মাঠে যেতেন।মাঠটা আমাদের বাড়ীর সামনেই পূর্ব দিকে। আমি দাদার কৃষি কাজ দেখতে মাঠে যেতাম সকালে নাশতা করার পরে...।
মনেপড়ে, একদিন জোর করে গরু দিয়ে জমি হাল দেয়ার মইয়ে চড়ে ছিলাম। তারপর যথারীতি, মই থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম। তখন আমাদের একমাত্র ঔষধ ছিল দূর্বা ঘাসের রস। দাদা আমাকে মন্ত্র পড়ে দূর্বা ঘাসের রস পায়ে মেখে নিয়ে ঝাড়ফুঁক দিয়েছিলেন। আমার ব্যথা গায়েব হয়ে গিয়েছিল...।
দাদা চাকু দিয়ে আখ টুকরো টুকরো করে কেটে দিতেন, আর আমি ক্ষেতের আলে বসে চিবিয়ে চিবিয়ে রস খেতাম। ঘাস ফড়িং আর প্রজাপতির পেছনে ঘুরতাম।
একদিন আমি, দাদাকে আকাশে উড়তে থাকা ঘুড়ি দেখিয়েছিলাম। তারপর, দাদা আমাকে কাগজের ঘুড়ি বানিয়ে সেই দিনই ঘুড়ি উড়াতে শিখিয়েছিলেন...।
আমার জীবনের প্রথম কষ্টের স্মৃতিটা আজও মনেপড়ে। আমি মানুষের মৃত্যু এবং মৃত্যুর পর যেভাবে কবর দেয়া হয়, সেটা জানতাম না।
প্রায় আশি (৮০) বছর বয়সে আমার দাদার মৃত্যু হয়। আমি সেদিন গ্রামের বাড়িতেই ছিলাম। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সব বয়সের লোক আমাদের বাড়িতে এসেছিল। আশেপাশের গ্রামে আমাদের যতো আত্মীয়স্বজন ছিল, তারা সবাই এসেছিলো। বাড়িতে বাচ্চারা আর মহিলারা একটানা কান্নাকাটি করছিল।
গ্রামের লোকজন দাদাকে গোছল করিয়ে নতুন সাদা কাপড় পড়াল। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব ধর্মীয়/সামাজিক আনুষ্ঠানিকতা দেখলাম। তারপর তারা দাদার ইচ্ছে অনুযায়ী তার প্রিয় জমিতে (যে জমিতে তিনি কৃষি-কাজ করে জীবনের বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করেছেন) কবর দেয়া শুরু হল।
সবাই দাদাকে কবরে নামিয়ে মুঠো মুঠো মাটি দিতে লাগলো...। আমি দাদার কবরে মাটি দেয়া মানতে পারলাম না..., সবাইকে থামতে বললাম। ফুপু, চাচাকে বললাম তোমরা লোকদের থামাও, দাদা কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনল না...।
দাদার মৃত্যুর পর আমি কাঁদি নাই। কিন্তু যখন আমি দেখলাম কেউ আমার কথা শুনল না। আমি কাঁদতে লাগলাম ‘এক সময় মাটিতে গড়া গড়ি দিয়ে কাঁদলাম’
আমি আমার দাদার কবরে মাটি দেই নাই।
আমি আমার দাদার কবরে কি করে মাটি দিবো?
আমার দাদাতো আমাকে কোনদিন কাউকে কষ্ট দিতে শিখায় নাই!
--------------------
২২ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৪১
খোরশেদ খোকন বলেছেন: আপনার ভাল লেগেছে... এটা জেনে, আমারও ভাল লাগছে, শুভেচ্ছা।
©somewhere in net ltd.
১|
২২ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:১৪
ক খ ত্রিমোহনী বলেছেন: খুব ভাল লাগল।