নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার জন্ম টাঙ্গাইলের হামজানি গ্রামে। শৈশব, কৈশোরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ছিলাম; বাবার সরকারী চাকুরীর জন্যে। কলেজ ছিল টাঙ্গাইল জেলায়। তারপর পড়াশুনা ঢাবি\'র ফিন্যান্স বিভাগ। গত নয় বছর যাবত প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মজীবন চলছে। www.facebook.com/khokonz

খোরশেদ খোকন

এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।

খোরশেদ খোকন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির জোনাকিরা... (শৈশবের দিনগুলি-০৬)

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২০

সময়টা ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে হবে, বাবা তখন শেরপুর জেলার নকলা থানার চাকরী করতেন। আমদের পরিবারের জন্য সরকারী কোয়ার্টার ফাঁকা ছিলনা; তাই আমরা একটি পুরাতন জীর্ণ টিনের ঘরে ভাড়া থাকতাম। বাড়ীর সামনে ছিল কাঁচা বাজারের রাস্তা, সম্ভবত সপ্তাহে দুইদিন হাট বসতো, আর প্রতিদিন বিকেলে দেখতাম বাড়ীর বারান্দায় পান-সুপারি, তেল-নুন, মশলা-পাতি আর বাদাম-ছোলার দোকান বসতো। মানুষজন জটলা করে আমাদের বাড়ীর বারান্দায় বিকেল ৪টা থেকে রাত ৮টা নাগাদ সদাই-পাতি কেনাকাটা করতো। আমরা বিকেল হলেই ঘরের সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দিতাম।

বাড়ীটার পেছনে মানে পশ্চিম দিকে ছিল নিচু জামি, সেখানে গ্রীষ্মকালে এক ফসলের চাষ হতো আর বাকী সময়টা পানিতে পরিপূর্ণ থাকতো। বাড়ীর পেছনের দিকে তাকালে মনে হতো সারা দুনিয়া বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। বাড়ীর সামনে হেঁটে বেড়ানোর জায়গাটার পুরোটাই ছিল বাজার; আর বাড়ীর পেছনে ছিল অথৈ পানি। আমাদের সব সময় দম বন্ধ মানে বন্দি বন্দি লাগতো। বাবা অফিসে যেতেন সকাল ৮টায় আর ফিরতেন রাত ৮টায়। মা, আপা আর আমি; আমরা এই তিনজন সারাদিন ঘরের মধ্যেই বন্দি থাকতাম।

একটি সরকারি প্রাইমারী স্কুলে আমি আপার সাথে যেতাম কিন্তু পড়াশুনা কি করেছিলাম তা মনে নেই...!? প্রতিদিন বিকেল বেলা আপা আর আমি বাবার অফিসে যেতাম, বাবা আমাদের দুইজনকে এক টাকা করে মোট দুই টাকা দিতেন। আমরা সেই টাকা দিয়ে সারা বাজার ঘুরে ঘুরে হাওয়াই মিঠাই, হজমী, বাদাম, পানি-ফল (সিঙ্গারা), বাদাম আরও হরেক রকম খাবার কিনে খেতাম। দুই ভাইবোন মিলে বিকেলে হাত ধরাধরি করে সারাটা-বাজার, বাবার অফিস, স্কুলের মাঠ আর বড় রাস্তায় বেড়াতে যেতাম।

আমাদের স্কুলের পাশে একটা নতুন বাড়ী হচ্ছিল সেখানে বিভিন্ন মানুষ ইট-ভাঙ্গার কাজ করতো আমরা দুইজন প্রতিদিন তাদের ইট-ভাঙ্গা দেখতাম। বাবার অফিসের কাছে একটা পুকুর বানানো হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে আমরা মাটি-কাটার কাজ দেখতাম; মাটি-কাটার সময় মাটির ভেতর থেকে এক প্রকার বড় বড় পোকা বের হতো, সেই পোকাগুলো আবার উড়ে উড়ে দূরে চলে যেতো, আমরা সেই পোকা দেখতাম আর ভয় পেতাম। মাটি কেটে কেটে ঢালু সিঁড়ির মতো বানানো হতো, আমরা সেই ঢালু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতাম আবার উপরে উঠে আসতাম...এই খেলাটা আমাদের খুব ভাল লাগতো।

বাড়ীর অদূরে একটা ধানের খলা (ধান মাড়াইয়ের কারখানা) ছিল। তপ্ত রোদে মহিলারা ধান শুকানোর কাজ করতো। কাঁচা ধান সিদ্ধ করে হাপর দিয়ে টেনে টেনে ছড়ানো হতো রোদে, মহিলারা দল বেঁধে সেই কাজ করতো। পুরুষরা ধান সিদ্ধ করার বিশাল চুলায় আগুন দিয়ে পানি বাস্প করার কাজ করতো। আমরা ধান সিদ্ধ করা থেকে চাল বানিয়ে বস্তা বোঝাই করা পর্যন্ত কাজটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখতাম।
আমাদের বাসার পাশেই একটা সাইকেল-রিক্সা সারাই করা মেকানিকের দোকান ছিল। সেই দোকানের পেছনেই ছিল দোকানদারের বাড়ী, সে আমাদের মজার মজার খেলনা বানিয়ে দিতো। কাগজের নৌকা, কাগজের প্লেইন, কাপড়ের পুতুল, গাছের শিকড়-বাঁকর দিয়ে খেলনা পিস্তল বানানোতে তার অসম্ভব পারদর্শিতা ছিল। সে সুযোগ পেলেই তার রিক্সায় ফ্রি ফ্রি আমাদের নিয়ে সারা বাজার ঘুরে বেড়াতো...। সেই মেকানিকের রিক্সার বেল বাজানোর একটা প্যাটার্ন ছিল; আজও সেই রিদম কানে বাজে...!

আমাদের বাড়ীর পেছনের ডোবায় অনেক শাপলা ফুল ফুটে থাকতো। কলমি আর হেলেঞ্চা জাতীয় শাক হতো। কচুরিপানা ভেসে যেতো আর সাদা-বেগুনি ফুল ফুটে থাকতো। পাশের বাড়ীর লোকেরা আর আমাদের বাড়ীর মালিক সবাই হাঁস পালতো। আমরা সন্ধ্যায় দেখতাম ঝাঁক বেঁধে হাঁসগুলো প্যাক প্যাক করতে করতে ডোবা থেকে উঠে আসতো বাড়ীতে। ডোবার গাঁয়ে হাঁসের ডিম পাওয়া যেতো। সেই ডিম আমরা কুড়িয়ে আনতাম। বর্ষা মাসে আমরা নৌকা দিয়ে ডোবায় বেড়াতে যেতাম। হাঁসের মাংসের রান্না হতো খুব মজা করে খেতাম...!
আমাদের পাশের বাড়ীতে সখিনা নামে একটি ৮ম কিংবা ৯ম শ্রেণীতে পড়া মেয়ে থাকতো, আমরা তাকে সখী খালা বলতাম। সখী খালার মা বাবাকে দেখতাম প্রায়ই সখী খালাকে স্কুলে যেতে দিতেন না, সব সময় চোখে চোখে রাখতেন। সে খালা অনেক গান জানতো, তার প্রিয় ছিল ছায়াছাবির গান, তার একটা গানের খাতাও ছিল, সে তার খাতাটার খুব যত্ন করতো, কাউকেই ধরতে দিতো না!

সে সময় বাংলা সিনেমার নায়ক-নায়িকারা মানে আলমগীর-সাবানা, রাজ্জাক-কবরী, জাফর ইকবাল-ববিতা এরা মানুষের মুখে মুখে খুব জনপ্রিয় ছিল। আমাদের সখী খালা সারাদিন ছবির গল্প বলতো আর রেডিওতে গান শুনতো। আমাদের দুনিয়াটা রঙ্গিন করে দিয়েছিল আমাদের সেই সখী খালা।

যাই হোক, আমরা তখন প্রেম- ভালবাসা, বিয়ে-পরিবার এসব কিছুই জানতাম না। আমাদের বাড়ীর পেছেন ডোবার সীমানায় তাল গাছ ছিল; রাতে পাকা তাল পানিতে পড়তো আর আমরা বলতাম বাড়ীতে ভূত এসেছে... গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকতাম আর ভোরে দেখতাম বাড়ীওয়ালা আমাদের পাকা তাল দিয়ে যেতো; তালের রস আর রস দিয়ে বানানো পিঠা খাবার জন্য। বাড়ীওয়ালা আর তার স্ত্রী খুব ভাল মানুষ ছিল, যাই তাদের বাড়ী রান্না হতো আমাদের এক বাটি দিয়ে যেতো। খাবার দেয়া-নেয়া দেখে মনে হতো, তারা আমাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় হন।

আমরা বুঝেছিলাম, বাড়ীর আশেপাশের কেউই সখী খালার স্বাধীনচেতা স্বভাব আর গান গাওয়াটাকে ভাল ভাবে নিতো না। সখী খালাদের বাড়ীর পেছনে ছিল বিশাল একটা বেল গাছ। আমরা সারা বছরই সখী খালাদের গাছের বেল পেতাম, সেই সময় কাঁচাবেল পুড়িয়ে খেতাম, কাঁচাবেল খাটের নিয়ে রেখে রেখে পাকিয়ে তারপর খেতাম, বাবা পছন্দ করতো পাকা বেলের সরবত। বিকেলে ছুটির দিনে মৌসুমি ফল আর ফলের সরবত বানিয়ে খাওয়া ছিল বাবার খুব আনন্দের কাজ।

সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাবা হাঁসের মাংস আর খিচুড়ি রান্না করতেন আমারা জটলা পাকিয়ে সেই রান্না করা দেখতাম, বাবার রান্না করা খিচুড়ি আর মাংস পেট-পুড়ে খেয়ে মনে মনে বলতাম, একদিন আমিও রান্না করবো বাবার মতো...!

মনে আছে, আমি মাথার চুল কাটার ব্যাপারে খুবই ঝামেলা করতাম, কিছুতেই নাপিতের দোকানে যেতাম না...। বাবা আমার ইচ্ছে মতো মিষ্টি খাওয়ার শর্তে রাজি হলেই কেবল আমি চুল কাঁটার ব্যাপারে রাজি হতাম। আমার স্বভাব মতো একদিন চুল কাঁটার নাপিতের দোকানে চুল কাটছিলাম, বাবা কি কাজে জেনো নকলা বাজারের অন্য-দোকানে গিয়েছিলেন। আমি চুল কাটা শেষে মিষ্টি খাবার জন্য বাবা কে একা একা সারা-বাজার খুঁজছিলাম। সেই অন্যমনস্ক খোঁজা খুঁজির মধ্যে আমার পায়ের উপর দিয়ে একটি সাইকেল চলে গিয়েছিল। আমি যখন রাস্তার পাশে বসে কান্না কাটি করছিলাম তখন বাবা আমাকে খুঁজে পান। বাবার সাথে সেই আমার জীবনের প্রথম হাসপাতালে যাওয়া আর গজ দিয়ে ব্যান্ডেজ করা...। বাবার চোখ সেদিন এতোটাই লাল হয়েছিল যে, তার চোখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না...।

বাসায় আসার পর মা আর আপা কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিল..., আমি সপ্তাহ খানেক ছুটি পেয়েছিয়াম স্কুলে যাওয়া থেকে...!
একদিন, সকালে শুনলাম আমাদের পাশের বাড়ী মানে সখী খালাদের বাড়ীতে কি জেনো একটা ঘটনা ঘটেছে; তাই বাজারের সব মানুষ ভীর করে আছে, বাড়ীর সবাই কান্না কাটি করছে, থানা-পুলিশ কাণ্ড ঘটে গেছে। বাজারের সবাই শুধু বলছে সখী এটা কি করলো!? আপা আর আমি কিছুই বুঝিনা, এদিকে মা আমাদের সখী খালাদের বাড়ী যেতে দিচ্ছেন না। কেন দিচ্ছেন না তাও বুঝলাম না, এদিকে মা বললেন আজ তোমাদের স্কুলের যেতে হবে না।

আপা আর আমি জানালা দিয়ে বাজারের লোকজনের কথা শুনে যা বুঝলাম সেটা ছিল এইযে, গতরাতে আমাদের সখী খালা তাদের বাড়ীর পেছনের বেল গাছে ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে...!? কেউ বলছিল, ভূত-প্রেত এ কাজ করেছে; কেউ বলছিল বাবা-মা এতো অত্যাচার করলে তো ফাঁসি দিবেই। কেউ বলছিল, পাশের পাড়ার একছেলের সাথে নাকি সখী খালার কি একটা সম্পর্ক ছিল; সেই ছেলে দুইদিন আগে বিয়ে করেছে তাই সখী খালা মনের দুঃখে ফাঁসি দিয়েছে।

যাই হোক, আমাদের সখী খালাকে বেল গাছ থেকে নামানো হলো, থানা-পুলিশ বাড়ীতে আসা যাওয়া হলো, কেন জানি খালাকে হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া হলো, এদিকে বাজারে একটাই আলোচনা আর সেটা হলো সখী খালার ফাঁসি...।
জীবনের প্রথম ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করতে শুনলাম। কেউ আমাদের সখী খালাকে শেষবার দেখার সুযোগ করে দিলো না; মনে মনে খুবই কষ্ট পেলাম...।

আপা আর আমি আমাদের প্রতিদিন আনন্দ, হাঁসি, গান মানে ভাললাগার একটি মাত্র স্বাধীন মানুষকে হারিয়ে কেমন জেনো নীরব হয়ে গেলাম...।

তারপর থেকে আপা আর আমি বিকেল বেলা ডোবার দিকে যাই না; সন্ধ্যার আগেই ঘরে চলে আসি; কাঁচা পাকা কোন বেলই খাই না। প্রতিরাতেই অন্ধকার হলে ভূত-প্রেত আর শয়তান এসে আমাদের ভয় দেখায়...।
একদিন আমাদের সখী খালার ভূত এসে আমাদের ঘাড়-মটকাবে; এটা ভেবে আতংকিত হই। মনে মনে ভাবী কোনদিন কি সখী খালার মনে আমরা দুঃখ দিয়েছি!?

যদি নাই দিয়ে থাকি, তাহলে ভুতটা গল্প থেকে কিভাবে রাতের অন্ধকারে আমাদের ঘরে এসে ঘাড়-মটকাবে!?
-----------------------
২৮ আগস্ট ২০১৫

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ৩:২৮

এ কে এম রেজাউল করিম বলেছেন:
আজকের আপনার "স্মৃতির জোনাকিরা"-এর স্মৃতি পড়িয়া মনটা খারাব হইয়া গেলো।
তবুও আপনার লিখা সব সময়ই ভালো লাগিয়া থাকে এবং আপনার প্রতিটি পোষ্টই আমি পড়ি।


আপা আর আমি আমাদের প্রতিদিন আনন্দ, হাঁসি, গান মানে ভাললাগার একটি মাত্র স্বাধীন মানুষকে হারিয়ে কেমন জেনো নীরব হয়ে গেলাম...।

বাড়ীর আশেপাশের কেউই সখী খালার স্বাধীনচেতা স্বভাব আর গান গাওয়াটাকে ভাল ভাবে নিতো না।
এটা কোন সালের কথা?

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২৭

খোরশেদ খোকন বলেছেন: আপনি আমার লেখা পড়েন জেনে খুবই ভাল লাগছে।
সময়টা ১৯৮৬-৮৭ সালের দিকে শেরপুর জেলার নকলা থানার।
ভাল থাকবেন, সব সময়। ধন্যবাদ।

২| ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০৭

টয়ম্যান বলেছেন: শৈশবই ভালো । সুন্দর লেখা

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:২৯

খোরশেদ খোকন বলেছেন: আপনার সুদৃষ্টি আর স্মৃতিকথা পড়ার আগ্রহকে সাধুবাদ জানাচ্ছি।
ভাল থাকবেন। শুভেচ্ছা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.