নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার জন্ম টাঙ্গাইলের হামজানি গ্রামে। শৈশব, কৈশোরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ছিলাম; বাবার সরকারী চাকুরীর জন্যে। কলেজ ছিল টাঙ্গাইল জেলায়। তারপর পড়াশুনা ঢাবি\'র ফিন্যান্স বিভাগ। গত নয় বছর যাবত প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মজীবন চলছে। www.facebook.com/khokonz

খোরশেদ খোকন

এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।

খোরশেদ খোকন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির জোনাকিরা... (কৈশোরের দিনগুলি-০২)

১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২১

সেই সময়টা ছিল ১৯৯৩ সালের মার্চ মাস। বাবা মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে বদলী হয়ে শিবালয় থানায় চলে এসেছেন আর আমরা আরিচায় বসবাস করা শুরু করেছি। আমি শিবালয় সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছি। মানিকগঞ্জ সরকারী স্কুলের সহপাঠী বন্ধু শিশির (Bhuiyan Ehatasham) একদিন আমাদের আরিচার বাসায় এসে উপস্থিত। ১৯৯৩ সালের ২৫শে মার্চ দিনটি ছিল ঈদুল ফিতর। ঈদের দিনে মানিকগঞ্জ শহরের বাস স্ট্যান্ড এলাকার নবীন সিনেমা হলে তখন একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল নাম ছিল “কেয়ামত থেকে কেয়ামত”। সালমান শাহ আর মৌসুমি জুটির প্রথম ছবি।

শিশির ছবিটি দেখেছিল আর আমাকে বলেছি, চল মানিকগঞ্জ গিয়ে ছবিটা তোকে দেখাই। আমি বলিউডের আমীর খান (Aamir Khan) আর জুহি চাওলা (Juhi Chawla) অভিনীত ১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া ““Qayamat Se Qayamat Tak”” ছবিটা দেখেছিলাম ১৯৯২ সালে; তাই বাংলা রিমেক ছবি দেখার তেমন আগ্রহ ছিল না। আমার জানা ছিল ““Qayamat Se Qayamat Tak”” ছবিটা ছিল ইংরেজ সাহিত্যিক Shakespeare এর “Romeo and Juliet” গল্পের অনুকরণে তৈরি গল্প নিয়ে সিনেমা।
সে সময় আরিচায় আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তেমন কেউ ছিলনা, তাই আমি সময়/সুযোগ পেলেই মানিকগঞ্জ যেতাম আর শিশিরও সময়/সুযোগ পেলেই আরিচায় চলে আসতো।

যাই হোক, শিশিরের সাথে সময় কাটানো আর মজা করতেই সেদিন আমি মানিকগঞ্জ গেলাম আর “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” ছবিটা দেখলাম। সত্যি কথা বলতে কি, আমি ছবিটা দেখে ১০০ তে ৬০ এর বেশী নাম্বার দেয়ার মতো কিছুই পেলাম না!?
যতোই দিন যেতে লাগলো, ছেলেরা মেয়েরা ছবিটা দেখতে লাগলো আর সারা দেশে সালমান শাহ আর মৌসুমি বিখ্যাত হয়ে গেলো। একটা সময় এসে গেলো, যখন যুবক ছেলেদের স্টাইল আইকন হল, সালমান শাহ। মেয়েরা সালমান শাহ টাইপের হালকা পাতলা গড়ন, উজ্জল শ্যামলা, বড় কপাল আর বোকা বোকা টাইপের ছেলেদের পছন্দ করা শুরু করে দিল।

আমার যেহেতু শরীরের কোন কিছুই সালমানের মতো না তাই আমি মনে মনে জেলাসি হয়ে গেলাম। এক বন্ধুর বড়ভাই ঢাকায় কোন এক অনুষ্ঠানে সালমানের সাথে ছবি তুলেছিল, সেটা আমাকে দেখালো। আমি দেখলাম সিনেমাতে সালমানের যে চেহারা সেটাই প্রকৃত চেহারা, আমারও ভাল লাগলো, তবে জেলাসি গেলো না।

সে সময় যেহেতু ইন্টারনেট ছিল না তাই গুগলে সার্চ দিতে পারতাম না, আমাদের ভরসা ছিল দৈনিক পত্রিকা আর ম্যাগাজিন। একদিন সিনেমার খবর থেকে জানলাম, সালমানের আসল নাম “শাহরিয়ার চৌধুরী” আর ডাকনাম “ইমন”। ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সিলেট জেলার জকিগঞ্জ তার জন্ম। তাঁর পিতা কমর উদ্দিন চৌধুরী ও মাতা নীলা চৌধুরী। সে পরিবারের বড় ছেলে। সালমান শাহ ১২ আগস্ট ১৯৯২ বিয়ে করেছেন এবং তাঁর স্ত্রীর নাম সামিরা। আরও জানতে পারি যে, সে খুলনা বয়রা মডেল হাইস্কুল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৮৭ সালে ধানিমন্ডির আরব মিশন স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি, আর ধানমন্ডি'র মালেকা সায়েন্স কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করেন।

আমি বুঝতে পারি, জেলাসি হবার কিছু নেই। ১৯৯৩ সালে আমি পড়তাম অষ্টম শ্রেণীতে আর তখন সে পড়াশুনা শেষ করে বিয়ে করে রীতিমতো অভিনয়কে পেশা হিসেবে নিয়েছে।

যাই হোক জীবন থেমে থাকে না। ১৯৯৪ সালে বাবার বদলী হয় শেরপুর জেলায়। আমরা মানিকগঞ্জের আরিচা থেকে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি চলে যাই। আমি শেরপুর ভিক্টোরিয়া একাডেমীতে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হই। পরিবারের সবাই ছিল নালিতাবাড়ি বাবার সরকারী কোয়ার্টারে আর আমি স্কুলের জন্য ছিলাম বাবার পরিচিত এক উকিলের বাসায়।

উকিলের নাম ছিল, হেলাল আর তার বাসাটা ছিল শিংপাড়ায়। উকিলের স্ত্রী ছিলেন স্কুলের টিচার, তিনি তখন ময়মনসিংহ টিচার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে ট্রেনিং করছিলেন। তাদের ছিল একটি ছোট ছেলে যার বয়স ৪/৫ বছর। সেই বাসার রুম ছিল দুইটা একটাতে উকিল সাহেব থাকতেন আর অন্যটা বসার-ঘর মানে "উকিলের চেম্বার"। উকিলের বাবা এক সময় জাহাজে চাকরী করতেন। আমি সুযোগ পেলেই সেই মুরুব্বীর কাছ থেকে জাহাজে চাকরী-কালীন জীবন-যাপন নিয়ে গল্প শুনতাম।

উকিল সাহেবের ছোট ভাইয়ের নাম ছিল চঞ্চল। সে শেরপুর সরকারী কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তো। সে ছিল আমার বন্ধুর মতো। আমি আর চঞ্চল ভাই দুজনে টিনের ঘরের দুতলা মতো একটা খুপরি ঘরে রাতে ঘুমাতাম। সারাদিন শহরে কি কি ঘটনা ঘটলো তার গল্প শুনতাম চঞ্চল ভাইয়ের কাছে। আমার গল্প শুনতে খুবই ভাল লাগতো।

ভিক্টোরিয়া একাডেমীর দশম শ্রেণীর ক্লাসে একদিন পরিচয় হলো নাহিদের সাথে। সে তার নানার বাড়ি মানে জুগ্নিমুড়া গ্রামে থাকতো। জুগ্নিমুড়া গ্রামটা শেরপুর শহর থেকে ৫/৬ কিলোমিটার দূরে। নাহিদ ভাঙা-চোরা একটা সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন শহরে এসে স্কুলে ক্লাস করতো আর প্রাইভেট পড়তো। যাই হোক, সেই নাহিদ একদিন আমার শিংপাড়ার লজিং বাড়ীতে গেল আর আমার অবস্থা দেখে আমাকে প্রস্তাব দিল, চল আমরা একটা মেসে উঠি...।

যাই হোক, আমি আর নাহিদ ঢাকলহাটি নামের এলাকায় মমিন অটো-রাইস মিলের বিপরীতে একটা মেস পেয়ে উঠেগেলাম। সেই মেসের মালিক ছিলেন আমদের স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক (সম্ভবত নাম আমজাদ স্যার, ভুলও হতে পারে)।
সেই মেসে আমিনুল ভাই নামে একজন ছিল, সে শেরপুর কলেজে বিএ পড়তো আর একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে চাকরী করতো, আমিনুল ভাই দুনিয়ার সব জিনিস বাঁকা চোখে দেখতো। প্রায় প্রতিদিন মানুষের সাথে তার উটকো ঝগড়া লেগেই থাকতো, এতো ধৈর্যহীন মানুষ আমি আর জীবন দেখিনি!?

দুলাল ভাই নামে একজন ছিল, সে শেরপুর কলেজে বিকম পড়তো, তার বাড়ি ছিল চর এলাকায়, সে বিবাহিত ছিল, স্ত্রী গ্রামে থাকতো, প্রতি সপ্তাহে সে গ্রামে যেতো। এতো নরম স্বভাবের আর অল্পতে সন্তুষ্ট মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি।

বাড়ীর মালিকের ছেলের নাম ছিল সুজন ভাই। সে ঢাকায় থাকতো আর কবি নজরুল কিংবা জগন্নাথ কলেজে বিকম পড়তো। সে শেরপুর আসা মানেই ছিল ভরপুর আড্ডা। আড্ডা দিতে আসতো আতিক নামের একজন, সে জিমে ব্যায়াম করতো।

আমি আর নাহিদ এক-রুমে এক-বিছানায় থাকতাম। জানালা দিয়ে তাকালে রাস্তা দেখা যেতো। আমাদের পাশের ঘরে থাকতো জুয়েল নামের আমাদের এক বছরের ছোট এক বন্ধু। সে জিকে স্কুলে পড়তো আর ভাল ফুটবল খেলতো। জুয়েলের বাবা জামালপুর টি-এন্ড-টি অফিসে চাকরী করতো।

আমি আর নাহিদ মেলাতে পারতাম না যে; জুয়েল, জুয়েলের বাবা, জুয়েলের বোন এই তিনজন এতো ফর্সা আর সুন্দর হলেও জুয়েলের মা দেখতে এতো ঘন-কালো আর বিশ্রি ছিল কেন?

একদিন বিকেলে, কথাটা দুলাল ভাইয়ের সামনে তুললে সে একটি গল্প বলেছিল। গল্প বলছি কিন্তু বাস্তব সত্য; একদম বাংলা সিনেমার মতোই গল্প।

যাই হোক, গল্পটা হলো জুয়েলের বাবা খুব সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ, সে শেরপুর টি-এন্ড-টি অফিসে চাকরী করা কালীন সময়ে তার স্ত্রী আর বাচ্চারা কোন এক ছুটির জন্য গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। সেই ছুটির মধ্যে কিছু খারাপ লোক (যাদের সাথে জুয়েলের বাবার শত্রুতা ছিল) তারা টি-এন্ড-টি অফিসের পাশে বসবাসকারী এক গরীব কালো অশিক্ষিত মেয়েকে টাকা দিয়ে ষড়যন্ত্র করে জুয়েলের বাবাকে নারী ঘটিত সমস্যা ফেলে দেয়ার ব্যাবস্থা করে!

ষড়যন্ত্র সফল হয়, কেননা একরাতে কালো মেয়েটিকে টি-এন্ড-টি অফিসের কর্তাটির সাথে আপত্তিকর অবস্থায় পাওয়া যায় আর এলাকাবাসী ঝামেলা পাকায়। যেহেতু টি-এন্ড-টি অফিসের কর্তাটি ভাললোক, সেহেতু সে বিয়ে করে সমস্যার সমাধান করে।
গল্পটি শোনার পড় জুয়েলের মায়ের জন্য আমাদের খুব খারাপ লাগে, কেননা সারাজীবন সে চেষ্টা করছে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে উঠে আসতে।

আমার জানা মতে, সহপাথীদের মধ্যে তুহিন, সফিকুল, নাহিদ (বাড়ি সজবরখিলা), ইদি আমীন আর লাভলু আমাদের মেসে বেড়াতে আসতো।

আমি আর নাহিদ, নজরুল উকিলের ছেলে নাম মেহেদী ভাইয়ের কাছে বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়তাম। মেহেদী ভাই তখন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পড়তেন। তিনি বিবাহিত ছিলেন। বিকেলে মুখে একটা পান নিয়ে চিবুতে চিবুতে উকিলের চেম্বারে বসে আমাদের প্রাইভেট পড়াতেন; আমাদের মনে হতো মেহেদী ভাইয়ের মতো সুখী মানুষ আর দুনিয়াতে একটাও নেই।

আমাদের ব্যাচে একটি মেয়ে পড়া শুরু করেছিল (নাম ভুলে গেছি), মেয়েটির চোখের মনি ছিল সাদা-ঘোলা (আমরা যেটাকে বেড়ালের চোখ বলি)। সেই মেয়েটা খুব ফট ফট করতো পড়ার সময়। এদিকে নাহিদ পড়া বলতে না পারলে সেই মেয়েটি উচ্চ স্বরে হাসতো; আমার মেয়েটাকে খুব দুষ্ট আর অহংকারী মনে হতো।

সেই সময় শেরপুর শহরে এক বৃদ্ধ রিক্সা চালক ছিল (নাম জানিনা)। যদি বলতাম, ঐ পাড়ায় যাবেন? সে বৃদ্ধ বলতো, জামু। তারপর যদি বলতাম, কত নিবেন? সে বলতো, দেইন জে। সে রাস্তার সব রিক্সাকে মান্য করে আগে যেতে দিয়ে তারপর গন্তব্যে পৌঁছাতো। গন্তব্যে পৌঁছেই ভাড়া নিয়ে ঝাগড়া শুরু করে দিতো। সে বৃদ্ধ “দেইন জে” বলে যে "স্পেস" রাখতো সেই "দেইন জে" কথার সুযোগেই ভাড়া বাড়িয়ে নিতো।

আমি দেখেছি আমার কপাল যেদিন খারাপ থাকতো, সেদিন আমি সেই বৃদ্ধ রিক্সা চালককে রাস্তায় পেতাম...!?
আমাদের মেসে আড্ডা দিতে আসতো আতিক ভাই। আমরা জানতাম সে বিশ্বপ্রেমিক; লুকিয়ে লুকিয়ে পাশের পাড়ায় প্রেম করেন। একদিন আতিক ভাইয়ের প্রেমিকার বড়ভাই বিষয়টি নিয়ে তার সাথে কথা কাটাকাটি করে। তারপর থেকে আতিক ভাই আর তার বন্ধুরা প্রেমিকার পাড়ায় যাওয়া বন্ধ করে দেন, যদি কোন ঘটনা ঘটে...!?

না, শেষ রক্ষা হয় না, একদিন সন্ধ্যায় আতিক ভাই, দুলাল ভাই আর আমিনুলকে সেই প্রেমিকার‍ বড়ভাই রাস্তায় পেয়ে যায়, তারপর কিল, ঘুসি আর লাথি মারতে থাকে... মারতে মারতে রাস্তার পাশের ড্রেনে ফেলে দেয়...। আমাদের মেসে খবর আসে, আমরা দৌড়ে গিয়ে তাদের উদ্ধার করি আর প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য শেরপুর সদর হাসপাতালে যাই। তারপর জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে শেরপুর থানায় জেনারেল ডায়েরি করি।

যাই হোক, সেই মেসে ঝামেলা একটার পর একটা লেগেই ছিল বলে; আমি আর নাহিদ গৌরিপুর মেসে চলে আসি। এই মেসটা এক ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি। ব্রাক এনজিও অফিস হিসেবে তিনতলা বাড়ীটা ভাড়া নিয়েছিল আর পাশের ঘরটা ছিল হাফ বিল্ডিং; আমার সেখানেই উঠেছিলাম।

আমাদের মেসের কেয়ার-টেকার ছিল লিটন ভাই। সে ছিল রসিক মানুষ ছিল। সারাদিন গান-বাজনা, গল্প-গুজব, আর আড্ডা-বাজি করতো। সে চাচার প্রোপার্টি দেখাশোনা করতো আর শেরপুর কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়তো। সে তিনতলার চিলেকোথায় থাকতো আর জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে স্কুলগামী মেয়েদের ইশারা দিতো। আমরা ভাবতাম, এই সব ইশারায় কোন কাজ হয় না।
কিন্তু না, সত্যি সত্যি একদিন দেখলাম, তার চিলেকোঠায় একটি ফুট ফুটে সুন্দর মেয়ে এসেছে। স্কুল ড্রেসের মেয়েটা প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসে লিটন ভাইয়ের সাথে রান্না করে দুপুরে ভাত খেয়ে বিকেলে বাড়ি চলে যেতো...!? আমরা আশ্চর্য হয়ে দেখতাম।

আমাদের রান্না করতে আসা গ্রাম্য মেয়েটা ছিল ছিমছাম সুন্দর একটা ১৬/১৭ বছর বয়সী মেয়ে; যার স্বামী ছিল ভ্যান চালক। ভ্যান চালকের বয়স ছিল ৩৫/৪০ এর মতো, উচ্চতা ৬ ফুটের কাছাকাছি, বিশাল দেহের মানুষ, মুখ ভর্তি ব্রন, সারাদিন পান চিবাতো আর বিড়ি ফুঁকতো।

সে ভ্যান চালকটি আমাদের মেসের পূর্ব পাশের একটা টিনের ঘরে ভাড়ায় থাকতো। প্রায়ই সকালে কিংবা রাতে ভ্যান চালক লোকটি আমাদের রান্নার মেয়েটিকে স্ত্রী সম্পর্কের অজুহাতে তুচ্ছ কারনে মার-ধর করতো। আমরা আওয়াজ শুনতাম আর আমাদের হ্রদয় শূন্যতায় ভরে যেতো। আমরা ভাবতাম মানুষ কি করে এতোটা নির্মম হতে পারে?

আমাদের পাশের বাসার ৭/৮ বছর বয়সী একটি স্কুল পড়ুয়া বাচ্চা মেয়ে, বিকেলে আমাদের উঠানে খেলতে/বেড়াতে আসতো। আমরা মাঝে মধ্যে তাকে চকলেট/বিস্কুট খেতে দিতাম। তার নাম ছিল সুইটি। এতো সুন্দর আর ছটফটে স্বভাবের ছিল মেয়েটি। একদিন আমাদের মেসে সে না এলে আমাদের মনে হতো, তাকে দেখিনা বহুদিন...।

একদিন নাহিদ মেয়েটিকে দুষ্টামি করে বলেছিল, এই সুইটি তোমাকে আমি এই যে প্রতিদিন চকলেট/বিস্কিট দেই তুমি কি আমাকে ভালবাস? আমাকে বিয়ে করবে?

সেই মেয়েটি বলেছিল, তোমারা তো মেসে ভাড়া থাকো, এই পাড়ায় অনেক ৩/৪ তলা বাড়িওয়ালার ছেলেও আমাকে একই কথা বলে, আমি তাদের কাউকে পাত্তা দেই না। কথাটা বলেই, সে তার ভুবন ভোলানো হাঁসি দিয়েছিল...।

আমাদের মেসের এক সদস্য ছিল জুলফিকার ভাই। সে আমাদের বলেছিল; তার প্রেমিকার সাথে সে দেখা করতে যাবে, সাথে যেহেতু কাঁচা আম আর কিছু গিফট আছে তাই তার একজন সঙ্গী দরকার। আমি আর নাহিদ জুলফিকার ভাইয়ের সঙ্গী হতে রাজি হই। সেদিন বিকেলে কাঁচা আম আর অন্যান্য গিফট নিয়ে গৌরীপুর থেকে পায়ে হেঁটে কৃষি জমির উপর দিয়ে এগিয়ে যাই সজবরখিলা এলাকায় একটি রাইস মিলের দিকে। সেই রাইস মিলের সংগে ছিল জুলফিকার ভাইয়ের প্রেমিকার বাড়ি।

আমরা রাইস মিলের পেছনের দিকের দেয়াল ঘেঁষে দাড়িয়ে ছিলাম। দাড়িয়ে দাড়িয়ে আধা ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলে সেই স্কুল পড়ুয়া ১৫/১৬ বছর বয়সী মেয়েটি আমাদের কাছে এসেছিল। মেয়েটির সাথে কথা শেষে উপহার দিতে গিয়ে দেখি মেয়েটার বাবা লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসছে...!?

মেয়ের বাবাকে দেখে আতংকে আমরা তিনজন দিক্বিদিক শুন্য দৌড়াতে থাকি...। দৌড়াতে দৌড়াতে মেসে চলে আসি। সন্ধ্যায় নাহিদ আর আমি পায়ের চামড়া ছিলে যাওয়া ক্ষততে মলম লাগাই আর তাই দেখে মেসের অন্যরা হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি দেয়।
একদিন আমাদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। গণিত পরীক্ষার আগে লিটন ভাই, নাহিদ আর আমি সালমান শাহের বাংলা ছবি দেখতে সিনেমার হলে যাই, সিনেমা শেষে দেখি রাত বাজে ১১.৪০টা। এদিকে নাহিদ সিনেমা হলের চেয়ারে ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেছে।
লিটন ভাই মুচকি হেঁসে বলে, খোকন চল নাহিদ আরাম করে ঘুমাক আর আমরা বাড়ি চলে যাই। আমরা সত্যি সত্যি নাহিদকে সিনেমা হলে রেখে মেসে চলে আসি। গভীর রাতে সিনেমা হলের টিকেট চেকার নাহিদকে হলের ভেতর আবিষ্কার করে...। আর ঘুম থেকে উঠায়।
নাহিদ ঘুম ঘুম চোখে লিটন ভাই আর আমাকে খুঁজে তারপর আশেপাশে না পেয়ে মেসে এসে সেই রাতে ভীষণ রাগ করে...। সে রাতের ঘটনা নিয়ে দিনের বেলা মেসে আরেক দফা হাসা হাঁসি হয়।

শেরপুরের মেস জীবন শেষে, আমি টাঙ্গাইল লায়ন নজরুল কলেজে ভর্তি হই। বাবা তখন শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি থেকে শ্রীবরদী থানায় বদলী হয়েছেন। কলেজে ছুটির দিনে আমার কাজ ছিল টাঙ্গাইল থেকে শেরপুর ছুটে যাওয়া আর আড্ডা দেয়া। নাহিদ, জনি, ইদি আমীন, সব স্কুলের বন্ধুদের সাথে কলেজের মাঠে আড্ডা, আহ! কি যে মজা...।

সে সময় রিপা নামের একটি মেয়ের সাথে আমার খুব ভাব ছিল। রিপা’র আসল নাম ছিল “মাহমুদা পারভিন”। আমার এক বন্ধু আমাকে দুষ্টামি করে “মাহমুদ” বলে ডাকতো, হা হা হা।

রিপা শেরপুর শহরের চকপাঠক এলাকায় থাকতো। বিকেল হলেই আমি চকপাঠক চলে যেতাম। রিপা’র বড়বোন “রেখা” আমার এক বছরের বড় হলেও খুব ভাল বান্ধবী ছিল। আমি শেরপুর রেখা/রিপা’দের বাসায় গিয়ে দুপুরে লাঞ্চ করে; বিকেলে আড্ডা দিয়ে; সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আসতাম। লুকিয়ে লুকিয়ে রিপা’কে ব্যান্ডের গানের ক্যাসেট গিফট করতাম।

রিপার প্রিয় মানুষ ছিল নায়ক সালমান শাহ। সারাদিন সে সালমান শাহের সিনেমা আর তার স্টাইল নিয়ে মেতে থাকতো। আমার সাথে কথা হলেই সালমান শাহ প্রসঙ্গ চলে আসতো। রিপার সাথে গল্প করার অসীম ধৈর্য যেমন আমার ছিল, তেমনি অসীম জেলাসি ছিল সালমান শাহ’র প্রতি।

যাই হোক, সে সময় আমি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ি। কি একটা ছুটিতে শেরপুর গিয়েছিলাম মনে নেই। সেই সন্ধ্যায় আমি আর রিপা গল্প করছিলাম। রেখা ঢাকায় গিয়েছিলো মেডিক্যালে ভর্তির কোচিং করতে। ড্রইং রুমে টিভি চলছিল আর রিপা’র বোন ইভা দুষ্টামি করছিল।

এক সময় বিটিভিতে সন্ধ্যার সংবাদ শুরু হল, দেখলাম সংবাদে বলছে, নায়ক সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। সময়টা ছিল ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ। আমি মনে মনে বলেছিলাম, যাক বাঁচা গেল; সালমান বেটা কাপুরুষ আত্মহত্যা করে আমাকে বাঁচিয়ে দিলো।

আমি রিপা’কে বললাম, “ফাজিলটা তাহলে ফাঁসি দিয়ে মরল, বেটা কাপুরুষ কোথাকার?”
আমি রিপা’র দিকে তাকিয়ে দেখি, সে খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে, তারপর কেঁদে দিল, কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো...।

আমি দেখলাম, সে পানি মুছে ফেলছে না...।
আমি বুঝলাম, সালমানের মৃত্যু রিপা'র জন্য কতটা ভয়াবহ ঘটনা!?
আমি জানি, রিপা চোখের পানি মুছবে না...।
আমি মুছিয়ে দিবো; সে সাহস দেখালাম না।
ভাবলাম, যদি কেউ অন্যকিছু ভাবে?

১৯৯৩ সালের মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে “কেয়ামত থেকে কেয়ামত” দিয়ে শুরু করে “স্বপ্নের পৃথিবী”পর্যন্ত যে ১৮টি সিনেমা রিপা দেখেছিল প্রকাশ্যে; সেগুলোই আমি দেখেছিলাম জেলাসি নিয়ে (লুকিয়া লুকিয়ে) কিন্তু আমাদের দুজনের দৃষ্টিই ছিল ভালবাসার দিকে...।

আমাদের কাছে আসতে..., ভালবাসতে..., নতুন রুপে বাঁচতে... শিখিয়েছিল এক যাদুকর, যার পোশাকি নাম “সালমান।”
আমি কি করবো? সেদিন বুঝিনি।

আজ বুঝি, কতটা ভালবাসা থাকলে মানুষ কাউকে কোনদিন না দেখে, না জেনে, এমনকি বিবাহিত জেনেও ভালবেসে কাঁদতে পারে!?
আসলে রিপা চাইতো আমি সালমানের মতো মানবিক আর দুষ্ট-প্রেমিক হই।

আমি সেটা বুঝতাম না, আমি ভাবতাম সালমানই আমার শত্রু আর তাই ছিল আমার আজন্ম জেলাসি।

১৯৯৬ সালের পরে, একদিন শেরপুর থেকে আমি চলে এসেছি টাঙ্গাইল। এদিকে আমার বাবা বদলী হয়ে চলে জান মাদারীপুর।
তারপর ১৯৯৭ সালে টাঙ্গাইল থেকে কলেজ শেষ করে চলে আসি ঢাকায়।
ওদিকে রিপা তার বাবার সরকারী চাকরীর কারনে চলে যায় দূরে কোথায়...!?

আমার স্কুলের বন্ধুরা বলে, আমি রিপা'র কোন খোঁজ জানি কিনা?
আমি বলি, “না, জানি না। কি হবে এতো জেনে!?”

আজ প্রায় ১৯ বছর পরে অনেক কথা মনে পরে গেলো...!!!

ভুল করেও তো মানুষের সাথে মানুষের—পাখির সাথে পাখির—বাক্যের সাথে বাক্যের দেখা হয়ে যায়।
আমার সাথে রিপা’র দেখা হয়নি!

জীবনে প্রথম বার ২০০৩ সালে সিলেটে পীর শাহ জালাল (রঃ) এর দরগায় গিয়ে, আমি পাহাড়ের উপর খুঁজে বের করেছিলাম সালমানের কবর। কবরের পাশে দাড়িয়ে সালমানকে নিয়ে রিপা’র উচ্ছ্বাস আর আমার জেলাসির দিনগুলি ভেবে ভেবে ভেসে গিয়েছিলাম নষ্টালজিয়ায়।

আমার সহপাঠী বন্ধু মাসুদ বলেছিল, মৃত মানুষের কবরে তাকিয়ে এতো কি দেখিস? আমি বলেছিলাম, “আমি যা দেখি, তা হয়তো ঠিক করে কাউকেই বলা যায় না!

সেই রাতে পীর শাহ পরান (রঃ) এর মাজারের পূর্ব পাশের মাঠে দাড়িয়ে একাকী জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে রিপা’কে বলতে চেয়েছি, দেখো আমি তোমার প্রিয় মানুষটিকে আর জেলাসি করি না...। তুমি কাছে নেই, কিন্তু তোমার আর আমার দিনগুলি নিয়ে আমাদের মনের মাঝে সালমান “স্বপ্নের ঠিকানা” হয়ে ঠিকই বেঁচে আছে...!

একদিন রিপা আমাকে বলেছিল, তুমি কি অন্ধকার ভালবাস, নাকি ভয় পাও?
আমি কনফিউসড ছিলাম তাই বলেছিলাম, কেন বলতো?
সে বলেছিল, “আমার অন্ধকার ভাল লাগে, আমার মনে হয় অন্ধকারে মানুষ নিজেকে খুব বেশী করে কাছে পায়, নিজেকে চিনতে পারে, জানতে পারে। আসলে অন্ধকার মানে অহংকারহীন একটা জগত। যারা ভয় পায় তারা অহংকারী; যারা অন্ধকার ভয় পায় না তারা নিরহংকারী, মানে প্রকৃত মানুষ”।

আমি, নীরব বসে ছিলাম; কিছুই বলিনি। বার বার ভাবছিলাম, ১৪/১৫ বছর বয়সের কোন মেয়ের পক্ষে এতোটা ভারী কথা কি করে বলা যায়!?

আমি রিপা’কে কখনোই খুঁজি না...!!!

আমি চাই রিপা’কে নিয়ে আমার একটা মুগ্ধতা চিরদিন থাকুক...।

আমার অন্ধকারে সে থাকুক..., অজ্ঞানতায় সে বাঁচুক..., নির্জনতায় সে ঘুরে বেড়াক...।
রিপা’কে ঘিরে আমার সমস্ত মুগ্ধতা একটা পাখি হয়ে বেঁচে থাকুক...।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:২৪

এ কে এম রেজাউল করিম বলেছেন:
অন্যান্য স্মৃতির জোনাকিরা.।.।.। মতো আজকের স্মৃতির জোনাকিরা'ও পড়লাম ভালো লাগা রহিল।

২| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৮

খোরশেদ খোকন বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই, আমার ধারণা আজকের লেখাটা বেশী বড় হওয়াতে কম পাঠকই পড়বে। ধারণা ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। পড়ার জন্য শুভেচ্ছা।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.