নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার জন্ম টাঙ্গাইলের হামজানি গ্রামে। শৈশব, কৈশোরে দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ছিলাম; বাবার সরকারী চাকুরীর জন্যে। কলেজ ছিল টাঙ্গাইল জেলায়। তারপর পড়াশুনা ঢাবি\'র ফিন্যান্স বিভাগ। গত নয় বছর যাবত প্রাইভেট ব্যাংকে কর্মজীবন চলছে। www.facebook.com/khokonz

খোরশেদ খোকন

এই শহরে কিছু কিছু শব্দ কলম নয় হ্রদয় থেকে নেমে আসে, একা। এই শহরে বিনয় ঝুলে থাকে মরা গাছের ডালের মতো, একা।

খোরশেদ খোকন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির জোনাকিরা... (পরিত্যাক্ত রাজবাড়ীর সাপ...)

২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ সকাল ১১:৩৬

শত বছরের পুরানো রাজবাড়ীর দুতলায়; আমাদের বোর্ডিং স্কুলের বাতি নিভে যেতো রাত ১০টায়। সে সময়টা ছিল কার্তিক মাসের শুরু মানে বাংলায় হেমন্ত কাল। রাতে বাতি নিভে গেলেও, আমি বিছানা আর পড়ার টেবিলের পাশের চেয়ারটাতে একা একাই বসে থাকতাম। দক্ষিণের জানালার একটু দুরে একা দাড়িয়ে থাকতো একটি ল্যাম্পপোস্ট। সেই ল্যাম্পপোস্টের মাথায় বাল্বের আলোকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে ঘুরতো একঝাঁক পোকা-মাকড় আর আমি চেয়ে চেয়ে আলো নিয়ে পতঙ্গের উৎসব দেখতাম।

রাত বাড়ার সাথে সাথে রুমের সবাই মশারীর ভেতর ঢুকে যেতো। আমি অশ্বত্থ গাছের দিকে তাকিয়ে দেখতাম তার এলোমেলো পাতার ফাঁক দিয়ে ল্যাম্পপোস্টর আলো গিয়ে পড়ছে নীরব রাস্তার বুকের উপর। বাতাসে কাঁপতো গাছের পাতা আর রাস্তার উপর কাঁপতো ভীতিকর আলো-ছায়া।

একটু মাথা তুলে দক্ষিণে তাকালেই দেখা যেতো মেঘহীন পরিষ্কার আকাশে কার্তিক মাসের স্বচ্ছ চাঁদ উঠেছে আর চারপাশ আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। চেয়ে চেয়ে দেখতাম উথাল-পাথাল জ্যোস্নায় ভেসে যাচ্ছে রাজবাড়ীর বড় পুকুরের জল। নদীর স্রোতের মতোই একটা শীতল হাওয়ার স্রোত ক্রমশ জানালা দিয়ে এগিয়ে এসে আমার গাঁয়ে লাগতো, আমি শীতের ঘ্রাণ নাকে নিয়েই বুঝে যেতাম দুর্গা পূজার দিন এগিয়ে আসছে।

সেদিন আমাদের স্কুল একটু আগেই ছুটি হয়েছিল, স্কুল থেকে বোর্ডিংএ ফেরার পথে আমাদের স্যার বলেছিল তোমরা মাঠের চোরকাঁটা পরিষ্কার করো। আমরা দল বেঁধে সেই চোরকাঁটা (আমরা বলতাম প্রেমকাঁটা) পরিষ্কার করছিলাম আর গল্প করছিলাম। আমাদের গল্পের বিষয় ছিল টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পোড়াবাড়ীর চমচম। সেদিন গল্প করতে করতেই আমরা সিদ্ধান্ত নেই পোড়াবাড়ী জায়গাটা যেখানেই থাকুক, আমরা সেটাকে খুঁজে বের করবো।

সেদিন বোর্ডিংএ ফিরে ম্যাসেঞ্চার নুরু চাচাকে বললাম, চাচা পোড়াবাড়ী কোন দিকে?
চাচা বলল, এইতো বোর্ডিং স্কুল থেকে পশ্চিম দিকে ৪/৫ কিলোমিটার দুরেই।
আমরা বললাম, চাচা পোড়াবাড়ীর চমচম নিয়ে তুমি যা জানো, সেটা আমাদের বলতো।
চাচা বলল, এই সন্তোষ থিকা রিক্সায়/ভ্যানে পশ্চিম দিকে গেলেই দেখবা একটা রাস্তা চইলা গেছে চারাবাড়ীর দিকে। সেই রাস্তা দিয়া কিছুদূর আগাইয়া গিয়া দেখবা একটা রাস্তা সোজা আর একটা রাস্তা বায়ে মোড় নিসে। সোজা গেলেই চারাবাড়ি বাজার পাইবা আর বায়ে মোড় নিয়া আগাইয়া গেলেই পোড়াবাড়ী।

চাচা একটু দম নিয়ে পান মুখে দিয়ে আবার শুরু করলো; পোড়াবাড়ী গ্রামটার লগেই একটা নদী আছে। হেই নদীটার নাম হইল এলেংজানি। শুনছি, ব্রিটিশ আমলে আসাম থাইকা এক হিন্দু মিষ্টি কারিগর পোড়াবাড়ী গ্রামে আইছিল। সেই কারিগর এলেংজানি নদীর পরিষ্কার মিঠা পানি আর পোড়াবাড়ী গ্রামের গরুর খাটি দুধ দিয়া মিষ্টি বানাইছিল। সেই মিষ্টি খাইয়া সবাই খুব তৃপ্তি পাইছিল। শুনছি এলেংজানি নদীর পানি ছাড়া ভাল চমচম বানানোই যাইতো না। সেই সময় পোড়াবাড়ী গ্রামে চমচমের বড় ব্যাবসাও শুরু হইছিল।

চাচা আরেকটু দম নিয়ে পানের পিক ফেলে মুখটা গামছা দিয়ে মুছে আবার শুরু করলো; এক সময় নাকি এলেংজানি নদীর পাড়ে একটা বড় ঘাট মানে নদী বন্দর আছিল। যার নাম আছিল তালান-ঘাট। সেই ঘাটে মেলা সওদাগরী নৌকা, জাহাজ আর লঞ্চ ভিড়তো। সেই সময় দেশী-বিদেশী কারবারীরা পোড়াবাড়ী আইতো। ব্রিটিশের রাজধানী কলকাতা থাইকা সরাসরি স্টিমার এই ঘাটে আইসা ভিড়তো। দেশ বিদেশের মানুষ পোড়াবাড়ীর ঘাটে নাইমা তিন বেলার খাবার খাওনের পরে আরাম কইরা চমচম খাইতো। জাহাজ আর লঞ্চ দিয়া অন্য ঘাটে যাওনের সময় ইচ্ছা মতো চমচম কিনা নিয়া যাইতো আত্মীয় পরিজনের জন্য। সেই সময় পোড়াবাড়ী গ্রামের চমচমের সুনাম সারা ভারতবর্ষে ছড়াইয়া গেছিল।

পরের দিন মাসুম, আতিক, মনির আর আমি; আমরা এই চারজন মিলে কুতুবউদ্দিন স্যারের কাছ থেকে পারমিশন নিয়েছিলাম টাঙ্গাইল শহরে যাবার জন্য। স্যার পারমিশন দিয়ে বলেছিলেন, সন্ধ্যা ৬.৩০টার আগে অবশ্যই বোর্ডিংএ ফিরতে হবে।

আমরা চারজন টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ীর চমচম এর ঐতিহ্য জানতে সন্তোষ থেকে একটি ভ্যানে চেপে রওনা হয়েছিলাম পশ্চিম দিকে। চারজন প্রায় ৪/৫ কিলোমিটার যাবার পরে দেখা পেয়েছিলাম একটা নদীর। সেই নদীর পাড়ের গ্রামটার নামই ছিল পোড়াবাড়ী।

সেদিন নদীর পাড়ে গিয়ে দেখলাম, শারদীয় দুর্গা পূজার জন্য মূর্তি বানানো হচ্ছে। মূর্তি বানানোর শিল্পীদের হাত আর মুখ এর দিকে আমরা কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের কৌতূহল দেখে এক শিল্পী বলল, তোমরা কি জানতে চাও কি করে প্রতিমা বানানো হয়? আমি বললাম, হ্যা আমরা জানতে চাই কি করে প্রতিমা বানানো হয়।

সে আমাদের বলল, প্রথমে আমরা ধানের খড় দিয়ে একটি একটি করে মানুষের শরীরের অঙ্গ মানে হাত, পা, মাথা ইত্যাদি বানাই। তারপর মানুষের শরীরের আকার দেয়ার জন্য একটা অঙ্গের সাথে অন্য একটা অঙ্গ জোড়া লাগাই। জোড়া লাগানো হয়ে গেলে, প্রতিমার গাঁয়ে মাটির পাতলা প্রলেপ দিয়ে দেই। সেই প্রলেপ শুকিয়ে গেলে আমরা তাতে রঙ লাগাই। রঙ প্রতিমার গাঁয়ে বসে গেলে, আমরা প্রতিমাকে শাড়ি আর অলংকার পরিয়ে দেই। সব কাজ শেষ হয়ে গেলে আমরাই প্রথম প্রতিমাকে প্রণাম জানাই; তারপর অন্যরা মাকে প্রনাম করে।

প্রতিমা বানানোর কাজ দেখে আমরা এলেংজানি নদীর পাড় ধরে বহুদূর এগিয়ে গিয়ে গ্রামের শেষ সীমানা খুঁজে দেখি। তারপর সেই গ্রামের কৃষকের ক্ষেত, রাখালের গরু আর পাখীদের কোলাহল দেখে সন্ধ্যা নামার আগেই বোর্ডিংএ ফিরে আসি।

বোর্ডিং এ ফিরে জানতে পারি এলেংজানি নদীর কাগজে কলমে নাম হচ্ছে ধলেশ্বরী। আর ধলেশ্বরী নদী আসলে যমুনার একটা শাখা নদী।

এক সকালে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের বোর্ডিং স্কুল পরিচালনা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা আর পুরানো রাজবাড়ীতে থাকছি না। আর আমাদের আজ বিকেলেই পুরানো বাড়ী থেকে টিনশেড হাফ বিল্ডিংএ চলে যেতে হবে। আমরা সবাই সেদিন বিকেলেই পুরানো বিল্ডিং থেকে নতুন বিল্ডিংএ উঠে যাই। পুরানো রাজবাড়ী পরিত্যাক্ত ঘোষণা দেয়া হয়।

উত্তর দক্ষিণ লম্বা একটা টিনশেড বিল্ডিং এর দক্ষিণ দিকের রুমে আমি উঠলাম। আমার পাশেই একটা দেয়াল আর দেয়ালের ওপাশে কুতুবউদ্দিন স্যার থাকেন। আমার পূর্ব দিকের জানালায় তাকালে একটি বিশাল মাঠ। সে মাঠের ওপাশে আরও একটা পুরানো রাজবাড়ী। সেই রাজবাড়ীতে আমরা কোনদিন যাইনি।

আমার জানালার দিয়ে তাকালে যে মাঠ, সে মাঠেই আমরা বিকেলে ফুটবল আর গোল্লাছুট খেলা খেলতাম। রাত হলেই আমার সেই আগের পুরানো রাজবাড়ীর পাশের রাস্তা আর রাস্তার পাশের বটগাছ আর ল্যাম্পপোস্টকে মনে পারতো। ইচ্ছা থাকলেও আর চোখের সামনে রাজবাড়ীর বড় পুকুরটাকে দেখতে পেতাম না। মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে সেই বটগাছটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করতো।

একদিন দেখি, আমার জানালার পাশের মাঠের চারদিকে বেড়া দেয়া হচ্ছে। আমরা ভাবলাম হয়তো সবজি কিংবা ফুলের চাষ করা হবে। কিন্তু না; দেখলাম মাঠের চারপাশ বেড়া দেয়ার পরে মাঠের বুকের সব মাটি কেটে নিয়ে দূরে কোথাও ফেলে দেয়া হচ্ছে। আমরা কুতুবউদ্দিন স্যারের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, এই মাঠের মধ্যেই একটা স্বল্প-গভীর পুকুর কাঁটা হচ্ছে। সেই পুকুরে অল্প-পানিতে চাষ করা যায় এমন মাছ মানে সিলভারকার্প, মিররকার্প, গ্রাসকার্প, বিগহেড, সরপুঁটি ইত্যাদি চাষ করা হবে। আমাদের খেলার মাঠ হারিয়ে, বোর্ডিং এর পশ্চিম পাশের হাই স্কুলের বড়ভাইদের মাঠের পাশের রাস্তায় বসে বসে বড়দের ফুটবল খেলা দেখতে শুরু করলাম।

মাঠের মাটি কাঁটা শেষ হলেই মাছ চাষ শুরু হল। আমার জানালায় একটি মাঠ নিমিষেই পুকুর হয়ে গেলো। বিকেলে রাস্তায় গিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমরা দেখতে লাগলাম আমাদের পুকুরের পোষা মাছ দিন দিন কতটুকু বড় হচ্ছে। মাঠের অগভীর স্বচ্ছ পানিতে ছোট ছোট মাছের ঝাঁক বেঁধে সাঁতার দেয়া দেখা আমাদের জন্য নতুন ভাললাগা নিয়ে এলো।

আমাদের যেহেতু খেলার মাঠ নেই; তাই আমাদের ঘুরাঘুরির মাত্রা দিন দিন বেড়ে গেলো। আমরা হাই স্কুলের মাঠ পেড়িয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র পেড়িয়ে পুরানো আর জরাজীর্ণ পরিত্যাক্ত মূল রাজবাড়ীর দিকে যাতায়াত করতে লাগলাম। সেই রাজবাড়ীর পশ্চিম দিক দিয়ে ঢুকে এগিয়ে গেলে ভাঙাচোরা ইট, দেয়াল, মূর্তি আর ঝোপঝাড় দেখা যেতো।

কোন কোন দিন আমরা চার/পাঁচ জন দল বেঁধে সেই পরিত্যাক্ত রাজবাড়ীর ভেতর বেড়াতে যেতাম, কোনদিন হাই স্কুলের হোস্টেলের দিকে মানে উত্তর দিক দিয়ে বেড়িয়ে যেতাম আর কোনদিন পূর্ব দিক দিয়ে মানে মাছ চাষের পুকুরের দিক দিয়ে বেড়িয়ে যেতাম।

রাজবাড়ীর নীচের তলার বেইজমেন্ট এর নীচে একটা আন্ডারগ্রাউন্ড ছিল, সেটা ছিল বিশাল বাড়ীর পুরাটা জুড়েই। আমরা বলতাম, এই আন্ডারগ্রাউন্ড এ এক সময় বাঘ পোষা হতো; কেউ আইন ভঙ্গ করলে এই আন্ডারগ্রাউন্ড এ তাকে ছেড়ে দেয়া হতো। আন্ডারগ্রাউন্ড এর দেয়াল ছিল কারাগারের মতোই শিকল দিয়ে তৈরি। রাতে রাজবাড়ীর আন্ডারগ্রাউন্ড এর কথা মনে হলে, বুকের ভেতর একটা হাহাকার শুনতাম; শুনতাম একটি খালি গাঁয়ের গ্রাম্য যুবক প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে, আর কিছুক্ষণ পরই বাঘের থাবায় প্রাণ যাবে তার। কি যে ভয়ংকর আতংক চোখে মুখে আর বুকে...।

বড় রাজবাড়ীর যে গেটটা হাই স্কুলের আবাসিক হলের দিকে মানে উত্তর দিক দিয়ে বেড়িয়ে গেছে তার কাছেই ছিল একটা বড় আকারের কুয়া। সেই কুয়ার দুইপাশ দিয়ে দুইটা বড় লোহার পিলার উঠে গেছে উপরে। আর সেই পিলার দুইটার উপর আড়াআড়ি ছিল একটা বড় রডের মতো লোহার দন্ড।

সবাই বলতো উপরের ঐ দন্ডের সাথে দড়ি বেঁধে এই কুয়ার মধ্যে ঝুলিয়ে দেয়া হতো অপরাধীদের। কুয়াটাকে আমরা একটা ফাঁসির মঞ্চ ভাবতাম। আমরা সেই কুয়ার চারপাশের সান-বাঁধানো বৃত্তের উপর বসে থাকতাম। কোনদিন কুয়ার গভীর অন্ধকারের দিকে জোরে চিৎকার করে তার প্রতিধ্বনি শুনতাম। মনে মনে ভাবতাম, না জানি কত মানুষ বিনা অপরাধে এই ফাঁসির মঞ্চে জীবন দিয়ে দিয়েছে।

রাতে ঘুমাতে গেলেই, সেই রাজবাড়ীর সুনসান নীরবতার মাঝে একঝাঁক কবুতর উড়ে যাবার স্বপ্ন দেখতাম। আর ঘুম ভেঙে ভাবতাম, আমি হয়তো রাজবাড়ীর ভেতর কোথাও একদিন হারিয়ে যাবো। আমাকে হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কিন্তু বিকেলে বন্ধুদের সাথে রাজবাড়ী বেড়াতে যাবার সময় রাতের কথা মনেই রাখতাম না। কেননা রাজবাড়ী যারা যায় না, তারা ভীতু। আমি বন্ধুদের কাছে সব সময় সাহসী হতেই চাইতাম।

একদিন মাসুম, আতিক আর আমি; তিনজন মিলে রাজবাড়ীর ভেতর পথ হারিয়ে ফেলি। আকাশে মেঘ ছিল তাই হয়তো দিনের আলোয় রাজবাড়ী ভেতরটা অন্যদিনের মতো পরিষ্কার ছিল না। আমরা দেখি একঝাক পায়রা আমাদের দেখে পাখা ঝাঁপটিয়ে উড়ে গেলো। তারপর এগিয়ে দেখি একটা সিমেন্টের ভাঙা নারী মূর্তি পরে আছে ইট, সুরকি আর জঙ্ঘলের ভেতর। আতিক সেই মূর্তির বাকী অংশটা দেখতে এগিয়ে গেলো। আমি আর মাসুম দুজনে মিলে আতিককে নিষেধ করলাম সামনে যেতে, কিন্তু সে কথাই শুনলো না।

এদিকে মাসুম ছিল আমার সামনে, সে এগিয়ে যাবার রাস্তায় দেখে একটি সাপ ফনা তুলে তাকিয়ে ফস ফস শুরু করেছে। মাসুম আমাকে ইশারা দিয়ে সাপটাকে দেখিয়ে দিলো। আমি সাপ দেখলাম কিন্তু চিনতে পারলাম না এটা আসলে কি সাপ? আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল অনুভূতি ঘাড় থেকে নীচের দিকে নেমে গেলো।

আমি চিৎকার দিয়ে আতিক কে ডাকতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। আতিক একা একাই সামনেই এগিয়ে গেলো। মাসুম আর আমি আসলে কি করবো সেটাই বুঝতে পারলাম না। তাই দুইজন হেঁটে কিছুটা পেছনে চলে আসলাম; আর আতিক কে দেখলাম এগিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে আতিক এগিয়ে গেলো মূর্তির দিকে; তারপর সেও একটা সাপকে দেখে আঁতকে উঠলো; সেই সাপের ফনা নাকি অস্বাভাবিকভাবে ডানে বামে দুলছিল।

যাই হোক, আতিক মূর্তির বাকী অংশ দেখার কাজ বাদ দিয়ে আমাদের দিয়ে ঘুরে আসতেই মাসুম চিৎকার দিল “সাপ”। চিৎকারের সাথে সাথেই আমরা তিনজনে একটানা দৌড় দিলাম মূল গেটের দিকে...।

মূল গেটের কাছে এসে দেখা গেলো আতিকের পায়ে কাঁটা দাগ।
আমি বললাম, আতিক তোর পায়ে রক্ত কেন?
আতিক বলল, মাসুম তোর দেখা সাপটা কি আমার পায়ের কাছে ছিল?
মাসুম বলল, পায়ের কাছে না, সাপটা ছিল তোর পেছনের বামে একটা ঝোপের কাছে।

আতিক এবার চিৎকার শুরু করে দিল। আতিকের ধারণা তাকে সাপে কামড় দিয়েছে। আতিকের কান্না আর হাহাকার দেখে, মাসুম আর আমি কনফিউজড হয়ে গেলাম। আসলেই কি আতিক কে সাপে কামড় দিয়েছে? নাকি দৌড়াতে দিয়ে কাঁচ, কাঁটা টিন অথবা অন্য কোন ইট, পাথরে কেটে গেছে!

আমি আর মাসুম দুজনে এবার আতিকের দুই-হাত আমাদের দুই-কাধে নিয়ে হাসপাতালের দিকে হাটতে লাগলাম। আতিকের গাঁয়ে আর কোন শক্তি জেনো অবশিষ্ট নেই। সে পা বাড়াতেই পাড়ছে না। আতিকের গাঁয়ের ওজন হঠাৎ এতো বেড়ে গেলো কেন? সাপে কাটলে কি মানুষের গাঁয়ের ওজন বেড়ে যায়?

রাজবাড়ীর গেটের সামনেই ছিল ছোট একটা হাসপাতাল। আমরা সেখানে গিয়ে একটা নার্সকে খুঁজে পেলাম, আর আতিকের পা পরীক্ষা করে দেখতে বললাম। সেই নার্স আতিকের পা পরীক্ষা করে দেখলো আর গজ দিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো।

হাসপাতালের নার্স আমাদের জানালো, এই কাঁটা ক্ষতটা আসলে সাপের কামড় না। এটা কাঁচ অথবা টিনের সাথে পা লেগে কেটে যাওয়ার ক্ষত।

আমরা একটা হাপ ছেড়ে বাঁচলাম। আর আমাদের বন্ধু আতিক তার মহা মুল্যবান প্রাণটা বুকের মাঝে ফেরত পেলো।
---------------
২১/১০/২০১৫

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:১২

হাসান মাহবুব বলেছেন: ভালো লাগলো। সুখপাঠ্য।

২৭ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:৪৯

খোরশেদ খোকন বলেছেন: ধন্যবাদ।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, পাঠক সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
বিষয়টাকি তাই? নাকি সবাই ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
ভাল থাকবেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.