নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্যের পথে, সংস্কৃতির রথে

কবি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ

কবিতা এবং সাহিত্যের ছাত্র

কবি আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চড়ুই নীড়ের শূন্যতা

২৭ শে মে, ২০২৫ রাত ৮:৫১

বাইরে স্কুল মাঠ; ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করে, কণ্ঠ ভেসে আসে বাতাসে। পুরাতন এক বিল্ডিং এর ভেতরে আমি, কাগজপত্র আর মাথার ওপরে ঘূর্ণমান পাখা৷
ঘরের দরজার ওপর ছোট একটা ভেন্টিলেটর গ্রিল আছে।
সেই ফাঁকে বহুদিন হয়, একটি চড়ুই পাখি ঘর বেঁধেছে । মানুষের ঘরের ছোটো এক কোনে চড়ুইদের ঘর সাধারণ বিষয়৷ দুজনের একই আশ্রয় বলে, ও আসত, বসত দরজার কোণে।
মাঝেমাঝে জানালার গ্রিলে দাঁড়িয়ে ঘরটাকে পর্যবেক্ষণ করত। কখনো আমার দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকত,
যেন কিছুর সন্ধান করছে৷ পাখিটির উপস্থিতিতে মনে হতো, এই পুরাতন ঘরটিরও একটা হৃদস্পন্দন আছে। ও যেন এই ঘরের ভেতরের প্রাকৃতিক এক ক্ষুদ্র দূত।
ওর সাথে, এ ঘরে আসা-যাওয়া করা যান্ত্রিক জীবনের, কোনো চুক্তি নেই সম্পর্কের৷ তবু আমার নিয়মিত আয়োজনে, এক অপার মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে থাকায় যেন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷
আজও ঘরের পাখা ঘুরছিল, আমি খাতা দেখছিলাম৷ হঠাৎ একটা শব্দ৷ তাকিয়ে দেখি পাখিটি মেঝেতে পড়ে আছে৷
ও আর নড়ছে না। ডানার নিচে লাল একফোঁটা দাগ,
ছোট্ট, অথচ বুকে ছুরি বসিয়ে দেওয়ার মতো গাঢ়। পাখার বাড়িতে ওর পা ছিড়ে গিয়ে পড়েছে বহুদূর৷
আমি শব্দ না করে ওকে কাগজে মুড়িয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে রেখে এলাম।
আজ আর কোনো কিচিরমিচির নেই। ঘরের নীরবতাও যেন আর শান্ত নয়, অবসন্ন।
প্রতিদিনের কাজ চলছে, মনে হয় সে আছে কিন্তু তাকাতেই সেখানে কিছুই নেই৷
দৃষ্টিতে পাখিটি ছিল না কিন্তু স্নায়ুর স্পন্দনে যেন ওর উপস্থিতি ছিল জীবন্ত। এখন ও নেইতবু ওর অনুপস্থিতিটাই যেন সবচেয়ে প্রবল।
ঘরের প্রতিটি কোণে, জানালার ধারে, দরজার ওপর, তাকালেই মনে হয়, কিছু একটা শূন্য হয়ে গেছে।
আর তা ভরাট করার মতো কিছু পৃথিবীর কোথাও নেই।
আমি এখন আগের মতোই মানুষ, আগের মতোই কর্মচারী,
তবে মাঝে মাঝে ভাবনা এলো, আমি কি প্রকৃতির এক ছোট বন্ধুকে হারিয়ে ফেললাম?
যে নীরবে আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল, গল্প শুনিয়েছিল প্রতিদিন?
না, ওর জন্য আমি কিছুই করিনি তবুও আমার পাশাপাশি এসেছিল। কতজন শখ করে পাখি পালন করার চেষ্টা করে কিন্তু ওকে পোষ মানানোর দরকার পড়েনি৷
এ যেন ভার্জিনিয়া উলফের 'stream of consciousness'—প্রবাহমান এক অনুভব, যা ঠেকিয়ে রাখা যায় না, আবার স্পষ্ট করাও যায় না।
প্রতিদিনের মতো আজও মনে পড়ে সেই প্রশ্নটি:
"পৃথিবীর সমস্ত কিচিরমিচির কি একদিন এভাবেই থেমে যাবে?"
হয়তো থেমেই যাবে।
হেমিংওয়ের মতো সংক্ষিপ্ত ও তীব্র এক নীরবতায়।
চড়ুইটি ক্ষণস্থায়ী, সামান্য, দাবি-নাহীন একটি সত্তা, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ঘরের নির্জনতাকে অর্থ দিত, সময়কে সংগীতময় করত। যখন সে নেই, তখন উপলব্ধি হয়, তার প্রভাব কতটা গভীর ছিল।
এটি হাইডেগারের "Being-in-the-world" ধারণার সঙ্গেও মেলে—আমরা অস্তিত্বকে বুঝি সম্পর্কের মধ্য দিয়ে, বিচ্ছিন্ন কোনো সত্তা হিসেবে নয়।
পাখিটির অস্তিত্ব খুব স্বাভাবিক, অভ্যাসের মতো ছিল—প্রতিদিন আসত, কিচিরমিচির করত। আমাদের মস্তিষ্ক এ রকম নিয়মিত জিনিসগুলোকে “background presence” হিসেবে গ্রহণ করে।
কিন্তু তার হঠাৎ অনুপস্থিতি আমাদের চেতনায় একধরনের ভাঙন ঘটায়।
এই ঘরানার ব্যাখ্যায় ফ্রয়েড বলতেন—এই ধরনের ক্ষতি আমাদের অবচেতনে এক ‘loss object’ হিসেবে প্রবেশ করে, এবং তা প্রতিদিনের অভিজ্ঞতাকে ছায়া দিয়ে রাখে।
এই পাখি তাই শুধুই পাখি নয়, সে এক স্মৃতিবাহী symbolic object—যার মৃত্যুতে দুঃখ নয়, বরং আত্মোপলব্ধি তীব্র হয়।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে মে, ২০২৫ সকাল ৯:৫৪

রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.