নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা › বিস্তারিত পোস্টঃ

‘আমি খোদার কাছে সব বলে দেব’

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৪৯


‘আমি খোদার কাছে সব বলে দেব’, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার মুখে এই ছিল তিন বছর বয়সী অন্য এক সিরীয় শিশুর শেষ আর্তনাদ। বিশ্বের রাজাধিরাজেরা তখন শোনেননি। এরই সাড়ে তিন মাস পর একই বয়সী আরেকটি শিশুর নির্বাক প্রতিবাদ দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দিল। যে মানবতা ভেসে গেছে, সেই অমানবতার সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে শিশুটি এসে ঠেকেছিল তুরস্কের উপকূলে। সেই দৃশ্য কেউ তুললেন, কেউ তা ফেসবুকে দিলেন, কোনো পত্রিকা তা প্রকাশ করল, কোনো টেলিভিশনে তা প্রচারিত হলো। যে ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড পত্রিকা সান আগের দিন সিরীয় উদ্বাস্তুদের প্রতি বিদ্বেষমূলক শিরোনাম করেছিল: উদ্বাস্তু ঠেকাও। পরদিন তারাই সমুদ্রের ঢেউ ছুঁয়ে থাকা আয়লানের ছবি ফলাও করে ছাপল। আবারও প্রমাণিত হলো, নিষ্পাপের মৃত্যু অসহনীয়, অবর্ণনীয়, ক্ষমার অযোগ্য। আয়লান একাই বিশ্বমানবতার ঘুম ভাঙিয়েছে, বিশ্বনেতাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দায়িত্বহীনতার কাঠগড়ায়, বিশ্ববাসীকে জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ভয়াবহ দোজখের দুর্দশার কথা।
আয়লানের ওই ছবিটা যেন অপার্থিব বিষাদের প্রতীক। যেন সে ঘুমিয়ে আছে এক শুভ্র বিছানায়। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন তার শীততাড়ানি কম্বলের ঝালর। পায়রার বুকের মতো কোমল গাল পেতেছে সে যে বেলাভূমিতে, তা যেন তার মায়ের পাতা সোহাগী বিছানা। তার লাল জামাটি যেন অতীতের কোনো যুদ্ধহীন দিনের স্মৃতির ঝলক। তার পায়ের জুতা জোড়াও তার মতোই আদুরে। জুতা নিয়ে সব শিশুরই দারুণ আমোদ, উৎসাহ আর গল্প থাকে। পৃথিবীতে যা সবচেয়ে সুন্দর, তার ধ্বংসই সবচেয়ে অসহনীয়। আয়লানের মৃত্যুর মর্মান্তিকতার আরেক পিঠে তাই দেখা যায় যুদ্ধবাজ রাজনীতির নৃশংসতা আর রাষ্ট্রনেতাদের স্বার্থপরতার প্রমাণচিত্র।
আয়লানের জুতাজোড়া মনে করিয়ে দেয় আর্নেস্ট হেমিংওয়ের এক বাক্যের এক গল্পের ধাক্কা, ‘বিক্রি হবে: কখনো না পরানো এক জোড়া পুরোনো জুতা।’ আয়লানের ওই ছবিটা ফিরিয়ে এনেছে ভিয়েতনামে মার্কিন নাপাম বোমায় পোড়া কিশোরীর ভয়ার্ত মুখ, ফিরিয়ে এনেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অসহায় ইহুদি কিশোরী আনা ফ্রাঙ্কের আকুতি। বিপন্ন শৈশব বিপন্ন মানবতার চিহ্ন, সেই চিহ্নই আজ ভাসছে ভূমধ্যসাগরে।
যখন ভূমিতে জল্লাদ, তখন দরিয়ায় কী ভয়! আয়লানের বাবা-মাও তাই মরিয়া ছিলেন দেশ ছাড়তে। ফেরাউনের ভয়ে শিশু মুসা (আ.)-এর প্রাণ বাঁচাতে তাঁর মাও তাঁকে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন নীল নদে, ছোট্ট একটি গামলায়। পরিণত বয়সে আবারও তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছিল মৃত্যু ও উত্তাল সমুদ্রের কিনারে। সমুদ্র সেদিন তাঁকে ও তাঁর জাতিকে পথ করে দিয়েছিল। কিন্তু এটা কলিকাল। আবদুল্লাহ কুর্দির মতো অসংখ্য সিরীয়-লিবীয়-ইয়েমেনীয় উদ্বাস্তুর ডাক শুনবে কে? ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই, মানুষ নামের মানুষ আছে দুনিয়া বোঝাই’।
মহান আরব ভ্রাতৃত্ব অন্ধ ও বধির। ধনী আরব শাসকেরা গরিব আরবদের ধ্বংসে মেতেছে। ইউরোপীয় সভ্যতা আর সেই সভ্যতার ত্রাতা যুক্তরাষ্ট্র দূর থেকে দেখছিল। জীবনের মায়া এমন, সন্তানের জীবনের ভয় এমন অদম্য যে হতভাগ্য আবদুল্লাহ কুর্দি দমে যাননি। তিনি কানাডায় বোনের কাছে যাওয়ার আবেদন করেছিলেন কানাডীয় সরকারের কাছে। একদা অভিবাসীদের স্বর্গ কানাডায় এখন রক্ষণশীল সরকার। সেই সরকারের আমলারা কাগজপত্রের খুঁত দেখিয়ে পরিবারটিকে বারবার ফেরায়। অবশেষে টাকা জোগাড় করে তুর্কি দালালের কাছে ধরনা দেন আবদুল্লাহ। জাহাজের কথা বললেও পরিবারটিকে আরও অনেকের সঙ্গে তুলে দেওয়া হয় ছোট্ট একটি নৌকায়। (সাম্প্রতিক বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের মর্মান্তিক মৃত্যুর আখ্যান যেন) যথারীতি মাঝ দরিয়ায় তা ডুবে যায়। পিতা কেবল উঠতে পারেন তীরে। সমুদ্র নাকি সবই ফিরিয়ে দেয়। আবদুল্লাহর দুই সন্তান ও স্ত্রীকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু জীবনটা কেড়ে নিয়ে।
আবদুল্লাহ কুর্দি ছিলেন এক সিরীয় কুর্দি নাপিত। বোনের দোহাই দিয়ে কুর্দি কানাডায় আবেদন করেছিলেন, ‘আমাদের খরচ সে জোগাবে’। বোনও কানাডীয় কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন, ‘তারা আমার সঙ্গে চুল কাটার কাজ করতে পারবে। আমি তাদের কাজও খুঁজে দিতে পারব।’ থাকার, চলার অসুবিধা হতো না। তবু অনুমতি মিলল না। হলে আয়লান বেঁচে যেত। এখন কানাডীয় সরকার দেশবাসীর কাছে অনুতাপ করছে। আয়লানের ফুফুও কেঁদে কেঁদে বলছে, ‘কেন আমি ওদের আসতে বললাম!’ এখানেই থামেননি তিনি, ‘আমি আজ সত্যিই যা চাই তা হলো যুদ্ধের অবসান। সারা পৃথিবীর মানুষের উচিত এগিয়ে এসে সিরীয় যুদ্ধ বন্ধ করা। তারাও তো মানুষ!’
যে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলো সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উচ্ছেদের জন্য অর্থ, অস্ত্র ও প্রশিক্ষক ঢেলেছিল, যে সৌদি আরব ইরান ও সিরিয়াকে এক ঢিলে ঘায়েল করতে জঙ্গি জিহাদি সৃষ্টি করেছিল, তারা জানত না যুদ্ধ মানেই গণহত্যা, দেশান্তর আর নিরীহ-নিষ্পাপের নিধন? কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিদেল কাস্ত্রো অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলই বর্বর আইএসকে সৃষ্টি করেছে, যেমন করেছিল তালেবানদের। ব্রিটেনের জনপ্রিয় দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় সেই পত্রিকার নামজাদা প্রতিবেদক সিম্যাস মিলনে তথ্য–প্রমাণসহ প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ইরাক ও সিরিয়ায় আইএস অথবা আইসিসের উত্থানে জ্বালানি জুগিয়ে গেছে। আইএসের ধ্বংসযজ্ঞের সুবাদেই আজ তেলের দাম কম, জোগান বেশি আর তেল ব্যবসায়ীদের রমরমা। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যে বিরাট আকারের গণহত্যা চলে আসছে, তার দায়ও যেমন তারা স্বীকার করেনি, তেমনি বলকান অঞ্চলে যে ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’ দেখা গিয়েছিল, এখানে তার দরকার মনে করেনি। কিন্তু চোখের আড়ে পাহাড় লুকানো যায় না। প্রতিবাদ, খবর, হুঁশিয়ারি যা পারেনি, এক আয়লানের লাশের ভাসান সেই মিথ্যার জারিজুরি ছিঁড়ে ফেলেছে। কোনো বুলেট যা পারেনি, আয়লান তা পেরেছে। সে বেহুঁশ বেবুঝ শাসকদের মুখোশ খুলে দিয়েছে।
আর তখনই দেখা গেল, মানুষের ভরসা আজও সাধারণ মানুষই। অভিবাসীদের যাত্রাপথের দেশের সাধারণ মানুষ সিরীয় উদ্বাস্তুদের বরণ করে নিতে রাস্তার পাশে খাবার, পানি ও ফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করেছে। উদার জার্মানি দুয়ার খুলে দিয়েছে। ইউরোপীয় জাতগর্বী দুর্গের দেয়াল টিকিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
কিন্তু কী করবেন আয়লানের বাবা? যে কানাডা তাঁর পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, তারাই এখন তাঁকে সাধছে। কিন্তু কী আসে যায় এখন? নিউইয়র্ক টাইমস-এ এসেছে তাঁর হাহাকার: ‘সারা দুনিয়ার সব দেশ দিয়ে দিলেও আমি তা চাই না। যা ছিল অমূল্য, তার সবই তো গেছে আমার!’
জীবনে আশ্রয় পায়নি আয়লান, মৃত্যুতে পেয়েছে। বছরের পর বছর ধরে ইরাক, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন ও সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। নিহত হয়েছে লাখো শিশু। অমানবিকতার পাষাণ পাথর তাতে নড়েনি। নতুন নতুন দেশে তেল দখলের, ভূমি দখলের, শাসক বদলের আর গণতন্ত্র রপ্তানির যুদ্ধ রপ্তানি চলছেই। শিশু আয়লানের ছোট্ট দেহটি এই যুদ্ধবাজ রাজনৈতিক অর্থনীতিকেই প্রশ্ন করছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ একাত্ম হয়ে কেঁদেছে আয়লানের বাবা আবদুল্লাহর সঙ্গে।
যে চলে গেছে তার যন্ত্রণার অবসান হয়েছে। যিনি বেঁচে আছেন, আয়লানের সেই হতভাগ্য পিতা এখন রোজ উদ্বাস্তু শিবিরে যান, মানব পাচারকারীদের কাছে যেতে নিষেধ করেন শরণার্থীদের। এদিকে নিউইয়র্ক টাইমস-এর আরেক প্রতিবেদক শরণার্থী দলের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে সিরীয়-লিবীয়দের মধ্যে আবিষ্কার করেন এক বাংলাদেশিকে। যুদ্ধের বিশ্বায়ন মৃত্যুরও বিশ্বায়ন ঘটাচ্ছে।
একা এক আয়লান সত্যিই সব বলে গেছে।
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.