![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গান বাজতেসে - “তোমার প্রেমের নেশায় আমি বুদদদদদদদ হয়ে রই। এইটাকে বলা হয় চিরকুটিক পরিভাষায় বুদ হয়ে থাকা। আমার ভাবতেও আশ্চর্য লাগে মানুষ কিভাবে বুদ না হয়ে থেকে বুদদদদদ হয়ে রয়। আমি ড্রাইভার সাহেবকে রেডিও চ্যানেল পরিবর্তন করতে বলতে পারতেসি না। কারন আমার ধারনা সে এই গানে বেশ বুদ হয়ে আছে। তারচেয়ে বড় কথা এই গাড়ির ড্রাইভার যেই সেই ড্রাইভার না। তার গাড়িও যেই সেই গাড়ি না। গাড়ির নাম পাজেরো স্পোর্ট। আমার মতো মানুষ যখন গাড়িতে উঠেই বুঝে ফেলবে এই গাড়িটা নতুন তখন বুঝতে হবে এই গাড়িটা নতুন না হলেও বাংলাদেশে গাড়ি নতুন করার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। গাড়ি ঝকঝকে তকতকে নতুন। গাড়ির সিটের উপরের প্লাস্টিক সদ্য ছেড়া। তার মধ্যে গাড়ির ভেতরের ব্যবস্থা ভালো। ড্রাইভারসহ সাত সিটের গাড়ি। প্রথম সারির একটা সিট অর্ধসয়ংক্রিয়। সুইচ চাপ দিলেই খুলে বের হয়ে পেছনের সিটে যাওয়ার রাস্তা করে দিচ্ছে।
বাইরে ঝিম ঝিম বৃষ্টি। আমি দীর্ঘ চল্লিশ ঘন্টার মতো নির্ঘুম। তবুও আরামদায়ক গাড়িটার মধ্যে আমি ঘুমায়ে যেতে পারতেসিনা। কারন আমার ধারনা এই গাড়িতে একটা বড়সড় ঘাপলা আছে। এই গাড়ি আমার স্ত্রী মেঘনা পাঠিয়ে দিয়েছে। এবং এই ড্রাইভার আমার কার্যক্রম পর্যবেক্ষন করছে। আমার এই ধরনের ধারনা হওয়ার কারন আছে। আমি যখনই মেঘনাকে কোথাও খুঁজে বের করতে যাই তখনই আমার মনে হয় উল্টো সে আমাকে ফলো করছে। আসলে সে কখনোই আমাকে ফলো করে না। এটা আমার একটা ব্যক্তিগত মনে হওয়া।এই ধরনের বিপদজনক পরিস্থিতিতে আমি জড় হয়ে যাই। জড় হয়ে যাওয়ার কারনে এখন ঘুমাতে পারছি না। মাথা গুঁজে চোখ বন্ধ করলেই ঘুম চলে আসতেছে। ঘুমায়ে গেলে আমার মুখ থেকে লালা পড়ে। এই ড্রাইভার মেঘনাকে যদি বলে দেয় ঘুমিয়ে গেলে আমার মুখ থেকে লালা পড়ে তাহলে কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে। মেঘনার সাথে আমার দীর্ঘদিন ধরে ঝগড়া। লালা পড়ার বিষয়টা নিয়েই ঝগড়া। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর চেষ্টা করলাম। ড্রাইভার ভদ্রলোক তার মাথার উপরের আয়না দিয়ে আমাকে দেখছে নাকি সেই দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করলো হঠাৎ। এখন ভয়ে আমি আয়নার দিকে তাকাচ্ছিনা। তাকালে ড্রাইভার সাহেব আমাকে সন্দেহ করতে পারে যে আমি বুঝে ফেলেছি মেঘনা আমাকে ফলো করছে। আমি চাইনা মেঘনা যদি আমাকে ফলো করেই থাকে তাহলে আমার ধরে ফেলার বিষয়টা সে টের পাক। আয়নার দিকে না তাকানোর কারনে আমার সমস্যা আরও বেড়েছে। আমার বিশ্বাস স্থির হচ্ছে যে ড্রাইভার সাহেব আমার দিকে ঠিকই লক্ষ্য রাখছে। আমি স্থির হয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতে পারছি না। একজন লক্ষ্য করতে থাকলে কি করা উচিত চিন্তা করে বের করতে হচ্ছে। জানালা দিয়ে দাঁত ক্যালায়ে একটা হাসি দেয়া যায়। ড্রাইভার সাহেব মেঘনাকে যেয়ে বললো এই লোক পাগল সে অযথা হাসে। তাতেও সমস্যা। মেঘনার অহেতুক হাসি অপছন্দ। আর নাইলে ভেজাল বাদ। মেঘনার অপছন্দের কাজগুলার মধ্যে একটা করে বসে থাকি। চুপচাপ একটা পায়ের উপর আরেকটা পা তুলে বসে থাকি। মেঘনা অবশ্য রিকশায় পা তুলে বসা অপছন্দ করে। গাড়িতে পা তুলে বসলে কি মনে করবে তা জানি না। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে ড্রাইভার সাহেবের দিকে তাকালাম। সে মনের সুখে গাড়ির জানালা খুলে গাড়ি চালাচ্ছে। তার লক্ষন দেখে মনে হচ্ছে না আমি কি করি না করি তা নিয়ে সে বেশ চিন্তিত।এ মূহুর্তে বিরক্ত লাগছে। কারন আদতে মেঘনা আমাকে ফলো করছে না বা ফলো করার জন্য কোন লোক বসায়ে রাখে নাই। আমি মেঘনাকে খুঁজতে বের হওয়ার কারনে এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি। আমি যখনই তাকে খুঁজতে বের হই তখনই মনে হয় সে আমাকে ফলো করছে। আসলে সে আমাকে কখনোই ফলো করেনা।
মেঘনার সাথে আমার ঝগড়া প্রায় চার বছর। চার বছর ধরে সে বেশ নিরাপদেই লুকিয়ে বেড়াচ্ছে। লুকিয়ে বেড়ানোর ব্যাপারটাতে সে পারদর্শী। আমি চার বছর ধরেই তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। যে যেই তথ্য দেয় আমি সেই তথ্যানুযায়ী তাকে খুঁজতে বের হই এবং কখনোই তাকে খুঁজে পাই না। এবারের মূল তথ্য প্রদানকারী মেঘনার নিকটভাজন বন্ধু। সে জানালো মেঘনা আজকে খৈয়াছড়া ঝর্নায় একগাদা বন্ধুসহ ঘুরতে যাবে। আমি ব্যাগে দুইটা শার্ট নিয়ে খইয়াছড়া রওয়ানা দিয়েছি গতরাতে। আমার ধারনা ছিলো খইয়াছড়া যথেষ্ঠ দূর। চট্টগ্রাম অন্তত চার ঘন্টার রাস্তা হওয়ার কথা। সেই হিসাবে রাত বারোটার বাসে ওঠা যৌক্তিক। বারোটার বাস আমাকে রাত আড়াইটার সময় ফেনী নামিয়ে দিয়ে বললো মীরেরসরাই এর জন্যে অন্য বাস ধরতে হবে। আমি বাসের কাউন্টারে আগের রাতে বলসিলাম মীরেরসরাই যাবো। বলে নিশ্চিন্তে পায়ের উপর পা তুলে বসে ছিলাম কারন আমার ধারনা ছিলো মেঘনা কাউন্টারে আগেই বলে রাখসে যেন ঠিকমতো খইয়াছড়ায় পৌঁছাই। পায়ের উপর পা তুলে থাকার ফলাফল মাঝরাত্রে কাউন্টারে বসে থাকা। আমি বুঝি না আমি এত বোকা কেন? যাকে খুঁজতে যাচ্ছি তার নিজেরই যাত্রার সঠিক বন্দোবস্ত করার তো আসলে কোন প্রয়োজন থাকার কথা না। আমি মাঝরাত্রে ফেনী সদর বাস কাউন্টারে বিব্রত অবস্থায় বসে ছিলাম। একটু ঝিমুনি আসতেই মনে হলো হইচই শুনতে পেলাম। তড়াক করে পেছনে তাকিয়ে দেখি বিশাল দল। দলটা আমার থেকে বেশ দূরে। সম্ভবত এরা খইয়াছড়া যাবে। আমি দলের মেয়েগুলার দিকে নজর দেয়ার চেষ্টা করলাম। দুরত্বের কারনে দেখা যাচ্ছে না। একটা মেয়েকে মনে হলো লুকিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। আমি তাড়াতাড়ি মাথা লুকালাম। মেয়েটা মেঘনা হলে আমাকে দেখলেই সে সড়ে যাবে। আমাকে যেটা করতে হবে তাকে পেছন দিয়ে জাপটে ধরার চেষ্টা করতে হবে। সামনে দিয়ে ধরতে গেলেই বিপদ। আমি শিকারের আশায় ওৎ পেতে পাঁচ মিনিট বসে থাকার পড়ে নিজেই শিকারে পরিনত হলাম। দলটা গায়েব হয়ে গেলো। কিছুক্ষন পর আমার মনে হতে লাগলো মেঘনা আমাকে দূর থেকে ফলো করছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়া মানেই বিপদ। কিছু একটা করতে গেলেই মনে হয় যে আমাকে ফলো করছে সে আমার কর্মকান্ড দেখে কি চিন্তা করছে। এই মনে হওয়াটাই একটা বিপদ। যেমন সেদিন চা খেতে খেতে হঠাৎ মনে হলো মেঘনা মনে করছে আমি বেশ আরাম করে চা খাচ্ছি। মনে হওয়ার সাথে সাথে আমার চা নামক পানীয়টাকে বিষ মনে হওয়া শুরু হলো। তবুও তৃপ্তি তৃপ্তি ভাব করে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। এই তৃপ্তি তৃপ্তি ভাবটা জঘন্য। কারন আদতে আমার তৃপ্তি লাগতেসে না। তৃপ্তির অভিনয় করা। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো কেউ ফলো করলে ভদ্রতাস্বরূপ ভদ্রলোকের আচরন করা উচিত। অতিরিক্ত সময় এই ভদ্রতা কাজ করতে থাকলে নিজেকে সার্কাসের জানোয়ার মনে হয়। আচ্ছা মেঘনাই যদি আমাকে ফলো করবে তাহলে তাকে খুঁজতে যাওয়া আমার এত জরুরী কেন? প্রথমত মেঘনা আমাকে ফলো করতেসে না। এইটা আমার একটা ভুল মনে হওয়া। আমি আমার স্ত্রীকে তাই খুঁজতেই পারি। মনে হওয়ার সাথে সাথে আমি একটা সিগারেট ধরালাম। সিগারেট মেঘনার অপছন্দ। দ্বিতীয়ত তাকে খোঁজাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণও আমার জন্য। আমার বাড়ি আর তার বাবার বাড়ি থেকে তাকে খুঁজে বের করার জোড় প্রচেষ্টা চলছে। আর মূলত সব দোষ আমার। তার পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলো আমার আরেকটু গুরুত্বের সাথে নেয়া উচিত ছিলো। সেজন্যও তাকে খুঁজতে খইয়াছড়া যাওয়াটা গুরুত্বপূর্ন। তার পায়ে ধরে মাফ টাফ চাওয়া যায়।স্ত্রীর কাছে পায়ে ধরে মাফ চাওয়া যাবে না আমার নিজেকে কখনো এরকম গরীব মনে হয়না। কিন্তু আমি জানি আমি মেঘনাকে এ যাত্রায়ও খুঁজে পাবোনা। আর সে আমাকে ফলো করছে এই মনে হওয়াটা আমার অনবরত বাড়তেই থাকবে।
গাড়ি বেশ শান্তভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তায়ও ড্রাইভার সাহেবের কোন তাড়া দেখা যাচ্ছে না। আমি ড্রাইভারের আচরনে বিরক্ত। ফলো করা খেলায় নতুন সংযোজন আরেকটা গাড়ি। এই গাড়ির নামও পাজেরো স্পোর্ট। গাড়ির জানালার কাঁচ কালো রঙের। ভেতরে কেউ উলঙ্গ হয়ে বসে থাকলেও আমার জানার কোন উপায় নেই। এখন আমার মনে হচ্ছে মেঘনা এই গাড়িতে বসে আমাকে ফলো করছে। আমি যথারীতি সহজ সরল চেহারা নিয়ে বসে আছি। এবং যথারীতি নিজেকে সার্কাসের জানোয়ার মনে হচ্ছে। গাড়িটা টপকে সামনে যেতেই চেহারাটা বিকৃত করার চেষ্টা করলাম। অনেকক্ষন গোবেচারা হয়ে বসে থাকার কারনে বিকৃতকরন। বিকৃত করেই মনে হলো কেউ ফলো না করলে আমি চেহারা বিকৃত করে বসে থাকি না। আর সবচেয়ে বড় বিষয় চেহারা বিকৃত করার বিষয়টা ড্রাইভার সাহেব মনে হয় দেখে ফেলেছে। সে দেখে ফেললে নির্ঘাৎ মেঘনাকে বলে দেবে লোকটা পাগল - অকারনে শিম্পাঞ্জীর মতো করে। বিষয়টা মনে হওয়ার সাথে সাথে আমার চেহারা সত্যিই শিম্পাঞ্জীর মতো বিকৃত হয়ে গেলো। ড্রাইভার সাহেব কি ভাবলো জানতে ইচ্ছা করছে না। কারন মেঘনার আমাকে ফলো করার কোন কারন নেই। আমার তাকে ফলো করার কথা। এবং ফলো করতে বের হওয়ার শাস্তি ভালোভাবেই ভোগ করতে হচ্ছে। বাসা পর্যন্ত পৌঁছানো প্রয়োজন। বাসায় ঢুকে পড়ার আগ পর্যন্ত আমার এমন মনে হতেই থাকবে। ড্রাইভার সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তার চিন্তা ভাবনা অন্যরকম। সে মনে হয় বাড়িতে ঢোকা মাত্রই কোন মেঘনা তাকে ফলো করা শুরু করবে তাই আস্তে গাড়ি চালানোটাই তার জন্য বেশী গুরুত্বপূর্ন। আমি মেঘনা সমস্যা মাথা থেকে দূর করার জন্য গাড়ি রহস্যে মনোনিবেশ করলাম। এই ড্রাইভার সাহেব আমাকে মাত্র দুইশ টাকার বিনিময়ে মীরের সরাই থেকে ঢাকা পৌছে দিচ্ছেন। এইটাই এই গাড়ির যেই সেই গাড়ি না হওয়ার মূল কারন। আমার ধারনা ছিলো মেঘনা চায় আমি একটু আরাম করে ঘুমাই তাই এই গাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু আসলে মেঘনা আমার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেয় নাই। কারন তার ক্ষমতা থাকলে সে আমার খুঁজতে বের হওয়া উপলক্ষে আজকে বাস ধর্মঘট চালু করে দিতো। আমি গাড়ির রহস্যটা তাই গুরুত্বের সাথে নিলাম। মোবাইল ইন্টারনেটে পাজেরো স্পোর্ট এর দাম জানা গেলো। এর দাম ইন্ডিয়ান ওয়েবসাইট এ ২৬ লাখ টাকা দেখা যাচ্ছে। ইন্ডিয়ার টাকার সাথে তুলনা করলে এই গাড়ির দাম প্রায় ৭০ লাখ এর মতো। ইন্ডিয়ার চকলেটের দামের সাথে তুলনা করলে এইটার দাম প্রায় দেড় কোটির মতো হওয়ার কথা। আমার মনে হচ্ছে এই গাড়ি চোরাই। চট্টগ্রাম পোর্টের থেকে এই গাড়ি চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় নেয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চোরাই গাড়ি সন্দেহ দূর করার জন্যে আমাকে গাড়িতে তোলা হয়েছে। আমি বোঝার চেষ্টা করছি বড়লোক টাইপের দেখতে লোক নাকি গরীব টাইপের দেখতে লোক গাড়িতে বসা থাকলে ড্রাইভারের বেশী উপকার হয়। বুঝতে পারছি না। কারন বিষয়টা নিয়ে আমার কোন আইডিয়া নাই। এদিকে আমি গরীব গরীব চেহারায় মোটামোটি মানসিক বিপর্যস্ত চেহারা নিয়ে গাড়িতে বসে আছি। মনে হয় দুবেলা খায় টাইপের চেহারার লোক গাড়িতে বসে থাকলে ড্রাইভার সাহেবের সমস্যাও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে বেচারার শুধু শুধু খালি গাড়ি ঢাকায় নিয়ে আসার চাইতে দুইশ টাকাই অনেক। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই গাড়ির তেলের দামই দুইশ টাকার চেয়ে অনেক বেশী। আর গাড়ির সার্ভিসের দাম কম হওয়ার কথা না। এই গাড়ি চোরাই হলে রাস্তায় ভালো বিপদে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আমি ড্রাইভার সাহেবকে চা খাবার জন্যে থামতে বললাম। আমার ইচ্ছা চা খাবার উছিলায় গাড়ির নম্বর প্লেট দেখে নেয়া। সটকে পড়ে বাসে টাসে উঠে গেলেও পারি। ড্রাইভার সাহেবের চোখে রহস্যের হাসি দেখা গেলো। তার হাসি দেখে আমার মনে হলো তাকে মেঘনা বলেছে আমি চা খাওয়ার জন্যে থামতে চাবো। এবং আমার আরও মনে হচ্ছে মেঘনা ঠিক করে দিয়েছে আমি কোথায় চা খাবো। আমি মাথা কোলে গুঁজে বসলাম। এরকম অদ্ভুত মিথ্যা চিন্তা মাথায় আসতে থাকলে চা খাওয়ার চেয়েও বাসায় পেীঁছানো বেশী জরুরী।
কুমিল্লায় হোটেল নূরজাহানের সামনে গাড়ি থামলো। আমার নেমেই মনে হলো মেঘনার পছন্দ খারাপ। এখানে চা খাওয়ার চেয়ে রসমালাই খাওয়া ভালো। আবারো বিপদ। আমি আর কত নিজেওে বুঝাবো যে মেঘনার খায়ে দায়ে অনেক কাজ আছে। তার আমার পিছনে লেগে থাকার কোন কারন নাই। আমার কাছে রসমালাই খাওয়ার টাকা নেই। সিগারেট ধরায়ে গাড়ির নম্বর প্লেট লক্ষ্য করার চেষ্টা করলাম। গাড়ির নম্বর প্লেট হাতে লেখা - ঢাকা ১৪৮য়। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি য় লেখা নম্বর প্লেট কোথাও দেখিনি। হতে পারে আমি গাড়িটাকে সন্দেহ করছি দেখে আমার এমন মনে হচ্ছে, য় লেখা গাড়ি আমি প্রায়ই দুই একটা দেখি। অথবা আমি বিষয়টা কখনো খেয়াল করিনি। ড্রাইভার সাহেবকে দেখা যাচ্ছে বিরস বদনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার গাড়ি ঘোড়া সম্পর্কে ধারনা কম। ধারনা বেশী হলে বুঝে ফেলতাম আসলে ড্রাইভার সাহেবের আমাকে নিয়ে আসার উপলক্ষ কি। আমার ধারনা ঘোড়া সম্পর্কেও কম। একবার কক্সবাজারে ঘোড়া বলে একটা গাধার উপরে উঠিয়ে একলোক দশটা ছবি তুলে ফেললো। ছবির ফি একশ টাকা। আমাকে বলা হয়েছিলো একটা ছবির দাম দশ টাকা। ভদ্রলোক আমাকে জানায় নি সে দশটা ছবি তুলবে। হিসেবে দশটার দাম একশই হওয়ার কথা। আমি ঘোড়ার পিঠে উঠে দশ টাকা দিয়ে একটা ছবি তোলার বদলে গাধার পিঠে উঠে একশ টাকা দিয়ে দশটা ছবি তুললাম। এই দুর্দশার কারন আমার ধারনা ছিলো মেঘনা ঘোড়াওয়ালাকে পাঠিয়েছে। মন খারাপ মানুষটার যদি ঘোড়ার উপর একটা ছবি তুললে মন ভালো হয় সে আশায় সে এই কাজ করেছে। একশ টাকার নোট পকেট থেকে বের হওয়ার পরে বুঝলাম মেঘনা ঘোড়াওয়ালাকে পাঠায়নি। তার চেয়ে বড় বিষয় কক্সবাজারে মেঘনাকে খুঁজতে আমি গিয়েছিলাম। সে আমাকে খুঁজতে যায়নি। আমার উল্টো উচিত ছিলো এমন কোন মজার কাজ করা। অবশ্য আমি প্রায়ই মজার কাজ করার চেষ্টা করি। যেমন সেবার কক্সবাজারে আমি ঠিক করেছিলাম তাকে পাওয়া গেলে ঝিনুকের মালা উপহার দিবো। মেঘনাকে সেবার কক্সবাজার খুঁজে পাওয়া যায়নি। উল্টো সে আমাকে ফলো করছে এই দুর্দশাযুক্ত অবস্থায় আমি বাসায় ঢুকেছি।আমি দীর্ঘদিন সেই ঝিনুকের মালা পকেটে নিয়ে ঘুরেছি। কারন মেঘনার ধারনা হতে পারে আমার ঝিনুক বেশ পছন্দের জিনিস যেহেতু আমাকে সে ঝিনুক নিয়ে বীচে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। পছন্দ না হলে আমি কি জন্য মালা কিনবো। আমি কি সমুদ্রের পাড়ে ঝিনুকের মালা নিয়ে প্রেম প্রেম মশকরা করি নাকি? আদতে মালা টালা আমার খুব পছন্দের কিছু না। মজার কিছু করার জন্য কেনা। সেই ঝিনুকের মালাটা কয়েকদিন আগে ঘর ঝাড়– দিতে গিয়ে ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পাওয়া গেছে।
ঢাকা ১৪৮য় নিয়ে চিন্তামগ্ন আমি। মোবাইলে মেগাবাইট শেষ। জানতে পারছি না য় অক্ষরের নম্বর প্লেট আছ কিনা। এদিকে মনে হচ্ছে মেঘনা আমাকে সিগারেট খেতে দেখে বিরক্ত হচ্ছে এবং মনে মনে ঠিক করছে আর জীবনেও বাসায় আসবে না। আমি চেষ্টা করছি অনেক কষ্ট কষ্ট চেহারা করে সিগারেট খাওয়ার। যেন তার আমার সিগারেট খাওয়া দেখে মনে হয় তার শোকে আমি সিগারেট খেতে খেতে মারা যাবো ঠিক করেছি। সে বাসায় ঢোকা মাত্র আমি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবো। এই বিষয়টা কিভাবে অভিনয় করতে হয় আমি জানি না। তবুও আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। সিগারেটে টান দিয়ে মুখটা তিক্ত করে ফেলি আর ধোঁয়া ছাড়ার সময় ভাব নেই যে এটা কোন আনন্দের কিছু না। কিছুক্ষন এই কাজ করে যখন আমি আবিষ্কার করলাম আসলে কোন মেঘনাই দূর থেকে আমাকে দেখছে না তখন এতক্ষনের অভিনয়ের জন্য বেশ বিরক্ত লাগলো। সিগারেট ফেলে দিলাম। কোন কারন ছাড়া অভিনয় করার জন্য অসুস্থ লাগছে। আমি জড়তা দূর করার জন্য দুইবার আড়মোড়া দেয়ার চেষ্টা করলাম। আড়মোড়া দিতেই আমার মনে হলো মেঘনা আসলে এতক্ষন আমাকে ফলো করছিলো না। মাত্র আড়মোড়া দেয়ার ব্যাপারটা সে গুরুত্বের সাথে দেখছে। তার আমার আড়মোড়া দেয়ার ভঙ্গি অপছন্দ। আমি নিজের ওপর হতাশ। আমার আড়মোড়া দেয়ার কাজ আমি আমি আড়মোড়া দিয়েছি। মেঘনা আবার কে? কিন্তু আমি বাসায় ঢোকার আগ পর্যন্ত এই বাজে চিন্তাগুলো মাথায় আসতেই থাকবে। হাল ছেড়ে দিয়ে গাড়িতে উঠলাম। এই গাড়ি চোরাই হলেও আমার বাসায় যেতে হবে। মেঘনার বাবার হলেও আমার বাসায় যেতে হবে। ড্রাইভার ভদ্রলোক দুইশ টাকা নিলেও যেতে হবে। সে টাকা না নিলেও যেতে হবে। আমার সবচেয়ে বেশী যেইটা করতে হবে সেইটা হলো মেঘনা খুঁজতে বের হওয়া বিষয়টা বন্ধ করতে হবে। তাকে কখনোই খুঁজে পাওয়া যায় না। হয় সে আমার গতিপ্রকৃতি আমার আগে লক্ষ্য করে অথবা আমি সবসময়ই ভুল তথ্য নিয়ে তাকে খুঁজতে বের হই। এ মুহূর্তে সে কই আছে কে জানে।
পাজেরো স্পোর্ট রাত আটটার দিকে মালিবাগে থামলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে মোটামোটি আতঙ্ক নিয়ে ড্রাইভার সাহেবকে দুইশ টাকা দিলাম। আমি জানি মেঘনা আমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দেয় নাই। সবচেয়ে বড় কথা তার একটা পাজেরো স্পোর্ট কেনার টাকা নেই। আমার ধারনা এই স্পোর্ট কার কেনার টাকা থাকলে সে বাসায়ই থাকতো। রাগ করে ঘুরে বেড়াতো না। টাকা পয়সা বাজে জিনিস। না থাকলে অনেক রকম অশান্তি। ড্রাইভার সাহেব দুইশ টাকা নিয়ে হাসি দিয়ে গাড়ির জানালা লাগিয়ে দিলো। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। একটা পাজেরো স্পোর্টে মীরের সরাই থেকে দুইশ টাকায় মালিবাগ। এবং কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই। আমি আনন্দে একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আমার মনে ধারনা প্রবল হচ্ছে মেঘনা আমার পেছনে হাঁটতেসে। আমি হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়েছি কারন আমি জানি সে আমার পেছনে হাঁটছে না। এইটা আমার মনের ভুল। বাসায় ঢোকার আগ পর্যন্ত আমি অনবরত এই ভুল করতে থাকবো। আমি বিব্রত অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মেঘনার মোবাইলে ফোন করার চেষ্টা করলাম। তার নাম্বার বন্ধ। জানা কথা। তবুও চেষ্টা। হাঁটতে হাঁটতে বাসায় যাওয়া পর্যন্ত একটা কাজ পাওয়া গেলো। এখন আমার মনে হচ্ছে মেঘনা আমার পেছনেই হাঁটছে আর আমার বোকামি দেখে নিজের মোবাইল বের করে মনে মনে হাসছে। আমি হাঁটার গতি কমিয়ে দিলাম। এরকম সংকটজনক অবস্থায় তাড়াহুড়ার মানে হয়না। বরং মাথা ঠান্ডা রাখা ভালো। বাসায় ঢুকে পড়লেই ভেজাল শেষ। আজকে বাসায় ঢুকে শপথ করবো আর জীবনেও মেঘনাকে খুঁজতে বের হবো না।
বাসার কলিংবেল টিপতেই মনে হলো কেউ নুপুর পড়ে দৌড়াচ্ছে। আম্মু নুপুর পড়ে না। বাসায় কোন বাচ্চা কাচ্চা নেই। মেঘনার নুপুর পড়ার অভ্যাস আছে। কিন্তু সে বাসায় নুপুর পড়ে দৌড়াচ্ছে না নিশ্চিত। কারন এই নুপুরের শব্দ আমি মাঝে মাঝে এমনিতেই শুনি। তাও আমার মনে হলো মেঘনা বাসায়। আমি উটকো মনে হওয়াকে প্রশ্রয় দিলাম না। কারন মাঝে মাঝেই বাসায় ঢোকার সময় আমার এমন মনে হয়। মনে হওয়ার কারনে বিরক্তবোধও বেশী হয়। আরেকবার কলিংবেল টিপতেই মেঘনা দরজা খুলে দিলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে কি করবো বুঝতে পারছি না। হাসি হাসি মুখ করা উচিত না রাগ রাগ মুখ করা উচিত বুঝতে পারছি না। তাকে দেখতে সুন্দর লাগছে এইটা বলা যায়। আমি বললাম - তোমাকে সুন্দর লাগতেসে। মেঘনার চেহারা দেখে মনে হলো বিষয়টা সে জানে। রুমে ঢুকে দেখি আমি ঝিনুকের মালার শব্দকে নুপুরের শব্দ ভাবছিলাম। মেঘনা ঝিনুকের মালা নিয়ে বেশ গবেষনা করছে। দেখে মনে হচ্ছে নষ্ট ঝিনুকের মালাটাকে ব্যবহারের উপযোগী করার চেষ্টা করছে। আমার একবার মনে হলো সে মনে হয় এই ঝিনুকের মালাটা আমাকে কিনতে দেখেছে। দুশ্চিন্তাটাকে প্রশ্রয় দিলাম না। দেখুক আর না দেখুক সে বাসায় এইটা আমার জন্য সুখবর। মালা বুনতে বুনতে মেঘনা হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললো - তোমার পকেটে একটা এয়ার অ্যাকশন চকলেট আছে সেটা মুখে দাও অথবা আমার সামনে থেকে যাও। সিগারেটের গন্ধ অসহ্য লাগতেসে।আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পকেটে হাত দিয়ে সত্যি সত্যি একটা এয়ার অ্যাকশন বের করে নিয়ে আসলাম।
আমি বোকার মতো চকলেট হাতে নিয়ে মেঘনার দিকে তাকিয়ে আছি। এই চকলেট আমার পকেটে কোথা থেকে এসেছে সেটা আমি নিজেও জানিনা। সে কি জাদু টাদু শিখলো নাকি কে জানে। আমার স্ত্রী মেঘনার চোখে মুখে রহস্যের হাসি। রহস্যের হাসিতে তাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে।
©somewhere in net ltd.