নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

লুনা রুশদী

i'm lost and alone and i'm fair and i'm free you am what you is and i are who i be what i'm lacking in strength i make up for in smarts you keep your stability i'll keep my heart

লুনা রুশদী

আমি অনেক হাসি। আমার বই পড়তে, কবিতা পড়তে, আড্ডা দিতে, গান শুনতে, সিনেমা দেখতে, ঝগড়া করতে, তর্ক করতে, পরচর্চা করতে, কুটনামী করতে, ঘুরে বেড়াতে অনেক ভালো লাগে। [email protected]

লুনা রুশদী › বিস্তারিত পোস্টঃ

সুমন রহমানের গল্প ও আমার মন্তব্য (কবিসভা)

১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৬ রাত ১:১০

গল্প 1



ডেঙ্গুচর্চার দিনগুলি



এই বর্ষাবিধৌত সন্ধ্যাগুলোতে আমার টবচর্চা, আমার উদার পানিসিঞ্চন-বারান্দায় টবের ফুলগাছগুলো হাঁসফাঁস করে ওঠে। তাদের দিকে না তাকিয়ে আমি অবিরাম পানি ঢেলে যাই। এভাবে বদনার নল ও ফুলগাছের শেকড়ের মধ্যে এক পানীয় রাস্তা স্থাপিত হয়, অব্যাহত পানির স্রোত প্রথমে তাদের বিস্ময়, পরে বিরক্তি, তারোপরে বিবমিষা, তস্যপরে খিস্তিখেউড়সমেত ডুবিয়ে একটা ছোট্ট কিন্তু তীব্র জলাশয় তৈরি করে। সেখানে খেলতে আসে বর্ষাশেষের বাতাস, তাদের শিস খুব হালকা আর নরম উস্কানিতে ভরা, যেন সামনে, গাছপালা কেটেছেঁটে ঐ যে নাকবরাবর দূরে একটা নকল বনানীমত বানানো হয়েছে, তার আড়াল দিয়ে আমার মুক্তিদশার নদী কলকল করে বইছে।



তখন কেমন একটা দার্শনিকতাও পেয়ে বসে। প্রাচীন ঋষিরা বলেন পানিই নাকি জগতের মর্ম; আমার কাছে মনে হচ্ছে, পানি নয়, পানিসিঞ্চন। মানুষ ও প্রকৃতি আসলে পানিসিঞ্চনই করে, পৃথিবীর ভূত-অভূত নানান শিকড়ে। এটাই জগতে একমাত্র কাজ। হে মনুষ্য! পরিণাম চিন্তা না করিয়া তোমার আরাধ্য শিকড়গুলাতে পানি ঢালিয়া যাও...পৃথিবীর কোন একটা পুরাণগ্রন্থে এরকম একটা বাক্য থাকতেই পারে। ফলে বদনার নল দিয়ে পানি অবিরাম পড়ে, টব উপচিয়ে কখন যে বারান্দা টপকে নিচের ফাটের বারান্দায় পড়তে শুরু করে আমার খেয়াল থাকে না। বা থাকলেও কিছু করণীয় থাকে বলেও মনে হয় না। কানের পাশে অফিসফের্তা সাবরিনার নিচু গলার হিসহিস চাবুক আছড়াতে থাকে।



তুহিনদের ফ্যাটে পানি পড়তেছে, শুনতে পাও না?



আমি হিসহিস শব্দ শুনি।



ডেইলি সন্ধ্যায় একই কান্ড, এখন ন্যাকড়া-ত্যানা নিয়া যাও, ওদের বারান্দা মুইছা দিয়া আসো।



হিস হিস হিস। একদিন দেখা যাবে তুহিনের বাবা আইসা কান ধইরা বারান্দা মুছাইতে নিতেছে...



হিসহিসহিস। স্বীয় স্বামীর কর্ণযুগল অপর একজন স্বাস্থ্যবান পুরুষ কর্তৃক আকর্ষণের কল্পনা, যৌন উত্তেজক নিশ্চয়ই! ততক্ষণে আমার কাজ শেষ। ঘরে এসে শুয়ে পড়ি মশারি টাঙিয়ে।



শুয়ে শুয়ে ভাবি। কত কিছু! আমার শৈশব, সাইকেল শেখা, নদী সাঁতরানো। প্রথম চুম্বন, যৌন অসততার দগদগে স্মৃতিগুলো-বের করে করে চিবাই। টবের পানিতে আজ একটা লেয়ার পড়বে, ভোরের নরম আলোয় সেটা আকর্ষণ করবে কোনও পথহারা এডিসকে-এডিস তুমি কি পথ হারাইয়াছ, ডিম্বভারে তুমি কি স্লথগতি, আশ্রয় খুঁজিতেছ, দেখ আমার পরাগধানী, আর নিচে কী সুন্দর স্বচ্ছ টলমল জল, ঘণ্টা দুই তুমি আমার পরাগধানীতে বিশ্রাম করো বাছা, দেখবে তোমার ছেড়ে দেয়া ডিম থেকে লার্ভা বের হয়ে টলমল পানির ভেতর মৃদু মৃদু ঘুরছে...এরকম একটি মহৎ সম্ভাবনা আমার মশারির উপরে ঘুরপাক খায়। একটা ধারাবহির্ভূত অফৌজদারি মরণদশা বানায়। সেই দশার ভেতর আমি সাবরিনা'র মুখখানি বসিয়ে দিয়ে পরম আরামে ঘুমাই।



সাবরিনাকে আমি মনে মনে ডাকি, আমার র্যাডিক্যাল রজনীগন্ধা। রজনীগন্ধার মত ঋজুতা আছে ওর, ফলে আমি রজনীগন্ধাকেও ঘৃণা করি। শুয়ে শুয়ে ওর কথা ভাবি, বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশ্চয়ই ওর ডিপার্টমেন্টাল কলিগের বোনের বিবাহে যেতে না পারার বছরপূর্ব বেদনাটিকে শিক দিয়ে খোঁচাচ্ছে। এরকম দুয়েকটি বেদনা আছে ওর, সংবৎসর গণগণে থাকে, একটু টোকা পড়লেই কন্টেম্পোরারি হয়ে যায়। এরাই আমার আমোদের উৎস, হৃদয়ে শান্তি আনে। শান্তি আসে আমার আলাদা ঘরে আলাদা বিছানায় টানানো মশারির বড় বড় দুটো ছিদ্র দিয়ে। এই ছিদ্র দুটো সেলাই করে দেয়ার কথা প্রতিদিনই বলে সাবরিনা, আর প্রতিদিনই 'ভুলে' যায়। সকালবেলা ওর অফিসের গাড়ি যখন নিচে ঘন ঘন হর্ন বাজায়, ঘড়ি পরতে পরতে আমার ঘরে উঁকি দেয় সে।



- মশারিটা আনুমানিক কত বছর পরপর একবার খোলা যাইতে পারে বইলা তোমার ধারণা?



- বলা খুব মুশকিল। আপাতত এইটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।



- ওহহো...ছিদ্র দুইটা সেলাই করা হইল না। দেখি, আজকা আইসা কইরা দিমু।



দেয়া হবে না কোনোদিন, জানি আমি, এরাই যে ওর মুক্তির দরজা। হাসি নিজের মনে। সে যদি প্রতিদিন মশারি সেলাইয়ের কথা নাও বলত, আমি কোনোদিনই নতুন মশারি কিনে আনতাম না। বস্তুত, এটা এমন একটা ডুয়েল যেখানে আমি সুঁইসূতা হাতে নিই না, যেমন সেও ফেলে দেয় না টবে জমে থাকা বাড়তি পানিটুকু। এটা হচ্ছে এমন একটা নৈতিক পরিস্থিতি যাকে আমি অনেকদিন ধরে ভেবে ভেবে বানিয়েছি, এবং আমার অসহ্য লাগে যখন দেখি সাবরিনা'র চোখেও একই কৃতিত্বের আভা।



এভাবেই আমরা দুটি ডুবন্ত পিঁপড়ের মত জড়াজড়ি করে উপর নিচ করতে করতে আসন্ন ডেঙ্গু মহামারীর দিকে আগাই। আমাদের কোনো যৌথতা নাই, কেবলমাত্র টেলিভিশনের সংবাদ দেখা ছাড়া। সংবাদ শুনতে শুনতে আমার চোখ চক চক করে ওঠে, ওরও মুড়ি চিবানো বন্ধ হয়ে যায়। স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী স্বয়ং এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে। অর্থাৎ মিন্টো রোড পর্যন্ত এসে গেছে? পরম বন্ধুর মত আমরা চকিত তাকাই একে অপরের দিকে। আহাহা...আর মাত্র পরীবাগের ঢাউস কয়টা অ্যাপার্টমেন্ট আর ইস্টার্ন প্লাজা নামক জঙ্গলটা...তারপরই তো ভূতের গলি! এত খুশি লাগছিল, মনে হলতক্ষুনি একটা মেঘদূত লিখতে বসি। হঠাৎ 'কালিদাস' 'কালিদাস' বলে আমি চীৎকার করে উঠি।



- কালিদাস মানে?



- কবি কালিদাস...স্বাস্থ্য উপমন্ত্রীর বাড়ির কেয়ারটেকার। চিলেকোঠায় থাকে।



- তারে ডাকতেছ ক্যান?



- কারণ অইই মশা নামাইছিল। উইড়া আসা এক দঙ্গল মশারে মেঘ মনে কইরা মেঘদূত লেইখা ফালাইছিল...আর যায় কই!



- এডিস ছিল ঐগুলা?



- নাহ্...এডিসের জ্ঞাতিগোষ্ঠী। আসল এডিস ভিতরেই ছিল।



... বলাবাহুল্য, আমরা এই হেঁয়ালিটাকে টানতে টানতে অনেকদূর নিয়ে যাই। দু'জনেরই উদ্দেশ্য, অন্যজন যাতে মূল প্রসঙ্গটি এইসব ডালপালার মধ্যে খোয়ায়। কিন্তু নিখিল আলস্যস্রোতে ভবি ভুলবার নয়। ওর সোজা হয়ে-থাকা মেরুদন্ড খেয়াল করে আমি বেশ বুঝতে পারি, কী ভাবছে সে, যেমন সেও তাকিয়ে আছে আমার হঠাৎ-লাফানো-শুরু-করা কপালের শিরার দিকে। পুরোপুরি পেশাদার প্রস্তুতি, যেন ইতালিয়ান ফুটবলের ফাইনাল।





পরের দিন সকাল। ওয়ার্ম আপ। আমি।



নাহ...অফিসে যাব না আজ। কেমন জ্বর জ্বর লাগতেছে। - সত্যি...যাঃ কিচ্ছু না, অফিস কামাই কইর নাতো, যাও, ঠিক হয়া যাবে।



কয়েক ঘণ্টা পর। ওয়ার্মআপ ব্যাক। সাবরিনা।



হ্যালো, গায়ে কেন জানি ব্যথা করতেছে খুব। মনে হয় জ্বর আসবে। রান্না করতে পারব না, তুমি বাইরে খায়া আইস। আমি অফিস থেকে ফেরার পথে ডাক্তার দেখায়া আসব।



- ডাক্তার দেখায়া লাভ কী। ঐগুলা তোমার পুরান বাতের ব্যথা। বাসায় আইসা গরম পানির সেঁক নাও, ভাল হয়া যাইব।



একদিন সন্ধ্যায় আমাদের ফ্যাটের নিচে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন থামে। কিছু জটলা হয়। দুয়েকটা উঁচুগলার কথাবার্তা ভেসে আসে। সাবরিনার ভাষায়, নিষ্ঠুরতাহেতু আমি এসব দৃশ্যের দর্শক হই না, স্নায়বিক দুর্বলতার কথা বলে পাশ কাটাই। সাবরিনা কিন্তু দ্যাখে, আমি জানি যে সে এই দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে, অম্লান এক টুকরা সহমর্মিতা মুখে ঝুলিয়ে।



শুনছ...তিনতলার ভাবি মনে হয়, ধরাধরি করে এম্বুলেন্সে উঠাচ্ছে। কালকে শুনছিলাম ভাবির জ্বর। তিনদিন ধইরা। ডেঙ্গু নাকি? তাই তো বলাবলি করছে নিচে। সাবরিনার গলায় স্পষ্ট আমন্ত্রণ। একটা বোনাস পয়েন্ট। জেন্ডার ক্যাটেগরিতে আমি সেটা কেইম করতে পারি। আমি বেদনায় বিমূঢ় হয়ে যাই। এটা কী রকম রসিকতা? এ যেন বত্রিশ নাম্বার পেয়ে ফেল করা, নিরানব্বই রানে আউট হয়ে যাওয়া, লটারিতে শেষ ডিজিট না মেলায় পাক্কা ত্রিশ লাখ টাকা হাতছাড়া হওয়া। আমি উদভ্রান্তের মত বারান্দায় ছুটে যাই। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি ইঞ্জিনিয়ার শাহাবউদ্দিন সাহেবকে।



লুঙ্গি পরা, উস্কোখুস্কো, বউয়ের স্ট্রেচার ঠেলে এম্বুলেন্সে তুলছেন। অথচ ভেতরে ভেতরে কী নির্ভার আর সপ্রতিভ লাগছে তাকে। ওয়েলডান শাহাবউদ্দিন, বিড়বিড় করে বলি আমি, আর ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় ছারখার হয়ে যাই। তবে নিশ্চয়ই সময় এখনও শেষ হয়ে যায় নাই, রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবি। দূর থেকে মিউনিসিপ্যালিটির মশানিধন যন্ত্রের বিকট আওয়াজ ঘর্ঘর ঘর্ঘর করে আমার স্নায়ু কাটে। খুব ত্রস্ত লাগে, জীবনকে সাংঘাতিক ছোট মনে হয়। ভেঙে পড়া যাবে না, বিড়বিড় করে নিজেকে বলি, কে না জানে যে মিউনিসিপ্যালিটির ওষুধে মশার কিচ্ছু হয় না। হতে পারে, মন্ত্রীর ডেঙ্গু হওয়ায় পরিস্থিতি গুরুতর হয়ে গেছে, তাতে কিছু অন্তত খাঁটি ওষুধ মশাদের পেটে যাওয়ার সম্ভাবনা। এমন অবস্থায়, ধরা যাক, এমনও তো হতে পারে, ওষুধ ছিটানোর ফলে মিন্টো রোডের মশা সব ভূতের গলির দিকে পালাচ্ছে। বাহ্ এই তো, চমৎকার একটা পরিস্থিতির কথা ভাবা যাচ্ছে! পানি ঢালার শিফট আরেকটা বাড়াব ঠিক করি, প্রয়োজনে কাল আরো কয়েকটা ফুলের টব কিনে নিয়ে আসব, কারণ আমার মশারিতে আজ তৃতীয় যে ছিদ্রটি দেখছি ওটা নতুন, এবং ওটা দিয়ে শুধু মশাই নয়, আস্ত একটি মুরগিই ঢুকে পড়তে পারবে।



মার্চ 2005



গল্প 2



শায়লার দিকে যাওয়া



সোয়াকোটি লোকের এই ঢাকা শহরে শায়লা নাজনীন কোথায় থাকতে পারে? আমার দারিদ্র বিমোচন প্রজেক্টের ড্যানিশ কনসালটেন্ট শীতের শুরুতে ঢাকায় ল্যান্ড করলে তারে এই প্রশ্নটা ছুঁড়ে মারি, এজন্য না যে তিনি শায়লারে চেনেন, বরং এজন্য যে, গতবার নিজদেশে ফেরত যাওয়ার আগে তিনি বলতেছিলেন, হাতের তালুর মত আমাদের এই ঢাকা শহর মেট্রোপলিটন হয় কেম্নে?



এইবার আমি তারে বিনয় মজুমদার স্টাইলে ধরি : হাতের তালুর সমান স্পেস ঢাকা শহরকে মেট্রো বানায় না, বানায় সোয়া কোটি পপুলেশন। সোয়া কোটি লোক মানে সোয়া কোটি স্পেস, একেকটা গড়ে দেড়শ' গিগা কইরা। এই শহরে তুমি যদি কাউরে হারায়া ফেল, নর্মাল স্ট্যাটিস্টিকসে আবার ওরে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা সোয়া কোটি ভাগের এক ভাগ। তোমার কোপেনহাগেন-এ সেইটা বড় জোর বিশ লাখ ভাগের এক ভাগ। আবার ধর, প্রতিদিন এই শহরে তোমার সাথে বড়জোর শ'খানেক লোকের দেখাসাক্ষাৎ হয়। বছরে দেখা হয় চলি্লশ হাজার লোকের সাথে। টেনেটুনে তুমি যদি আর তিরিশ বছর বাঁচো, মোট বার লাখ লোকের দেখা পাবে তুমি। এখন দেখ, একবার যদি তুমি এই শহরে কাউরে হারায়া ফেল, বাকি জীবনভর খুঁজাখুঁজি কইরা তারে পাওয়ার সম্ভাবনা 14 শতাংশ মাত্র। নর্মাল স্ট্যাটিস্টিকস।



দেশী মসলার রান্না খাইয়া আমার ড্যানিশ কনসালটেন্ট ঘন ঘন কোপেনহাগেন। দারিদ্র বিমোচন পিছায়া যায়, এই অবসরে আমি শায়লারে খোঁজাখুঁজির প্লান করতে থাকি। নর্মাল স্ট্যাটিস্টিকসে যে চেষ্টা সুদূর পরাহত, কস্টার স্যামপ্লিং-এ সেইটা সম্ভাবনার সীমানায় এসে দাঁড়ায়। শায়লা পড়ত ইকনমিক্সে, মাঝারি মানের ছাত্রী ছিল বরাবর। নিম্নমধ্যবিত্ত রক্ষণশীল ব্যাকগ্রাউন্ড, সুতরাং ব্যাংকে বা কলেজে চাকরি করার সম্ভাবনা।



ঢাকা শহরে তপসিলী অ-তপসিলী মিলায়া মোট 25 খানা ব্যাংক আছে, যাদের হেড অফিস, লোকাল অফিস, কর্পোরেট অফিস, মহিলা শাখা, বিলবুথ মিলায়া প্রায় 250 টি শাখাপ্রশাখা। ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটি আর বাংলাদেশ ব্যাংকের সংগৃহীত ডাটা থেকে খুঁজে খুঁজে আমি মোট 15 জন শায়লা নাজনীনকে বার করি, জন্মতারিখ বিবেচনায় বাদ দিই 11 জনকে। বাকি থাকে 4 জন। হইতে পারে এই চারজনের একজনই সেই শায়লা, যারে আমি খুঁজতেছি। হইতে পারে, পূবালী ব্যাংকের যে শাখায় আমি একটা একাউন্ট অপারেট করি, সেখানেই শায়লা চাকরি করে। হয়ত ব্যাংকের রিমোট কোনায় কিং সাইজের একটা লেজার বইয়ের উপর হামলে-থাকা হেজাব-পরা মহিলাটিই শায়লা, যার হেজাবের ভেতরে কোনো মুখমণ্ডল আছে কি না জানার প্রত্যাশা আমার কোনোদিন হয় নাই। আমার ভাবনার দৌড় এবার সত্যি-সত্যি আমায় আতঙ্কিত করে :



হ্যালো ম্যাডাম, চিনতে পারছেন?



আরে.....তুমি? এখানে?



এখানে তো আমি আসি দু'বছর ধরে।



কিন্তু...একদিনও তোমার সাথে দেখা হয় নি...আশ্চর্য!



অভিযোগ-উতরানো আভা। আলোচনা, অত্যন্ত সঙ্গত কারণে, অফিসের টেবিল থেকে দ্রুত কোনো রেস্তোরাঁর দিকে গড়ায়।



তুমি একদম বদলাও নি।



কোনো কোনো রেস্তোরাঁর পরিবেশে এরকম বিবৃতি দানের উস্কানি থাকে।



তুমি কিন্তু অনেক বদলেছ। আমি হেজাব দেখাই।



ব্যাংকার শায়লা হাসে। হঁ্যা...শ্বশুরবাড়ির নিয়ম। সবাই হেজাব পড়ে। ব্যাকডেটেড।



না না...বরং মোস্ট আপডেটেড। এখন তো পশ্চিমে হেজাব পরার রাইট নিয়ে ব্রাইট ব্রাইট সব মুভমেন্ট হচ্ছে।



তোমার একাউন্ট কি সেভিংস?



আমার বিত্ত আন্দাজ করার চেষ্টা শায়লার।



না। কারেন্ট। আমি ক্ষণবাদী মানুষ। সেভিংসে বিশ্বাস নেই।



স্পেস করার জন্য আমার একটু খ্যামটা।



শায়লা তত্ত্বের ফাঁদে পা দেয় না।



কারেন্ট একাউন্টে খুব নমিনাল একটা ব্যালান্সের এগেইনস্টে আমাদের কনজিউমার ক্রেডিট লোনটা কিন্তু খুব ভাল। গাড়ি আছে তোমার?



আমার বসের একটা আছে।...আচ্ছা, টেবিলের কাচের নিচে যে ছবিটা ছিল...তোমার ছেলে?



হঁ্যা, সানিডেলে পড়ে। টু-তে। পাশেরটা নিশ্চয়ই স্বামীর।



না না...ওটা তো গাব্রিয়েল বাতিস্তুতার ছবি।



ঐ যে...আর্জেন্টিনার ফুটবলার।



মনে পড়ল, শায়লার সাথে হাকিম চত্বরে ঘুরাঘুরির মাত্র তৃতীয় দিনে ক্যাম্পাসের এক লম্বাচুল ক্যাডারের হাতে কী মাইরটাই না খাইছিলাম। ওরে সবাই বাতিস্তুতা ডাকত, শায়লার প্রেমাকাঙ্ী ছিল সে। শেষে একদিন পিস্তল ঠেকাইয়া সন্ধ্যাবেলা আমার কাছ থেকে নিয়া যায় শায়লারে, ছাড়ে পরের দিন। শাপে বর হইল এই ঘটনা। বাতিস্তুতার প্রেমাগি্ন নির্বাপিত হইল, অনুতাপ আর অসহায়ত্বে আমরা আরো প্রেমঘন হয়া উঠলাম।



ব্যাংকার শায়লার সাথে বাক্যালাপ আর আগায় না। আমি নানাভাবে কল্পনাকে ঠেলি, কিন্তু ওর চাকা কাদার মধ্যে একেবারে ডাইবা গেছে মনে হয়। অগত্যা একদিন আমার কনসালটেন্টের অফিসে গিয়া ওর গলা জড়ায়া হাউহাউ কর্যা কাঁদি। বলি, লণ খুব খারাপ, ডাটার মধ্যে মরহর জিনি ইনডেক্স নাইমা যাইতেছে, পরিসংখ্যানের বই থেকে গরিবী বিদায় নিতেছে, আমার আর চাকরি নাই। কনসালটেন্ট হো হো হাসে। বলে, মন্দ কী, ফি বছর আসা লাগব না, তিন বছর পর পর আইসা একটা ইভালুয়েশন কইরা যামু গা। এই বালের বেইজ লাইনে আমার জান কাবার হওয়ার দশা!



এ পর্যায়ে আমি টিচার শায়লারে নিয়া আশায় বুক বাঁধি। কল্পনায় তারে দেখি, হেজাব নয়, ফিনফিনে ফ্রেমের চশমা পরা। একদঙ্গল ছাত্রছাত্রীঘেরা অবস্থায় একটি বিরাট মথের মত কাশরুম থিকা বাইর হইতেছে। সেইদিনই ডাটার জন্য ব্যানবেইজ যাই। সরকারি-বেসরকারি মিলায়া মোট 36টা কলেজ আছে ঢাকা শহরে। এর মধ্যে মাত্র দুইটিতে অর্থনীতি বিভাগ নাই। বাদবাকি 34 টার মধ্যে শায়লা একাধিক থাকলেও অর্থনীতির প্রভাষক শায়লা নাজনীন আছে একজনই। পড়ায় তিতুমীর কলেজে। অতএব ফিল্ড ইনভেস্টিগেশন।



দুরু দুরু বক্ষে তিতুমীর কলেজে গিয়া দেখলাম বিশ্ব পরিষ্কার দুই শিবিরে বিভক্ত। এক শিবিরে ছাত্র, অন্য শিবিরে শিক। যেখানে ছাত্র আছে, সেইখানে শিক্ষক নাই। আবার যেখানে শিক্ষক আছে সেইখানে ছাত্র নাই। দুই দলই মহাখুশি। অর্থনীতি বিভাগের ম্যাডাম শায়লা নাজনীন ছুটিতে আছেন। চার মাসের প্রসূতি ছুটি।



আহা হা! এখন কী নিশ্চিন্ত মনে প্রকাশ্য সংবাদ হয়া গর্ভধারণ করলা প্রিয়তমা! মনে আছে, সেই যে ঝামেলা বাঁধায়া ফেললাম? তারপর তোমার কত হাতে ধরা পায়ে ধরা! রোজ সকালে এগারটা ম্যাটার্নিটি কিনিকের ঠিকানা নিয়া ধর্না দিতাম তোমার হলে। ডেসপ্যারেট বেলী-রাজু জুটির কাহিনী শুনাইতাম, আলাপ করায়া দিতাম তিন্নী-পিয়ারদের সাথে। তোমার ভয়ে-নীল মুখের সামনে ওরা ওদের অ্যাবরশনের ডালভাত মার্কা কাহিনীগুলি বলত সমানে।



কাজ পিছায়া যাইতেছে, কনসালটেন্টের এই অভিযোগ নিয়া একদিন তার সাথে তুমুল বাহাসে নামি। তারে বাংলাদেশ স্ট্যাটিস্টিক্যাল বু্যরো থেকে হিড়হিড় কইরা বার কইরা আনি, আর বলি, ঐসব জিনি ইনডেক্সে আমি বিশ্বাস করি না। এইসব ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের টাকা খাওয়া আমাদের মাথামোটা ইকনমিস্টদের বুজরুকি। পভার্টি-গ্যাপ বাড়তেছে, আমি হলফ কইরা কইতে পারি। আলট্রা-পুউর দের নিয়া কোনো বেইজ লাইন নাই। সরকার, ওয়ার্ল্ডব্যাংক বা এডিবি কেউ করে নাই। ওরা মডারেট গরীবদের পরিস্থিতিরেই পভার্টি বইলা চালায়। সত্যিকারের পভার্টি লাইন অনেক নিচে ডাইবা গেছে, স্ট্যাটিস্টিকসে এইগুলা নাই, সব এইচআইভি/এইডস-এর ফান্ড বাড়ানোর ধান্দা। ভাতের বদলে কনডম গিলাইতে চায় শালারা।



ডিড য়ু্য এভার ইন দ্য লেফট পলিটিকস? আমার কনসালটেন্টের মুখে সস্নেহ সংশয়।



আই ওয়াজ নট, স্যার! আমি মিলিটারি স্টাইলে চিল্লাই।



বাট আই ওয়াজ মাই সান। আই ড্রিমট অব অ্যা সোশ্যালিস্ট ডেনমার্ক থ্রু-আউট মাই ইয়ুথ।



খেদায় ঢুকাইতে চায়। বহুৎ পুরান ট্রিকস।



দ্যাট আনাবলস ইউ কোপিং উইদ দ্য ওয়েলফেয়ার ক্যাপিটালিজম। গুড হোমওয়ার্ক।



মনে মনে বলি। আর মুখে বলি, ঐটা তোমার সমস্যা। বামপন্থার ভূত আমার ঘাড়ে নাই। ফলে কনসালটেন্ট তার পন্থা বদলের ইতিহাস বয়ান থিকা আমারে নিষকৃতি দেন। টিচার শায়লার ব্যাপারে আমি বীতশ্রদ্ধ হয়া পড়ি। ওর গর্ভাবস্থার ডাটা আমার হাইপোথিসিসরে নাল বানায়া দিয়া ওর সুখীসমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবনটারে ফোরকাস্ট করতে থাকে। ব্যাংকার শায়লাও আমার মনে এতখানি আতঙ্ক পয়দা করতে পারে নাই। আগে মনে হইত, ওর সরকারি চাকরিজীবী স্বামী রিমোট পোস্টিং লয়া কোনো থানা সদরে হাবুডুবু খাইতেছে। এখন আমি শিউর হালার পোস্টিং সচিবালয়ে। নন-ক্যারিয়ারিস্ট মুডে সকাল সন্ধ্যা সংসার সেবা করে। গর্ভবতী স্ত্রীর শয্যাপাশে একটি করুণ কমলালেবু। অসহ্য!



অনেক দিন আগের কথা মনে পড়ে, শায়লার যেবার অসুখ করল, দীর্ঘদিন বাড়িতে, বাড়ি থিকা আমার হলের ঠিকানায় চিঠি আসল ওর। করুণ আহ্বান ভরা একটা চিঠি। আমারে সম্বোধন করা, চিঠির শেষে ওরই নাম, কিন্তু হাতের লেখা ওর ছিল না। পরে জেনেছিলাম, ঐ চিঠি লিখ্যা দিছিল ওর মা। কাঁপা কাঁপা অক্ষরে একটি নিখুঁত পারিবারিক ষড়যন্ত্র। আমি দেখতে যাই নাই।



আমি তখন সাবরিনার নানা রকম উচ্চাভিলাষের অংশ হয়া গেছি। সকাল সন্ধ্যা ডাটা টেম্পার করি, প্রাইমারি ডাটা নষ্ট করি, শায়লার সাথে আমার এফেয়ারটারে আমার তরফে চ্যারিটি বইলা চালাই। স্ট্যাটিস্টিকস আমায় উৎসাহ দেয়, স্ট্যান্ডার্ড এরর আওতার মধ্যেই থাকে। সাবরিনা আমার মহত্ত্বে মুগ্ধ হয়, সাবরিনার মহত্ত্বে আমিও পাল্টা মুগ্ধ হই, শেষে নিজের মহত্ত্বে নিজেই মুগ্ধ হইতে শুরু করি। এতসব মুগ্ধতার মাঝে আলট্রা-পুউরের মত মিলায়া যায় শায়লা নাজনীন। মাস্টার্স ফাইনাল দিতে আইসা জ্বলজ্যান্ত দুইমাস হলে থাকলেও আমার সাথে দেখা হয় না তার।



আমার ড্যানিশ কনসালটেন্ট নানা রকম মেইল কইরা আমারে ডাক পাড়েন। বলেন, সেকেন্ডারি ডাটার আটার বস্তার নিচে তিনি নাকি চিৎপটাং হয়া আছেন। এখন নাকি গরিবদের এসেট-এনালিসিস করতে চান। আমি উত্তর দিই, ফালায়া থোও ঐসব ডাটার বস্তা, ঐখানে যারা আছে তারা মডারেট, পাতিবুর্জোয়ার চাইতেও ভয়ানক। ওরা জানে তোমার কী কী ডাটা লাগবে, তোমার প্রয়োজনে ওরা ল্যান্ডলেস হয়, ক্রেডিটের টাকা তুইলা মৌজ মারে। হার্ডকোর গরিব হয়া ওরা এনজিও অফিসে যায়, আবার ইভালুয়েশন রিপোর্টের সময় ঠিক ঠিক প্রয়োজন মত ওয়েলঅফ হয়া যায়। এতে তোমার আত্মতুষ্টি হয়, তোমার আত্মতুষ্টি আর কীসে কীসে হয় ওরা জানে। ওরা তোমার জিনি-ইনডেক্স দিয়া মোয়া বানায়া খায়, অ্যাসেট অ্যানালিসিস-এর কাগজ দিয়া বাচ্চার হাগা মোছে। তুমি শীতকালে বেড়ায়া যাও, এসি-লাগানো পালকিতে উইঠা মানিকগঞ্জের দুইটা গ্রাম ঘুইরা ঘুইরা দেখ আর ফটাফট ছবি তোল। সন্ধ্যা হইতে-না-হইতেই তোমার গুলশানের রেস্ট হাউজে হান্দায়া যাও। তুমি গ্রামে যাওয়ার তিনদিন আগে থেকে সেখানে রিহার্সাল চলে। আর সেই নাটকে ঢুকে তুমিও ঘন ঘন ঘড়ি দেখ, ওদের কাজ আরো সহজ কইরা দাও। তুমি পভার্টি মাপো তোমার প্রজেক্টে, এর বাইরে তোমার যাওয়ার উপায় নাই। আর তোমার লোকাল রিসিভার এনজিওরা মাত্র দুই দশকে এই দেশে এমন এক তুখোড় রেসপন্ডেন্ট জেনারেশন বানাইছে, যারা তোমার অফস্পিন, লেগস্পিন, গুগলি সব বোঝে। রাতের অন্ধকারে বোঝে। তাদের দুধের বাচ্চারাও বোঝে। তুমি দেখ নাই বর্ষায় অষ্টগ্রাম কেমন থৈ থৈ করে, ুধার মহামারী কী জিনিস। তুমি কোনোদিন জানবা না আলট্রা-পুউর নিজের ঘরের মধ্যেই কেম্নে দিনের পর দিন ইনভিজিবল হয়া থাকে।



কথা শেষ করে আমি হাঁপাই। ডিভোর্সের প্রথম বছরে পুরুষেরা এরকম একটুআধটু র্যাডিক্যাল হয়া যায়, আমার কনসালটেন্ট আমারে এইভাবে মাপেন। ফলে আমার চাকরি বহাল থাকে। উপরন্তু কয়েক দিনের ছুটি জোটে।



আচ্ছা, এমনও তো হইতে পারে যে, শায়লা শেষমেশ নারীবাদী হয়া গেছে! কদমছাঁট চুলের শায়লা নাজনীন অ্যাকশন-এইডের টাকায় ডমিস্টিক ভায়োলেন্সের উপর ডকুমেন্টারি বানাইতেছে! লিভ টুগেদার করতেছে শ্মশ্রুমণ্ডিত ও নারীবাদী কোনো যুবকের সাথে। রগরগে যৌনতা ছাড়াই। অতৃপ্ত আদর্শবাদী জীবন। উত্তেজনায় আমি শোয়া থেকে উইঠা বসি।



এনজিও বু্যরো'র ডাটা রিলাইয়েবল লাগে না। ওরাই পই পই করে বলেছে, রেজিস্ট্রেশন দেখবেন এক নামে, সাইনবোর্ড দেখবেন আরেকটা। কেব্লা ঘুইরা গেলে ওদেরও যে ঘুরতে হয়। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম! তিনজন শায়লাকে পাওয়া যায় যারা নারীবাদী উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে। ঠিক করি, র্যানডম নয়, যেখানেই নারী অধিকারের গন্ধ পাব, সেইখানেই শায়লা নাজনীনের কথা জিগায়া দেখব। খুঁজব সর্বত্র। পুরুষতান্ত্রিকতা সহ। শায়লা জানে, প্যাট্রিয়ার্কি ছাড়া যৌনতায় ইনটেনসিটি আসে না। ওর রক্তে সেই বীজ ঘুমন্ত আছে। প্রয়োজন তারে জাগায়া দেয়া। একদিন আমার কনসালটেন্ট বাড়িতে আইসা হাজির। চোখেমুখে বামপন্থী অনুতাপ। আলট্রা-পুউর বিষয়ে প্রাইমারি ডাটার সন্ধানে নামতেছেন। আমি তারে অনেক বোঝাই। বলি, দেখ, দেখানোর দা আর কোপানোর দা এক না। আলট্রা-পুউর নিয়া কথা কইবা, ফান্ড চালু থাকব। আলট্রা-পুউর খুঁজতে গেলে তুমিই আলট্রা-পুউর হয়া যাবা। এই কথায় আমার কনসালটেন্টের মনে আরো বিপ্লবী জোশ আসে। আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় আমার, রবার্ট চ্যাম্বার্স-এর আদলে চে' গুয়েভারার ভূত দেখি। আলট্রা-পুউর নয়, নতুন চাকরি খুঁজি আমি। সাথে সাথে নারীবাদী অফিস। খোঁজ পাই, আমার ড্যানিশ কনসালটেন্ট মধুপুরের জঙ্গলে গিয়া খুঁটি গাড়ছেন। পায়ে পা বাঁধায়া ঝগড়া লাগাইছেন কারিতাসের সাথে। চার্চের একটি রেস্ট হাউজে থাকেন তিনি, রোজ রাতে তার টিনের ঘরের চালে আইসা হনুমান শাসায়া যায়। তিনি ফিল্ডে নামলেই চার্চের ফাদাররা নাকি আলট্রা-পুউরদের গহীন জঙ্গলের দিকে ভাগায়া দেয়। সেই অবসরে তিনি গোটা বর্ষাকাল ধরে হেন্ডারসন দ্য রেইনকিং স্টাইলে একটা উপন্যাসও নাকি লিখতেছেন।



আর আমি অলিতেগলিতে চাকরি ও নারীবাদ খুঁজি। সোয়াকোটি স্পেসের বিশাল এই মেট্রোপলিটনে। এভাবে প্রতিদিন শায়লার দিকে একটু একটু করে যাই। একেকটা এলাকায় খোঁজাখুজি শেষ কইরা ফিরা যাবার পথে দেখি, আরো গোটাদুই নারীবাদী অফিস গজায়া গেছে। তাতে স্বস্তি হয়। মেটাফিজিঙ্ হয়। একই ক্যাটাগরিতে অনন্তকাল খোঁজাখুঁজি চালায়া যাওয়ার সম্ভাবনা বলবৎ থাকে।



টীকা (না পড়লেও ক্ষতিবৃদ্ধি নাই)



অ্যাসেট অ্যানালিসিস : গরীবদের সয়সম্পদ মাপার জন্য একটা পশ্চিমা ফরম্যাট। উন্নয়নের বাজারে খুব চালু।



আলট্রা পুউর : অতিগরিব বা হতদরিদ্র। দারিদ্রসীমার একেবারে তলানির দিকে যারা থাকে। বা থাকে না।



প্রাইমারি ডাটা : নিজে নিজে ফিল্ড থেকে সংগৃহীত ডাটা। ফিল্ড রিসার্চার নামক একদল বোবা এবং কলুর বলদ এই কাজ করে থাকে।



সেকেন্ডারি ডাটা : উন্নয়ন-গবেষকদের স্বপ্নের ধন। অন্যের রক্তেঘামের এই জোগাড় তাদেরকে ঢাকা বা নু্যইয়র্কে (কখনও প্লেনের মধ্যে ল্যাপটপে) বইসা বাংলাদেশ নিয়া গিগা গিগা ম্যাটার বানাইবার উৎসাহ দেয়।



পভার্টি লাইন : দারিদ্রের লক্ষণরেখা। এই রেখার নিচে যাদের আয়ব্যয় তারাই গরিব, পশ্চিমা গবেষকেরা এইভাবে তৃতীয় বিশ্বে জুতা আবিষ্কার করেন। এ প্রসঙ্গে তারাপদ রায়ের বিখ্যাত কবিতাটি স্মর্তব্য।



ব্যানবেইজ : বাংলাদেশের একটি সরকারি সংস্থা যেখানে শিাবিষয়ক তথ্যাদি সংরণ (ও গবেষণা?) করা হয়। এসব তথ্যের একমাত্র কাজ বিনা-উৎকোচে তালাবদ্ধ থাকা।



জিনি ইনডেক্স : একটা দেশে ধনীগরিবের ব্যবধান মাপার একটা ব্যবস্থা। নামটি গিনিপিগের কথা মনে করায়া দেয় বইলা এরে গিনি না বইলা আদর কইরা 'জিনি' ডাকা হয়।



রবার্ট চ্যাম্বার্স : সাসেক্সর শিক্ষক। গ্রামীণ দারিদ্র এবং উন্নয়নের রীতিকৌশল নিয়া অনেক চ্যাটাং চ্যাটাং আলাপসালাপ করেন, কিন্তু তার চাকরি ও প্রমোশন অব্যাহত থাকে।



স্ট্যান্ডার্ড এরর : যতটুকু ভুল করলে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ খাপ্পা হয় না।



প্যাট্রিয়ার্কি : একটি (অ)মানবিক, (অ)মানসিক এবং দৈশিক অবস্থা, যা নারীপুরুষ নির্বিশেষে কিছু কিছু মানুষের চেতনায় ও রাজনীতির মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু নারীবাদ এরে পুরুষের একচ্ছত্র সম্পত্তি বইলা হাহুতাশ করে।

মার্চ2005 . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . সুমন রহমান : জন্ম. ভৈরব 30 মার্চ 1970; ঢাকা, বাংলাদেশ প্রকাশ: গদ্যসঞ্চালন 5 (মার্চ 19, 2005) ....................................................................



আমার পাঠ প্রতিক্রিয়া



এক.



সুমন রহমানের গল্প পড়ে অবাক হয়েছি।



'ডেঙ্গুচর্চার দিনগুলি' পড়ার সময় সবচেয়ে আগে নজর কেড়েছে গল্পের জমিন। সাধারণ স্বামী স্ত্রী'র সংসার, দুইজন আফিস করে, বিকালবেলায় বাসায় আসে, বারান্দায় ফুলের টব আছে, নিচের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী, সন্ধ্যার খবর শোনা দুইজন একসাথে বসে - এই সবই স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনের পরিচয় বহন করে এক ঝলক দেখলে । এর ভেতর থেকেই বোনা হয়েছে গল্প, যা ভয়ঙ্কর - এতটাই, যে কৌতুককর ।



প্রথম লাইন - এই বর্ষাবিধৌত সন্ধ্যাগুলোতে আমার টবচর্চা, আমার উদার পানিসিঞ্চন পড়ার সময় একটা হালকা অস্বস্তি টের পেয়েছি, যদিও প্রথমবারে এর কারণ বুঝতে পারি নাই। আমার এক বন্ধু একবার রবীন্দ্রসংগীতের কিছু শব্দ অদল বদল করে গাইছিল - 'তোমার হৃদয়ে দিব চরণ তুলিয়া' । তখনও একই ধরণের অস্বস্তি টের পেয়েছিলাম। মনে হতে থাকে কি জানি ঠিক নাই। অথচ সেই ঠিক না থাকাটা যে কি, তা পরিষ্কার হয় না শুরুতেই। আরেকটু পরে মনে হলো, তাইতো! সন্ধ্যাটা যদি বর্ষাবিধৌত হয়, তবে পানিসিঞ্চন এর কি দরকার । এইভাবেই সুমন তাঁর গল্পের ভেতর টেনে নেন পাঠককে ।



গল্পটা লেখা প্রথম পুরুষে। এই আপাত নিরীহ ও সরল মানুষটার জটিল এবং ষড়যন্ত্রী অভ্যন্তরের সাথে পরিচিত হই তারই অকপট স্বীকারোক্তিতে। তার ভাবনার ধারায় আত্মবিশ্লেষণের ভাব আছে, নিজের থেকে কিছুটা সরে দাঁড়িয়ে। যেন নিজের ভাবনার সুতাগুলি পাঠকের সাথে একত্রেই নজরে পড়ছে তারও। যদিও গল্পের কোথাও সেইরকম প্রত্যক্ষ বর্ণনা দেয়া নাই তবু এর নায়কের কথা ভাবতে গেলে বাহ্যত একজন বোকা বোকা ও উদাসীন ব্যক্তির কথা মনে এসেছে। যে একই ভুল বারবার করে কারণ কোনো ব্যাপারেই তেমন মনোযোগ তার নাই। যার কানের কাছে তার স্ত্রী এসে হিস্ হিস্ করতে পারা ও নিচতলার প্রতিবেশীর (কান ধরে ঘর না মুছালেও) হম্বিতম্বি করতে পারাটা নিতান্তই সম্ভবপর ব্যাপার বলে বোধ হয়। স্ত্রীর এই হিস্ হিস্ কিন্তু সে বৈরাগ্যভরে উপেক্ষা করে না বরং মনে মনে সঞ্চিত ক্রোধ ও স্ত্রীর প্রতি বিরাগের জ্বালানী হিসাবে ব্যাবহার করে।



তার ডেঙ্গুচর্চায় নিবিষ্টতাও বৃদ্ধি পায় এতে। এতক্ষনে পাঠক হিসাবে আমি বুঝতে পারি যে ডেঙ্গুচর্চা বিষয়টা শুধুমাত্র ডেঙ্গু সংক্রান্ত ভয়, আলাপ অথবা ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ না। বরং ডেঙ্গুচর্চার মানে আসলে ডেঙ্গু পরিচর্যা। তাকে (মানে ডেঙ্গুকে) রীতিমত আমন্ত্রণ, অতিথিরূপে এবং তারই বাৎসল্যহেতু এই উদার পানিসিঞ্চন। নায়কের মশারির ক্রমবর্ধমান ছিদ্রসংখ্যাও ডেঙ্গুচর্চার অংশ। এই অঘোষিত চুক্তিতে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আবদ্ধ কোনো রকম পূর্ব আলোচনা ছাড়াই ।



"বস্তুত, এটা এমন একটা ডুয়েল যেখানে আমি সুঁইসূতা হাতে নিই না, যেমন সেও ফেলে দেয় না টবে জমে থাকা বাড়তি পানিটুকু। এটা হচ্ছে এমন একটা নৈতিক পরিস্থিতি যাকে আমি অনেকদিন ধরে ভেবে ভেবে বানিয়েছি, এবং আমার অসহ্য লাগে যখন দেখি সাবরিনা'র চোখেও একই কৃতিত্বের আভা।"



অর্থাৎ ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, নির্ভরতা বা সাহচর্য নয় (যে বিষয়গুলিকে বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত ধরা হয় সামাজিক ও পরম্পরার সূত্রে), এদের চালিত করে এই ডুয়েল। তাই কালিদাস, মেঘদূত আর মশার ঝাঁক বিষয়ে তাদের কথোপকথন যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় পারষ্পরিক খুনসুটি, আসলে বিস্তৃত করে যুদ্ধক্ষেত্র। গল্পের ভাষায় কোথাও শিথিলতা নেই। সবসময় টানটান একটা সম্ভাবনা, বা কোনো কিছু ঘটার অপেক্ষা টের পাওয়া যায়। বাক্যগুলি অনেকটা ভাবনার জালের মতন খুলেছে আস্তে আস্তে এবং পাঠক হিসাবে আমাকে আকৃষ্ট করেছে গল্পের চরিত্রদের সম্পর্ক ও অধিষ্ঠানের আবরণগুলি লক্ষ্য করতে ।



এই গল্পের বিবরণগুলি আছে প্রমিত বাংলায় আর কথোপকথন কথ্যভাষায়। আবার পরের গল্প শায়লার দিকে যাওয়াতে ব্যাপারটা উল্টা। এর একটা কারণ আমার মনে হয়েছে বর্ণনাকারীর সাথে পাঠকের ও অন্যান্য চরিত্রদের সম্পর্ক নির্দেশ। যেমন প্রথম গল্পে পাঠকের সাথে সম্পর্কটা ফরম্যাল (যদিও অকপট) আর স্ত্রী শত্রুপক্ষ হলেও তার সাথে ঘরোয়া সম্পর্ক। দ্বিতীয় গল্পে পাঠককে হয়তো আলাদা কোনো সত্তা হিসাবে ধরা হয় নাই অথচ ড্যানিশ কনসালটেন্ট এবং শায়লা দুইজনের সাথেই যোগাযোগটা সামাজিক।



লুনা রুশদী

কবিসভা, এপ্রিল, 2005

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৩/-১

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৬ সকাল ৮:০১

অতিথি বলেছেন: আফা আফনে ইতা কিতা লিখলেন। আন্নের গিয়ানের পরিধি পিরথিবি পার হয়ে মংগলে গেছে। এমন বিশ্লেষণের প্রয়োজনীয়তা কি? আপনি যে আলোচনা করছেন ওটা শিশুপাঠ হয়ে যাচ্ছে। আমি আন্তরিক ভাবে ধন্যবাদ দিচ্ছি গল্পগুলোর জন্যে কিন্তু আপনার উন্নত !!!!!!!!!বিশ্লেষন সম্পূর্নটার মান কমিয়েছে তিন দাগ।

মফিজ একটা বিড়ি আন বিশ্লেষন ফরি মাথা গরম হই গিয়ে।

২| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৬ সকাল ৮:০১

লুনা রুশদী বলেছেন: ভাই আমি এইরকম মানেরই লিখতে পারি, কি করমু, আমি একজন অজ্ঞান মানুষ।

৩| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৬ সকাল ৯:০১

হাসিন বলেছেন: ভালই লিখেছেন

৪| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৬ রাত ৯:০১

লুনা রুশদী বলেছেন: হাসিন - আপনার প্রোফাইলে দেখলাম আপনি একজন উদভ্রান্ত মানুষ, পাগলে কি না বলে...

৫| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৬ রাত ৯:০১

ভূত বলেছেন: মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। যাই হোক। যে কথা বলার জন্য লেখা সেটা হলো আপনার ভাষাটা আমার পছন্দ হয়েছে। আপনি রবীন্দ্রনাথের শুদ্ধ বাংলা পরিহার করে একদম চাড়ালদের ভাষা ব্যবহার করছেন। এইটা কিন্তু একটা নতুন দিগন্ত খুইলা দিবো আমাগো সাহিত্য চর্চায়।

৬| ১৯ শে জানুয়ারি, ২০০৬ রাত ৯:০১

ভূত বলেছেন: আরে! গল্পটা দেখি আপনার না! তাহলে এত কষ্ট করে পুরো গল্পটা টাইপ করে পোস্ট করতে গেলেন কেনো?

৭| ২০ শে জানুয়ারি, ২০০৬ রাত ১২:০১

লুনা রুশদী বলেছেন: ভূত, এইখানে আমার পছন্দের অনেককিছুই আমি পোষ্ট করতেছি। আমার লেখা ছাড়াও অন্যদের লেখা আমার পছন্দ হইলে পোষ্ট না করে উপায় কি?

৮| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০০৬ রাত ৮:০১

হিমু বলেছেন: লুনা, সুমন রহমানের -ডুমরি- পড়ে দেখবেন সুযোগ পেলে ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.