নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পথহারা পথিক

অস্তিত্ববিহীন প্রবাসী বাঙ্গালী

মোঃ নাজমুস সাহাদাত

আমি মোঃ নাজমুস সাহাদাত। পেশায় মাস্টার। দেশের এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পোলাপাইনদের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল শেখানোর চেষ্টা করছি। নিজের ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে মাঝে মাঝে কিছু লেখার চেষ্টা করি। এ আমার পেশা না নেশা। পড়তে ভালবাসি কারণ লেখা ও পড়া কখনো আমাকে ছেড়ে যায় না, আমাকে কখনো ঠকায় না। নানা মানুষের নানারকম সৃষ্টিমূলক চিন্তাভাবনা খুব ভালবাসি এবং বিভিন্নশ্রেনীর মানুষের ভেতর থেকে তাদের এই চিন্তাভাবনাগুলোকে খুজে বের করে নিজে কিছু শেখার ও শেয়ার করার চেষ্টা করি; এইটা উপলব্ধি করতে খুব ভাল লাগে যে সৃষ্টিকর্তা সবার মাঝেই কিছু না কিছু চমৎকার ভাল গুন দিয়ে দিয়েছেন।

মোঃ নাজমুস সাহাদাত › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফিডব্যাক

১৮ ই মে, ২০১২ সকাল ৭:০৭

সকাল ১০.২৫ মিনিট। পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে আরো ২৫ মিনিট আগে। ইনভিজিলেশনে আছি আমি আর আমার এক কলিগ। এমন মুহুর্তে প্রায় দৌড় দিয়ে এক ছাত্র আসল। অনুমতি চাইল ভেতরে আসার। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি আছে পরীক্ষার রুমে এনট্রির। তাই তাড়াহুড়া করে প্রশ্ন ও খাতা এগিয়ে দিলাম তার দিকে। খাতা নিয়ে বেশ সিরিয়াস ভাব নিয়ে লেখা শুরু করল। পরীক্ষার বিষয় ছিল ইলেকট্রনিক্স।

আমার এই ছাত্রটির নাম রাফি। দেখতে বেশ ভোলা ভালা। অনেক আরাম প্রিয়। কোন অ্যাসাইনমেন্টই ঠিকমত জমা দেয় না। চান্স পেলেই ফাঁকিবাজি করে। তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ, দিনে ঘুমানো আর রাত জাগা। রাত জেগে মুভি দেখতে তার বেশ ভাল লাগে। আর সবচেয়ে বেশি মুভি দেখতে ভাল লাগে, পরীক্ষার আগেরদিন রাতে। পরীক্ষার আগের রাতে অসম্ভব বোরিং মুভিও যেন তার অনেক ভাল লাগে। ভাল লাগে খোলা ছাদে বসে চাঁদ দেখতে অথবা বাতাস খেতে। ইঞ্জিনিয়ারিং তার চক্ষুশূল। সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে পরীক্ষা। প্রতি সেমিস্টারের পরীক্ষা তার কাছে একইরকম মনে হয়। কারণ কোন পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তরই সে ঠিকমত জানেনা। অনেক কষ্ট করেছিল ইউনিভার্সিটির প্রথম পরীক্ষা দেওয়ার সময়, ফলাফল শূন্য। সেই থেকেই তার কাছে মনে হয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং হবে না তাকে দিয়ে।

আজকের পরীক্ষাও একইরকম লাগছে তার কাছে। মনটা খুব খারাপ, চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এইভাবে আর কত? কতদিন পরীক্ষায় কিছু লিখতে পারবেনা। অনেক ক্লান্তি ভাব নিয়ে গালের নিচে হাত রাখে। অনেকক্ষন দেখছি, লেখা বাদ দিয়ে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে। বৃষ্টির পরে ছাদ থেকে পানি পড়ছে সেটা দেখতেই যেন তার ভাল লাগছে। অবাক হয়ে দেখছে। কিছুক্ষন পরে তার চোখ আস্তে করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বার বার আমার দিকে খেয়াল করছে, দেখছে আমি দেখে ফেলেছি কিনা! আমি দেখেও না দেখার ভান করলাম। পরীক্ষা শেষ করার পরে তাকে আমার রুমে ডাকলাম।

রাফি অনেক ভয়ে ভয়ে আমার রুম নক করল। মনে মনে ভাবছে, এই বুঝি স্যার দেখে ফেলেছে। রুমে ঢোকার পরেই আমি তাকে বসতে বললাম। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই বলল, “স্যার আমি আসলে ঘুমায়নাই কিন্তু”। রাতে অনেক পড়েছি তাই একটু ঝিমুনি এসেছিল। আমি একটু হেসে দিলাম। আমার হাসি দেখে সে একটু রিল্যাক্স হলো। তারপরে প্রশ্ন করলাম আসলে তোমার সমস্যাটা কোথায়? পড়ালেখা.....বলার আগেই সে উত্তর দিল, “স্যার সত্যি বলছি অনেক পড়েছি, গত তিন দিন ধরে পড়েছি, কিন্তু কিছুই বুঝিনাই”। রেগে গিয়ে বললাম, “কয়টা মুভি পড়েছ?” সাথে সাথে বেচারার মুখটা চুপসে গেল। অনেক ভয়ে ভয়ে বলল, “স্যার আসলে আমি পড়তে গিয়ে মজা পাইনা”। ভাল লাগেনা আমার এই ইলেক্ট্রনিক্স। বলেই সে বিড়বিড় করতে লাগল। মনে হল বলছিল, “কে যে আবিস্কার করেছে এই ইলেকট্রনিক্স”। একটু হেসে জিজ্ঞাসা করলাম তো রাফি সাহেব, আমাকে আপনার পড়া ইলেক্ট্রনিক্সের সবচেয়ে কঠিন টপিক বলেন তো। সে সাথে সাথেই বলল স্যার ফিডব্যাক এমপ্লিফায়ার। এই টপিকের কথা বলার পেছনে তার কারণ আছে। ক্লাসের একজন ভাল ছাত্রের কাছে থেকে সে শুনেছে, এইটা অনেক কঠিন টপিক।

প্রথমেই বোঝানো শুরু করলাম ফিডব্যাক মানে কি। বললাম ধর তোমার এক বন্ধু সিলেট থেকে ঢাকা যাচ্ছে। তুমি কিছুক্ষন পর পর তাকে ফোন করে জানতে চাইছ সে কোথায়। তোমার বন্ধু ফোনে তার অবস্থান সম্পর্কে তোমাকে জানিয়ে দিচ্ছে বার বার, এর মানে হচ্ছে তোমার বন্ধু তোমাকে ফিডব্যাক দিচ্ছে। রাফি আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম সে কিছুই বোঝেনাই।

আবার বললাম ধর তোমাদের আমি ক্লাসে অনেক কিছু পড়িয়েছি। এখন কেমন করে বুঝব তোমরা কতটুকু শিখেছ? পরীক্ষা নিয়ে। তোমাদের পরীক্ষার খাতা দেখা মানে হচ্ছে তোমরা কতটুকু শিখেছ সেটার ফিডব্যাক নেওয়া। একটু একটু বুঝেছে বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু মুখটা দেখলাম একটু বিকৃত। কারণ জানতে চাইলে, সে বলল, “স্যার এইখানে তো আপনি বুঝলেন আমরা কতটুকু শিখেছি কিন্তু এমপ্লিফায়ার ফিডব্যাক নিয়ে কি বোঝে?” বুঝলাম যে, সে দুইটা উদাহরণের মাঝে সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছে না।

এইটা বোঝানোর জন্য একটা ট্রিক অ্যাপ্লাই করলাম। আমার হাতে একটা কলম ছিল। কলমের হেড খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। রাফির একহাতে হেড একহাতে কলম। এখন বললাম কলমটাতে হেড পরাও। সে অনেক খুশি, কারণ এর চেয়ে সহজ পরীক্ষা আমি কখনও নেই নাই। কলমে হেড পরায়ে মুচকি একটা হাসি দিল। আমি আরেকটা হাসি দিয়ে বললাম এবার চোখ বন্ধ কর এবং কলমে হেড পরাও। সে কলমে হেড কয়েকবার পরাতে গিয়ে ব্যর্থ হল। চেহারাটা আবার মলিন হয়ে গেল।

এবার তাকে আমি বুঝিয়ে বললাম। তোমার যেমন টার্গেট কলমে হেড পরানো, তেমনি এমপ্লিফায়ারের টার্গেট যতটুকু দরকার ততটুকু সঠিকভাবে এমপ্লিফাই করা। সে যদি ফিডব্যাক না নেই তাহলে সে তোমার মতই হেড পরাতে মিস করতে পারে। এমপ্লিফায়ার এর আউটপুট থেকে তার লাগিয়ে ফিডব্যাক নেওয়া হয়। আর তুমি এখানে চোখ দিয়ে কলম ও হেড দেখে ফিডব্যাক নিয়ে তোমার লক্ষ্য, কলমে হেড পরিয়ে ফেলেছ। পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সে অনেক খুশি। রুম থেকে বেরুবার আগে আমাকে কথা দিয়ে গেল, আগামী থেকে সে ঠিক মত পড়ালেখা করবে।

মাঝে মাঝেই চিন্তা করি, কিভাবে এইসব ছাত্রছাত্রীদের শুধু মাথায় না, মনে ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা জায়গা করে দিতে পারি আমরা? সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এদের মাঝে সৃষ্টির একটা আনন্দকে উপলব্ধি করানো। একবার যদি কেউ সৃষ্টির আনন্দকে উপলব্ধি করে তবে তার কাছে ইঞ্জিনিয়ারিং এর চেয়ে মজার জিনিস আর কিছু হতেই পারে না। আমার মতে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাদানের পদ্ধতির কিছুটা পরিবর্তন আনা অপরিহার্য। ইঞ্জিনিয়ারিং এর থিওরী ক্লাস, ক্লাসরুমে না ল্যাবে হওয়া উচিৎ অথবা ক্লাস রুমে ডেমো দেওয়ার আলাদা ব্যবস্থা থাকা অপরিহার্য। আমি যখন ইলেকট্রনিক্সের মত মজার টপিক পড়াই তখন কেমন জানি ছাত্রছাত্রীরা ঠিক মন থেকে উপলব্ধি করতে পারে না আসল ব্যাপারটা। যখন তারা ল্যাবে যায়, তখন আগের থিওরির প্রায় পুরোটায় হজম করে ফেলে। ক্লাসটেস্ট এর প্রেসার ছাড়া কেউ বই খুলতে চায় না। এভাবে প্রেসার দিয়ে নতুন কিছু করার আনন্দ সৃষ্টি করা যায় না। গ্রেডের পেছনে দৌড়াতে গিয়ে বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী হাঁপায়ে উঠে। একসময় আশা ছেড়ে দেয়। দেখা যায় অর্ধেকের চেয়ে বেশি ছেলেমেয়েরা প্রকৃতভাবে কিছুই শিখতে পারছেনা। আর এইসব ছেলেমেয়েকে নিয়েই আমাদের চিন্তা করা উচিৎ, কারণ এদের সংখ্যাটা অনেক বেশি।

বাংলাদেশে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে প্রকৃত ইঞ্জিনিয়ারদের মত কাজ করার সু্যোগ অনেক কম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ইঞ্জিনিয়ারদের যে কাজ করানো হয় সেটা হল মেইন্‌টেনেস। যেকারনে বেশিরভাগের মনে একটায় ধারণা, বেশি পড়ালেখা করে কোন লাভ নেই, মোটামোটি একটা রেজাল্ট নিয়ে, ভাল বেতনের চাকুরী পেলেই অনেক কিছু। সবার মাঝে কেমন জানি একটা অর্থনৈতিক চিন্তা! পড়ালেখা, চাকুরী, বেতন। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে প্রকৃত জ্ঞান আমাদের মনে কখনও জায়গা করতে পারবেনা, নতুন কিছু সৃষ্টি কখনই হবে না।

পুরো পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন আবিস্কার হচ্ছে। সেখানে বাঙালীদের অবদান কোন অংশে কম নয়। নতুন কিছু করার কারণে যদি আজকে আমরা ১০০ জন বাঙ্গালীর নাম স্মরণ করি তবে আগামীতে এর পরিমাণ হবে ১০০ গুন ইনশাল্লাহ্‌, যদি আমরা আমাদের শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে পারি, যদি ছোটবেলা থেকেই আমরা শিশুদেরকে নতুন কিছু করার/বানানোর জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করাতে পারি। আর একবার সৃষ্টির আনন্দ যে পেয়েছে তাকে জ্ঞান আহরণের জন্য তাগিদ দিতে হয় না। সে নিজেই নিজের পথ বেছে নেয়।

এক ব্যক্তির উক্তি দিয়ে আমি শেষ করতে চাইঃ

“কাউকে পরিপূর্নভাবে কিছু শেখানো যায় না, শেখার জন্য তার মনে শুধু আগ্রহ সৃষ্টি করা যায়”।



বি দ্রঃ রাফি একটি কাল্পনিক নাম।

উ ৎ স র্গঃ আমার সেইসব অমনযোগী ছাত্র-ছাত্রীদেরকে, যাদের জন্য বাবা-মা অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সরকার বিপুল পরিমান অর্থ ব্যয় করছে।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মে, ২০১২ রাত ১১:২৭

আহমাদ জাদীদ বলেছেন: আপনি তাহলে স্যার......আপনার মনোভাব বুঝতে পারছি, আপনার এই ছাত্ররা আপনার সহায়তা পাবে, এই আশাই করছি...... :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.