নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আল্লাহ মহান সর্বশক্তিমান

লেখতে ভালো লাগে ...

রাশীদ মাহদি

আমি স্বপ্ন দেখি, একদিন সব কোলাহল থেমে যাবে। থাকবে না রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। আমরা স্বাধীন জাতি, গোলামির শৃঙ্খল ভেঙে আমরা হবো মুক্ত। আমাদের প্রতি যার দয়া, আমরা হবো কেবল তারই ভৃত্য...

রাশীদ মাহদি › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির পাতায় ৫-মে ২০১৩

০৬ ই মে, ২০১৫ রাত ৮:০৯

৫মে '১৩ সকাল, সাইনবোর্ড, নারায়ণগঞ্জ

প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে। সবাই ছাউনি খুঁজছেন। দৌড়তে গিয়ে কয়েকজন পড়ে গেলেন। মুহূর্তকাল থেমে গেল তাকবীর ধ্বনি আর লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত স্লোগানের আওয়াজ। এভাবে তো হবে না! আমরা ক'জন মাথায় পলিথিন বাঁধলাম। কারণ জোশের সাথে হুশ ঠিক রাখতে হবে। এক ঘণ্টা দু'ঘণ্টা নয়, ১৩ দফা বাস্তবায়ন হওয়া পর্যন্ত আমরা অবস্থান করবো এখানে। তাই শারীরিক সুস্থতা খুব প্রয়োজন। তবে যে আন্দোলনের জন্য সুস্থ থাকা তাই যদি থেমে থাকে তাহলে সুস্থ থাকার কী দরকার? আমরা নেমে গেলাম আবার রাস্তায়। সাইনবোর্ড পয়েন্টে তখন আমরা পাঁচ ছ'জনই খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে স্লোগান তোললাম। ধীরেধীরে আরো মানুষ জমতে শুরু করল। রাস্তাপাশের দোকানের ছাউনি থেকে মানুষের ঢল নামতে শুরু করল। আবার জ্বলে উঠল সবার রক্ত। বৃষ্টিই যেন এখন আমাদের শিফা। সত্যি বিশ্বাস করেন, ঐ দিনের বৃষ্টি না আমাদের গায়ে ঠাণ্ডা লাগিয়েছে না কেউ ক্লান্ত হয়েছে। বরং গতদিনের দীর্ঘ সফর আর চলতি সব ক্লান্তি ধুয়েমুছে আমাদেরকে নতুন এক শক্তি দান করেছিল। যা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ রহমত। যা আল্লাহর রাস্তাতেই পাওয়া যায়............


৫মে '১৩র সন্ধ্যা, মতিঝিল

সারাদিন শাপলা চত্বরের পশ্চিমে সোনালী ব্যাংকের সামনে বসে-দাঁড়িয়ে কাটিয়েছি। মাগরিবের পর ওয়াবদা মসজিদ থেকে ওযু-ইস্তেনজা সেরে আসলাম। সন্ধ্যার পর মানুষের চাপ আরো বেড়েছে, ক্রমশ বাড়ছেই। আমরা বসে গেলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩য় গেইটের পাশে। সারাদিনের খাবার বলতে সকালে খিচুড়ি, সন্ধ্যায় কলা আর রুটি। অবশ্য এক চিলতে তরমুজও খেয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর থেকেই আমরা গোলাগুলি আর বোমাবাজির শব্দ পাচ্ছিলাম। বাংলামটরের দিকে আকাশ ক্ষণেক্ষণে আলোকিত হয়ে ওঠছিল। কিছুটা ভয় আর কিছুটা সংশয় আমাদেরকে কাবু করে রেখেছিল। কিন্তু এত মানুষের ভিড়ে সাহস হারাই নি। আমাদেরকে উত্তেজিত করে তুলেছিল আমাদের চার ভাইয়ের রক্তাক্ত লাশ। পল্টন এলাকায় দুপুরের পর খুব মারামারি হয়েছে। অনেকেই আহত হয়েছেন।

আমি ভাবিই নি যে, ওরা এই রাতের বেলা এত মানুষের উপর স্টিম রোলার চালাবে। পুটলি থেকে জায়নামাজ বের করে আমি শুয়ে পড়লাম। সেদিন আকাশের তারাগুলো ঝলমল করছিল। কিছুক্ষণ তারা গুণলাম। গভীর রাত। গোলাগুলির আওয়াজ তখনও পাচ্ছিলাম। মঞ্চে তখনও বয়ান হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর ইসলামি তারানা গেয়ে পরিবেশন করছিলেন শিল্পীরা। চোখ লেগেছিল কিনা জানি না। ৩ টার দিকে অনেকেই ওযু করে এসে তাহাজ্জুদে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমরা ওয়াবদা মসজিদে রওনা হলাম ওযু করার জন্য।

এরপর প্রথমে মাইকের কানেকশন ছিন্ন করা হল এবং বাতি নেভানো হল। মিডিয়াকে তো শুরুতেই কব্জা করা হয়েছিল। শুরু হল তৌহিদি জনতা ও হাফেজ-ওলামা নিধনের শেষ পর্ব। প্রথমে টিয়ার শেল। তারপর লাঠিপেটা। তারপর গুলিবর্ষণ। বাদ যায় নি হাত বোমাও। সরকারদলীয় বেসামরিকরা আজ সামরিক হয়ে রামদা আর দেশি বিদেশি অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল হায়েনার মত। অসহায়, সদ্য ঘুমভাঙা দিশেহারা মানুষরা পড়লেন গ্যাড়াকলে। আচ্ছা, তিন দিক থেকে ধেয়ে আসা হায়েনা থেকে বাঁচার উপায় আছে? তার উপর ইয়া বড় বড় অট্টালিকার ইয়া উচা উচা দেয়াল!

ঘুমন্ত এই মস্ত শহর কাঁপছিল থরথর। অবলোকন করছিল এক নতুন হুনাইনের দৃশ্য। আকাশ-বাতাস কাঁদছিল। সেদিন ঘটেছিল জানা-অজানা অনেক ঘটনা। তবে সবকিছু জানেন আল্লাহ তায়ালা। সবকিছু দেখেন আল্লাহ তায়ালা। তিনি সবকিছু করেন পূর্বনির্ধারিত ফায়সালা অনুযায়ী। আল্লাহর যেদিন ধরবেন সেদিন বাঁচার কোনো পথ পাওয়া যাবে না......

৬মে

ভোর হল, আমরা জড়সড় হয়ে বসে আছি। ওয়াবদা মাদরাসার ৩য় তলায়। নতুন ভবনে তখনও বৈদ্যুতিক আলো আসে নি। আলো-আধারিতে আমরা সবাই চুপ করে বসে আছি। টিয়ারগ্যাসের গন্ধ তখনও পাচ্ছিলাম। তবে গোলাগুলির শব্দ এখন আর নেই। ছাদ ঢালাইয়ের বাঁশগুলি সরিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম। ঘুমে চোখ খোলা রাখতে পারছিলাম না। একটু হেলান দেয়ার জু-ও নেই। সিমেন্টের বস্তায় বালু ভরে রাখা ছিল, ওখানে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পাঁচ মিনিট হবে হয়ত, সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভবনধ্বস না হয়ে যায়। তা ছাড়া রেলিংও ছিল না। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, আমাদেরকে ৩০ মিনিট সময় দেয়া হয়েছে, এর মধ্যে মতিঝিল ত্যাগ করতে হবে। আমি তখনও ভাবছিলাম এবং কয়েকজনকে বললামও, আমাদের অবস্থান করা উচিত, আমীরে হেফাজতের নির্দেশ জানা উচিত। হয়ত তিনি আমাদেরকে আবার একত্রিত হতে বলবেন। উপস্থিত বড়রা বললেন, সেই সম্ভাবনা ক্ষীণ। চল, আগে অন্যকোথাও যাই।

মাদরাসার পিছন দিয়ে একটি রাস্তা আছে। সামনের রাস্তায় পুলিশের বহর। অলি-গলি বেয়ে বেয়ে আমরা যাত্রাবাড়ী উড়ালসেতুর দিকে রওনা হলাম। আমি রাস্তা চিনতাম না। সবার সাথে সাথে কখনো হাঁটছি কখনো দৌড়চ্ছি। একটা রেলক্রসিং পার হবার পর, সম্ভবত গোলাপবাগ হবে, এক হোটেল চোখে পড়ল। হোটেলের মালিকের জন্য আমরা সবাই অন্তর থেকে দুয়া করলাম। এখনো যখন সেই ঘটনা মনে পড়ে তার জন্য দুয়া করি। ইয়া বড় এক পাত্রর মধ্যে সকালের নাস্তা প্যাকেট প্যাকেট করে রাখা। ৩টা পরোটা আর হালুয়া। দোকানের কর্মচারী বা মালিকের ছেলেরা রাস্তার মধ্যে এক হাত পর পর এমনভাবে দাঁড়িয়েছে যে সবাইকে সার্ভ করা সম্ভব হয়। আমরা চলন্ত অবস্থায় মহামূল্যবান এই খোদায়ী তোহফা গ্রহণ করলাম। পরে যাত্রাবাড়ী মাদরাসায় পৌঁছে খেয়ে নিলাম।

যাত্রাবাড়ী আমরা যখন পৌঁছি, তখন মাদরাসা থেকে আহত ছাত্রদেরকে ভেনে করে হাসপাতাল নেয়া হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, যুবলীগের যুবকরা হামলা করেছিল মাদরাসায়। অনেক ছাত্র আহত হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। মতিঝিল থেকে যেতে বলল গেলাম। আশপাশের মাদরাসায় আশ্রয় নেব সেখানেও হামলা! ওদিকে চিটাগাং রোডে চলছে হায়েনাদের জ্বলন্ত নৃত্য। আমরা কোথায় যাব? আমাদের জন্মভূমি, আমাদের আবাসস্থলেই আজ যেন আমরা রিফিউজি! সারারাত রক্ত ঝরিয়েও ওদের পিপাসা মেটে না?

চার্জ না থাকায় আমার মুঠোফোন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চার্জ দেয়ার পর দুপুরের আগে সুইচ অন করার সাথে সাথে বাসা থেকে ফোন আসল, বাসায় যেতে হবে। আমি যে ঢাকায় এসেছি তা আমি জানিয়েছিলাম গত সকালে সাইনবোর্ডে মিছিলের মাঝে দাঁড়িয়ে। অচেনা অলি-গলি দিয়ে গেণ্ডারিয়া পৌঁছুলাম। নারায়ণগঞ্জের ট্রেনে উঠে মানুষের মুখে জানতে পারলাম আমীরে হেফাজত গ্রেপ্তার হয়েছেন। বানুনগরীও গ্রেপ্তার হয়েছেন। নিজের উপর নিজের কর্তৃত্ব থাকল না। অঝোরে চোখের পানি গড়াতে লাগল। তখন আমাকে যারা দেখছিল তাদের ১০ জনের ৬জন এই বলে হাসাহাসি করছিল যে, ঐ যে হেফাজত। মার খেয়ে পালাচ্ছে। তবে কয়েকজনের দৃষ্টিতে মায়া আর অনুগ্রহও ছিল। বন্ধ জবানের বাণী ছিল, আমরা পারলাম না, আমরা চেষ্টা করেছিলাম। হে বীর, তুমি কেঁদো না। একদিন ইসলামের জয় হবেই।

বাসায় পৌঁছার পর একেকজন একেক কথা বললেন। তাঁরা আমাকে ভালোবাসেন তাই আমার ক্ষতি হোক চান নি। তাই বকেছেন। অনেক আত্মীয় ফোনেও বকেছেন। সারাদিনের ক্লান্তি আর ভাঙা মন কিছুটা শান্ত হল ইতালি থেকে ছোট কাকার ফোন পেয়ে। তিনিও আমাকে শাসিয়েছেন। তবে তা ছিল অনেকটা মধুবর্ষণের মত। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "তুমি আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হতে পারো নি এজন্যে আমি দুঃখ প্রকাশ করবো না তুমি সুস্থ শরীরে বাসায় পৌঁছেছ এজন্যে শুকরিয়া আদায় করবো?" আমি তখন উত্তর দিতে পারি নি। নিশ্চুপ কেঁদেছিলাম। ফোনের অপ্রান্তে তিনি হয়ত আমার উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন......

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.