নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

যাযাবর জীবন আমার , স্বপ্নালু মন

মাহফুজ তানজিল

আমি বরাবরই একজন আশাবাদী মানুষ , হতাশা সহজে আমাকে স্পর্শ করে না । এই ছোট্ট জীবনটা খুব আনন্দে কাটাতে চাই ।মানুষের জয় হোক,বেঁচে থাকুক চির অম্লান ভালোবাসা ।

মাহফুজ তানজিল › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুখচোরা কিশোর ও একজন ভিলেন নরসুন্দর

২২ শে আগস্ট, ২০১৪ সকাল ১১:১২

শৈশবে আমার চুল কাটানোর স্মৃতি খুব সুখকর নয়। একেবারে ছেলেবেলা থেকেই আমার সেলুনে চুল কাটানোর অভ্যেস, যে বয়সে বালকদের চুলের একমাত্র বান্ধব ছিলো এক টাকার বলাকা ব্লেড, ওই বয়সে আমি রীতিমতো সেলুনে চুল কাটাতাম! কিন্তু একজন ভীতু বালকের কাছে তখন সেটা সেলুন -বিলাসিতা ছিলো না। ছিলো ভীতিকর অভিজ্ঞতা।



আমি ছোটবেলায় যথেষ্ট মুখচোরা ও লাজুক ছিলাম, আমার বয়সী বন্ধুরা যখন পুরো এলাকা দাপিয়ে বেড়ায় । মারামারি, দুষ্টুমি করে সারাদিন কাটিয়ে দেয় তখন আমি হয়তো ঘরের কোণে বসে টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখছি বা চাচা চৌধুরীর কমিকস্ বই পড়ছি।



আমার আব্বা কখনোই আমার চুল কামাতে দিতেন না, আমার মাথা টাক করার প্রতি তাঁর এমন অদ্ভুত অনীহা ছিলো কেন কে জানে!

চুল বড় হলে শুক্রবার তিনি বাজারে যাওয়ার সময় আমাকে সেলুনে নিয়ে যেতেন । সেলুনে চুল কাটাতে বলে আব্বা সদাই কিনতে যেতেন, এরপর বাজার শেষে আমাকে নিয়ে বাসায় ফিরতেন।



আমার জীবনে সর্বপ্রথম ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন নরসুন্দর, প্রচলিত ভাষায় নাপিত ।

আমাকে নিয়মিত একটি সেলুনেই চুল কাটাতে হতো। সেটি ছিলো এক বিহারির! ভদ্রলোকের বিশাল দেহ, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো। একজন বালকের কচিমনে তার বিশাল বপু স্বভাবতই ভয় ধরিয়ে দেবে, আমার বেলায়ও ঠিক তাই ঘটে।



তিনি আমাকে আগে কোলে বসাতেন, ততক্ষণে আমি মোটামুটি কান্না শুরু করে দিতাম। এরপর তিনি সবচেয়ে বড় যে ভুলটা করতেন তা হলো, আমার কান্না থামানোর জন্য চুল কাটার কাচি নিয়ে আমাকে নানাভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতেন। এই ব্যাপারটা আমার মনে স্থায়ীভাবে ছাপ ফেলে দেয়। আমি আরো জোর গলায় চেঁচামেচি শুরু করে দিতাম, কিন্তু একজন সামান্য বালকের চিৎকারে তাদের মন গলবে না এটাই স্বাভাবিক। এভাবেই প্রতিবার আমাকে চুল কাটাতে মহা ঝক্কিঝামেলার প্রয়োজন হতো।



তখন থেকেই আমার মনে প্রচণ্ড সেলুনভীতি কাজ করতো, এমনকি এ ভয়টা গত তিন চার বছর আগেও ছিলো। চুল ইয়া বড় বড় হয়ে পাখির বাসা হয়ে যেতো, আম্মু বকাঝকা করে চুল কাটাতে পাঠাতেন।



আমার বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ, সেই বিহারি একদিন দোকান ছেড়ে দিলেন, কেন জানি না। তবে আমি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছি।সেই ভয়ঙ্কর লোকের কাছে আর চুল কাটাতে হবে এতেই আমি খুশি। এরপর তার আর কোন খোঁজ নেই ।



সেই ঘটনার পর আজ নয় দশ বছর হয়ে গেছে। ইতোমধ্যেই আমি অন্য দোকানে চুল কাটাতে শিখে গেছি। আচমকা সেদিন রাস্তায় দেখা হয়ে গেল সেই পুরনো বিহারি চাচার সাথে, এক নিমেষেই মনে পড়ে গেল আমার ফেলে আসা কৈশোর।



তাঁকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। শরীরের আগের সেই জৌলুস নেই, এখন দেহে ভাটার টান। মাথার চুল প্রায় সবই সাদা। রাস্তার পাশে একটি চেয়ার নিয়ে বসে আছেন, দোকান ভাড়া নিয়ে সেলুন করার সামর্থ্যটুকু নেই। চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। স্রেফ কৌতুহলের টানে একদিন তাঁর সাথে দেখা করলাম। আমাকে চিনেছেন বিহারি চাচা।



কি মনে করে একদিন চুল কাটালাম তার কাছে, আমাকে পেয়ে অনেক কথাই বললেন তিনি। তার অকর্মণ্য পুত্রদের কথা বলতে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেললেন, তারা সবাই বুড়ো বাবা মাকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করে সংসারী হয়েছে। পিতার খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। তিনি এখন জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত একজন সৈনিক। এই অর্থব জীবনের ভার নেয়ার সাধ্য তার আর নেই। জীবনের খেলাঘরে নিতান্তই বাধ্য হয়ে খেলে যাচ্ছেন।



পাদটীকাঃ আমি এখন নিয়মিত বিহারি চাচার কাছেই চুল কাটাই। এমনিতে দোকানে চুল কাটালে পঞ্চাশ ষাট টাকা বিল আসে, আমি চাচাকে একশো টাকা দেই। বাকি টাকা ফেরত দিতে চাইলে স্মিত হাসি দিয়ে রেখে দিতে বলি।

কি আশ্চর্য! একসময় বিহারি চাচার দোকানে চুল কাটাতে ভয় লাগতো, এখন প্রচণ্ড আনন্দ লাগে। মনের ভেতরটা প্রশান্তিতে ভরে যায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.