![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গতিই জীবন, স্থিতিই মৃত্যু
ওর আসল নাম মনিরুল। ভাঙা ভাঙা হাতের লেখা দিয়ে নিজের নামটা লিখে দেখায় যখন সে ১ম আমাদের বাসায় আসে।আমাদের বাসায় থাকে ও।
ওর আরেকটা পরিচয় ও একজন বাক ও শ্রবন প্রতিবন্ধি। নানা নিয়ে আসেন আমাদের বাসায়। নানার অফিসে ওর বাবা কাজ করত। আমি আমাদের পাশের বাসায় খেলছিলাম। আমার নানা আমার খালাত বোন মৌ কে কোলে নিয়ে আসলেন সেই বাসার গেটে। সাথে ছিল মনিরুল। আমাকে ডেকে বললেন,"নানা এই হোল মনির, তোমার বোনের মতই ও কথা বলতে পারে না। ওর সাথে একসাথে খেলবা। কখনও মারামারি করবা না। ও তোমার বোনের মতই অবুঝ।" সেই দিন থেকে ও আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেছে। আমার খুব ভালো বন্ধু ও। কথা বলে ভাঙা ভাঙা শব্দে। কানেও কম শোনে।
পাড়ায় ও বেশ বিখ্যাত মানুষ। সেদিন ওকে নিয়ে দোকানে গেলাম। যে দেখে সে ই বলে "বস ভালো আছেন", "নেন বস বসেন", "ওই বসেরে সালাম দে"।
মনে হচ্ছিল বিশাল সেলিব্রিটি নিয়ে ঘুরতে বের হইছি। কিছু একটা হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তাড়াতড়ি বাসায় চলে আসলাম।
উইলস্মিথ, আমাদের বাসার এই কাজের ছেলেটার নাম
। নামটা যে আমারই দেওয়া সে ব্যাপারে কারো কোন সন্দেহ থাকার কথা না
। কাজের ছেলে না হলে ওকে উইলস্মিথ অথবা উইসলি স্নাইপ্স বলে চালিয়ে দেওয়া যেত
। তার মতই চেহারা, গায়ের গড়ন। হলিঊডে গেলে কাড়াকাড়ি পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।আমাদের পাড়ায় তো একরকম সেলিব্রিটিই ও।
আমাদের বাসায় ২ টা করে কামরাঙ্গা গাছ,পেয়ারা গাছ,আমড়া,আম ও একটা তেঁতুল গাছ আছে।এই কারনে পাড়ার যত ছোট ছেলেমেয়ে আছে সবারই তালিকায় আমাদের বাসা আছে। তো আমাদের নায়ক মনির সেই বীজবাউন্ডুলদের একটাকে একদিন ধরে ফেলে কামরাঙ্গা টোকানোর সময়। ধরার অবশ্য অন্য কারনও ছিলো। ওরা মনিরকে ভেংচি কাটতো, "বোবা বোবা" বলে জ্বালাতন করত।
মনিরকে বললাম,-আজকে এইটারে খাবি??মনির মাথা নাড়ালো ও এমন ভাব নিল বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে যে মনে হয় এখনি সে খেয়ে ফেলবে।চোখ দুটো এমন বড় করে তাকালো যে ভয়ে বাচ্চাটি কেঁদে ফেলল। আমি বললাম-ওই মনির যা তো মসলা নিয়ে আয়। আজ ওকে রান্না করে খাবো মনিরও ভাব নিয়ে চলে গেলো যেন সত্যি সত্যি সে মসলা আনতে যাচ্ছে।মনির যাওয়ার পর বাচ্চাটীকে জিজ্ঞেস করলাম "কিরে তোর বাসা কই??
""মোর বাড়ি সামনেই।মোরে হামনেরা খাইয়েন না। মুই আর করমু না"
"আর কখনও বোবা বলে ডাকবি ওরে??"
"না না আর ডাকমু নাহ।"
বেচারার অবস্থা দেখে দুঃখ বোধ করলাম। ওদিকে মনির আবার হাতে বটি নিয়ে আসছিল। তা দেখে বাচ্চাটার অবস্থা আরও খারাপ। শেষে ওকে ছেড়ে দিলাম। তারপর মজার ঘটনা লক্ষ্য করলাম যে আমাদের বাসায় বাচ্চাদের আনাগোনা কমে গেলো। বাচ্চাদের ব্যাপারে এই একটা মজার। একজন কোন জিনিস জানলে সবাই তা জেনে যায়। সবার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক। বড়দের মধ্যে এই ব্যাপারটা নাই। এমন যদি হত যে পৃথিবীর সবাই বাচ্চা থাকত। কেউ বড় হত না। সবাই সাম্যাবস্থানে। ভাবতে ভালোই লাগছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, আমেরীকার প্রেসিডেন্ট বিখ্যাত বিজ্ঞানী, শিক্ষাবীদ। উকিল অপরাধী সবাই ই বাচ্চা। বাচ্চা অবস্থায়ই আমাদের চুল বড় হবে , দাড়ি গজিয়ে যাবে, চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসবে। সেই অবস্থায়ই আমরা মারা যাবো। হারানো শৈশব বলে কিছু থাকবে না। কিন্তু তখন নতুন করে দুঃখ দেখা দিবে। আর তা হলো বড় না হওয়ার দুঃখ। মানুষের দুঃখের কোন শেষ নেই। একটা দুঃখ ঘুচলে আরেকটা দুঃখ দেখা দিবেই।মানুষ বড়ই দুঃখ বিলাসী।
[][][][][][][][][][][][][]
ব্যাপারটা এই প্রথম না। আগেও এমনটা হয়েছে। প্রতিবারই প্রথমে আমি দ্বিধায় পড়ে যাই যে এটা বাস্তব না অবাস্তব। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি যে এটা অবাস্তব। স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটা এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে মাঝে মধ্যে বাস্তবে যা ঘটে তাও স্বপ্ন বলে মনে হয়।
আজকের সকালের স্বপ্নটা বাস্তবে হলে ভালোই হত। স্বপ্নে দেখলাম আমি অনেকের সাথে বসে আছি একটা বিশাল রুমে। সবার গায়ে সাদা এপ্রোন। গম্ভীর হয়ে এক লোক লেকচার নিচ্ছে। তবে সে মেডিকেল নিয়ে কোন কথা না,তিনি বাংলা একটা ছড়া নিয়ে কথা বলছিলেন।
"পাড় হয়ে যায় গরু পাড় হয় গাড়ি
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি"
স্বপ্নের এই পর্যায়ে আসার পর আমি বুঝতে পারলাম আমি স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্ন দেখার আনন্দটাই মাটি হয়ে গেল। আমরা আদম সন্তান, মাটি দিয়েই আমাদের সৃষ্টি। তবুও বাস্তবে কোন জিনিস মাটি হয়ে গেলে আমরা কেমন যেন দুঃখ পাই। এই দুঃখ পাওয়ার বিষয়টা আমরা উত্তরাধিকার সুত্রেই পেয়েছি। স্বপ্ন মাটি হয়ে যাওয়ার পর ঘুমাতে আর ইচ্ছে করছে না। আমি ঘুম থেকে উঠে পড়লাম।
সামনে কোরবানির ঈদ আসছে। কোরবানির ঈদ মানেই চাকলাদার বাস, দাদাবাড়ি, খেজুর রসের হাড়ি, হৈ হুল্লোর। এই বাসায় কবে শেষ কোরবানির ঈদ করেছিলাম মনে নেই। দাদাবাড়ি কোরবানির ঈদের মজা একটাই। তা হল ঈদের পরদিন জ্যোৎস্না রাতে সাইকেল নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি রামপুর থেকে জামতলা বাজারে যাওয়া, বিশাল বিশাল ৩ টা সাদেক গোল্লা খাওয়া। অবাক লাগে এই সাদেক গোল্লার নামই ঢাকায় হয়ে গেছে "স্পঞ্জ মিষ্টি"।
আসল নামটা দিলে কিছুই হত না। কোন একটা জিনিসকে ব্যবসায়িক কারণে মুল নাম থেকে পরিবর্তন করা হয়েছে। কোথায় "সাদেক গোল্লা", কোথায় "স্পঞ্জ মিষ্টি"!! অদ্ভুত এই নামকরনের কাহিনী। বাংলাদেশই মনে হয় একমাত্র দেশ যেখানে নাম পরিবর্তন করার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়। ডিম ভাজি হয়ে যায় অমলেট আর সাদেক গোল্লা হয়ে যায় স্পঞ্জ মিষ্টি!!!
আমার সামনে বসে আছে উইলস্মিথ ওরফে মনিরুল। ওর জীবনের বেশ কিছু ঘটনা আছে যা রহস্যময় মনে হয়। খুব ছোটবেলায় ও নাকি ওর বাবাকে দেখেছে ওর আপন মাকে নিজ হাতে গলা টিপে হত্যা করতে। ও বোবা দেখে বাবা নাকি ওকে কিছু বলে নাই। অঙ্গভঙ্গি করে ও আমাদের বুঝানোর চেষ্টা করে। আমরা বুঝি কিন্তু কি করার আছে জানি না। কিছু কিছু ব্যাপার আছে যা আমরা বুঝি আমাদের কিছু করা দরকার কিন্তু আমরা কিছু করতে পারি না। সব স্রষ্টার উপর ভরসা করে ছেড়ে দেই। এখানের ব্যাপারটাও সেরকমই।
দিন যায় দিন আসে। মনিরুল বাড়ি চলে গেছে। ওর এই একটা সমস্যা। আমাদের বাসায় আসার আগে সে বেশ দুর্বল ছিল। খাওয়া দাওয়া ঠিকমত করার পর সে বেশ সুস্থ হয়ে ওঠে। তারপর বাড়ি যাওয়ার কথা বলে চলে যায়। ১ মাসের মধ্যে আসবে বলে কিন্তু আর আসে না।আমরাই জানি ও আর আসবেনা। যখন আবার আসার দরকার হবে নিজেই চলে আসবে।
মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষার আগের দিনগুলো এভাবেই কাটে আমার উইলস্মিথের সাথে। ও আবার আসবে। আশা করি আমিও কোথাও না কোথাও চান্স পেয়ে যাব।
(২০১০ সালের ডায়রি)
©somewhere in net ltd.