নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার সীমিত জ্ঞান কারো উপকারে আসলে শান্তি পাই

মায়মুনা আহমেদ

আমার সীমিত জ্ঞান কারো উপকারে আসলে শান্তি পাই...

মায়মুনা আহমেদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডায়েরি থেকে...(৩)

২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:২৩



বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

২০ নভেম্বর ২০১৮। এজেন্সি থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সব নিয়ে এসেছি। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ফোন করে, মেসেজ দিয়ে জানালাম, ২৮ তারিখ রাতে যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ। খবরটা শুনে সবাই খুব খুশি হলো, দোয়া করতে বললো।
বাসায় একটা উৎসবের আমেজ। প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো আত্মীয় দেখা করতে আসছে, চাচা-চাচী, খালা-ফুফুরা, বান্ধবীরা দেখা করতে এলো । বিভিন্নজন বিভিন্ন টিপস, উচিত-অনুচিত শিখিয়ে দিতো। বেশি বেশি দোয়া করার কথা, নবীজী সাঃ এর রওজায় সালাম পৌঁছে দেয়ার কথা বলতো। নিজেকে খুব স্পেশাল লাগছিল।

কাউন্ট-ডাউন চলছে। নানু প্রতিদিন ফোন দিয়ে নানান বিষয়ে জানতে চায়। একদিন ফোন দিয়ে বলছে, "আচ্ছা, ঐখানে কি সবাই শুধু আরবিতে কথা বলে"। আমি বললাম, "না উর্দু/ইংরেজি ও অনেকেই জানে"। তিনি খুব আফসোস করে বললো, "আমি তো কোনোটাই পারি না, তুমি কথা বলবা আর আমার খালি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা লাগবে"। তার মাথায় এমন টুকটাক অনেক প্রশ্ন ঘুরতো। হঠাৎ অসময়ে ফোন করে জিজ্ঞেস করতো, " আচ্ছা, আমার স্যুটকেস(ব্যাগ) কে নিবে?" বা "বুবু, সালোয়ার-কামিজ তো নিছি, একটা শাড়ি নিয়া নিবো?" অথবা "ঐ দোয়াটা, লাব্বাইক আল্লাহ, মুখস্থ হইছে, তুমি শুনবা?" আলহামদুলিল্লাহ, উমরাহতে যাওয়ার প্রস্তুতি পুরোদমে চলছে। বাসার পিচ্চু দুইটা বিশাল দুইটা লিস্ট দিয়ে গিয়েছে।

২৮ নভেম্বর ২০১৮। সব গোছগাছ শেষ। আর কয়েকঘন্টা পর উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বেরিয়ে যাবো। সন্ধ্যা থেকে বাবা(চাচা) যে কতোবার গোছগাছ দেখতে এসেছে! এয়ারপোর্টে নিচ্ছি না বলে তার মন একটু খারাপ। দেখতে দেখতে রওনা হওয়ার সময় প্রায় হয়ে এসেছে। আমরা কুয়েত ট্রানজিট ফ্লাইটে গেলেও বাসা থেকে ইহরাম বেধে নিলাম।

গ্যারেজে গাড়ি চলে এসেছে। ব্যাগ-ব্যাগেজ সব নিয়ে গেল। শেষবারের মতো ঘরের দিকে চোখ বুলিয়ে বেরিয়ে গেলাম। সবকিছুর জন্য এতো মায়া হচ্ছিল! এর আগেও তো কতো জায়গায় বেড়াতে গেলাম, এমন মায়া তো লাগেনি! গাড়িতে উঠে আমরা দুইবোন হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। বারবার শুধু মনে হচ্ছিল, "এতো মায়া, এতো টান! এবার তো মাত্র ১৫ দিনের জন্য যাচ্ছি। আল্লাহ চাইলে আবার ফিরে আসবো। কাফন পড়ে যখন বের হতে হবে, তখন তো আর ফেরত আসতে পারবো না। এতো মায়া কি করে কাটাবো!? "

গাড়ি নানু বাসার রাস্তার সামনে আসার পর নানু, মামী, মামাতো ভাই, ছোট মামা গাড়িতে উঠলো। এই রাতের বেলায়, খালামনিরা, খালাতো বোন, খালু বাসা থেকে রাস্তায় নেমে এসেছিল। সবাইকে দেখে আবার কেঁদে ফেললাম। সবার কাছে মাফ চেয়ে বিদায় নিলাম।
এয়ারপোর্টে পৌছানোর পর এজেন্সির দেয়া নাম্বারে ফোন দিলাম। গেট থেকে আমাদের রিসিভ করে বোর্ডিং পাস কালেক্ট করে ইমিগ্রেশন পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। ভালোভাবে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে অপেক্ষা করছিলাম, এমনসময় জানতে পারলাম ফ্লাইট একঘন্টা ডিলে হবে। ছোটবেলায় আম্মু যখন আম্মুর ছোটবেলার গল্প শোনাতো তখন মনে হতো এয়ারপোর্ট আমার নানার সম্পত্তি। নানা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা বিদেশে যাওয়ার সময় মা-খালারা বাস ভাড়া করে এয়ারপোর্টে বেড়াতে আসতো! এরকম বেড়ানোর সুযোগ আমাদের আর হয়ে উঠেনি। ফ্লাইট ডিলে শুনে নানার হারানো সম্পত্তি ঘুরে ঘুরে দেখলাম।

ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে যাবে, ওজু করে নিলাম। প্লেনে যাত্রী উঠানো শুরু হলো। চেকিং শেষে, সিরিয়াল মেইনটেইন করে প্লেনে উঠলাম। বোর্ডিং পাসে সিট নাম্বার লেখা থাকে। সিট নাম্বার মিলিয়ে আমরা আমাদের সিটে বসলাম। জানালার পাশে পল্টু, তারপর আমি, আমার পাশে নানু। একই সিরিয়ালের পাশের সিটগুলোতে আম্মু-আব্বু বসেছে।

নানুর ঠান্ডা লেগেছে। প্লেনে উঠেই এসি অফ করে দিলাম, তারপরও সে সমানে কাঁপছে। কেবিন ক্রু ব্ল্যাংকেট দিয়ে গেল। সিট বেল্ট বেঁধে, আমার আর নানুর দুইটা ব্ল্যাংকেটকে গিট দিয়ে নানুকে ব্ল্যাংকেটবন্দী করলাম। এতে কাঁপাকাঁপি কিছুটা কমলো।
জীবনের প্রথম প্লেন জার্নি! কতো কতো query, কতো excitement। বামপাশে বসা মানুষটার কষ্ট দেখলে সব হারিয়ে যাচ্ছিল। মেজাজ ও মন দুইটাই খারাপ হচ্ছিল। সবর...সবর...সবর...!

এয়ারহোস্টেজ এসে সবার সিট বেল্ট বাধতে, উইন্ডো ওপেন করতে বলে গেল। আমি আমার সামনের স্ক্রিনে ফরোয়ার্ড ক্যামেরা চালু করে দিলাম। প্লেন রানওয়ে ধরে হেটে যাচ্ছে। হাটার গতি বাড়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনের শব্দ জোড়ালো হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকালাম, রানওয়ের দুইপাশের লাইটগুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। প্লেন মূল রানওয়েতে চলে এসেছে। আকাশে উড়া আর কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার মাত্র!

Ready! 1...2...3...আলহামদুলিল্লাহ! আমি আকাশে! আবার জানালা দিয়ে উঁকি দিলাম। বিদায় আমার ঘুমন্ত শহর!

নানু ভয় পাচ্ছিলো। আমার হাত শক্ত করে ধরে আছে, সাথে দোয়ার বন্যায় চারিদিক ভাসিয়ে দিচ্ছে। কথা বলে নানুকে হালকা করলাম। রাতের অন্ধকারে ফরোয়ার্ড বা ডাউনওয়ার্ড ক্যামেরা চালু রেখে আর কিছুই দেখা সম্ভব না। ম্যাপ ওপেন করলাম। আধাঘন্টা পর বাংলাদেশের আকাশ পার করে ভারতের আকাশসীমায় প্লেন পৌছালো। কিছুক্ষণ পর খাবার সার্ভ করলো। খাওয়া শেষে নামাজ আদায় করলাম। সব বাতি বন্ধ করে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দিলো।

নানুর অবস্থা ভালো না। সে প্রচন্ড ছটফট করছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, হালকা জ্বর; সর্দির জন্য বেশি কষ্ট পাচ্ছে। অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঔষধ খেতে রাজি করলাম। এয়ারহোস্টেজের কাছে পানি চাইতেই পানি দিলো কিন্তু সে পানি দুনিয়ার ঠান্ডা! আমরা হাত ঘষে গরম করে পানি মোটামুটি নরমাল করলাম। ঔষধ খাওয়ানোর পর সবাই ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুম ভাঙলো কুয়েতে ল্যান্ড করার আধাঘন্টা আগে। সবাইকে সিট বেল্ট বাধতে বললো।

নানুর অবস্থা পুরাই বিধ্বস্ত! নানুর পাশে বসে থাকায় আমিও একটু কাহিল। আমার সামনে কেউ হাচি দিলেই আমি খিচ খিচ করি। আর নানু তো গত কয়েকঘন্টা যাবৎ আমার পাশে বসে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে শেষ! কিছু করার নাই। নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম, বকা দেয়ার সুযোগ অনেক আসবে কিন্তু এখন ধৈর্য ধরে থাকলে উমরাহ সুন্দরভাবে পালন করতে পারবো।

একটা সাগরের উপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। জাহাজগুলো ছোট্ট খেলনার মতো দেখাচ্ছিল। প্লেন কম উচ্চতায় ফ্লাই করায় রাস্তাঘাট, বিভিন্ন কারখানা/প্রজেক্ট স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কুয়েতের আকাশে অনেকটা সময় উড়ে প্লেন এয়ারপোর্ট পৌছালো। ফরোয়ার্ড ক্যামেরায় রানওয়ে দেখছিলাম। নানু যথারীতি আমাকে শক্ত করে ধরে আছে আর আমি তাকে শান্তনা দিচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ! খুব স্মুথলি ল্যান্ড করলো। ধীরেসুস্থে প্লেন থেকে বের হলাম।

এবার সিড়ি দিয়ে নামতে হলো। সিড়ি উঁচু হওয়াতে নানুর কষ্ট হচ্ছিল। আমাদের ফ্লাইট ডিলে থাকাতে কুয়েতে আর অপেক্ষা করতে হয়নি। শাটল বাস করে চেকিং পয়েন্ট আবার বাসে করে কানেক্টিং ফ্লাইটের প্লেনের কাছে গেলাম। প্লেনে উঠে সিট খুঁজে বসলাম। সিট বেল্ট বাধলাম। প্লেনের গেট লাগিয়ে দিয়েছে। পেছন থেকে এক ইন্দোনেশিয়ান মহিলা আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো, "এই প্লেন জেদ্দায় যাবে কি না!"

এবার আমি জানালার পাশে, নানু মাঝখানে আর পল্টু নানুর ডানপাশের সিটে বসেছে। আব্বু আম্মু পাশের সিটে বসা। জানালা দিয়ে বাহিরে দেখছিলাম। কুয়েত এয়ারপোর্ট তো বেশ বড়! কুয়েত শহর পেরিয়ে একটা সাগর পার হলাম। সাগরের নাম কুয়েত সাগর। সামনের স্ক্রিনে ম্যাপ ওপেন করলাম, জেদ্দা পৌঁছাতে আর দেড় বা দুইঘন্টা সময় লাগতে পারে। প্লেনে ব্রেকফাস্ট দিলো। নানু কিচ্ছু খায় নি। অনেক বুঝালাম কিন্তু কাজ হলো না। নানুর শরীর খুব খারাপ আর আমার মেজাজ খারাপ। সবার উপর খুব রাগ হচ্ছিল। নিজেকে খুব কষ্টে কন্ট্রোল করে আছি।

মুড ঠিক করতে ম্যাপে মনোযোগ দিলাম। ম্যাপে দেখাচ্ছে প্লেন মদিনার উপর দিয়ে যাবে। মসজিদ এ নববীর পাশ দিয়ে যাবে? মসজিদ কি দেখা যাবে? আম্মু তো মক্কার হেরেম শরীফ দেখেছিল, মসজিদ এ নববী তো দেখেনি! দরুদ শরীফ পড়ছিলাম।

মদিনার আকাশ সীমানায় পৌছেছি। জানালা দিয়ে যতদূর দেখা যায়, দেখার চেষ্টা করছি। একনজর, একটি বারের জন্য যদি নবীজী সাঃ এর রওজা শরীফের সবুজ গম্বুজ দেখতে পেতাম! বারবার ম্যাপ চেক করছি। মদিনা কি পার হয়ে গেলাম? না, মদিনাতেই আছি। আবার জানালা দিয়ে উঁকি দেই। হঠাৎ সবুজ রঙের কি যেন দেখা গেল! প্লেন অনেক উপরে। শুধু সবুজ আর পাশে একটু ছোট সাদা কিছু দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে মসজিদ বা হোটেল কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। আন্দাজ করছিলাম এটা মসজিদের গম্বুজ। আমার নবীজী সাঃ এর রওজা!? কিন্তু চারপাশ মরুভূমির মতো দেখাচ্ছে। প্রতি মূহুর্তে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল। একদৃষ্টিতে শুধু দেখছিলাম আর নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, এ ও কি সম্ভব? এতো তাড়াতাড়ি এতোটা পেয়ে যাবো!? অন্য কোনো মসজিদ কে কি ভুলে মসজিদে নববী ভাবছি? মনের ভিতর প্রশ্নগুলোর জবাবে তীব্র প্রতিবাদ শুনছিলাম; না, না, আর কোনো দ্বিধা নেই। আমার চোখের সামনের মসজিদটা আমার নবীজী সাঃ এর রওজা ছাড়া অন্য কোনো মসজিদ হতেই পারে না। দরুদ ও সালাম পেশ করলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।

এরপর তায়েফের আকাশে যখন প্লেন পৌছালো তখন আগের তুলনায় বেশ নিচ দিয়ে উড়ছিল। তায়েফের পাহাড় বুঝা যাচ্ছিল। পাহাড়ের গায়ে পেচানো রাস্তা, গাড়ি ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছিল। এরপর জেদ্দায় পৌছার আগে রেড সির উপর কিছুক্ষণ উড়লো। প্লেন এখন বেশ নিচে দিয়ে যাচ্ছে। রেড সির সৌন্দর্য! সুবহানআল্লাহ! সুবহানআল্লাহ! নীল-সবুজাভ নীল রঙের পানি, মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ। এতো সুন্দর! অনেকটা সময় ধরে রেড সির উপর দিয়ে প্লেন উড়লো। জেদ্দার ৩০কিলোমিটার সমুদ্রের পাড় ঘিরে তাদের নানান স্থাপনা। কখনো ভাবিনি, এভাবে পাখির মতো করে জেদ্দার পুরাতন ও নতুন কর্ণিশ দেখতে পাবো! আলহামদুলিল্লাহ! নিজেকে বুঝাচ্ছিলাম, আল্লাহ ধৈর্যের পুরস্কার দিচ্ছেন। কখনো আশা করিনি যে এতোটা দেখতে পাবো! আলহামদুলিল্লাহ!

এরপর জেদ্দা শহরে কিছুক্ষণ উড়ে প্লেন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করলো। শাটল বাসে করে এয়ারপোর্টের নির্ধারিত অংশে নিয়ে গেল। লেখা অনেক বড় হয়ে গেছে। আজকের মতো এখানেই ইতি টানি।

ধৈর্য ধরে পড়ার জন্য জাজাকাল্লাহ খাইরান!

ছবি - নেট

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৭

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
সৌদি ভ্রমেণের বিস্তারিত বর্ণনার জন্য
আপনাকে ধন্যবাদ।

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:১৬

মায়মুনা আহমেদ বলেছেন: জাজাকাল্লাহ খাইরান!

২| ২৫ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:৪৬

রাজীব নুর বলেছেন: ভালো লেখা। সহজ সরল।

২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:১৭

মায়মুনা আহমেদ বলেছেন: জাজাকাল্লাহ খাইরান!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.