![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সুমন অফিস থেকে ফিরছে হঠাৎ রাস্তার বামে তাকাতেই তার প্রিয় রফিক স্যারকে দেখতে পেয়ে রিক্সাওয়ালার ঘারে পিছন থেকে হাত দিয়ে বলল, ভাই একটু প্লিজ।
রিক্সার গতি কমতে কমতেই রাস্তায় নেমে সুমন সরাসরি স্যারের সামনে দাড়িয়ে- স্যারের মুখের দিকে তাকিয়েই অবাক হয়ে গেল, স্যারের এ কি অবস্থা? শুধু চেহারাটাই চেনা যাচ্ছে, তার সেই হাসি ভরা মুখ, সুন্দর গোছানো চকচকে সাদা দাড়ি কিছুই নেই- দাড়িগুলো এলোমেলে মনে হচ্ছে দাড়ি রাখার পরে আর সাবান চিরুনি পড়েনি, দেহ ও মনের চরম ক্লান্তির ছাপ বিকেলে পড়ন্ত রোদ মুখের উপর পড়ায়, তেজহীন বিবর্ণ আলোর সাথে সাথে প্রতিফলিত হয়ে বের হয়ে দূরে কোথায় যেতে চাচ্ছে এই ভেবে যে- এই মন ও দেহে আর কতদিন থাকব অনেক হয়েছে আর না, থাকতে থাকতেই বিরক্ত।
সুমন স্যারের সামনে দাড়িয়ে আছে কিন্তু স্যার সুমন কে চিনতে পারছে না, সুমন তা বুঝতে পেরে বলল,
-স্যার কেমন আছেন? আমি আপনার সুমন স্যার।
-সুমন! তোমাকে ঠিক চিনতে পারছি না।
-স্যার আমি সুমন, পাবনা কলেজে আমি আপনার ছেলে রজত এর ক্লাস মেট ছিলাম স্যার, আপনি আমাদের পদার্থ বিজ্ঞান পড়াতেন- আমি আপনার কাছে প্রাইভেটও পড়তাম। আপনি একদিন কলেজের গলিতে রজতের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে আমাকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাস করেছিলেন আমি রজতের বন্ধু কিনা? আমি হ্যাঁ বলায় আপনি বলেছিলেন- তুমি আর আমাকে প্রাইভেট পড়ে টাকা দিবে না, তবে তুমি যে টাকা দাও না এটা আর অন্য কাউকে বলবে না কারণ এতে অন্য ছেলেগুলোর কাছ থেকে টাকা পেতে অনেক কষ্ট হবে। ওরা মনে মনে সবাই রজতের বন্ধু হতে চাইবে, বন্ধু বানিয়ে যদি কোনভাবে নিজের বাবার কাছ থেকে টাকা ঠিকই এনে বন্ধুর বাবাকে মানে স্যার কে না দিয়ে মাসে মাসে দু-তিন’টে সিনেমা ভালভাবে দেখা যায়, তাতে খারাপ কি? এমনিতেই আমার চার মেয়ে এক ছেলের বিশাল দেহী এক পরিবার, দুইশ টাকাও অনেক হিসাব কষে চারবার ভাঙ্গিয়ে আটবার খরচ করতে হয়।
-ও, মনে পড়েছে। তুমি রজতের বন্ধু তোমার বাবা উকিল ছিল। তোমার বাবাকে দিয়ে আমার একজন আত্মীয়র একটা মামলাও লড়িয়েছিলাম বোধ হয়। তুমি এখানে, বাবা? কোথায় আছ কেমন আছ?
-জ্বি স্যার ভাল, আমি এখন একটা বেসরকারি বাংকে চাকরি করি। আমার স্ত্রীও একই বাংকে আছে তবে দুজন দুই শাখায় ।
-ও আচ্ছা। তবে তুমি তো জানি রসায়নে অনার্স পড়েছিলে, কি ভাগ্য রজত ব্যবস্থাপনায় অনার্স পড়ে ঔষধ কোম্পানীর সেলস অফিসার ছিল আর তুমি রসায়নে পড়ে ব্যাংক কর্মকর্তা?
প্রায় দশ বছর আগে সর্বশেষ রজতের সাথে সুমনের দেখা হয়েছিল, তবে মোবাইলে মাঝে মাঝে কথা হতো। রজত বিয়ে করার পরের বছরেই ছেলের বাবা হয়েছিল কিন্তু ছেলের বয়স এক বছর হওয়ার আগেই সে যে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনার স্বীকার হয়ে পরপারের বাসিন্দা হয়েছে, সুমন তা জানত বলে সে আর রজতের বিষয়ে কথা না বলে রজতের ছেলেটির বিষয়েই জিজ্ঞাসা করল।
-স্যার, রজতের ছেলেটি কেমন আছে, কোথায় আছে?
-আছে ভালই আছে, রজতের ছেলে ও রজতের স্ত্রী দুজনই আমার কাছেই আছে। আর ওদের জন্যই আমি পাবনা ছেড়ে ঢাকায় চলে এসেছি।
-ঢাকায় কি কোন কলেজে চাকরী নিয়েছেন, স্যার?
-রজতের দূর্ঘটনার পরপরই আমি চাকরী থেকে অবসরে যাই। এরপর ঢাকায় এসে অনেক কলেজে এমনকি কয়েকটা স্কুলেও খন্ডকালীন শিক্ষকতার চেষ্টা করে না পেয়ে বাসায় বাসায় গিয়ে প্রাইভেট পড়িয়েই যা পাই তা দিয়েই নাতী ও বউমাকে নিয়ে কোনমতে ঢাকা শহরে বেঁচে আছি।
-স্যার, রজতের দূর্ঘটনার পরে ওর অফিস থেকে তেমন কোন আর্থিক সাহায্য পেয়েছিলেন?
-হ্যাঁ, আর্থিক সাহায্য বলতে রজত যে মাসে দূর্ঘটনার স্বীকার হয়েছিল সে মাস পূর্ণ হতে নয় দিন বাকী ছিল কিন্তু বেতন পুরো মাসেরই পেয়েছিলাম। পরে ওদের মার্কেটিং জিএম এর সাথে আমি দেখা করলে বেচারা ভদ্রলোক বলেছিল, রজতের কাছে কোম্পানীর যে পাওনা আছে আগে আপনাদেরই তা বুঝে দিতে হবে। তারপর আপনারা আর্থিক সাহায্যের জন্য একটা আবেদন করলে কোম্পানীর পরবর্তী বোর্ড সভায় বিবেচেনা করা হবে।আর রজতের দেনা পরিশোধ করতে না পারলে অভিভাবক হিসেবে আপনার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
ওদের কোম্পানী মার্কেটে ক্রেডিটে ব্যবসা করত বলে অনেক দোকানদারের কাছেই বাকীতে ঔষধ দেওয়া ছিল, কিন্তু কোন দোকানদারই রজতের দূর্ঘটনার পরে আর বাকী বকেয়ার কথা স্বীকার করে নাই, রজত মৃত্যুর আগে যে ভাবে যে ভাবে বলে গিয়েছিল সে ভাবেই জায়গায় জায়গায় যাওয়া হয়েছিল কিন্তু সবাই এমন ভাব দেখয়েছিল যে কেউ রজতকে চেনেই না। সবমিলে মার্কেটে প্রায় ছয় লাখ টাকার বাকী ছিল, মার্কেট থেকে কোন টাকা না পেয়ে নিজের অবসরের টাকা ও আরও কিছু ধার-দেনা করে তা পরিশোধ করে আর্থিক সাহায্যের জন্য দরখাস্ত করলেও বোর্ড সভার সিদ্ধান্ত আজও পাইনি।
-স্যার আপনার মেয়েরা কোন সাহায্য করে নি?
-মেয়েরা বলেছিল, আমার শেষ সম্বল পাবনা শহরের বাড়ীটি তাদের সবাইকে হিসাব মত লিখে দিতে, কিন্তু আমি রজতের ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের কে না দেওয়ায় তারা সবাই একজোট হয়ে শত্রু বনে গেছে। তাদের ধারনা আমি তাদের ঠকিয়েছি শধুমাত্র রজতের ছেলের কারণে। তাই তারা আমার ও আমার নাতীর কোন খোজ খবরই নেয় না, আর বৌমাতো অন্যের মেয়ে- তাদের ধারণা বউমার কপাল দোষেই নাকি তারা ভাই হারিয়েছে, সাহায্য তো অনেক দূরের কথা। আজ নিজের রক্তের টানের জন্যেই নিজের রক্ত শত্রু হয়ে গেছে।
সবাই রজতের ছেলে ও স্ত্রী কে দূরে সড়িয়ে দিলেও আমি তো আর তাদেরকে ফেলে দিতে পারি না। তাই প্রতিদিন নাতির নতুন নতুন আবদার পূরণের জন্য আর বউমাকে নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদেই সারাদিন প্রাইভেট পড়াই, এখন প্রাইভেটেও তেমন খুব একটা ভাল করতে পারছিনা। কারণ শরীরের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচেছ, চোখেও দেখতে সমস্যা হয়, মাঝে মাঝেই পড়াতে যেতে পারি না বলে ছাত্র-ছাত্রীও কমে যাচ্ছে।
এখন একটাই ভাবনা রজতকে মাস্টার্স করাতে কষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত শেষ হয়েছিল কিন্তু ওর ছেলেকে কতদূর নিতে পারব সেটা একমাত্র আল্লাহই জানেন।
তোমরা দোয়া কর বাবা শিক্ষকতার পেশায় ছিলাম কোনদিন মানুষের কাছে হাত পাতিনি, নীতি-নৈতিকতা সবাইকে যেমন শিক্ষা দিয়েছি তেমনি পালন করারও চেষ্টা করেছে।
কিন্তু শেষ বয়সে এসে নিজেই বাস্তবতাকে সাথে নিয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়ে অজানা এক আতংকে দিন পাড় করছি। না জানি কখন, কি হয়। আমি ছাড়া রাফির তো শেষ সম্বল তার মা, তার মা কি পারবে আমার অনুপস্থিতিতে রাফিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে????
এম আলম তারেক
১০-০৮-২০১৪
©somewhere in net ltd.