![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লিখক শিক্ষাবিদ ও গবেষক
কাদিয়ানী সম্প্রদায় অমুসলিম কেন?
বিষয়ঃ কথিত 'উম্মতিনবী' আগমন করার দলীল(?) ও আমাদের খন্ডন
কয় দিন আগের কথা। ইমন ভুইয়া নামের একজন জেনারেল শিক্ষিত ভাই আমাকে স্যোসাল মিডিয়ায় নক করলেন। কিছু প্রশ্ন এবং সেগুলোর জবাব চাইলেন। বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই বললেন - ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১১ নং ওয়ার্ড এর শিমবাইল কান্দি গ্রামে। গ্রামটি কাদিয়ানী অধ্যুষিত। তিনি আমাকে লিখলেনঃ আমি অনলাইনে দেখেছি কাদিয়ানিরা বর্তমানেও নবুওত জারি থাকা বা নতুন নবী হতে পারা এসবের সমর্থনে পবিত্র কুরআন থেকে বেশকিছু আয়াত উল্লেখপূর্বক দলিল দিয়ে থাকে। এতে অনেকে বিভ্রান্ত হচ্ছে। এ সম্পর্কে জানতে চাই।
তার উক্ত প্রশ্নের উত্তরে কিভাবে লিখলে সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারবে, লিখার পরিধিও কিভাবে ছোট রাখা যায় এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। বেশ কিছুদিন ধরে প্রশ্ন গুলোর সঠিক ও যুক্তিক জবাবের পেছনে নিজেকে ব্যস্ত রাখলাম। রূহানী খাযায়েন এর ২৩ খন্ডের সম্পূর্ণ ভলিউম আগেই ডাউনলোড করেছিলাম। সেটিও নাড়াচাড়া দিতে লাগলাম। আল্লাহর মেহেরবানি, তারপর যথাসাধ্য এই লিখাটি লিখে পেললাম। লেখাটি তাত্ত্বিকভাবে নির্ভুল করার আপ্রাণ চেষ্টা করলাম। তার পরেও কোনো ভুল ক্রুটি হয়ে গেলে তজ্জন্য আমি-ই দায়ী থাকব।
মূলকথায় ফেরা যাকঃ আমি প্রশ্নকারীর প্রতিউত্তরে বিজ্ঞ পাঠকমন্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, মির্যা কাদিয়ানীর যেসব অনুসারী মির্যার কথিত "উম্মতিনবী" এর পক্ষে পবিত্র কুরআন থেকে মতলবসিদ্ধ কতিপয় আয়াত (আলে ইমরান, ৮১; নিসা ৬৯; আ'রাফ ৩৫; হজ্জ ৭৫; মুমিনূন ৫১; আহযাব ৭; সূরা জুমা ০৩ এবং সূরা আন-নাহল ০২) দেখানোর দুঃসাহস করে, আপনি তাদের দুঃসাহসিকতার খন্ডনপূর্বক নিচের প্রশ্নগুলো তাদের সামনে রাখুন আর তাদের জিজ্ঞেস করুন এভাবে -
আপনারা সহজ সরল মুসলমানদের ধোকা দেয়ার জন্য মির্যা কাদিয়ানিকে "উম্মতিনবী" প্রমাণ করার ক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন থেকে কতিপয় আয়াত পেশ করে থাকেন। অথচ সবাই জানে যে, পবিত্র কুরআনে "উম্মতিনবী" হবে মর্মে এইরূপ কোনো দলিল নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনারা মির্যার নবুওত দাবীর বদনাম ঘোচাতে এই নিকৃষ্ট কাজটির পিছু নিয়েই আছেন।
এবার মির্যা কাদিয়ানির দাবিটা কিরকম শব্দচয়নে ছিল তা জেনে নিন! মির্যার অনুসারীরা ভারতের "কাদিয়ান" (গুরুদাশপুর জেলা, পাঞ্জাব) গ্রামের যেই মানুষটিকে নবী, রাসূল, ইমাম মাহদী ইত্যাদি বিশ্বাস করে থাকেন, সেই মানুষটি কিরূপ শব্দচয়নে নিজেকে "নবী" দাবী করে গেছেন তা একবারের জন্য হলেও তার লেখিত বইগুলো থেকে দেখে নিন! সংক্ষেপে বলতে গেলে, তিনি নিজেকে এই উম্মতের মধ্যে একমাত্র কথিত ঝিল্লি (উম্মতি) নবী বলেই মনে করতেন এবং যারা তাকে অস্বীকার করবে তিনি তাদেরকে "মুরতাদ" আখ্যা দিতেন। যেমন তদানিন্তন সময়ের ডাক্টার আব্দুল হাকিমকে তিনি মুরতাদ আখ্যা দিয়েছিলেন। কারণ তিনি দীর্ঘ ২০ বছর মির্যার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে অবশেষে তাকে ত্যাগ করে ইসলামের মূলধারায় ফিরে এসেছিলেন। মির্যা সাহেব তার বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎবাণীও করেছিলেন। যদিও সেই ভবিষ্যৎবাণী কখনো আলোর মুখ দেখেনি। (রূহানী খাযায়েন ২৩/৬৩৩ দ্রষ্টব্য)।
মির্যা সাহেবের বই পুস্তক পড়ে আরো জানা যায় যে, মির্যা কাদিয়ানীর দাবী অনুসারে কেয়ামত পর্যন্ত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পরে মির্যা সাহেবই এমন এক ব্যক্তি যিনি ছাড়া অন্য আর কেউ "নবী" নাম পাওয়ার উপযুক্ত নন। (মির্যা কাদিয়ানী কর্তৃক রচিত "হাকীকাতুল ওহী" [রচনাকাল - মে, ১৯০৭ইং] দ্রষ্টব্য; আরো দেখুন রূহানী খাযায়েন ২২/৪০৬-৭)।
পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণঃ প্রথমে জানিয়ে দিতে চাই যে, পবিত্র কুরআন থেকে কাদিয়ানিদের পেশকৃত আয়াতগুলোতে দেখতে পাবেন যে, নবী, রাসূল শব্দগুলো বহুবচনে উল্লেখ রয়েছে। যার ফলে কাদিয়ানিদের পক্ষে এই ধরণের আয়াত দলিল হতে গেলে তখন তাদেরকেও কমপক্ষে তিনের অধিক উম্মতিনবী আগমনকরা মেনে নিতে হবে! কিন্তু জীবন থাকতে কাদিয়ানিরা 'উম্মতি নবী' এর সংখ্যা তিনের অধিক হতে পারা মেনে নেবেনা! এবার নিচে কাদিয়ানিদের কথিত উম্মতিনবীর দাবী আর পেশকৃত আয়াতের বর্ণনাভঙ্গির মধ্যকার অসঙ্গতিগুলো অতিব সংক্ষেপে দেখে নিন!
# সূরা আ'রাফ, আয়াত নং ৩৫; 'হে বনী আদম! যদি তোমাদের মধ্য হইতে কোনো রসুল তোমাদের নিকট আসিয়া আমার নিদর্শন বিবৃত করে তখন.....।' (অনুবাদঃ ইফা)। ## জবাবঃ- কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা হল, এই আয়াতে রাসূল শব্দের বহুবচন "রসূল" رسل (রাসূলগণ) উল্লেখ আছে। কাজেই এই আয়াত তাদের দাবীর সমর্থনে মেনে নেয়ার অর্থই হল, (তাদের বিশ্বাস মতে) এই উম্মতের মধ্যে অত্যাসন্ন রাসূলের সংখ্যা শুধুই একজন নন, বরং অধিক সংখ্যক। অপরদিকে মির্যা কাদিয়ানী এই উম্মতের মধ্যে নিজেকেই একমাত্র কথিত "উম্মতিনবী" লিখে গেছেন। তো এবার সমীকরণ কিভাবে মিলাবেন? সত্যানুসন্ধানীবন্ধুদের উদ্দেশ্যে এখানে আমাদের জবাব হল, আপনি তাফসীরের যে কোনো কিতাব থেকে অত্র আয়াতের শানে নুযূল দেখে নিলেই ব্যাপারটি ক্লিয়ার হয়ে যাবে। যেহেতু হাদীস শরীফে এই আয়াতের প্রেক্ষাপট বর্ণনায় বলা হয়েছে যে, আল্লাহর এই ফরমান বনী আদমের রূহের জগতে তাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে ছিল। অতএব এই আয়াতকে খতমে নবুওতের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চাওয়া চরম মূর্খতার পরিচায়ক।
# সূরা হজ্জ, আয়াত নং ৭৫; 'আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য হইতে মনোনীত করেন বাণীবাহক এবং মানুষের মধ্য হইতেও; আল্লাহ তো সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা।' (ইফা) ## জবাবঃ- কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা হল, এই আয়াতেও রাসূল শব্দের বহুবচন "রসুল (রসুলান)" رسلا (রাসূলগণ) উল্লেখ আছে। কাজেই এই আয়াত তাদের দাবীর সমর্থনে মেনে নেয়ার অর্থই হল, (তাদের বিশ্বাস মতে) এই উম্মতের মধ্যে অত্যাসন্ন রাসূলের সংখ্যা শুধুই একজন নন, বরং অধিক সংখ্যক। সুতরাং অবশিষ্ট জবাব আগের মতই। যদিও আরো বহু জবাব দেয়া যাবে।
# সূরা নিসা, আয়াত নং ৬৯; 'আর কেহ আল্লাহ এবং রাসূলের আনুগত্য করিলে সে নবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ ও সৎকর্মপরায়ণ - যাহাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করিয়াছেন - তাহাদের সঙ্গী হইবেন এবং তাহারা কত উত্তম সঙ্গী!' (ইফা) ## জবাবঃ- কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা হল, এই আয়াতে নবী শব্দের বহুবচন "নাবিয়্যীন" النبيين (নবীগণ) উল্লেখ আছে। উল্লেখ্য, কাদিয়ানী সম্প্রদায় বিশেষত, এই আয়াত দ্বারা তাদের মির্যা কাদিয়ানির তথাকথিত উম্মতি নবী দাবীর সমর্থনে দলিল দেয়ার চেষ্টা করে। অথচ তাদের এই দলিলটাও যে আদতে তাদেরই নীতি-বিরুদ্ধ; সেটি হয়ত এবার তাদের বোধগম্য হবে! প্রিয় আহমদিবন্ধু! সত্য গ্রহণ করার মানসিকতা থাকলে আপনি "তাফসীরে ইবনে কাসীর" থেকে আয়াতটি খুলে দেখুন। তার শানে নুযূল (নাযিলের প্রেক্ষাপট) বলছে, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্যকারীদের জন্য নবীগণ, সিদ্দিক, শহীদ এবং নেককারদের সঙ্গ (সান্নিধ্য) অর্জন করার সুসংবাদ পরকালীন জীবনের সাথে সম্পর্কিত। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, আপনারা এরপরেও বিতর্ক করেই যাবেন। আয়াতের শানে নুযূলের দিকে বিন্দুমাত্রও ভ্রুক্ষেপ করবেন না। আর তাই আপনাদের পূর্বাপর আকিদার আলোকেই আমার নিচের প্রশ্নটির জবাব দিন!
প্রশ্ন হল, মির্যা সাহেবের রচিত একটি কিতাবের নাম "হামামাতুল বুশরা" (আরবি)। তিনি সেখানে আহলে মক্কার জন্য দোয়া করে আল্লাহ'র দরবারে ফরিয়াদ করেছিলেন এই বলে যে, نسئله ان يدخلكم في ملوكته مع الأنبياء و الرسل و الصديقين و الشهداء و الصالحين অর্থাৎ তাঁর নিকট ফরিয়াদ করছি তিনি যেন তোমাদেরকে নবী, রাসূল, সিদ্দিক, শহীদ এবং নেককারদের সান্নিধ্য নসিব করেন। (রূহানী খাযায়েন খন্ড ৭, পৃষ্ঠা নং ৩২৫ দ্রষ্টব্য)। এবার এর কী হবে? মির্যা সাহেব কি তাহলে আল্লাহ'র নিকট আহলে মক্কা বা মক্কার অধিবাসীদের "উম্মতিনবী" হবার দোয়া করেছিলেন বলবেন? অথচ মির্যা সাহেব নিজের দোয়া সম্পর্কে লিখেছেন, আল্লাহ তা'য়ালা তাকে নাকি বলেছেনঃ أجيب كل دعائك الا في شركائك (উজীবু কুল্লা দু'আয়িকা ইল্লা ফী শুরাকায়িকা) অর্থাৎ আমি তোমার সকল দোয়া কবুল করব, তবে তোমার অংশীদারদের দোয়া ব্যতীত। (দেখুন, মাসিক রিভিউ অফ রিলিজন্স, খন্ড ৩ এপ্রিল ১৯০৪ ইং 'ইসলামের বরকত' শীর্ষক শিরোনাম দ্রষ্টব্য)। তো এবার মক্কার সকল অধিবাসীও মির্যা সাহেবের দোয়ায় কথিত "উম্মতিনবী" হয়ে গেলেন? কোনো রূপকের কাসুন্দি নয়, সোজাসাপ্টা জবাব চাই!
# সূরা আল মুমিনূন, আয়াত নং ৫১; 'হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হইতে আহার কর ও সৎকর্ম কর; তোমরা যাহা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।' (ইফা) ## জবাবঃ- কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা হল, এই আয়াতেও রাসূল শব্দের বহুবচন "রসুল" الرسل (রাসূলগণ) উল্লেখ আছে। কাজেই এই আয়াত তাদের দাবীর সমর্থনে মেনে নেয়ার অর্থই হল, (তাদের বিশ্বাস মতে) এই উম্মতের মধ্যে অত্যাসন্ন রাসূলের সংখ্যা শুধুই একজন নন, বরং অধিক সংখ্যক। যা খোদ কাদিয়ানিদেরই নীতি-বিরুদ্ধ! তো এবার এর কী হবে? আপাদত অন্য আর কোনো জবাবে গেলাম না!
# সূরা আহযাব, আয়াত নং ৭; 'স্মরণ কর, যখন আমি নবীদের নিকট হইতে অঙ্গীকার গ্রহণ করিয়াছিলাম এবং তোমার নিকট হইতেও এবং নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও মরিয়ম তনয় ঈসার নিকট হইতেও - তাহাদের নিকট হইতে গ্রহণ করিয়াছিলাম দৃঢ় অঙ্গীকার।' ## জবাবঃ- কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা হল, প্রথমত, সম্পূর্ণ আয়াতটির অনুবাদ পড়লে বুঝতে পারবেন এ আয়াত কাদিয়ানিদের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে কেমন সাংঘর্ষিক! কারণ তাদের কথিত উম্মতিনবীর বক্তব্য হচ্ছে, তার নবুওত অন্যান্য নবীদের ন্যায় আল্লাহপ্রদত্ত নয়, বরং মুহাম্মদে আরাবীর আনুগত্য দ্বারা অর্জিত। (দেখুন হাকীকাতুুন নবুওত ১/৫৪২) অপর দিকে তাদের পেশকৃত আয়াতে বাহ্যত যেই রাসূলের আগমনী অঙ্গীকার রয়েছে তার নবুওত অন্য কারো আনুগত্য দ্বারা অর্জিত বুঝাবেনা, বরং আল্লাহপ্রদত্ত হওয়াই বুঝাবে। এমতাবস্থায় তাদের এই দলিল মির্যা কাদিয়ানীর পূর্বাপর নীতির বিরুদ্ধে গেল কিনা? ভেবে দেখুন তো!
দ্বিতীয়ত, আমি আগেই প্রমাণ করেছিলাম যে, মির্যা সাহেব এই উম্মতের মধ্যে একমাত্র "উম্মতিনবী" নিজেকেই মনে করতেন। অপর দিকে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত 'রাসূল' শব্দটি মির্যা সাহেবের মতে আম বা ব্যাপক অর্থবোধক। কেননা, মির্যার রচনাসমগ্র 'রূহানী খাযায়েন' এর ৫ নং খন্ডের ৩২২ নং পৃষ্ঠায় লেখা আছে, মির্যা সাহেব বলেন "রাসূল শব্দটি عام বা ব্যাপক। যার অর্থের মধ্যে নবী, রাসূল এবং মুহাদ্দাসও অন্তর্ভুক্ত।" আবার মির্যা সাহেব এও লিখে গেছেন : عام لفظ کو خاص معنی میں محدود کرنا صریح شرارت ہے অর্থাৎ 'আম' (عام) শব্দকে খাস (خاص) অর্থে সীমাবদ্ধ করা সুস্পষ্ট ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ। (রূহানী খাযায়েন ৯/৪৪৪)। এমতাবস্থায় কাদিয়ানিদের উপস্থাপিত এই আয়াতে বাহ্যত যেই নবীর আগমনী অঙ্গীকার রয়েছে তার নবুওত আম (ব্যাপক) হলে তখন এটি কথিত উম্মতি নবীর সমর্থনে দলিলযোগ্য হয় কিভাবে? খাসকে আম এর সাথে একীভূত করে ফেলা কি জায়েজ?
তৃতীয়ত, প্রকৃতপক্ষে আয়াতটিতে মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ) সহ অন্যান্য সকল নবী রাসূল হতে আল্লাহতালা কর্তৃক গৃহীত অঙ্গীকার নতুন কোনো নবীর আগমনী বিষয়ে নয়, বরং স্ব স্ব নবীর প্রতি ন্যস্ত জিম্মাদারি দিক থেকে আল্লাহ'র কালাম (কথা) মানুষের নিকট পৌঁছিয়ে দেয়ার বিষয়ে।
খেয়াল করুন যে, আয়াতে ميثاقهم [মীছাকুহুম] তথা 'তাঁদের প্রতি ন্যস্ত জিম্মাদারি পালনের অঙ্গীকার' শব্দ এসে এদিকেই ইঙ্গিত করছে। যার ফলে কাদিয়ানিদের পূর্বোক্ত ধারণামূলক দাবী বানোয়াট ও বাতিল সাব্যস্ত হল। (আয়াতটির টীকা নং ১৩৬১ দেখে নিন ; আল কুরআনুল কারীম, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন দ্রষ্টব্য)।
# সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ৮১; 'স্মরণ কর, যখন আল্লাহ নবীদের অঙ্গীকার লইয়াছিলেন যে, তোমাদেরকে কিতাব ও হিকমত যাহা কিছু দিয়াছি, অতপর তোমাদের কাছে যাহা আছে তাহার প্রত্যায়নকারীরূপে যখন একজন রাসূল আসিবে তখন তোমরা অবশ্যই তাহার প্রতি ঈমান আনিবে এবং তাহাকে সাহায্য করিবে।' (ইফা) ## জবাবঃ- কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা হল, এই আয়াতের শানে নুযূল বলছে এখানে "রাসূল" বলিয়া যার আগমনী সংবাদ রয়েছে তিনি হলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। মহান আল্লাহ রূহের জগতে সকল নবী রাসূল থেকে তাঁর আনীত বিধানের প্রতি ঈমান আনতে ও তাঁকে সাহায্য করতে অঙ্গীকারও নিয়েছিলেন (দেখুন, ইবনে জারীর আত তাবারী রহঃ রচিত 'তাফসীরে আত তাবারী' সূরা আ'রাফ আয়াত নং ৩৫ দ্রষ্টব্য)। তাই আয়াতে উল্লিখিত "রাসূল" হতে মির্যা কাদিয়ানী সাহেব উদ্দেশ্য হয়ে থাকলে তিনি নিজের নবুওতকে খোদাপ্রদত্ত হওয়া অস্বীকার করে বরং একজন রাসূলের আনুগত্য দ্বারা অর্জিত দাবী করলেন কেন? কেন-ই বা নিজের তথাকথিত নবুওতকে (ناقص) 'অসম্পূর্ণ' বললেন? যেমন তার ভাষায়ঃ 'নবুওতে তাম্মাহ নিহি হেঁ' তথা অসম্পূর্ণ নবুওত। (দেখুন, রূহানী খাযায়েন খন্ড ৩ পৃষ্ঠা নং ৬০)। তাই প্রশ্ন উঠবে, তবে কি আল্লাহতালা স্বয়ংসম্পূর্ণ নবী রাসূলগণকে মির্যার মত এমন একজন স্বঘোষিত অসম্পূর্ণ নবী(?)'র আনীত বিধানের উপর ঈমান আনতে বললেন? একটু ভাবুন তো! সুতরাং এটিও তাদের পক্ষে দলিল হিসেবে প্রমাণিত হয়নি।
# সূরা জুম'আ, আয়াত নং ৩; 'তিনি-ই উম্মীদের মধ্যে একজন রাসূল পাঠাইয়াছেন তাহাদের মধ্য হইতে, যে তাহাদের নিকট আবৃত্তি করে তাঁহার আয়াত সমূহ; তাহাদিগকে পবিত্র করে এবং শিক্ষা দেয় কিতাব ও হিকমত; ইতিপূর্বে তো ইহারা ছিল ঘোর বিভ্রান্তিতে; এবং তাহাদের অন্যান্যের জন্যও যাহারা এখনও তাহাদের সহিত মিলিত হয় নাই। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।' (ইফা) ## জবাবঃ - কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা হল, "আখারীনা" (آخرين) শব্দটিকে তারা দ্বিতীয় মাফউল (Second Object) ধরেই হয়ত এমন জঘন্য ভ্রান্তির শিকার হয়েছে। অথচ তাদের জানা থাকা জুরুরি ছিল যে, "আখারীনা" এটি একে তো শব্দগত বহুবচন (Plural); দ্বিতীয়ত, এটি বাক্যের মধ্যে মা'তূফ [সংযোজিত পদ] হয়েছে। সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারক মির্যা কাদিয়ানী স্বীকৃত যুগ ইমাম হযরত ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) রচিত "ফাতহুল বারী" কিতাবের 'কিতাবু তাফসীরিল কুরআন' অধ্যায় দেখুন, সেখানে 'আখারীনা' এর ইরাব (স্বরচিহ্ন) সম্পর্কে লেখা আছে وأن يكون مجرورا عطفا على الأميين তথা 'আখারীনা' শব্দটি জারের অবস্থায় আছে উম্মিয়্যীন এর উপর মা'তূফ হয়েছে বলে।
মির্যায়িদের জন্য চরম দুঃসংবাদ হল, এমতাবস্থায় মির্যার অনুসারীরা "ওয়া আখারীনা মিনহুম" (এবং তাহাদের অন্যান্যের জন্যও) দ্বারা মির্যা কাদিয়ানীর অস্তিত্ব কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারবে না! যদি পারতে হয় তাহলে 'বা'আছা' (بعث) অতীতকাল বাচক ক্রিয়াপদকে ভবিষ্যৎবাচক ক্রিয়াপদ দ্বারা পাল্টে দিতে হবে, যা কখনো সম্ভব নয়! কিন্তু তার পরেও সমস্যা থেকেই যাবে। কারণ 'আখারীনা' এটি বহুবচন। ফলে এর দ্বারা একমাত্র সত্তা মির্যাকে উদ্দেশ্য নেয়া যেতে পারেনা। কাদিয়ানিদের বিশ্বাস মতে, দুনিয়াতে মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ) মির্যা কাদিয়ানির স্বরূপে পুনঃ জন্ম করেছেন বলাও যাবেনা। কারণ অত্র আয়াতের কোনো শব্দ-ই এরকম কিছু বুঝায় না। ব্রাহ্মণ্যবাদী আকিদার ন্যায় কাদিয়ানিদের এ সমস্ত অপব্যাখ্যা থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আহমদীবন্ধুরা! নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করুন! আল্লাহ'র মেহেরবানিতে তার অপব্যাখ্যার সমুদয় ক্যাচাল থেকে উত্তোরণের পথ পেয়ে যাবেন, ইনশাআল্লাহ ।
# সূরা আন-নাহল, আয়াত নং ২; 'তিনি তাঁহার বান্দাদের মধ্যে যাহার প্রতি ইচ্ছা স্বীয় নির্দেশে ওহীসহ ফেরেশতা প্রেরণ করেন এই বলিয়া যে, তোমরা সতর্ক করো, নিশ্চয়ই আমি ব্যতীত কোনো ইলাহ নাই; সুতরাং আমাকে ভয় কর।' (ইফা) ## জবাবঃ- এখানেও কাদিয়ানিদের দাবী আর দলিল উভয়টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিকতা বিদ্যমান। আমি একটু পরেই সে বিষয়ে আলোকপাত করব, ইনশাআল্লাহ। তার আগে আয়াতটি নাযিলের বিশেষ উদ্দেশ্য আমাদের জানতে হবে। জ্ঞানীদের নিকট গোপন থাকেনি যে, এই আয়াতে 'ইয়ানযিলুল মালায়িকাতা বির রূহি মিন আমরিহি আ'লা মাঁঁই ইয়াশা-য়ু মিন ইবাদিহী আন আংযিরূ আন্নাহু লা ইলাহা ইল্লা আনা ফাত্তাকূনি" এর ভেতর '....মাঁই ইয়াশা-য়ু মিন ইবাদিহি' তথা.... তিনি তাঁর যে বান্দার ওপর চান ওহী দিয়ে তাঁর ফেরেশতাদের পাঠান' মর্মে এটি নির্দিষ্ট সময় সাপেক্ষ বক্তব্য মাত্র। যার সূচনা হযরত আদম (আঃ) দ্বারা হয় এবং সমাপ্তি ঘটে খাতামুন নাবিয়্যীন মুহাম্মদে আরাবী (সাঃ) দ্বারা। যেমন, কোনো বিদ্যালয়ের মাননীয় প্রিন্সিপাল ঘোষণা দিয়ে বললেন, প্রিয় ছাত্ররা! আমি তোমাদেরকে শিক্ষা সফর করাব। এর অর্থ এই নয় যে, তাঁর উক্ত শিক্ষা সফর করানোর ঘোষণা পরের বছরও বলবৎ থাকবে! কেননা প্রিন্সিপাল মহোদয়ের বক্তব্যটি সময় সাপেক্ষ ছিল। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন। এবার সেসব বন্ধুদের বই থেকে দেখা যাক তারাও আসলে কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত নতুন নতুন নবী রাসূলের জন্ম হতে পারে এমনটি বিশ্বাস করেন কিনা?
তাদের দাবীর সাথে এই আয়াতের সংঘর্ষিকতাঃ এখানে সূরা আন-নাহল এর ২ নং আয়াত দ্বারা মূলত কাদিয়ানী সম্প্রদায় আরো নতুন নবী হতে পারে মর্মে যে দলিল দেয় সেটি ভুল। একদা অনলাইনে তাদের এক ইনসার্চকে আমি এর প্রত্যুত্তরে বললাম, যেই আয়াত দ্বারা আরো নতুন নবী রাসূল হতে পারার পক্ষে দলিল দিতে চান সেখানে ان انذروا [আন আনযিরূ] অর্থাৎ "তোমরা যেন সতর্ক করতে পারো" বহুবচনে Imperative Verb (নির্দেশসূচক ক্রিয়া) উল্লেখ আছে। যার ফলে আপনাদেরই দাবী অনুসারে আরো একাধিক নতুন নবী হওয়ার দাবী রাখছে! কিন্তু আপনারাও কি এটি মেনে নেন? না! আফসোস! সূক্ষ্ম এই ব্যাপারটা কেন যে আপনাদের ভাবিয়ে তুলেনা! সে যাইহোক আপনাদের দাবী ধরে নিয়ে বলতে পারি যে, নতুন নবী একজন হবেনা, বরং একাধিক হওয়ার-ই দাবী রাখবে ! যেহেতু আয়াতে উল্লিখিত ক্রিয়াপদ "তোমরা সতর্ক করো" এটি বহুবচন। এখন এর কী জবাব? নিজেরাই নিজেদের অপব্যাখ্যার গ্যাঁড়াকলে আটকে গেলেন কিনা?
তারপর বললাম, আমি আপনাদের উক্ত দলিলটা মাত্র ১০ সেকেন্ডের জন্য তর্কের খাতিরে মেনে নিয়ে পালটা জিজ্ঞেস করতে চাই যে, এই আয়াত বর্তমানে নতুন নবী হতে পারে বুঝালে তখন নতুন নবীর সংখ্যা অন্ততপক্ষে তিনের অধিক হওয়ার-ই দাবী রাখতেছে এবং নতুন নবীদের প্রত্যেককে শুধুমাত্র উম্মতিনবী-ই হওয়া লাগবে! তার কারণ, আপনাদের বইতে লিখা আছে, নবী তিন (৩) প্রকার। হাকিকি নবী, মুস্তাকিল নবী এবং উম্মতি নবী। এমনকি আপনাদের বইতে পরিস্কার করে এটাও লিখা আছে যে, হাকিকি আর মুস্তাকিল এই দুই প্রকারের নবী হবেনা কিন্তু ঝিল্লি (উম্মতি) নবী'র আগমনের ধারা বন্ধ হয়নি। (মির্যা পুত্র বশির আহমদ এম.এ রচিত 'কালিমাতুল ফছলঃ ১৪/১১৮)। তবে ঝিল্লি (উম্মতি) নবী শুধুমাত্র একজনই হবেন। আর (মির্যা কাদিয়ানির দাবী মতে) সেই একমাত্র ঝিল্লি (উম্মতি) নবীটা নাকি মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেই ছিলেন! (হাকিকাতুল ওহী দ্রষ্টব্য)। তাহলে এবার নিচের প্রশ্নগুলোর জবাব কিভাবে দেবেন!
(১) এই আয়াত আপনাদের ধারণায় আরো নতুন নবী হওয়ার পক্ষে দলিল হলে তখন আপনারা সেই নতুন নবীদের সংখ্যা অন্ততপক্ষে তিনজন মেনে নিবেন কিনা?
(২) তর্কের খাতিরে মানলাম, এই আয়াত দ্বারাও শুধুমাত্র একজন উম্মতি নবী হবে বুঝিয়েছে। কিন্তু আমার জানার বিষয়, আয়াতটা তো 'হাকিকি, মুস্তাকিল কিংবা উম্মতি' এ ধরণের কোনো প্রকারকে খাস তথা নির্দিষ্ট করে বুঝায়নি। এককথায় এখানেও আয়াতটি মর্মের দিক থেকে 'আম' বা ব্যপক। বিপরীতে আপনাদের দাবী (উম্মতি) হচ্ছে 'খাস' বা নির্দিষ্ট। অথচ আম অর্থবোধক আয়াত কখনো খাসের জন্য দলিল হতে পারেনা। একথা মির্যা কাদিয়ানির বইতেও লিখা আছে। উপরে আবার দেখুন। তাহলে সমীকরণ কিভাবে মিলাবেন?
প্রিয়পাঠক ও পাঠিকা! বিচারের ভার আপনাদের নিরপেক্ষ জ্ঞানের উপর ছেড়ে দিলাম। একজন সত্যান্ধেষী মানুষ খুব সহজেই বুঝে নিতে পারেন যে, আয়াতের ভেতর কাদিয়ানিদের 'নতুন নবী হতে পারার সম্ভাবনা আছে' মর্মে সকল উপস্থাপিত দলিল-প্রমাণ ভ্রান্ত ও বাতিল। ইনশাআল্লাহ, আগামী পর্বে কাদিয়ানী সমস্যার প্রতিকার নিয়ে আমাদের উম্মতে মুসলিমার করণীয় কী সে সম্পর্কে লিখব। (চলবে)
লেখক, মুহাম্মদ নূরুন্নবী (এম. এ)
বর্তমান সময়ের আলোচিত বই 'আহমদীবন্ধু ইসলামে ফিরে এসো' এর লিখক
ইমেইল: [email protected]
সম্পূর্ণ লিখাটি ডকুমেন্টসহ লিখকের ফেইসবুক পেইজ থেকে পড়তে ক্লিক করুন
©somewhere in net ltd.