![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সই, কেমনে ধরিব হিয়া?
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমার আঙ্গিনা দিয়া!
সে বঁধু কালিয়া না চায় ফিরিয়া,
এমতি করিল কে?
আমার অন্তর যেমন করিছে
তেমনি হউক সে!
যাহার লাগিয়া সব তেয়াগিনু,
লোকে অপযশ কয়,
সেই গুণনিধি ছাড়িয়া পিরীতি
আর জানি কার হয়!
যুবতী হইয়া শ্যাম ভাঙ্গাইয়া
এমতি করিল কে?
আমার পরাণ যেমতি করিছে
সেমতি হউক সে!
“আমার পরাণ যেমতি করিছে তেমতি হউক সে! “ এই কথাটার মধ্যে কতটা কথা আছে! রাধা সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আর অভিশাপ খুঁজিয়া পাইল না। শত সহস্র অভিশাপের পরিবর্ত্তে সে কেবল একটি কথা কহিল। সে কহিল, “ আমার পরাণ যেমন করিছে, তেমনি হউক সে! “ ইহাতেই বুঝিতে পারিয়াছি রাধার পরাণ কেমন করিতেছে! ঐ এক “যেমন করিছে” শব্দের মধ্যে নিদারুণ কষ্ট প্রচ্ছন্ন আছে, সে কষ্ট বর্ণনা না করিলে যতটা বর্ণিত হয় এমন আর কিছুতে না। উপরি-উক্ত পদটির মধ্যে রাধা দুই বার অভিশাপ দিতে গিয়াছে, কিন্তু উহার অপেক্ষা গুরুতর অভিশাপ সে আর কোনমতে খুঁজিয়া পাইল না। ইহাতেই রাধার সমস্ত হৃদয় দেখিতে পাইলাম।
বিদ্যাপতি সুখের কবি,চণ্ডিদাস দুঃখের কবি। বিদ্যাপতি বিরহে কাতর হইয়া পড়েন, চণ্ডিদাসের মিলনেও সুখ নাই। বিদ্যাপতি জগতের মধ্যে প্রেমকে সার বলিয়া জানিয়াছেন, চণ্ডিদাস প্রেমকেই জগৎ বলিয়া জানিয়াছেন। বিদ্যাপতি ভোগ করিবার কবি, চণ্ডিদাস সহ্য করিবার কবি! চণ্ডিদাস সুখের মধ্যে দুঃখ ও দুঃখের মধ্যে সুখ দেখিতে পাইয়াছেন। তাঁহার সুখের মধ্যেও ভয় এবং দুঃখের প্রতিও অনুরাগ। বিদ্যাপতি কেবল জানেন যে মিলনে সুখ ও বিরহে দুঃখ, কিন্তু চণ্ডিদাসের হৃদয় আরো গভীর, তিনি উহা অপেক্ষা আরো অধিক জানেন! তাঁহার প্রেম “কিছু কিছু সুধা বিষগুণা আধা “, তাঁহার কাছে শ্যাম যে মুরলী বাজান তাহাও
“বিষামৃতে একত্র করিয়া “। –
কহে চণ্ডিদাস, ‘ শুন বিনোদিনী,
সুখ দুখ দুটি ভাই?
সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি,
দুখ যায় তার ঠাঁই। '
চণ্ডিদাস শতবার করিয়া বলিয়াছেন –
যার যত জ্বালা তার ততই পিরীতি –
“সদা জ্বালা যার, তবে সে তাহার মিলয়ে পিরীতিধন।” “অধিক জ্বালা যায় তার অধিক পিরীতি।” ইত্যাদি।
কিন্তু সেই চণ্ডিদাস আবার কহিয়াছেন –
সই, পিরীতি না জানে যারা,
এ তিন ভুবনে জনমে জনমে
কি সুখ জানয়ে তারা?
পিরীতি-নামক যে জ্বালা, পিরীতি-নামক যে দুঃখ, এ দুঃখ যাহারা না জানিয়াছে, তাহারা পৃথিবীতে কি সুখ পাইয়াছে? যখন রাধা কহিলেন –
বিধি যদি শুনিত, মরণ হইত,
ঘুচিত সকল দুখ।
তখন
চণ্ডিদাস কয়, এমতি হইলে
পিরীতির কিবা সুখ!
দুখই যদি ঘুচিল তবে আর সুখ কিসের? এত গম্ভীর কথা বিদ্যাপতি কোথাও প্রকাশ করেন নাই। যখন মিলন হইল তখন বিদ্যাপতির রাধা কহিলেন–
দারুণ ঋতুপতি যত দুখ দেল,
হরিমুখ হেরইতে সব দূর গেল।
যতহুঁ আছিল মঝু হৃদয়ক সাধ
সো সব পূরল পিয়া-পরসাদ।
রভস-আলিঙ্গনে পুলকিত ভেল,
অধরহি পান বিরহ দূর গেল।
চিরদিনে বিহি আজু পূরল আশ,
হেরইতে নয়ানে নাহি অবকাশ।
ভনহ বিদ্যাপতি আর নহ আধি,
সমুচিত ঔখদে না রহে বেয়াধি।
চিকিৎসক চণ্ডিদাসের মতে বোধ করি ঔষধেও এ ব্যাধির উপশম হয় না, অথবা এ ব্যাধির সমুচিত ঔষধ নাই। কারণ চণ্ডিদাসের রাধা শ্যামে যখন মিলন হয় তখন “ দুহুঁ কোরে দুহুঁ কাঁদে বিচ্ছেদ ভাবিয়া “। কিছুতেই তৃপ্তি নাই –
নিমিখে মানয়ে যুগ কোরে দূর মানি!
যখন কোন ভাবনা নাই, যখন শ্যামকে পাইয়াছেন, তখনো রাধার ভয় যায় না –
এই ভয় উঠে মনে, এই ভয় উঠে,
না জানি কানুর প্রেম তিলে জনি ছুটে।
গড়ন ভাঙ্গিতে, সই, আছে কত খল –
ভাঙ্গিয়া গড়িতে পারে সে বড় বিরল।
যথা তথা যাই আমি যত দূর পাই,
চাঁদ মুখের মধুর হাসে তিলেকে জুড়াই।
সে-হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়!
চণ্ডিদাস কহে, রাই, ভাবিছ অনেক –
তোমার পিরীতি বিনে সে জীয়ে তিলেক।
রাধা আগেভাগে অভিশাপ দিয়া রাখে, রাধা শূন্যের সহিত ঝগড়া করিতে থাকে! এমনি তাহার ভয় যে, তাহার মনে হয় যেন সত্যই তাহার শ্যামকে কে লইল। একটা অলীক আশঙ্কা মাত্রও প্রাণ পাইয়া তাহার সম্মুখে জীবন্ত হইয়া দাঁড়ায়, কাজেই রাধা তাহার সহিত বিবাদ করে। সে বলে –
সে-হেন বঁধুরে মোর যে জন ভাঙ্গায়
হাম নারী অবলার বধ লাগে তায়।
যদিও তাহার বঁধুকে এখনো কেহ ভাঙ্গায় নি, কিন্তু তা বলিয়া সে সুস্থির হইতে পারিতেছে কৈ? যখন শ্যাম তাহার সম্মুখে রহিয়াছে, তখনো সে শ্যামকে কহিতেছে –
কি মোহিনী জান বঁধু, কি মোহিনী জান!
অবলার প্রাণ নিতে নাহি তোমা হেন!
রাতি কৈনু দিবস, দিবস কৈনু রাতি –
বুঝিতে নারিনু বঁধু তোমার পিরীতি!
ঘর কৈনু বাহির, বাহির কৈনু ঘর–
পর কৈনু আপন, আপন কৈনু পর।
কোন্ বিধি সিরজিল সোতের সেঁওলি,
এমন ব্যথিত নাই ডাকি বন্ধু বলি।
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।
রাধার আর সোয়াস্তি নাই। শ্যাম সম্মুখে রহিয়াছেন, শ্যাম রাধার প্রতি কোন উপেক্ষা প্রকাশ করেন নাই, তবুও রাধা একটা “যদি”কে গড়িয়া তুলিয়া, একটা “যদি”কে জীবন দিয়া কাঁদিয়া সারা হইল। কহিল –
বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও
মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।
(চলবে)
চণ্ডিদাস ও বিদ্যাপতি (১)- Click This Link
©somewhere in net ltd.